প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য থাকতে পারে না
প্রথম আলো: আপনার আইনমন্ত্রিত্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করানোর ঘটনায় আপনি কি দুঃখিত?
আনিসুল হক: প্রথম কথা হলো, তিনি পদত্যাগে বাধ্য হননি। তবে হ্যাঁ, ঘটনার পরম্পরায় আমি নিশ্চয় দুঃখিত। সেটা কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এটা আমাদের বিচার বিভাগের ওপরে একটা বিরাট কালো ছায়া ফেলেছে, যেটা দুর্ভাগ্যজনক। এমনটা হোক, তা আমরা কেউ চাইনি।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ যথাযথ হয়েছে কি?
আনিসুল হক: নিশ্চয় যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়েছে।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতি পদ কি এখন শূন্য?
আনিসুল হক: এই পদ কিছুতেই শূন্য থাকতে পারে না। তার কারণ, ৯৭ অনুচ্ছেদ পরিষ্কার বলেছে পদ শূন্য হলে কী করতে হবে।
প্রথম আলো: ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনে রাষ্ট্র বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে রাখতে বাহাত্তরের সংবিধানের বিধান পুনরুজ্জীবনে জোর দিল। তাহলে ১১৬ অনুচ্ছেদে (অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকা) জিয়ার সামরিক ফরমানে বর্ণিত পরামর্শের বিধান টিকিয়ে রাখছেন কেন?
আনিসুল হক: এর পক্ষে অবশ্যই আমার যুক্তি আছে, যা শুনানিতে আলোচিত হবে। রিভিউ আবেদন এখন আদালতের এখতিয়ারে, তাই এখন কোনো মন্তব্য নেই।
প্রথম আলো: সংবিধানে বিচারক অপসারণসংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ এখন কি কার্যকর? এটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নির্বাচন কমিশনারদের জন্যও একই বিধান।
আনিসুল হক: (হাসি)। সংবিধান সংশোধন করবে সংসদ, তাতে সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য রদ হলো কি না, তা দেখবেন সুপ্রিম কোর্ট। তাঁরা বাতিল হওয়া সংশোধনী পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন না। কিন্তু তাঁরা তা করেছেন, আমার মতে তা সমীচীন হয়নি। রিভিউ দরখাস্তের জন্য কারণগুলো এখন বলব না। তবে ষোড়শ সংশোধনীতে আনা মূল ৯৬ অনুচ্ছেদ (অর্থাৎ সংসদের অপসারণ ক্ষমতা) এখনো বলবৎ রয়েছে।
প্রথম আলো: এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের পদত্যাগের অধিকার (রিভিউতে রাষ্ট্র বলেছে, রায় এই বিধান লুপ্ত করেছে) আছে কি না?
আনিসুল হক: যদিও ষোড়শ সংশোধনী এখতিয়ারবহির্ভূত বলে সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছেন, তবু মূল ৯৬ অনুচ্ছেদ এবং পরে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল দিয়ে প্রতিস্থাপিত ৯৬ অনুচ্ছেদে পদত্যাগের বিধান ছিল। তাই বলব, বিচারকদের পদত্যাগের ক্ষমতা বহাল আছে।
প্রথম আলো: রাষ্ট্র যদি বলে (রিভিউতে বলেছে) রাষ্ট্রপতির অননুমোদিত আচরণবিধি বৈধ নয়, তাহলে আইনত আচরণবিধির এখন কোনো অস্তিত্ব আছে কি?
আনিসুল হক: আগেও যেটা ছিল, সেসব কথা আদর্শলিপি ও বাল্যশিক্ষায় লেখা থাকে। সেটা অর্থহীন ছিল। কারণ, তাতে বিধি না মানলে কী শাস্তি হবে, তা বলা ছিল না।
প্রথম আলো: আদৌ কোনো আচরণবিধি আছে বলে মানেন কি না?
আনিসুল হক: দেখুন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে একটি আচরণবিধি দেওয়া হয়েছে, আর সেই রায় এখনো স্থগিত করা হয়নি। আচরণবিধি সংবিধানের অংশ নয়। তাই আমার মনে হয়, ওই আচরণবিধি বহাল আছে।
প্রথম আলো: আপনি বলেছিলেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের প্রতি আপনি শ্রদ্ধাশীল।
আনিসুল হক: অবশ্যই আমি শ্রদ্ধাশীল। এই রায় যেহেতু এখন স্থগিত হয়নি, তাই রায় তো আমাকে মানতে হবে।
প্রথম আলো: এই মুহূর্তে অন্য সাংবিধানিক পদধারীদের ক্ষেত্রেও কি এই আচরণবিধি অনুসরণযোগ্য?
আনিসুল হক: অন্য রকম সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিচারকদের এই আচরণবিধিসহ রায়ের যে অংশটুকু সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটুকু আমাকে মেনে চলতে হবে।
প্রথম আলো: আচরণবিধিতে প্রধান বিচারপতির সম্পদ বিবরণী দাখিলের বিধান (রিভিউ দরখাস্তে রাষ্ট্র আপত্তি তুলেছে) রাখা হয়নি।
আনিসুল হক: (হেসে) এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিষ্কার। আপনাকে উদাহরণ তৈরি করেই বাঁচতে হবে। এখন তো বিচারপতিরা প্রশ্ন তুলতে পারেন, আমরাই দেব, প্রধান বিচারপতি দেবেন না, সেটা কেমন করে হয়?
প্রথম আলো: ২০১৭ সালের আরেকটি আলোচিত বিষয় শৃঙ্খলাবিধি। ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটা করতে গিয়ে পরামর্শ হবে রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে। কিন্তু আপনি ও দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি আলোচনা করেছেন। তাহলে?
আনিসুল হক: কথাটা নিরর্থক। তার কারণ (১১৬ অনুচ্ছেদ পাঠ করে), এই যে সুপ্রিম কোর্ট, সেখানে আপিল বিভাগের সবার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, রাষ্ট্রপতি নিজে পুরো বিধিটা দেখেছেন। তারপর প্রজ্ঞাপন হয়েছে।
প্রথম আলো: একটি শর্ত পূরণ করেননি। হাইকোর্ট বিভাগের ৮৫ জন বিচারকের সঙ্গে কখন কথা বললেন?
আনিসুল হক: আমাকে এই ধারণা দেওয়া হয়েছে এবং অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি বলেছেন, তিনি ফুলকোর্টের সঙ্গে আলাপ করেছেন। তাঁরা সবশেষ যেটা করে দিয়েছেন, সেভাবেই প্রজ্ঞাপন হয়েছে। এটা আপনার লিখতে হবে যে ১৯৯৯ সালের মাসদার হোসেন মামলার ৭ দফা নির্দেশনামতে এই শৃঙ্খলাবিধি হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৫ সালের আগে এর উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। আমি যখন প্রথম খসড়া পাই, তখনই তা সুপ্রিম কোর্টে পাঠাই এবং প্রধান বিচারপতি একটি কমিটি করে দিয়েছিলেন।
প্রথম আলো: ঠিক কী কারণে বিরোধের জন্ম হলো?
আনিসুল হক: দেখলাম, খসড়ায় এমন কিছু বিধান আছে, যা ১১৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আর আমি ও আদালত তো ১১৬ শোধরাতে পারি না।
প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধু সুপ্রিম কোর্টই চাননি, হাইকোর্ট চেয়েছিলেন। তাই ১০৯ অনুচ্ছেদ হাইকোর্টকেই বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান করতে বলেছেন, অথচ আপনি তা অগ্রাহ্য করেছেন।
আনিসুল হক: ১০৯ অনুচ্ছেদ আমি অগ্রাহ্য করব তার সাধ্য কী? সেটা আমার নেওয়ার মতো ক্ষমতাও নেই। তত্ত্বাবধান ও শৃঙ্খলাবিধান দুটো কি পৃথক নয়? শৃঙ্খলাবিধি কোনোভাবেই হাইকোর্টের এখতিয়ার খর্ব করেনি। বঙ্গবন্ধু নিজে উপস্থিত থেকে যে বিধান করে গেছেন, সেটাই আমরা সমুন্নত করব। অধস্তন আদালত কারও পুতুল (পাপেট) নয়, তারাও এর অংশীজন। এবং তারা মনে করে যে বিষয়টি যদি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে থাকে, তাহলে তাদের স্ট্যাটাস (মর্যাদা) আরও বাড়ে। দেশের প্রথম, রাষ্ট্রের প্রথম ব্যক্তি আমাদের অভিভাবক, এই অনুভূতিটা তাদের মধ্যে ছিল। আমি এই বিষয়ে তাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছি।
প্রথম আলো: আপনি কি ১১৬ প্রশ্নে বাহাত্তরে ফেরার (নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ শুধু সুপ্রিম কোর্টের) কোনো স্বপ্নই দেখেন না?
আনিসুল হক: যেটা বাস্তবতা সেটা দেখুন। আজকের যে ১১৬ অনুচ্ছেদ আছে, সেটাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। আর যার গ্রহণযোগ্যতা আছে, তারই অস্তিত্ব দীর্ঘমেয়াদি। সেই কারণে এটা (বিদ্যমান ১১৬) থাকবে।
প্রথম আলো: বিডিআর মামলার রায় কার্যকর হতে বিলম্বের কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, অযথা বেশি লোককে আসামি করা হয়েছিল। শুরুতে আপনি এতে রাষ্ট্রের প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন।
আনিসুল হক: এটাই দুঃখজনক। অনেকেই মন্তব্য করেন, যাঁরা ভেতরের বিষয়টি জানেনই না। অজ্ঞ হলেও তাঁরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন না। পিলখানাসহ সব চৌকিতে বিদ্রোহ ও সহিংসতার যে ব্যাপকতা, সেটা অভূতপূর্ব। তাই এর অনুসন্ধান ছিল এক বিরাট বিষয়। আমি প্রসিকিউশনে ছিলাম বলেই নয়, আমার মনে হয় প্রসিকিউশন ও তদন্তকারীদের দেশবাসীর ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। এত অল্প সময়ে প্রায় সাড়ে আট শ আসামি ও প্রায় সাড়ে ছয় শ সাক্ষীর বিষয়ে যা আমরা করতে পেরেছি, এটা তো গিনেস বুকে যাবে। ডিউ প্রসেস বলে একটা কথা আছে। একটি লোক এক সেকেন্ডে খুন করে, সে জন্য তাকে বিচার বিভাগীয় ফাঁসি দিতে লাগে অন্তত তিন বছর।
প্রথম আলো: এক-এগারোতে ডিজিএফআই যে প্রায় সাড়ে ১২ শ কোটি টাকা নিল, এ বছর আপিল বিভাগের রায় সত্ত্বেও তা ফেরত দিচ্ছে না কেন? না দেওয়া কি নৈতিক?
আনিসুল হক: প্রথম কথা হলো একটা রায় হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত যে প্রশ্ন করেছেন, তা পুরো রায় পড়ে আমাকে উত্তর দিতে হবে। আইনমন্ত্রী হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করাটা ঠিক হবে না।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জের সাত খুনে হাইকোর্টের রায় পেলাম, কিন্তু এর কী প্রভাব পড়েছে আমাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর?
আনিসুল হক: এটি একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড, যার সঙ্গে পিলখানা হত্যাযজ্ঞ তুলনীয়। আমরা যদি এর বিচার করতে না পারতাম, তাহলে আইনের শাসনে আমাদের বিশ্বাস প্রশ্নবিদ্ধ হতো।
প্রথম আলো: আপনার কি মনে হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থার জবাবদিহি আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে? পরিসংখ্যান বলছে, এ বছরে ৬৭টি গুম হয়েছে, এটা আগের চেয়ে বেশি। আপনার সরকার বলত জিরো টলারেন্স...
আনিসুল হক: সেই জিরো টলারেন্স নীতি সম্পূর্ণ গতিময়তার সঙ্গে এখন পর্যন্ত নিশ্চয় বলবৎ রয়েছে। দেখুন, আমরা চেষ্টা করছি এটা কমিয়ে আনার। আমাদের সেই চেষ্টার কিছু ফল যে কোথায় পাচ্ছি, দেখেছেন? এই যে (নিখোঁজ ব্যক্তিরা) ফিরে আসছে।
প্রথম আলো: কয়েকজনের ফিরে আসার ব্যাপারে আইনমন্ত্রী হিসেবে আপনার মূল্যায়ন কী?
আনিসুল হক: আইনমন্ত্রী হিসেবে আমার মূল্যায়ন হলো এই যে আমি মনে করি, যারা ফিরে এসেছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচিত হবে তাদের প্রত্যেককে যথাযথভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা। এটা বুঝতে যে কেন তারা হারিয়ে যায়, আর কেন তারা ফিরে আসে। হারানো ও ফেরার দু-একটি গল্প যা শুনেছি, তাতে আমি মনে করি, এখানে আমাদের তদন্ত করা উচিত। কারণ, এ ঘটনায় আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।
প্রথম আলো: গত এক দশকে খালেদা জিয়া সাত শর বেশি গণতন্ত্রপন্থী গুম হওয়ার অভিযোগ করেছেন।
আনিসুল হক: উনি আগুন-সন্ত্রাস করার জন্য ইন্ধন জোগান। ওনার মুখে এই সাত শর বেশি গণতন্ত্রপন্থী কথাটিই তো হাস্যকর। আমার কথা হলো, উনি ফ্যাক্টস ল্যান্ড ফিগার নিয়ে আসুন, আমরাও ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগার দিয়ে ওনার কথার জবাব দেব। আমি তাঁর সঙ্গে একমত নই। তার কারণ, উনি আগুন-সন্ত্রাসের হোতা। আমরা দেখেছি, ওনার ইন্ধনে, ওনার ডাকে মানুষভর্তি বাস পোড়ানো হয়েছে। মানুষের ওপর পেট্রলবোমা মারা হয়েছে। এসবের অপরাধে তিনি অপরাধী।
প্রথম আলো: তাঁর অভিযোগ তদন্তের দাবি রাখে কি না?
আনিসুল হক: উনি যা বলছেন, তা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবু আমরা খতিয়ে দেখব। এবার আপনি বলুন, আপনি ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ বলতে কী বোঝেন?
প্রথম আলো: এটা রাজনৈতিক পরিভাষা, এর আইনি ভিত্তি নেই।
আনিসুল হক: ক্যু মানে হচ্ছে (অক্সফোর্ড ডিকশনারি থেকে পড়ে) ‘কোনো সরকারের কাছ থেকে সহিংস পন্থায় আকস্মিক বা অবৈধভাবে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া।’ হঠাৎ আমি পড়লাম যে উনি বলেছেন, সরকার জুডিশিয়াল ক্যু করেছে। এস কে সিনহার পদত্যাগটা তিনি জুডিশিয়াল ক্যু বলতে চাইছেন। সিনহা সাহেবকে আমরা সরকার থেকে হটাই নাই। প্রথম কথা তাঁকে হটানো হয়নি। দ্বিতীয়ত, সরকার তাঁকে হটায়নি। এখন সুপ্রিম কোর্টের কোনো রায়ের মাধ্যমে যদি সরকার উৎখাত হয়, তাহলে তাকে বলা হয় জুডিশিয়াল ক্যু। এখন প্রধান বিচারপতি যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে তা জুডিশিয়াল ক্যু হয় না। কথার কথা, যদি জোর করে তাঁকে কোনো সরকার সরিয়েও দিত, যেমনটা এরশাদ সাহেবের সরকার করেছিল, তাহলেও সেটা জুডিশিয়াল ক্যু হতো না। দেখুন, শব্দ যেটা ব্যবহার করবেন, সেটা জেনেশুনে ব্যবহার করা ভালো।
প্রথম আলো: কিন্তু আমরা এখানে একটা বিচার বিভাগীয় অপারগতা দেখি। আচরণবিধি অনুযায়ী প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে পরের জ্যেষ্ঠ তিনজনের কমিটির স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তদন্ত করা এবং তা লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে জানানোর কথা। সেটা হয়নি।
আনিসুল হক: আপনি এই প্রশ্ন তুলেছেন, আমি কিন্তু ওনাদের এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি। আমি যতটুকু শুনেছি এবং সম্ভবত এটা তাঁদের প্রেস রিলিজে আছে, তাঁরা সাবেক প্রধান বিচারপতিকে বলেছিলেন যে আপনার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, জবাব দিন। যদি এসব মিথ্যে হয়, তাহলে তারও উত্তর দিন। আর যতক্ষণ আপনার জবাবটা বিচার্য অবস্থায় থাকবে, ততক্ষণ আপনি পদ থেকে সরে দাঁড়ান। আমি মনে করি, তাঁরা তাঁদের কর্তব্য পালন করেছেন।
প্রথম আলো: সবশেষ প্রশ্ন, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কবে নিয়োগ পাচ্ছেন?
আনিসুল হক: (হেসে) আপনি সংবিধানের ওপর লেখালেখি করেন, সে ক্ষেত্রে আমি বলব, সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটা (প্রধান বিচারপতি নিয়োগ) সম্পূর্ণ এবং একমাত্র এখতিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রপতির। আমি জানি না তিনি কবে (নিয়োগ) দেবেন।
প্রথম আলো: অস্বাভাবিক বা আকস্মিক অবস্থা ছাড়া কোনো দেশেই এভাবে প্রধান বিচারপতির পদ খালি রাখা হয় না।
আনিসুল হক: কেন, এর আগে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান দীর্ঘ সময় অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
প্রথম আলো: সেটা বিশেষ অবস্থা ছিল, সে জন্য আমরা একাদশ সংশোধনী পাস করেছিলাম। তাহলে সেদিকে যাবেন?
আনিসুল হক: না। (হেসে) বললেন নজির নেই, তাই নজির দেখালাম। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি থেকে পুনরায় প্রধান বিচারপতি হওয়ার নজির কোথায় আছে? বাংলাদেশে হয়েছে। তাই এগুলো বলে তো লাভ নেই।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আনিসুল হক: ধন্যবাদ।
আনিসুল হক: প্রথম কথা হলো, তিনি পদত্যাগে বাধ্য হননি। তবে হ্যাঁ, ঘটনার পরম্পরায় আমি নিশ্চয় দুঃখিত। সেটা কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এটা আমাদের বিচার বিভাগের ওপরে একটা বিরাট কালো ছায়া ফেলেছে, যেটা দুর্ভাগ্যজনক। এমনটা হোক, তা আমরা কেউ চাইনি।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ যথাযথ হয়েছে কি?
আনিসুল হক: নিশ্চয় যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়েছে।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতি পদ কি এখন শূন্য?
আনিসুল হক: এই পদ কিছুতেই শূন্য থাকতে পারে না। তার কারণ, ৯৭ অনুচ্ছেদ পরিষ্কার বলেছে পদ শূন্য হলে কী করতে হবে।
প্রথম আলো: ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনে রাষ্ট্র বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে রাখতে বাহাত্তরের সংবিধানের বিধান পুনরুজ্জীবনে জোর দিল। তাহলে ১১৬ অনুচ্ছেদে (অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকা) জিয়ার সামরিক ফরমানে বর্ণিত পরামর্শের বিধান টিকিয়ে রাখছেন কেন?
আনিসুল হক: এর পক্ষে অবশ্যই আমার যুক্তি আছে, যা শুনানিতে আলোচিত হবে। রিভিউ আবেদন এখন আদালতের এখতিয়ারে, তাই এখন কোনো মন্তব্য নেই।
প্রথম আলো: সংবিধানে বিচারক অপসারণসংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ এখন কি কার্যকর? এটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নির্বাচন কমিশনারদের জন্যও একই বিধান।
আনিসুল হক: (হাসি)। সংবিধান সংশোধন করবে সংসদ, তাতে সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য রদ হলো কি না, তা দেখবেন সুপ্রিম কোর্ট। তাঁরা বাতিল হওয়া সংশোধনী পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন না। কিন্তু তাঁরা তা করেছেন, আমার মতে তা সমীচীন হয়নি। রিভিউ দরখাস্তের জন্য কারণগুলো এখন বলব না। তবে ষোড়শ সংশোধনীতে আনা মূল ৯৬ অনুচ্ছেদ (অর্থাৎ সংসদের অপসারণ ক্ষমতা) এখনো বলবৎ রয়েছে।
প্রথম আলো: এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের পদত্যাগের অধিকার (রিভিউতে রাষ্ট্র বলেছে, রায় এই বিধান লুপ্ত করেছে) আছে কি না?
আনিসুল হক: যদিও ষোড়শ সংশোধনী এখতিয়ারবহির্ভূত বলে সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছেন, তবু মূল ৯৬ অনুচ্ছেদ এবং পরে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল দিয়ে প্রতিস্থাপিত ৯৬ অনুচ্ছেদে পদত্যাগের বিধান ছিল। তাই বলব, বিচারকদের পদত্যাগের ক্ষমতা বহাল আছে।
প্রথম আলো: রাষ্ট্র যদি বলে (রিভিউতে বলেছে) রাষ্ট্রপতির অননুমোদিত আচরণবিধি বৈধ নয়, তাহলে আইনত আচরণবিধির এখন কোনো অস্তিত্ব আছে কি?
আনিসুল হক: আগেও যেটা ছিল, সেসব কথা আদর্শলিপি ও বাল্যশিক্ষায় লেখা থাকে। সেটা অর্থহীন ছিল। কারণ, তাতে বিধি না মানলে কী শাস্তি হবে, তা বলা ছিল না।
প্রথম আলো: আদৌ কোনো আচরণবিধি আছে বলে মানেন কি না?
আনিসুল হক: দেখুন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে একটি আচরণবিধি দেওয়া হয়েছে, আর সেই রায় এখনো স্থগিত করা হয়নি। আচরণবিধি সংবিধানের অংশ নয়। তাই আমার মনে হয়, ওই আচরণবিধি বহাল আছে।
প্রথম আলো: আপনি বলেছিলেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের প্রতি আপনি শ্রদ্ধাশীল।
আনিসুল হক: অবশ্যই আমি শ্রদ্ধাশীল। এই রায় যেহেতু এখন স্থগিত হয়নি, তাই রায় তো আমাকে মানতে হবে।
প্রথম আলো: এই মুহূর্তে অন্য সাংবিধানিক পদধারীদের ক্ষেত্রেও কি এই আচরণবিধি অনুসরণযোগ্য?
আনিসুল হক: অন্য রকম সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিচারকদের এই আচরণবিধিসহ রায়ের যে অংশটুকু সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটুকু আমাকে মেনে চলতে হবে।
প্রথম আলো: আচরণবিধিতে প্রধান বিচারপতির সম্পদ বিবরণী দাখিলের বিধান (রিভিউ দরখাস্তে রাষ্ট্র আপত্তি তুলেছে) রাখা হয়নি।
আনিসুল হক: (হেসে) এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিষ্কার। আপনাকে উদাহরণ তৈরি করেই বাঁচতে হবে। এখন তো বিচারপতিরা প্রশ্ন তুলতে পারেন, আমরাই দেব, প্রধান বিচারপতি দেবেন না, সেটা কেমন করে হয়?
প্রথম আলো: ২০১৭ সালের আরেকটি আলোচিত বিষয় শৃঙ্খলাবিধি। ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটা করতে গিয়ে পরামর্শ হবে রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে। কিন্তু আপনি ও দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি আলোচনা করেছেন। তাহলে?
আনিসুল হক: কথাটা নিরর্থক। তার কারণ (১১৬ অনুচ্ছেদ পাঠ করে), এই যে সুপ্রিম কোর্ট, সেখানে আপিল বিভাগের সবার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, রাষ্ট্রপতি নিজে পুরো বিধিটা দেখেছেন। তারপর প্রজ্ঞাপন হয়েছে।
প্রথম আলো: একটি শর্ত পূরণ করেননি। হাইকোর্ট বিভাগের ৮৫ জন বিচারকের সঙ্গে কখন কথা বললেন?
আনিসুল হক: আমাকে এই ধারণা দেওয়া হয়েছে এবং অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি বলেছেন, তিনি ফুলকোর্টের সঙ্গে আলাপ করেছেন। তাঁরা সবশেষ যেটা করে দিয়েছেন, সেভাবেই প্রজ্ঞাপন হয়েছে। এটা আপনার লিখতে হবে যে ১৯৯৯ সালের মাসদার হোসেন মামলার ৭ দফা নির্দেশনামতে এই শৃঙ্খলাবিধি হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৫ সালের আগে এর উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। আমি যখন প্রথম খসড়া পাই, তখনই তা সুপ্রিম কোর্টে পাঠাই এবং প্রধান বিচারপতি একটি কমিটি করে দিয়েছিলেন।
প্রথম আলো: ঠিক কী কারণে বিরোধের জন্ম হলো?
আনিসুল হক: দেখলাম, খসড়ায় এমন কিছু বিধান আছে, যা ১১৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আর আমি ও আদালত তো ১১৬ শোধরাতে পারি না।
প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধু সুপ্রিম কোর্টই চাননি, হাইকোর্ট চেয়েছিলেন। তাই ১০৯ অনুচ্ছেদ হাইকোর্টকেই বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান করতে বলেছেন, অথচ আপনি তা অগ্রাহ্য করেছেন।
আনিসুল হক: ১০৯ অনুচ্ছেদ আমি অগ্রাহ্য করব তার সাধ্য কী? সেটা আমার নেওয়ার মতো ক্ষমতাও নেই। তত্ত্বাবধান ও শৃঙ্খলাবিধান দুটো কি পৃথক নয়? শৃঙ্খলাবিধি কোনোভাবেই হাইকোর্টের এখতিয়ার খর্ব করেনি। বঙ্গবন্ধু নিজে উপস্থিত থেকে যে বিধান করে গেছেন, সেটাই আমরা সমুন্নত করব। অধস্তন আদালত কারও পুতুল (পাপেট) নয়, তারাও এর অংশীজন। এবং তারা মনে করে যে বিষয়টি যদি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে থাকে, তাহলে তাদের স্ট্যাটাস (মর্যাদা) আরও বাড়ে। দেশের প্রথম, রাষ্ট্রের প্রথম ব্যক্তি আমাদের অভিভাবক, এই অনুভূতিটা তাদের মধ্যে ছিল। আমি এই বিষয়ে তাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছি।
প্রথম আলো: আপনি কি ১১৬ প্রশ্নে বাহাত্তরে ফেরার (নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ শুধু সুপ্রিম কোর্টের) কোনো স্বপ্নই দেখেন না?
আনিসুল হক: যেটা বাস্তবতা সেটা দেখুন। আজকের যে ১১৬ অনুচ্ছেদ আছে, সেটাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। আর যার গ্রহণযোগ্যতা আছে, তারই অস্তিত্ব দীর্ঘমেয়াদি। সেই কারণে এটা (বিদ্যমান ১১৬) থাকবে।
প্রথম আলো: বিডিআর মামলার রায় কার্যকর হতে বিলম্বের কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, অযথা বেশি লোককে আসামি করা হয়েছিল। শুরুতে আপনি এতে রাষ্ট্রের প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন।
আনিসুল হক: এটাই দুঃখজনক। অনেকেই মন্তব্য করেন, যাঁরা ভেতরের বিষয়টি জানেনই না। অজ্ঞ হলেও তাঁরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন না। পিলখানাসহ সব চৌকিতে বিদ্রোহ ও সহিংসতার যে ব্যাপকতা, সেটা অভূতপূর্ব। তাই এর অনুসন্ধান ছিল এক বিরাট বিষয়। আমি প্রসিকিউশনে ছিলাম বলেই নয়, আমার মনে হয় প্রসিকিউশন ও তদন্তকারীদের দেশবাসীর ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। এত অল্প সময়ে প্রায় সাড়ে আট শ আসামি ও প্রায় সাড়ে ছয় শ সাক্ষীর বিষয়ে যা আমরা করতে পেরেছি, এটা তো গিনেস বুকে যাবে। ডিউ প্রসেস বলে একটা কথা আছে। একটি লোক এক সেকেন্ডে খুন করে, সে জন্য তাকে বিচার বিভাগীয় ফাঁসি দিতে লাগে অন্তত তিন বছর।
প্রথম আলো: এক-এগারোতে ডিজিএফআই যে প্রায় সাড়ে ১২ শ কোটি টাকা নিল, এ বছর আপিল বিভাগের রায় সত্ত্বেও তা ফেরত দিচ্ছে না কেন? না দেওয়া কি নৈতিক?
আনিসুল হক: প্রথম কথা হলো একটা রায় হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত যে প্রশ্ন করেছেন, তা পুরো রায় পড়ে আমাকে উত্তর দিতে হবে। আইনমন্ত্রী হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করাটা ঠিক হবে না।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জের সাত খুনে হাইকোর্টের রায় পেলাম, কিন্তু এর কী প্রভাব পড়েছে আমাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর?
আনিসুল হক: এটি একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড, যার সঙ্গে পিলখানা হত্যাযজ্ঞ তুলনীয়। আমরা যদি এর বিচার করতে না পারতাম, তাহলে আইনের শাসনে আমাদের বিশ্বাস প্রশ্নবিদ্ধ হতো।
প্রথম আলো: আপনার কি মনে হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থার জবাবদিহি আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে? পরিসংখ্যান বলছে, এ বছরে ৬৭টি গুম হয়েছে, এটা আগের চেয়ে বেশি। আপনার সরকার বলত জিরো টলারেন্স...
আনিসুল হক: সেই জিরো টলারেন্স নীতি সম্পূর্ণ গতিময়তার সঙ্গে এখন পর্যন্ত নিশ্চয় বলবৎ রয়েছে। দেখুন, আমরা চেষ্টা করছি এটা কমিয়ে আনার। আমাদের সেই চেষ্টার কিছু ফল যে কোথায় পাচ্ছি, দেখেছেন? এই যে (নিখোঁজ ব্যক্তিরা) ফিরে আসছে।
প্রথম আলো: কয়েকজনের ফিরে আসার ব্যাপারে আইনমন্ত্রী হিসেবে আপনার মূল্যায়ন কী?
আনিসুল হক: আইনমন্ত্রী হিসেবে আমার মূল্যায়ন হলো এই যে আমি মনে করি, যারা ফিরে এসেছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচিত হবে তাদের প্রত্যেককে যথাযথভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা। এটা বুঝতে যে কেন তারা হারিয়ে যায়, আর কেন তারা ফিরে আসে। হারানো ও ফেরার দু-একটি গল্প যা শুনেছি, তাতে আমি মনে করি, এখানে আমাদের তদন্ত করা উচিত। কারণ, এ ঘটনায় আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।
প্রথম আলো: গত এক দশকে খালেদা জিয়া সাত শর বেশি গণতন্ত্রপন্থী গুম হওয়ার অভিযোগ করেছেন।
আনিসুল হক: উনি আগুন-সন্ত্রাস করার জন্য ইন্ধন জোগান। ওনার মুখে এই সাত শর বেশি গণতন্ত্রপন্থী কথাটিই তো হাস্যকর। আমার কথা হলো, উনি ফ্যাক্টস ল্যান্ড ফিগার নিয়ে আসুন, আমরাও ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগার দিয়ে ওনার কথার জবাব দেব। আমি তাঁর সঙ্গে একমত নই। তার কারণ, উনি আগুন-সন্ত্রাসের হোতা। আমরা দেখেছি, ওনার ইন্ধনে, ওনার ডাকে মানুষভর্তি বাস পোড়ানো হয়েছে। মানুষের ওপর পেট্রলবোমা মারা হয়েছে। এসবের অপরাধে তিনি অপরাধী।
প্রথম আলো: তাঁর অভিযোগ তদন্তের দাবি রাখে কি না?
আনিসুল হক: উনি যা বলছেন, তা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবু আমরা খতিয়ে দেখব। এবার আপনি বলুন, আপনি ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ বলতে কী বোঝেন?
প্রথম আলো: এটা রাজনৈতিক পরিভাষা, এর আইনি ভিত্তি নেই।
আনিসুল হক: ক্যু মানে হচ্ছে (অক্সফোর্ড ডিকশনারি থেকে পড়ে) ‘কোনো সরকারের কাছ থেকে সহিংস পন্থায় আকস্মিক বা অবৈধভাবে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া।’ হঠাৎ আমি পড়লাম যে উনি বলেছেন, সরকার জুডিশিয়াল ক্যু করেছে। এস কে সিনহার পদত্যাগটা তিনি জুডিশিয়াল ক্যু বলতে চাইছেন। সিনহা সাহেবকে আমরা সরকার থেকে হটাই নাই। প্রথম কথা তাঁকে হটানো হয়নি। দ্বিতীয়ত, সরকার তাঁকে হটায়নি। এখন সুপ্রিম কোর্টের কোনো রায়ের মাধ্যমে যদি সরকার উৎখাত হয়, তাহলে তাকে বলা হয় জুডিশিয়াল ক্যু। এখন প্রধান বিচারপতি যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে তা জুডিশিয়াল ক্যু হয় না। কথার কথা, যদি জোর করে তাঁকে কোনো সরকার সরিয়েও দিত, যেমনটা এরশাদ সাহেবের সরকার করেছিল, তাহলেও সেটা জুডিশিয়াল ক্যু হতো না। দেখুন, শব্দ যেটা ব্যবহার করবেন, সেটা জেনেশুনে ব্যবহার করা ভালো।
প্রথম আলো: কিন্তু আমরা এখানে একটা বিচার বিভাগীয় অপারগতা দেখি। আচরণবিধি অনুযায়ী প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে পরের জ্যেষ্ঠ তিনজনের কমিটির স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তদন্ত করা এবং তা লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে জানানোর কথা। সেটা হয়নি।
আনিসুল হক: আপনি এই প্রশ্ন তুলেছেন, আমি কিন্তু ওনাদের এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি। আমি যতটুকু শুনেছি এবং সম্ভবত এটা তাঁদের প্রেস রিলিজে আছে, তাঁরা সাবেক প্রধান বিচারপতিকে বলেছিলেন যে আপনার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, জবাব দিন। যদি এসব মিথ্যে হয়, তাহলে তারও উত্তর দিন। আর যতক্ষণ আপনার জবাবটা বিচার্য অবস্থায় থাকবে, ততক্ষণ আপনি পদ থেকে সরে দাঁড়ান। আমি মনে করি, তাঁরা তাঁদের কর্তব্য পালন করেছেন।
প্রথম আলো: সবশেষ প্রশ্ন, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কবে নিয়োগ পাচ্ছেন?
আনিসুল হক: (হেসে) আপনি সংবিধানের ওপর লেখালেখি করেন, সে ক্ষেত্রে আমি বলব, সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটা (প্রধান বিচারপতি নিয়োগ) সম্পূর্ণ এবং একমাত্র এখতিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রপতির। আমি জানি না তিনি কবে (নিয়োগ) দেবেন।
প্রথম আলো: অস্বাভাবিক বা আকস্মিক অবস্থা ছাড়া কোনো দেশেই এভাবে প্রধান বিচারপতির পদ খালি রাখা হয় না।
আনিসুল হক: কেন, এর আগে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান দীর্ঘ সময় অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
প্রথম আলো: সেটা বিশেষ অবস্থা ছিল, সে জন্য আমরা একাদশ সংশোধনী পাস করেছিলাম। তাহলে সেদিকে যাবেন?
আনিসুল হক: না। (হেসে) বললেন নজির নেই, তাই নজির দেখালাম। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি থেকে পুনরায় প্রধান বিচারপতি হওয়ার নজির কোথায় আছে? বাংলাদেশে হয়েছে। তাই এগুলো বলে তো লাভ নেই।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আনিসুল হক: ধন্যবাদ।
No comments