পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ও জামায়াত জড়িত!
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে প্রায় নিশ্চিত হয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিরা জিজ্ঞাসাবাদে এ সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে সিটিটিসির সংশ্লিষ্টরা প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান শুরু করেছে। সিটিটিসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনীতিক এবং সে দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর যোগসাজশের বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। ভারতীয় জাল মুদ্রা পাচারের সঙ্গে আইএসআইর সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়েও তথ্য মিলেছে। সন্ত্রাসী অর্থায়নে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে জাল রূপি ভারতে পাচার করছে আইএসআই। এমনকি আন্তঃদেশীয় অপরাধী চক্রের সঙ্গে তাদের যোগসাজশের তথ্যও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। শুধু জঙ্গি অর্থায়ন নয়, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহে তাদের যোগসূত্র রয়েছে কিনা- তা খতিয়ে দেখা হ”েচ্ছ। সূত্র আরও জানায়, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর শিবিরের অনেক দুর্ধর্ষ ক্যাডার নব্য জেএমবিতে যোগ দিয়েছে। তাদের অনেকেই নব্য জেএমবিতে সামরিক কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছে। একাধিক ক্যাডার পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহতও হয়েছে। সর্বশেষ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত রফিকুল ইসলাম আবুর পরিবার এবং তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিয়ের পর তার স্ত্রী সুমাইয়া খাতুনের মাধ্যমে সে জঙ্গিবাদে জড়ায়। সে নিজেও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি জেএমবির কোনো কোনো সদস্য জাল মুদ্রা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এ জাল মুদ্রা আবার একটি বিশেষ দেশ থেকে তৈরি হয়ে আসে। এগুলো ভারতীয় জাল মুদ্রা। সে ক্ষেত্রে অনেক সময় বিশেষ দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যেই ওই বিশেষ দেশের দূতাবাসের একাধিক কর্মকর্তাকে জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহারও করে নেয়া হয়েছে বা ফেরত পাঠানো হয়েছে। মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, জঙ্গিবাদে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের কারও কারও সম্পৃক্ততা আমরা পেয়েছি। এ বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যাবে না। অনেক জঙ্গির ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেছি, তাদের অনেকেই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সঙ্গে আইএসআইর সম্পৃক্ততার বিষয়টি নতুন নয়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে ইদ্রিস শেখসহ চার জেএমবি সদস্য গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। সে আইএসআইর চর হিসেবে কাজ করছিল। তার কাছ থেকে একটি স্পাই মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়। ওই মোবাইল সেটটি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সরবরাহ করেছিল। এ ঘটনায় ইদ্রিস আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তার জবানবন্দিতে উঠে আসে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি ফারিনা আরশাদ কাজ করছেন। ইদ্রিসের সঙ্গে ফারিনার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। ওই ঘটনায় তখন পাকিস্তান সরকার তাকে প্রত্যাহার করে নেয়। এছাড়া ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগে পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা মাজহার খানকে বাংলাদেশ সরকার বহিষ্কার করে। সিটিটিসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুধু পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বা কূটনীতিক নন, পাকিস্তানভিত্তিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের চেষ্টা করছে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে আইএসআই। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা, তেহরিক-ই-তালিবান ও জইশ-ই-মুহাম্মদের অনেক সদস্য দেশের গোয়েন্দাদের হাতে বিভিন্ন সময় ধরা পড়েছে। তারা এখন কোথায় আছে এ বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। আইএসআইর সহায়তায় ভারতীয় জাল রুপির ব্যবসার বিষয়টিও নতুন নয়। ২০০৮ সালের শেষের দিকে ভারতীয় জাল রুপিসহ কলকাতায় গ্রেফতার হয় পাকিস্তানি নাগরিক সরফরাজ। সে ঢাকার কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির একটি ফ্ল্যাটে থাকত। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জাল রুপি এনে সে বাংলাদেশের রুট ব্যবহার করে ভারতে পাচার করত। তার সঙ্গে দেশীয় জঙ্গিদের যোগসাজশ ছিল। গোয়েন্দারা বলছেন, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা এবং সে দেশের জঙ্গি সংগঠন স্বর্ণ চোরাচালান, জাল মুদ্রা পাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশি জঙ্গিদের অর্থায়ন করছে।
নব্য জেএমবির ভয়ঙ্কর সামরিক কমান্ডাররা শিবিরের ক্যাডার : জেএমবির নতুন ধারার (নব্য জেএমবি) দুর্ধর্ষ সামরিক কমান্ডারদের অনেকেই আগে শিবিরের ক্যাডার ছিল। গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার অপারেশনাল কমান্ডার নুরুল ইসলাম মারজান শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের সাথী ছিল। জঙ্গিদের মগজ ধোলাইয়ের প্রশিক্ষক রায়হান কবির ওরফে তারেকও শিবির করত। গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাকারী জঙ্গিদের প্রশিক্ষক ছিল এ রায়হান। তারা দু’জনই পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ২০১৫ সালে সাভারে দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাতি, গাবতলী ও আশুলিয়ার চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা এবং পুরান ঢাকার হোসেনি দালানে শিয়া মসজিদে হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল দুর্ধর্ষ জঙ্গি আলবানী ওরফে হোজ্জা ওরফে শাহদত ওরফে মাহফুজ। সে আগে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। সে নব্য জেএমবির ঢাকা অঞ্চলের কমান্ডার ছিল। এছাড়া ২০১৫ সালের শেষ দিকে রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে আত্মঘাতী হামলাকারী তারেক আজিজ এবং তার সহযোগী জামালউদ্দিন শিবিরের রাজনীতি করত। হামলার সময় তারেক এবং পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জামালউদ্দিন মারা যায়। জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কানেকশন রয়েছে। জঙ্গি অর্থায়নের সঙ্গেও জামায়াত-শিবিরের কানেকশন পাওয়া যাচ্ছে।
No comments