ক্ষয়িষ্ণু যুক্তির জোর ফেনিয়ে উঠছে জোরের যুক্তি
বাংলাদেশের মানুষের জন্য যুক্তিবিদ্যা শেখা এখন অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। অর্থ, ব্যাখ্যা, উপস্থাপনা ও প্রত্যুত্তরের দোষে কিংবা স্বরাঘাতের তারতম্যের ফলে অথবা তুলনা করার অক্ষমতার কারণে কোন্ কথা কী ধরনের বিভ্রান্তি অথবা বিপদ ঘটাতে পারে, যুক্তিবিদ্যায় তার নানা উদাহরণ রয়েছে। এসব জ্ঞান আহরণ করলে বিভ্রান্তি ও বিপদ থেকে আমরা সুরক্ষাও পেতে পারি বৈকি। যেমন ধরুন, যুক্তিবিদ্যা বলছে, কেউ আপনাকে এমন কিছু প্রশ্ন করতে পারে, যার উত্তরে আপনি ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ দুটোর যে কোনোটি বললে আপনার সম্ভ্রমহানি ঘটবে অথবা আপনি বিপদে পড়বেন। এমন একটি প্রশ্ন হতে পারে- আপনি কি বউ পেটানো বন্ধ করেছেন? আপনি যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন, তার মানে দাঁড়াবে আগে পেটাতেন, এখন পেটান না। আর ‘না’ বললে আগেও পেটাতেন, এখনও পেটান। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দিতে হবে, যুক্তিবিদ্যায় তার রূপরেখা দেয়া আছে। এবার আসুন, স্বরাঘাতের তারতম্যের কারণে একই বাক্যের দু’রকম অর্থ হয়ে যেতে পারে। একটা সাধারণ উদাহরণ দিই। আপনি রিডিং রুমের চেয়ারে বসে আছেন। ডিনারের সময় হয়ে গেছে। স্ত্রী এসে পেছন থেকে বললেন- তুমি কি লিখছ? এর মানে আপনি লিখছেন কিনা। স্ত্রী যদি ‘কি’-এর ওপর স্বরাঘাত করেন, তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়াবে- আপনি কী বিষয় নিয়ে লিখছেন? স্বরাঘাত বুঝে আপনাকে উত্তর দিতে হবে। আবার দেখুন, আপনি যখন বলছেন- আমি এ পর্যন্ত যত মেয়ে দেখেছি, তাদের সবাই ছলনাময়ী, সুতরাং পৃথিবীর সব মেয়েই ছলনাময়ী- যুক্তিবিদ্যা তখন বলছে আপনার এই সিদ্ধান্ত অবৈধ সামান্যীকরণের দোষে দুষ্ট। আপনি নারী জাতির অতি সামান্যই দেখেছেন।
যেমন, আমি একবার লিখেছিলাম- তুমি এই ভেবে গর্ব করো না যে, তুমি মেয়েদের চিনেছ, কারণ আরেকটি মেয়ে তোমাকে এর চেয়েও বেশি কষ্ট দিতে পারে। শেকসপিয়রও অবৈধ সামান্যীকরণের দোষে দুষ্ট। হ্যামলেট নাটকে বাবার মৃত্যুর পর মা এক মাসের মধ্যে ক্লডিয়াসকে বিয়ে করলে শেকসপিয়র সন্তান হ্যামলেটের মুখ থেকে স্বগতোক্তি করিয়েছেন- Frailty thy name is woman. অথচ সত্য হল, পৃথিবীর সব নারীই অনৈতিক নয়। অবৈধ সামান্যীকরণের আরেকটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। একদিন উচ্চশিক্ষিত এক লোক আমাকে বললেন- আমার কাছে ধর্মের দাওয়াত নিয়ে যারাই এসেছেন, তাদের সবাই কাঠমোল্লা। এটুক পর্যন্ত বললে ঠিক ছিল। কিন্তু তিনি যোগ করলেন- আসলে সবাই কাঠমোল্লা। আমি বললাম, ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যাদাতা ও ধর্মীয় দার্শনিকের সংখ্যা কিন্তু অনেক, তারা আপনার কাছে আসে না, কারণ তারা ধর্মেই পেয়েছে যে, তারা আপনাকে হেদায়েত করতে পারবে না, হেদায়েত করতে পারেন একমাত্র আল্লাহ। যুক্তিবিদ্যার একটি অন্যতম শিক্ষার কথা বলি এখন। সেটা হল, অর্ধসত্য কখনও কখনও মিথ্যার চেয়েও বড় বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে, হয়ে উঠতে পারে মিথ্যার চেয়ে ভয়ঙ্কর। যেমন, মধ্যবয়সী অথবা প্রবীণ কেউ এক ষোড়শীকে বলেছেন- আমি তোমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসি; এরপর মেয়েটি যদি ‘মেয়ের মতো’ কথাটা ছেঁটে বাকি কথাগুলো কাউকে শোনায়, সেক্ষেত্রে ওই লোকের বিরুদ্ধে আমাদের সামাজিক প্রথায় বড়সড় অভিযোগ গঠন করা যাবে। মেয়েটি নিশ্চয়ই মিথ্যা বলেনি, বলেছে অর্ধসত্য। প্রসঙ্গান্তরে যাই। পাশ্চাত্য সমাজের মানুষ তাদের প্রাত্যহিক কথাবার্তায় তিনটি বিষয় এড়িয়ে চলে- রাজনীতি, ধর্ম ও সেক্স। এর কারণ, এই তিন বিষয় নিয়ে কথা বললে তৈরি হতে পারে ভুল বোঝাবুঝি; খারাপ হয়ে যেতে পারে মানুষে মানুষে সম্পর্ক। তারা বরং আবহাওয়া, স্পোর্টস, ক্যারিয়ার ইত্যাদি নিয়েই কথা বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করে। পক্ষান্তরে, শিয়াপ্রধান ইরানে ধর্ম নিয়ে এত কথা হয় যে, তেহরান বিমানবন্দরে আপনি অবতরণ করলে সম্ভাবনা রয়েছে আপনাকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করবে- আপনি মুসলমান, না সুন্নি? অর্থাৎ তার দৃষ্টিতে সুন্নিরা মুসলমান নন। বর্তমান বাংলাদেশে আমাদের যেহেতু প্রতিনিয়তই ধর্ম নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে- সেটা হয় টেলিভিশনের টকশোয় কিংবা পত্রিকার পাতায় অথবা মিটিং-মিছিল, হোটেল-রেস্তোরাঁয়- তাই আমাদের সবার এখন উচিত যুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠা। এই জাতির সবাই যদি যুক্তিবাদী হয়ে উঠতেন, তাহলে নিশ্চয়ই যে কথায় দোষ ধরা চলে না, সেটা নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি হতো না। সবচেয়ে ভালো হয়, ধর্ম নিয়ে বিতর্ক না করা। কোন্ কথায় অথবা কীসে আদালত অবমাননা হয়, সে ব্যাপারে যেমন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই, তেমনি কোন্ কথায় ধর্মের অবমাননা হবে, তারও কোনো সীমানা চিহ্নিত করা হয়নি, এমনকি ধর্মবেত্তারাও তা এখনও নির্দিষ্ট করেননি। দ্বিতীয়ত, একটি বহুধাবিভক্ত সমাজে মানুষের প্রকারভেদ রয়েছে যেহেতু, সেহেতু চিন্তারও নানা প্রকার থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
আরও সত্য, কোন্ কথা কার অনুভূতিতে আঘাত করবে অনেকে তা বুঝেও উঠতে পারে না। আবার ধর্ম এমন এক স্পর্শকাতর বিষয় যে, দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, হোন না তারা হিন্দু ও বৌদ্ধ, যদি বিশ্বস্ত থাকেন নিজ নিজ ধর্মের প্রতি, ধর্ম বিষয়ে তর্কে লিপ্ত হলে কোনো না কোনোভাবে উভয়পক্ষেরই অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। মূল কথায় আসি। ওইরকম একটি টকশোতে যাওয়াই উচিত হয়নি সুলতানা কামালের। আমরা এখন সবাই সুপ্রিমকোর্টের ভাস্কর্য নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে রয়েছি এবং উত্তেজনার মধ্যে থাকলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লাইনমতো কথা বলা যায় না। ইস্যুটি নিয়ে তার কথা বলা উচিত ভাস্কর্যটি সুপ্রিমকোর্টে রাখার পক্ষে ছিল যারা এবং ‘কী করিতে হইবে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছে না যারা’- তাদের সঙ্গে। যাকগে। দোষটা আসলে করেছিলেন মুফতি সাখাওয়াত হোসেনই। তিনি আসলে বুঝতেই পারেননি তার কথার অর্থ কী। বলেছিলেন, সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে কোনো ধর্মীয় স্থাপনা রাখা যাবে না। তার মতে, সেখানে ধর্মীয় স্থাপনা থাকলে তা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। এ কথার প্রতিক্রিয়ায় সুলতানা কামাল বলেছেন, আপনার কথামতো যদি সেখানে ধর্মীয় স্থাপনা রাখা না চলে, তাহলে বলব মসজিদও একটি ধর্মীয় স্থাপনা। পাঠক লক্ষ করুন, সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ধর্মীয় স্থাপনা রাখা চলবে না, ভিন্ন ধর্মের স্থাপনার কথা বলেননি। ধর্মীয় স্থাপনা বলতে সব ধর্মের স্থাপনাই বোঝায় নিশ্চয়ই। সুলতানা কামাল মুফতি মহোদয়ের কথার আক্ষরিক অর্থ করেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন আর তাতেই হয়েছেন দোষী! সুলতানা কামালকে কীভাবে বুদ্ধিমতী বলব! মুফতি সাখাওয়াত যেহেতু কৌশল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে আশ্রয় করেছেন, তিনিও যদি পাল্টা কৌশলে ধর্মকে আশ্রয় করে তার প্রতিক্রিয়ায় বিনয়ের সঙ্গে বলতেন- আপনার সঙ্গে আমার কথাই বলা উচিত নয়, আপনি মুসলমানপ্রধান একটি দেশে বাস করে গ্রিক ভাস্কর্য অপসারণের সঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে পবিত্র মসজিদ ও একটি পীরের মাজারও সরানোর ইঙ্গিত দিচ্ছেন এবং এটা বলে যদি তিনি টকশো কুইট করতেন, তাহলে বলটা কোর্ট পরিবর্তন করত। বিপদে পড়তেন মুফতি মহোদয়ই। সেক্ষেত্রে প্রচারকরা ‘সুলতানা কামাল একজন বেয়াদব’ এমন একটি মিথ্যা প্রচার করার সুযোগ পেতেন বড়জোর। সেই মিথ্যা নিশ্চয়ই অর্ধসত্য প্রচার করে তাকে যে পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে, সেই ভয়ঙ্কর অবস্থা তৈরি করত না। অনেকে হয়তো বলবেন, সুলতানা কামালের কি এমন কৌশলী হওয়া সাজে? কেন সাজে না? বাংলাদেশে এখন আদর্শ-ফাদর্শ বলে কিছু নেই, যা আছে তা হল কৌশলে কে কাকে বিপদে ফেলতে পারে। সেদিন ‘দেশ’ টিভিতে সুলতানা কামাল ইস্যুতেই এক টকশো শেষে ‘দেশ’-এর গাড়িতেই ফিরছিলাম। পথে ড্রাইভার বলছিলেন- দেশে এখন দুইটা দোকান খোলা হয়েছে, একটি ধর্মব্যবসায়ী, আরেকটি নাস্তিকদের। আমার সঙ্গে বসা ‘দেশ’ টিভির একজন সাধারণ কর্মচারী যোগ করলেন, গুড সেলসম্যানশিপের কারণে প্রথমটার বিক্রি বেশি। হ্যাঁ, মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীরা সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত নন। বাংলা ভাষায় কিছু কিছু শব্দ অকেজো হয়ে পড়েছে, সেগুলোর আর কোনো মানে নেই। ‘সম্প্রীতি’ তেমন একটি শব্দ। পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ করার জন্য এখন সদাউদগ্রীব সবাই। ঝগড়া বাধাতে না পারলে পেটের ভাত হজম তো হয়ই না, ওগুলো আবার চাল হয়ে যায়।
২. ঢং করছি না, চিন্তায় পড়ে গেছি লেখালেখি আর করব কিনা। আসক্তির একটা সংজ্ঞা দেয়া যায় এভাবে- নির্দোষ বস্তু বা কোনো ধারণাগত বিষয়ের সঙ্গে দেহ-মনের মিথষ্ক্রিয়ায় যদি এমন এক অবস্থা তৈরি হয় যে, বস্তুটি অথবা ধারণাগত ওই বিষয়ের ওপর মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং সেই বস্তু অথবা বিষয়টিকে প্রত্যাহার করে নিলে প্রত্যাহারজনিত উপসর্গ (withdrawl symptom) দেখা দেবে, তাহলে ওই অবস্থাটিকে আসক্তি বলা যাবে। বস্তুর আগে ‘নির্দোষ’ লাগিয়েছি, কারণ পৃথিবীতে এমন কোনো বস্তু নেই যা কোনো না কোনোভাবে মানুষের উপকারে না আসে, ব্যবহারের দোষে বস্তুটি দোষী হয়। পেঁয়াজের কোনো দোষ নেই, বিশেষ শরীরে অ্যালার্জি তৈরি করে তা দোষী সাব্যস্ত হয়। তো লেখালেখি বস্তু নয়, ধারণাগত বিষয় এবং এটাতে আমি আসক্ত হয়ে পড়েছি। মানসিক কাঠামো থেকে লেখালেখি প্রত্যাহার করে নিলে বমি বমি ভাব আসতে পারে জানি, তারপরও ছেড়ে দেব ভাবছি। কেন করব ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজ? ঝুঁকিটা নেয়া যেত, যদি তাতে কিছু লাভ হতো। ব্যাপারটা দেখুন, সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে লিখি যদি, তাতে সন্ত্রাস দমন হবে না, উল্টো সন্ত্রাসীর চাঁদার হার বাড়বে। সে সেই লেখা দেখিয়ে টার্গেটকে বলবে, আগে পঞ্চাশ হাজার দিতেন, এখন এক লাখ দিতে হবে। ঠিকই তো, মিডিয়া যখন বলছে, সে বড় সন্ত্রাসী না হয়ে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘর্ষের রিপোর্ট করার সময় পত্রিকার ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্টকে নাকি সন্ত্রাসীরা বলে, ভাই আমার নামটাও ঢুকিয়ে দিবেন। এর সোজাসাপ্টা মানে তাতে হায়ার অথরিটির কাছে তার বাজারদর বাড়বে। শেখ হাসিনার প্রথম টার্মে পিচ্চি শামীম নামে ছাত্রলীগের এক ‘ক্যাডার’ ছিল মহা আতঙ্কের প্রতিভূ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টি হল দখলে রেখেছিল সে। আমি তখন সাপ্তাহিক চলতিপত্রে কাজ করি। এক কলামে কড়া ভাষায় লিখলাম তার অপকর্ম নিয়ে। ঠিক ওই সময়টায় প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে নিয়ে ধমকাধমকি করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী কেন তাকে ডেকেছিলেন জানি না, তবে কাক উড়ে যাওয়ার সময়ই যেহেতু গাছ থেকে তালটা পড়েছে, তাই তাল পড়ার কারণ কাকের উড়ে যাওয়া- এমন কাকতালীয় ভাবনায় সে ভাবল আমার লেখার কারণেই প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে ধমকিয়েছেন। রমজান মাসের কোনো এক সন্ধ্যায় সে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে চলতিপত্র কার্যালয়ে এসে হাজির। আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। অযথাই ঘাবড়েছিলাম। শামীম আমার পরিচয় জেনে বলল- বস্ আপনি লেখছেন বলেই নেত্রী আমাকে ডেকেছেন। ওনার দেখা পাওয়া চাট্টিখানি কথা! শেরেবাংলা ফজলুল হককে একবার কেউ একজন বললেন, স্যার পত্রিকায় আপনার বিরুদ্ধে লেখালেখি হচ্ছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, লিখুক গে, যারা আমাকে ভালোবাসে (তার দলের নাম ছিল কৃষক-প্রজা পার্টি), তারা ওসব পড়ে না। নেহেরুর কথাগুলো আরও চমৎকার। তার কাছেও ঘনিষ্ঠ একজন এ ধরনের নালিশ নিয়ে এলে তিনি বলেছিলেন, তাতে কি আমার স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয়েছে?
২. ঢং করছি না, চিন্তায় পড়ে গেছি লেখালেখি আর করব কিনা। আসক্তির একটা সংজ্ঞা দেয়া যায় এভাবে- নির্দোষ বস্তু বা কোনো ধারণাগত বিষয়ের সঙ্গে দেহ-মনের মিথষ্ক্রিয়ায় যদি এমন এক অবস্থা তৈরি হয় যে, বস্তুটি অথবা ধারণাগত ওই বিষয়ের ওপর মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং সেই বস্তু অথবা বিষয়টিকে প্রত্যাহার করে নিলে প্রত্যাহারজনিত উপসর্গ (withdrawl symptom) দেখা দেবে, তাহলে ওই অবস্থাটিকে আসক্তি বলা যাবে। বস্তুর আগে ‘নির্দোষ’ লাগিয়েছি, কারণ পৃথিবীতে এমন কোনো বস্তু নেই যা কোনো না কোনোভাবে মানুষের উপকারে না আসে, ব্যবহারের দোষে বস্তুটি দোষী হয়। পেঁয়াজের কোনো দোষ নেই, বিশেষ শরীরে অ্যালার্জি তৈরি করে তা দোষী সাব্যস্ত হয়। তো লেখালেখি বস্তু নয়, ধারণাগত বিষয় এবং এটাতে আমি আসক্ত হয়ে পড়েছি। মানসিক কাঠামো থেকে লেখালেখি প্রত্যাহার করে নিলে বমি বমি ভাব আসতে পারে জানি, তারপরও ছেড়ে দেব ভাবছি। কেন করব ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজ? ঝুঁকিটা নেয়া যেত, যদি তাতে কিছু লাভ হতো। ব্যাপারটা দেখুন, সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে লিখি যদি, তাতে সন্ত্রাস দমন হবে না, উল্টো সন্ত্রাসীর চাঁদার হার বাড়বে। সে সেই লেখা দেখিয়ে টার্গেটকে বলবে, আগে পঞ্চাশ হাজার দিতেন, এখন এক লাখ দিতে হবে। ঠিকই তো, মিডিয়া যখন বলছে, সে বড় সন্ত্রাসী না হয়ে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘর্ষের রিপোর্ট করার সময় পত্রিকার ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্টকে নাকি সন্ত্রাসীরা বলে, ভাই আমার নামটাও ঢুকিয়ে দিবেন। এর সোজাসাপ্টা মানে তাতে হায়ার অথরিটির কাছে তার বাজারদর বাড়বে। শেখ হাসিনার প্রথম টার্মে পিচ্চি শামীম নামে ছাত্রলীগের এক ‘ক্যাডার’ ছিল মহা আতঙ্কের প্রতিভূ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টি হল দখলে রেখেছিল সে। আমি তখন সাপ্তাহিক চলতিপত্রে কাজ করি। এক কলামে কড়া ভাষায় লিখলাম তার অপকর্ম নিয়ে। ঠিক ওই সময়টায় প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে নিয়ে ধমকাধমকি করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী কেন তাকে ডেকেছিলেন জানি না, তবে কাক উড়ে যাওয়ার সময়ই যেহেতু গাছ থেকে তালটা পড়েছে, তাই তাল পড়ার কারণ কাকের উড়ে যাওয়া- এমন কাকতালীয় ভাবনায় সে ভাবল আমার লেখার কারণেই প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে ধমকিয়েছেন। রমজান মাসের কোনো এক সন্ধ্যায় সে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে চলতিপত্র কার্যালয়ে এসে হাজির। আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। অযথাই ঘাবড়েছিলাম। শামীম আমার পরিচয় জেনে বলল- বস্ আপনি লেখছেন বলেই নেত্রী আমাকে ডেকেছেন। ওনার দেখা পাওয়া চাট্টিখানি কথা! শেরেবাংলা ফজলুল হককে একবার কেউ একজন বললেন, স্যার পত্রিকায় আপনার বিরুদ্ধে লেখালেখি হচ্ছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, লিখুক গে, যারা আমাকে ভালোবাসে (তার দলের নাম ছিল কৃষক-প্রজা পার্টি), তারা ওসব পড়ে না। নেহেরুর কথাগুলো আরও চমৎকার। তার কাছেও ঘনিষ্ঠ একজন এ ধরনের নালিশ নিয়ে এলে তিনি বলেছিলেন, তাতে কি আমার স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয়েছে?
যদি না হয়ে থাকে, তাহলে তুমি এত চিন্তিত কেন? আমরা যখন সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে কাজ করতাম, সেটি তখন দুনিয়াব্যাপী বাঙালি সমাজের কাছে অতি সমাদৃত একটি পত্রিকা ছিল। তো আমরা দুটি ইস্যুর ওপর নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছি। একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পরমত সহিষ্ণুতা, আরেকটি সেক্যুলার দর্শন। আজ দুই যুগ পর দেখতে পাচ্ছি, এ দেশে যেসব বিষয়ের দ্রুত অধঃপতন ঘটে চলেছে, সেগুলোর তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে এ দুটি বিষয়। একবার কানাডাপ্রবাসী আমার এক পাঠক, তসলিম যার নাম, ঢাকায় এসে আমাকে খুঁজে বের করে চাইনিজে নিয়ে গিয়েছিলেন। খেতে খেতে বলেছিলেন, যায়যায়দিন দেশের ময়লা পরিষ্কার করার দায়িত্ব নিয়েছে। আপনাদের হাতে কি এত ঝাড়– আছে যে সব ময়লা পরিষ্কার করে ফেলবেন? আরেকটি বড় কারণে লেখালেখির কোনো মানে পাওয়া যায় না। প্রথমে বলি, একই বয়সের একটি ছেলে ও মেয়ের মধ্যে মেয়েটিই ম্যাচিউর বেশি, কারণ সে নানা ধরনের আক্রমণ মোকাবেলা অথবা সহ্য করে অপ্রিয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই বড় হচ্ছে। আবার বলা হয়ে থাকে, নতুন ডাক্তারের চেয়ে পুরনো রোগীই চিকিৎসাশাস্ত্র জানে বেশি। তো আমরা যারা কলাম লিখছি, তারা হয়তো বুঝতেই পারছি না পাঠকরা তাদের জীবনসংগ্রামে লড়তে লড়তে কতটা পেকে আছে। আর সেজন্যই খালেদা ওটা ভালো বলেননি, হাসিনা এটা ভালো বলেছেন (অথবা উল্টোটা), অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিকল্প নেই, দেশটা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ইত্যাদি লিখে ভাবছি না জানি কী উদ্ধার করে ফেললাম। আসলে কিছুই উদ্ধার করা যায়নি, কারণ পাঠক এসব কথার কোন্টাকে কতটা গুরুত্ব দিতে হবে লেখকের চেয়ে ভালো বোঝেন। হ্যাঁ, কিছু একটা উদ্ধার হতো বটে, যদি এই রাষ্ট্র, এই সমাজ, এই মানুষের কীভাবে পরিবর্তন ঘটানো যায়, তার একটা বিশ্বাসযোগ্য শুধু নয়, বাস্তবায়নযোগ্য রূপরেখা দিতে পারতাম। আমার ছোট ছেলেটি বলেছে ভালো- আব্বু প্রতি সকালে পত্রিকা পড়ে উত্তেজিত হই, পরদিন সকাল হতে না হতেই সেই উত্তেজনা শেষ হয়ে যায়, শুরু হয় নতুন উত্তেজনা। তার এ কথার মানে কী? মানে উত্তেজনা তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশে। আর টকশো তো আজকাল লোকে দেখে না বললেই চলে। এটা তাদের দৃষ্টিতে টেলিভিশনের রুটিন ওয়ার্কের বেশি কিছু নয়। বিশ্লেষণধর্মী কলামের পরিবর্তে রিপোর্টিংয়েই বরং কিছু কাজ হয়। ওসির দুর্নীতির খবর ছাপা হলে তার একটা শাস্তি হলেও হতে পারে। কিংবা ধরুন কোনো এক দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার যাপিত করুণ জীবনের কাহিনী পড়ে প্রধানমন্ত্রী দয়াপরবশ হয়ে তার ত্রাণ তহবিল থেকে কিছু টাকা দিলেন। এরকম আর কী! পাঠকও রিপোর্ট পড়তেই আগ্রহী, বিশ্লেষণ নয়, সেটা তার জানা। তারা পত্রিকা রাখে, কারণ তাতে জানা যায় লঞ্চডুবিতে তার নিকটাত্মীয় কেউ মরেছে কিনা, স্প্যানিশ লিগের ফাইনাল খেলাটা রাত ক’টায় শুরু হবে অথবা এবার হজে যেতে হলে কত টাকা লাগবে, বাজেটে কীসের দাম বাড়ল আর কমল কীসের ইত্যাদি। অথবা ছাত্রলীগের ছেলেরা যে কুপিয়ে অমুককে হত্যা করল, দেখি তো কীভাবে কোপালো! অতঃপর গভীরভাবে ভাবছি, কলামিস্ট পরিচয় মুছে ফেলে রিপোর্টার হয়ে যাব কিনা!
পুনশ্চ : গাজী ভাই (গাজী শাহাবুদ্দিন) মারা গেছেন। তার সম্পাদিত ‘সচিত্র সন্ধানী’ খুব প্রিয় ছিল মা’র। সেই ফাইভ-সিক্সে পড়ি যখন, পত্রিকাটিতে সিনেমার স্টিল ছবিগুলোর দিকে কীভাবেই না তাকিয়ে থাকতাম! এমন ছবির এত প্রাচুর্য এখন, তাকাতেই ইচ্ছা করে না। বয়সকালে এসে গাজী ভাইয়েরই স্থাপনাতে আমরা চলতিপত্রের কার্যালয় খুলেছিলাম। তার মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গের লেখক-বুদ্ধিজীবীরা একজন লোকাল গার্জিয়ান হারালেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা সেনসহ অনেকেই ঢাকায় এলে তার আতিথ্য গ্রহণ করতেন। একবার সুনীলদার ইন্টারভিউ করার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম- কোথায় উঠেছেন? তিনি বললেন- কোথায় আবার! আমি যার পোষ্যপুত্র, তার কাছে। বুঝলাম গাজী ভাই। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঠেকানো যায়নি, আমি তাই কোনো বিখ্যাত লোকেরই মৃত্যুতে দুঃখ-টুঃখ পাই না। একবার আমার অতি প্রিয় আলী ফিদা একরাম তোজোর একটি নাটকের মহরতে বক্তৃতা করেছিলাম। অনুষ্ঠানের শেষে ছিল গান-বাজনা। তরুণ-তরুণীরা মিউজিকের তালে তালে নাচছিল। এক মেয়ে নাচে তার সঙ্গী হওয়ার জন্য আমার হাত ধরে টানাটানি করছিল যখন, আমি ইতস্তত করতেই সে বলেছিল- বয়স আবার কী! বয়স তো একটি সংখ্যা মাত্র। সব মৃত্যুই আমার কাছে একটি ইনফরমেশন মাত্র, অতিরিক্ত কিছু নয়।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@yahoo.com
পুনশ্চ : গাজী ভাই (গাজী শাহাবুদ্দিন) মারা গেছেন। তার সম্পাদিত ‘সচিত্র সন্ধানী’ খুব প্রিয় ছিল মা’র। সেই ফাইভ-সিক্সে পড়ি যখন, পত্রিকাটিতে সিনেমার স্টিল ছবিগুলোর দিকে কীভাবেই না তাকিয়ে থাকতাম! এমন ছবির এত প্রাচুর্য এখন, তাকাতেই ইচ্ছা করে না। বয়সকালে এসে গাজী ভাইয়েরই স্থাপনাতে আমরা চলতিপত্রের কার্যালয় খুলেছিলাম। তার মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গের লেখক-বুদ্ধিজীবীরা একজন লোকাল গার্জিয়ান হারালেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা সেনসহ অনেকেই ঢাকায় এলে তার আতিথ্য গ্রহণ করতেন। একবার সুনীলদার ইন্টারভিউ করার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম- কোথায় উঠেছেন? তিনি বললেন- কোথায় আবার! আমি যার পোষ্যপুত্র, তার কাছে। বুঝলাম গাজী ভাই। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঠেকানো যায়নি, আমি তাই কোনো বিখ্যাত লোকেরই মৃত্যুতে দুঃখ-টুঃখ পাই না। একবার আমার অতি প্রিয় আলী ফিদা একরাম তোজোর একটি নাটকের মহরতে বক্তৃতা করেছিলাম। অনুষ্ঠানের শেষে ছিল গান-বাজনা। তরুণ-তরুণীরা মিউজিকের তালে তালে নাচছিল। এক মেয়ে নাচে তার সঙ্গী হওয়ার জন্য আমার হাত ধরে টানাটানি করছিল যখন, আমি ইতস্তত করতেই সে বলেছিল- বয়স আবার কী! বয়স তো একটি সংখ্যা মাত্র। সব মৃত্যুই আমার কাছে একটি ইনফরমেশন মাত্র, অতিরিক্ত কিছু নয়।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@yahoo.com
No comments