আহেদ তামিমি নামের মশা ও মধ্যপ্রাচ্যের নমরুদ

নমরুদ বাদশাহ আরশে উঠতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে নামিয়ে এনেছিল তুচ্ছ একটি মশা। মশাটা তাঁর কানে ঢুকেছিল, সেখান থেকে মগজের কেন্দ্রে। সেটাই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। উন্মত্ত ইসরায়েলি নেতাদের রাগে অন্ধ করে দিয়েছে এক সামান্য ফিলিস্তিনি বালিকা। পৃথিবীর বৃহত্তম ছাদখোলা কারাগার ফিলিস্তিনি শহর গাজার বাসিন্দা সে। অসম্ভব এক দৃশ্যের জন্ম দিয়ে সে এখন ফিলিস্তিনি সাহসিকতার প্রতীক। বাড়িতে ঢুকতে যাওয়া ইসরায়েলি সেনাদের দিকে তেড়ে যায় আহেদ তামিমি নামের মেয়েটি। আঙুল উঁচিয়ে তাদের গালি দিতে দিতে চড় মেরে দেয় সে। তারই বান্ধবী মোবাইলে দৃশ্যটি ভিডিও করে। ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে দুই শিবিরে দুই রকম আগুন ধরায়। ফিলিস্তিনিদের দেয় সাহস আর ইসরায়েলিদের করে বিভ্রান্ত, অপমানিত, ক্রুদ্ধ ও লজ্জিত। বর্ণবাদীরা ১৬ বছরের এক ফিলিস্তিনি বালিকার স্পর্ধা দেখে রাগে অন্ধ হয়। কেন তিন ইসরায়েলি সেনা চড় খেয়েও গুলি না করে ফিরে এল, তা নিয়ে বিভ্রান্ত হয়। পরদিন ওই তিন সেনাকে দুর্বলতা দেখানোয় প্রত্যাহার করা হয় আর রাতে আহেদ তামিমি ও তার এক ভাইকে তুলে এনে বন্দী করা হয় কারাগারে। কিন্তু সেখানেও মানুষ আছে, তারা এ ঘটনায় লজ্জা পায়। বুদ্ধিমানেরা বুঝতে পারে, কিশোরী আহেদ ইজরায়েলি দুর্গে ফাটল ধরিয়েছে। অনেকের মধ্যে বিবেকি জ্বালাপোড়া জাগিয়েছে। ক্ষমতান্ধরা ভয় পেয়ে দেখছে, ফিলিস্তিনি শিশুদের মোকাবিলা করতে গিয়ে তারা দুনিয়ার সামনে কেমন বর্বর বলে চিহ্নিত হচ্ছে। আহেদ তামিমিকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য ‘বিপজ্জনক’ ঘোষণা করে অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখার সিদ্ধান্তেই বোঝা যায়, আহেদের বিদ্রোহের নৈতিক শক্তির সামনে ইসরায়েল প্রতিরক্ষাহীন।
মেয়েটি এক চড়ে ইসরায়েলের মুখোশ খুলে দিতে পেরেছে। একবার নয়, এর আগেও আহেদ ইসরায়েলি সেনাদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি শিশুদের নিয়ে বক্তৃতার আমন্ত্রণ পেয়েও তাকে ভিসা দেওয়া হয়নি। ঠিক একইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আনা ফ্রাংকের ইহুদী পরিবারকে আমেরিকা শরণার্থী ভিসা দিতে রাজি হয়নি। ফলে তার মৃত্যু হয়েছিল। আহেদ তামিমির মতো ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোরদের মৃত্যুতেও আমেরিকার লিবার্টি অব স্ট্যাচু’র নড়ে ওঠার কথা নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে আহেদ বলেছিল, ‘আমরা ইসরায়েলের শিকার হতে পারি, কিন্তু আমরা গর্বিত আমাদের লক্ষ্যের লড়াইয়ে, যদিও জানি এর জন্য কী মূল্য দিতে হবে। আমি চাই না আমাকে শুধু নিপীড়িত হিসেবে দেখা হোক। আমি কে এবং কী আমি হয়ে উঠব, তা ঠিক করে দেওয়ার ক্ষমতা আমি তাদের দেব না। ...আমরা কিছু আবেদনময় কান্নার ছবি দেখিয়ে আপনাদের সমর্থন চাই না, বরং আমরা যে লড়াই বেছে নিয়েছি এবং যে লড়াই ন্যায্য তার জন্য আপনারা আমাদের সমর্থন করুন। কেবল এই পথেই একদিন আমাদের কান্নার অবসান হতে পারে।’ ফিলিস্তিনি আনা ফ্রাংক আহেদ তামিমি তবু পশ্চিমা গণমাধ্যম, তাদেরে একচচোখা মানবাধিকারবাদী, তাদের বশংবদ নারীবাদীদের সমর্থন পাবে না। ইউনেসকো পোস্টার ছাপাবে না ‘আই এম আহেদ’। গার্লপাওয়ার হ্যাশট্যাগ হবে না তার নামে। কেননা, পশ্চিমাদের বরপুত্র ইসরায়েল তাতে নাখোশ হবে। তারা তালেবানের গুলি-খাওয়া পাকিস্তানি কিশোরী মালালাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়, আর ইসরায়েলি বর্বরতা রুখে দাঁড়ানো আহেদকে অস্বীকার করে। তালেবানের কাজ ইসরায়েল করলেও মালালা আর আহেদ এক কাতারে দাঁড়ানোর অযোগ্য! আহেদকে নিয়ে কোনো হলিউডি চলচ্চিত্র নির্মাণের কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু ইসরায়েলি সেনাকে নায়িকা বানানো যায়। আমি এ বছরের ব্লকবাস্টার হলিউডি সিনেমা ‘ওয়ান্ডার উইমেন’-এর নায়িকা গাল গাডটের কথা বলছি। তার সঙ্গে আহেদ তামিমির তুলনাও করতে চাইছি। গাল গাডট সাবেক মিস ইসরায়েল ছিলেন, সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। এসবও বিষয় না। কিন্তু গাজায় হামলার সময় আরও বেশি ফিলিস্তিনি হত্যার জন্য তাঁর বাহিনীকে উৎসাহ দিয়ে টুইট করেছেন। পরে বিয়ে করেছেন একজন ইসরায়েলি রিয়েল স্টেট ডেভেলপারকে, দখলাধীন ফিলিস্তিনি জমিতে আবাসন নির্মাণ যাঁর ব্যবসা। একজন সেটলার ও বর্ণবাদী চরিত্রকে মানবতাবাদী ‘ওয়ান্ডার উইমেন’ সাজানো অবশ্যই সমালোচনার বিষয়। ‘ওয়ান্ডার উইমেন’-এর গল্পেও তিনি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এক এক দ্বীপরাজ্যের রাজকন্যা। এই রাজকন্যা আমেরিকান পাইলটের প্রেমে পড়ে দুনিয়ার সেরা ভিলেনকে হত্যা করে পৃথিবীকে রক্ষা করে। কল্পনার সুযোগ নেই, ইসরায়েলও আরব ভূমিতে দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন। বাস্তবেও ইসরায়েল ও আমেরিকা মিলে বদমাশ ‘ইরান-হিজবুল্লাহ-হামাস ও ফিলিস্তিনিদের’ হাত থেকে দুনিয়াকে রক্ষা করার নামে আগ্রাসন ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ‘ওয়ান্ডার উইমেন’কে দেখে অনেক হুজুগে পাগল তার মধ্যে নারীবাদ দেখলেও ‘অ্যাভাটার’খ্যাত চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরন একে বলেছিলেন, ‘এক ধাপ পেছানো’। ১৮ বছর বয়সী তরুণদের আকর্ষণ করা ছাড়া এই চরিত্রের মধ্যে কোনো নারীশক্তির প্রকাশ তিনি দেখেননি। ‘ওয়ান্ডার উইমেন’ লেবাননে নিষিদ্ধ হয়েছিল। হলিউড ও পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং পাশ্চাত্যের কোনো কোনো রাষ্ট্রনেতারা এভাবে ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী আগ্রাসী মূর্তিকে আড়াল করেন। বর্ণবাদী ঘৃণার পূজারি ইসরায়েলি সেনা এভাবেই ‘ওয়ান্ডার উইমেন’-এর নায়িকার বেশে হয়ে যান দুনিয়ার শান্তি কায়েমের ‘নায়িকা’। আর আহেদ তামিমির মতো সত্যিকার মানবতার বীরকিশোর-কিশোরীদের বানিয়ে দেওয়া হয় ‘বিপজ্জনক’ ‘সন্ত্রাসী’ ও শান্তির জন্য হুমকি। দস্যুকে উদ্ধারকারী সাজানোর এই ভেলকিবাজির কল্যাণেই ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর বৈধতা দিতে পারেন এবং ‘ওয়ান্ডার উইমেন’-এ অভ্যস্ত পাশ্চাত্যের অনেকের চোখে সেটা সয়ে যায়। আর ইসরায়েল চালিয়ে যায় ফিলিস্তিনি হলোকস্ট।
দুই. শিশু হত্যায় ইসরায়েলি ধ্বংসমেশিনের দ্বিধা নেই। ২০১৪ সালে তারা গাজার স্কুলে বোমা মেরেছিল। ৫০ দিনের যুদ্ধে কম করে হলেও ৫৫০ জন শিশু সময় নিহত হয়। তাদের অবরোধে অজস্র ফিলিস্তিনি শিশুর মৃত্যু হয় রোগে ও ভুগে। এভাবে শিশুনিধনে অভ্যস্ত হতে হতেই তারা দেখছে, শিশুর রক্তে ভেজা ইসরায়েলের মাটি, তাদের ভাবমূর্তি তাদের ভবিষ্যৎ। ৬০ বছরের গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসের বুলডোজারে যে ফিলিস্তিনিদের তারা বিনাশ কিংবা বিতাড়িত করতে পারেনি, আরও চল্লিশ বছরেও কি তা সম্ভব হবে? আহেদ তামিমির প্রতিরোধ এই প্রশ্নের সামনেই তাদের ফেলেছে। গত সপ্তাহের ঘটনা। ২৯ বছর বয়সী ইব্রাহিম আবু-থুরাইয়ার দুই পা আগেই উড়ে গিয়েছিল ইসরায়েলি বোমায়। এবার সে হুইলচেয়ারে করে হাজির হয়েছিল ইসরায়েলি সেনাদের হামলার প্রতিবাদ জানাতে। নিরস্ত্র কিন্তু প্রতিবাদরত। যে ইসরায়েলি সেনা তাঁকে হত্যা করে সে সাধারণ কেউ নয়—একজন দক্ষ শার্পশুটার। নিশানা দেখে-বুঝে একদম মোক্ষম স্থানে গুলি করাই তাদের নিয়ম। হুইলচেয়ারে বসা যুবকটিকে নির্ভুলভাবে মাথায় গুলি করে। বিবেকের পোড়ানি দখলদারদের থাকতে নেই। ছিলও না। বরং পঙ্গু ফিলিস্তিনি হত্যার ট্র্যাজেডিটা ইসরায়েলি সমাজে চুটকি কৌতুকের রূপ নেয়। কৌতুকটা এ রকম: শার্পশুটারকে বলা হয়েছিল বিক্ষোভকারীদের শরীরের নিম্নাঙ্গে গুলি করতে। কিন্তু ইব্রাহিমের কোনো নিম্নাঙ্গ না থাকায় মাথায় গুলি করা ছাড়া তার উপায় ছিল না। ওই নির্বোধ সেনা খেয়াল করেনি, ইব্রাহিম হলো ইহুদিধর্মের আদি নবীর নাম। আর যে প্রতিবাদী কিশোরীকে তারা বন্দী করেছে, সে আজকের আনা ফ্রাংক। এদিকে ইসরায়েলি শিক্ষামন্ত্রী আহেদ ও তার পরিবারকে আটকে রেখে নিঃশেষ করে দেওয়ার খায়েশ ব্যক্ত করেছেন; ঠিক নাজিরা যা করেছিল আনা ফ্রাংক ও তার পরিবারের সঙ্গে। জায়নবাদী ইসরায়েল নিজেই ইহুদি হত্যাকারী নাজিবাদী জার্মানির শূন্যস্থান পূরণ করছে। সংগ্রামী জাতি তাদের বীর ও শহীদদের জন্য শোক করে না। তাদের মায়েরা সন্তান জন্মায় হারাবে বলে, পিতারা কন্যাকে জাতির মুখ উজ্জ্বলকারী বীরের মতো ভালবাসে। আহেদ তামিমির বাবা বাসেত তামিমি ইসরায়েলিদের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘আমার মেয়েটি মাত্র ১৬ বছর বয়সী। অন্য কোনো দুনিয়ায়, তোমাদের দুনিয়ায় ওর জীবন একদম অন্য রকম হতো। আহেদ আমাদের জনগণের নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধি। এই প্রজন্মকে দুই ফ্রন্টে লড়াই করতে হবে। একদিকে, ইসরায়েলি দখলদারির মধ্যে তাদের জন্ম, তার ধ্বংস পর্যন্ত তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া তাদের কর্তব্য। অন্যদিকে, সবলভাবে নিজেদের জাতির স্থবিরতা ও রাজনৈতিক অধঃপতন মোকাবিলা করতে হবে। তাদের হতে হবে আমাদের বিপ্লবের জীবন্ত ধমনি।’ তিনি লিখেছেন যেভাবে বীরের জনকেরা কথা বলেন, ‘আহেদ, কোনো মা-বাবাই আপন সন্তানের বন্দিত্ব সইতে পারে না। তবুও আহেদ, তোমার জন্য আমার থেকে গর্বিত আর কেউ নেই।’
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.