ভ্যাট আরোপে এলপি গ্যাসের উদ্যোক্তারা আতঙ্কে
গ্যাসের মজুদ কমে আসায় পাইপলাইন গ্যাসের চাপ কমাতে সরকার সিলিন্ডার গ্যাস সম্প্র্রসারণ উৎসাহিত করছে। গত কয়েক বছরে এ খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এর উপকরণ তৈরি করতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগও করেছেন। কিন্তু আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট ভোক্তাপর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করায় উদ্যোক্তারা তাদের বিনিয়োগ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এর কারণ ভ্যাট আরোপের ফলে সিলিন্ডার প্রতি দেড় শ’ টাকা থেকে তিন শ’ টাকা দাম বেড়ে যাবে। এতে গ্রাহকেরা সিলিন্ডার ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। ফলে এ খাতে বিনিয়োগও ঝুঁকির মুখে পড়বে। একক ভ্যাট হারে শুধু এলপি গ্যাসেরই দাম বাড়বে না, বিদ্যুৎ ও পাইপলাইনের গ্যাসের দামও বেড়ে যাবে। বর্তমানে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিলের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। একক হার হলে এখন ১৫ শতাংশ হারেই ভ্যাট দিতে হবে। ফলে মোট বিলের ওপর গড়ে ১০ শতাংশ হারে দাম বেড়ে যাবে। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট হার কার্যকর হবে। এ কারণে দাম বাড়ার দুশ্চিন্তায় ভুগছেন এলপি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পাইপ লাইনের গ্যাসের গ্রাহকেরা। ভ্যাট আরোপের ফলে ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শামসুল হক আহমেদ এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, পাইপ লাইনের গ্যাসের মজুদ কমে যাচ্ছে। এ কারণে সরকার পাইপ লাইনে গ্যাসের চাপ কমানোর জন্য এলপি গ্যাসের সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে সিলিন্ডার গ্যাসের সম্প্রসারণের ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর চাপ কমে যাচ্ছে। গৃহস্থালির পাশাপাশি অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানও বিকল্প হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাসের ওপর ঝুঁকেছিল। এ উদীয়মান খাতকে উৎসাহিত করতে যেখানে সরকার আরো সহযোগিতার হাত বাড়াবে, তা না করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে এ খাত সঙ্কোচিত হয়ে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।
কারণ ভ্যাটের চাপ পুরোপুরি যাবে ভোক্তাদের ওপর। সিলিন্ডার প্রতি দেড় শ’ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে যাবে, যা অনেক গ্রাহকের ক্ষেত্রে বহন করা কষ্টকর হবে। সম্ভাব্য পরিস্থিতি এড়াতে ও এলপি গ্যাসের মূল্য সাধারণের সাধ্যের মধ্যে রাখতে এর ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য সরকারের কাছে তিনি অনুরোধ করেন। বিএম এনার্জির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর (এমডি) মোহাম্মদ নূরুল আলম বলেন, এলপি গ্যাসের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ফলে ৯০০ টাকার গ্যাস ১১ শ’ টাকায় উঠে যাবে। দাম বেড়ে যাওয়ায় সরাসরি চাপ পড়বে গ্রাহকদের ওপর। এতে এলপি গ্যাসের ব্যবহার কমপক্ষে ২০ শতাংশ কমে যাবে। এখানেই তাদের উদ্বেগের কারণ। তিনি বলেন, যেখানে সরকার পাইপ লাইন গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাসের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সেখানে এ খাতের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ সরকারের নীতি বিরোধী উদ্যোগ বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য তারা এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। একই সাথে জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকেও অর্থমন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে। তিনি আশা করেন উদীয়মান এ খাতকে উৎসাহিত করতে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেবে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আখতার হোসাইন সান্নামাত বলেন, পাইপ লাইনের গ্যাসের মজুদ কমে আসছে। এ কারণে সরকার বোতলজাত গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করছে। ফলে গৃহস্থালিসহ কিছু কিছু শিল্পকারখানায়ও বিকল্প হিসেবে এলগি গ্যাসের ব্যবহার বেড়ে গেছে। এ থেকে সরকার দুই দিক থেকে লাভবান হচ্ছে। প্রথমত, পাইপ লাইন গ্যাস সরবরাহ করা হয় ভর্তুকির মাধ্যমে। কারণ উৎপাদন ব্যয় ও বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে যে দরে গ্যাস কেনা হয়, সরবরাহ করা হয় তুলনামূলক কম দামে। এলপি গ্যাস ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় পাইপ লাইন গ্যাসের চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারের ভর্তুকিও কমে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত গৃহস্থালিতে পাইপ লাইনের গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় এ গ্যাস শিল্প কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে কাক্সিত হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করছে। এখন এলপি গ্যাসের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের ফলে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ভোক্তাপর্যায়ে। এতে ভোক্তারা নিরুৎসাহিত হলে পাইপ লাইনের গ্যাসের ওপর চাপ আবার বেড়ে যাবে। এতে সরকারের ভর্তুকির পাশাপাশি গ্যাসের মজুদের ওপরও চাপ বেড়ে যাবে। এ কারণে বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নতুন কোনো ত্রে আবিষ্কৃত না হয় তাহলে গ্যাসের বর্তমান মজুদ ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। সরকার পাইপ লাইনের গ্যাস শুধু শিল্পকারখানার জন্য মজুদ রাখতে চায়। এ কারণে বাসাবাড়িতে পাইপ লাইনের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে এবং এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনাও নিয়েছে। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ায় এলপি গ্যাস সম্প্রসারণ হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে বছরে ১০ লাখ টন এলপি গ্যাসের চাহিদা থাকলে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র পাঁচ লাখ টন। দেশে বিপিসির পাশাপাশি দেশী-বিদেশী ১০টির মতো প্রতিষ্ঠান এলপিজি প্ল্যান্ট স্থাপন করে উৎপাদন শুরু করেছে। এ খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা, যার বড় একটি অংশ ব্যাংক ঋণ নেয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন মতার মাত্র ৪০ শতাংশ কাজে লাগাতে পারছে। ভ্যাট আরোপের ফলে এ খাতের সম্প্রসারণের পরিবর্তে সঙ্কোচিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন। ফলে বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। এদিকে বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলের সাথে রেয়াতি হারে ৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিন্তু আগামী মাস থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে একক হার হিসেবে সব ক্ষেত্রেই ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। এতে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে। আর বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেলে চাপে পড়বে ভোক্তারা। তবে এনবিআরের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন ভ্যাট আইনে একক হার হিসাবে থাকলেও বিদ্যুৎ ও গ্যাসে উপকরণ কর রেয়াদ দেয়া হতে পারে। ফলে সেবা খাত হিসেবে কর রেয়াত দেয়া হলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বাড়বে না। এ বিষয়ে বিবেচনা করা হতে পারে বলে ওই কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন। এদিকে শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে তাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দেবে। নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন প্রযুক্তি ও রেয়াতনির্ভর। এ আইনে হিসাব সংরণসহ ভ্যাটের যাবতীয় কার্যক্রম অনলাইনের মাধ্যমেই পরিচালিত হবে। অথচ বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এখনো অনলাইনে ব্যবসায় পরিচালনা করে না। একই সাথে নতুন এ আইনে অনেক েেত্র উপকরণে কর রেয়াত নেয়া সম্ভব হবে না। ফলে আইনটি কার্যকর হলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে। সামগ্রিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ভোক্তাপর্যায়ে।
No comments