ঘটনাবহুল বছর নিস্তরঙ্গ রাজনীতি
গুম-খুনের
পীড়ন, দ্রব্যমূল্যের কশাঘাত আর নিষ্প্রভ-নিস্তরঙ্গ রাজনীতির মোড়কে বিদায়
নিচ্ছে ২০১৭। বিদায়ী বছরে সাধারণ মানুষ যতটা না আশায় বুক বেঁধেছিল, তার
চেয়ে ঢের বেশি নিমজ্জিত ছিল হতাশায়। দেশের কাঠামোগত উন্নয়ন তাদের
নিত্যদিনের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনি। চালের দেশে ভাতের ক্ষুধা, বছর শেষে
পেঁয়াজের দামে স্বর্ণের ছোঁয়া বিড়ম্বনাই বাড়িয়েছে। গুম-খুনের শিকার হওয়া
পরিবারের দুঃসহ কষ্ট নিবারণ হয়নি। স্বজন হারানোর বেদনা তাদের গুমরে গুমরে
কাঁদিয়েছে। অশ্রু শুকিয়ে গেছে, ফিরে আসেনি আপনজন। রাজনীতিতে কোনো সুখবর ছিল
না। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি পারেনি জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে। রোহিঙ্গা শিবির
পরিদর্শনে দলটির চেয়ারপারসনের কক্সবাজার সফর বাদে বছরজুড়ে দলটি ছিল
কর্মসূচিহীন। আদালতের বারান্দায় ঘুরেছেন বেগম খালেদা জিয়া। নির্বাচনকালীন
সরকার নিয়ে সমঝোতার আহ্বান কানে তোলেনি ক্ষমতাসীন দল। বিএনপির চেয়ে সরকারি
দলের কণ্ঠই ছিল উচ্চকিত। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে বিচারাঙ্গন ছিল
উত্তপ্ত। এ সূত্র ধরে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল
রাজনীতির। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকেই কার্যত দেশে
স্বাভাবিক রাজনীতির ছন্দপতন ঘটেছে। ২০১৫ সালে নতুন নির্বাচনের দাবিতে
বিএনপি টানা তিন মাস আন্দোলন করেছিল, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। ক্ষমতাসীন
দল আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী বিএনপির এই আন্দোলন ব্যর্থ করে দিয়ে আরো কঠোর
ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মামলার পাহাড়ে চাপা পড়ে বিএনপি। ২০১৬ সাল দলটি পার
করেছে মামলার বেড়াজাল থেকে বের হওয়ার চেষ্টার মধ্যে। ২০১৭ সালেও ছিল এরিই
ধারাবাহিকতা।
২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাস বিএনপির হাতে কোনো কর্মসূচি ছিল না।
কুমিল্লা সিটিতে অংশ নিয়ে দলটি জয়লাভ করে, বছর শেষে রংপুর সিটিতে লাঙ্গলের
রাজত্বে বিএনপি হারিয়ে যায়। খালেদা জিয়া বছরের তিন মাসেরও বেশি সময় লন্ডনে
কাটান। ফিরে এসে চার দিনের সফরে কক্সবাজারে নির্যাতিত রোহিঙ্গাশিবির
পরিদর্শনে বের হয়ে সাংগঠনিকভাবে বেশ আলোড়ন তৈরি করেন। এ সফরের কর্মসূচিতে
দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
যাওয়া-আসার পথে তার গাড়িবহরে হামলার নিন্দা জানিয়েছে সবাই। এক-দুইটি
কর্মসূচি বাদে গেল বছরে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বিএনপি।
জনঘনিষ্ঠ কর্মসূচি গ্রহণে খুব একটা তৎপর দেখা যায়নি তাদের। নেতাকর্মীরাও
আরেকটি বছর পার করেছেন হতাশায়। ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ
বাদে দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে নেতাকর্মীদের অনীহা ছিল উল্লেখ করার মতো।
২০১৭ সালের প্রাণহীন রাজনীতিতে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট
নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা-সমঝোতার আহ্বান কোনো পাত্তাই পায়নি। খালেদা
জিয়া যতবারই আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা
তা উড়িয়ে দিয়েছেন। আলোচনার টেবিলে বসার সব সম্ভাবনাকে তিনি নাকচ করেছেন
বারবার। বিএনপি ‘এখনো সময় আছে’ কৌশল নিয়ে সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করতে কোনো
আন্দোলন কর্মসূচিতে যায়নি। বছরজুড়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিএনপির তুলনায়
রাজনৈতিক বক্তব্যে বেশি আক্রমণাত্মক ছিল। আর বিএনপি এ ক্ষেত্রে শুধু
আত্মরক্ষা করেছে। পদ্মা সেতুতে স্প্যান বসানোর খবরসহ উন্নয়নমূলক নানা কাজের
ফিরিস্তি ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মুখে। কাস ওয়ান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়
পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের মহোৎসব, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি কিংবা
ব্যাংকিং খাতের ব্যর্থতা সরকারি দলের নেতাদের টলাতে পারেনি। সংসদে কিংবা
সংসদের বাইরে বিএনপিকে ঘায়েল করাই ছিল তাদের টার্গেট। বিএনপির জন্য
সভা-সমাবেশে বিধিনিষেধ থাকলেও সরকারি দল বছরজুড়ে প্রতিটি কর্মসূচি পালন
করেছে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায়, ঝাঁকঝমকভাবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ,
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনসহ ১৫ আগস্ট ও দিবসভিত্তিক কর্মসূচিতে দারুণ
সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল আওয়ামী লীগের।
নির্বাচনের মাঠ প্রস্তুতে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বিভিন্ন জেলায় উন্নয়ন কর্মসূচির উদ্বোধন করার পাশাপাশি
নির্বাচনী সমাবেশ করেছেন। ভোট চেয়েছেন নৌকায়। ২০১৭ সালে প্রধান প্রতিপক্ষ
বিএনপির কোন কর্মসূচি না থাকায় সাংগঠনিক ও প্রশাসনিকভাবে স্বস্তিতে সময় পার
করেছে আওয়ামী লীগ। সরকার প্রধান বিভিন্ন দেশ সফর করে ২০১৪ সালের ৫
জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধতার মোড়ক থেকে বের করে আনার চেষ্টা
করেছেন। অবশ্য ঢলের মতো বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে
কোনো কার্যকর সুসংবাদ দিতে পারেনি সরকার। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক ব্যর্থতার
দিকটি ছিল রাজনৈতিক আলোচনায়। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে অন্যকোনো রাজনৈতিক
দলের তেমন কোনো তৎপরতা ছিল না। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার
হয়েছেন গেল বছরে। দলটিকে দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। জাতীয়
পার্টি সরকারের অংশ হওয়ায় বিরোধীদলীয় কোন ভূমিকা পালন করতে পারেনি। শারীরিক
উপস্থিতি ছাড়া জাতীয় সংসদে দলটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। চেয়ারম্যান হুসেইন
মুহম্মদ এরশাদ একেক সময় একেক ধরনের কথা বলে হাস্যরসের জোগান দিয়েছেন। তবে
বছর শেষে রংপুর সিটি নির্বাচনে লাঙ্গলের বিজয় দলটির আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।
লাঙ্গলের বিজয় প্রত্যাশিত থাকলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নিমুখী ভোট
প্রাপ্তি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সরকারি দলের জোটের বাইরে থাকা বাম দলগুলোর
ভূমিকা ছিল যথারীতি। জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না থাকায় তাদের কোনো
কর্মসূচি ক্ষমতাসীন দলকে নাড়া দিতে পারেনি।
তবে গেল বছরে বিদ্যুতের দাম
বৃদ্ধির প্রতিবাদসহ রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের প্রতিবাদে
কয়েকটি বামদল ছিল কর্মসূচিমুখর। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটে থাকা দলগুলোর
ভূমিকা ও সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল খুবই দুর্বল। বিএনপি জোটে থাকা অন্তত দু’টি
দল ভাঙনের মুখে পড়ে। জোটের দলগুলো বিএনপি-আওয়ামী লীগমুখী হওয়ায় তাদেরকে
স্বাধীন কোনো ভূমিকায় দেখা যায়নি। গেল বছরের মাঝামাঝিতে বিচার বিভাগের একটি
রায় নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনীতি। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়
নিয়ে পানি গড়ায় বহুদূর। এ রায় বাতিলের মধ্য দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণের
ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে চলে যায়। রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে স্বাধীনতা
সংগ্রামসহ দেশের চলমান রাজনীতি ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান
অবস্থা। এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকারি দল চরম প্রতিক্রিয়া দেখায়। সংসদে তখন
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নানাভাবে কটাক্ষ করা হয়। আহ্বান
জানানো হয় পদত্যাগের। সরকারি দলের নেতাদের রাজনৈতিক বক্তব্যেও তীব্র
সমালোচনার মুখে পড়েন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। অন্য দিকে বিএনপি এ রায়কে
স্বাগত জানিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ রাখতে প্রধান বিচারপতির রায়
ঐতিহাসিক দলিল বলে উল্লেখ করে। কিন্তু সরকারি দলের প্রতিক্রিয়া শেষ
পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। সুরেন্দ্র কুমার
সিনহা দেশের বাইরে থেকে পদত্যাগপত্র পাঠান। এই পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন
তোলে বিএনপি। বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া একে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ বলে
মন্তব্য করেন। বিচারাঙ্গনের এ ঘটনা এখনো ম্রীয়মাণ হয়নি। নতুন বছরেও এই
ইস্যু ঘুরেফিরে উঠে আসবে আলোচনায়। গেল মাসে ষোড়শ সংশোধনী রায় পুনর্বিবেচনার
আবেদন করেছে সরকার। বিচারপতি সিনহার পর্যবেক্ষণ বাতিল চাওয়া হয়েছে এই
আবেদনে।
বছর শেষে রাজনীতিতে হঠাৎ কিছুটা উত্তাপ দেখা দেয় একটি আইনি নোটিশ
নিয়ে। বিদেশে খালেদা জিয়ার সম্পদ থাকার অভিযোগ করায় প্রধানমন্ত্রীকে আইনি
নোটিশ পাঠান খালেদা জিয়া। ক্ষমা না চাইলে ৩০ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ আদায়ে
আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয় নোটিশে। সুশাসনের বড় অভাব ছিল বিগত বছরে।
অপরাধপ্রবণতা রূপ নেয় নিত্যনতুন মাত্রায়। গুম, খুন, ধর্ষণ, হত্যা, দখল,
ছিনতাই, চাঁদাবজি, টেন্ডারবাজির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশ।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের দেয়া তথ্যানুযায়ী-২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে গেল
বছরের নভেম্বর পর্যন্ত চার শ’র বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। বিএনপি
চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন, গত ১০ বছরে তার দলের ৭৫০ জন
নেতাকর্মী গুম হয়েছেন। যদিও সরকার এ ধরনের পরিসংখ্যান মানতে নারাজ। তবে বছর
শেষে তিনটি পরিবারে প্রাণ ফিরে এসেছে। এ বছরই নিখোঁজ হওয়া তিনজন আবার
ফিরে এসেছেন। তিন মাস নিখোঁজ থাকার পর কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর
রহমানকে গ্রেফতারের কথা জানায় পুলিশ। দুই মাসেরও বেশি সময় নিখোঁজ থাকার পর
সাংবাদিক উৎপল দাসকে পাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জের ভুলতায়। দেড় মাস পর খোঁজ
মেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসানের। শিক্ষাঙ্গনে দলীয়
প্রভাব ছিল উল্লেখ করার মতো। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি ছিল একতরফা।
ছাত্রলীগ বিভিন্ন কুকর্ম দিয়ে নিজেদের ললাটে কালিমা লেপন করেছে। ছাত্রদলের
ক্যাম্পাস-কেন্দ্রিক কোনো তৎপরতা ছিল না। ডাকসু নির্বাচন ছিল মিছে আলোচনায়।
বছরজুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে উদর পুড়েছে সাধারণ মানুষের।
মোটা চালের
কেজি ৫০ টাকা ছুঁয়েছে গেল বছরে। ৭০ ঊর্ধ্ব টাকা চালের দামে চিকন ভাত উঠেছে
প্লেটে। অধিকাংশ সবজির দাম ছিল ৬০ টাকা কেজির ওপরে। বেসরকারি গবেষণা
প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) পর্যালোচনা
অনুযায়ী-চালের মূল্যবৃদ্ধিতে দারিদ্র্য বেড়েছে ৩২ শতাংশ। পেঁয়াজের দাম এ
যাবৎকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে গত বছরে। দেশি পেঁয়াজ ১২০-১৪০ টাকা কেজিতে
কিনেছে সাধারণ মানুষ। এর বাইরে বারবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে
ভোগান্তি ছিল চরমে। কৃষক মরেছে আরো। উৎপাদন করেছে ঠিকই, পায়নি
ন্যায্যমূল্য। বছর শেষে খাবার খেতে গিয়ে ১০ জনের মৃত্যুও বিচ্ছিন্ন ঘটনা
হিসেবে ভাবার অবকাশ ছিল না। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মরহুম মহিউদ্দিনের
কুলখানি উপলক্ষে আয়োজিত মেজবানে এক বেলা খাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের
উপচেপড়া ভিড় অর্থবহ। ভালো খেতে গিয়ে জীবন হারানোর এ ঘটনা সারা বছরের
ক্ষোভ-বেদনাকে যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন বছর সমাগত। নতুন সূর্য হোক নতুন
দিনের প্রেরণা। ২০১৮ সাল হোক সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের। কেটে যাক
বেদনার অতীত। গুম হওয়াদের স্বজনের মাঝে সঞ্চারিত হোক বেঁচে থাকার নতুন আশা।
সামাজিক অবক্ষয়ের মিছিলে ঘটুক ছন্দপতন। গড়ে উঠুক মাদকমুক্ত ও অবাধ যৌনতার
ছোবলমুক্ত একটি সুন্দর সমাজ।
No comments