ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রসঙ্গে

এ মাসে প্রধানমন্ত্রীর চারদিনের ভারত সফরের ফলাফল কী দাঁড়ালো এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বা তাদের জোট সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া ঠিকমতো জানা যায়নি, কোনো কোনো নেতার কিছু বিক্ষিপ্ত বক্তব্য ছাড়া। সেসব বক্তব্যের ক্ষেত্রেও প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী বিশেষ উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। এ ধরনের একটি অতি প্রচারিত সফরের পর এই অবস্থাকে এক ব্যতিক্রমী ব্যাপারই বলতে হবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকার ইংরেজি দৈনিক Daily Star-এর এক উপসম্পাদকীয়তে মোহাম্মদ বদরুল আহসান লিখেছেন, 'That Bangladesh isn't beside itself with joy is reflected in the indicators. There was no characteristic grand reception for the Prime Minister at the airport on her return from India. Billboards and banners haven't gone up aûwhere in the country trumpeting the visit as something spectacular. The ruling party leaders aren't gung-ho about leveraging its outcomes. Even the Prime Minister herself couldn't hold back her disappointment with the West Bengal chief minister's intransigence over sharing Teesta water with Bangladesh. (28.04.2017) এর প্রচারিত একটি রাষ্ট্রীয় সফর শেষে দেশে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রীর অর্জনের জয়ধ্বনির জন্য বিমানবন্দরে যে বিশাল সমাবেশ রেওয়াজ অনুযায়ী হওয়ার কথা, এটা না হওয়া সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও কয়েকজন নেতা গণভবনে তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে সংক্ষিপ্ত সংবর্ধনা জানানোর বিষয়টিও ছিল একই ধরনের ব্যতিক্রমী ব্যাপার।
এসব ঘটনাকে তাৎপর্যহীন মনে করার কারণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের এমনই অবস্থা যে, এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিশেষ কোনো কথাবার্তা শোনা গেল না। ভারতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কত সম্বর্ধনা পেয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রটোকল ভেঙে প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে অতিথি হিসেবে কত সমাদর লাভ করেছেন, তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থেকে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নবীন মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের জন্য পর্যন্ত কত উপহার নিয়ে গেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ এবং রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে নিজ হাতে ভাপা ইলিশ রাঁধা পর্যন্ত অনেক কিছুই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় যে, এসব থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার রাষ্ট্রীয় সফরে কী অর্জন করেছেন তার কিছুই বোঝা যায় না, অথচ এ বিষয়ে জানার অধিকার জনগণের আছে। দিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তাবিষয়ক বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক (গঙট) স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু এই নিরাপত্তা সমঝোতার এমন কোনো বিবরণ নেই যার থেকে বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট লাভ ও অর্জন বোঝা যায়। ভারতকে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে অহরহ প্রচার করা হয়। বাংলাদেশ ভারতের জমিন দ্বারাই তিন দিক বেষ্টিত। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ের জন্য নিরাপত্তা সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা বোঝা মুশকিল। বাংলাদেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির কথাও সমঝোতা চুক্তিতে আছে। কিন্তু ভারতবেষ্টিত বাংলাদেশে এই বৃদ্ধির জন্য ভারত থেকে কোটি কোটি ডলার ঋণ নিয়ে অস্ত্রশস্ত্র কেনার প্রয়োজন কেন হল? চীন থেকে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্রশস্ত্র কিনে থাকে। মাত্র অল্প কিছুদিন আগে বাংলাদেশ চীন থেকে দুটি সাবমেরিন কিনেছে! কেন এই কাজ করা হয়েছে সেটা বোঝা মুশকিল। কার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এর কোনো ব্যাখ্যা কোথাও নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি অনুন্নত দেশে জনগণের জন্য যেখানে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার জন্য ব্যয় বৃদ্ধি না করে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে, সেখানে চীনা সাবমেরিন বা ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র নতুন করে কেনার সঙ্গে জনস্বার্থের কী সম্পর্ক? প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় দিল্লিতে নিরাপত্তাবিষয়ক সমঝোতার কথাই সব থেকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছে। এর সঙ্গে আছে আরও কিছু চুক্তি যা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভারত থেকে চড়া দামে বিদ্যুৎ কেনার যে ব্যবস্থা হয়েছে, তাকে কি জনগণের জন্য কোনো অর্জন বলা চলে? কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মমতা ব্যানার্জি তিস্তার পানি না দিলেও বিদ্যুৎ তো দিতে সম্মত হয়েছেন!!
কিন্তু তিস্তার পানি না পাওয়ার জন্য যে ক্ষতি বাংলাদেশের হচ্ছে, সেটা কি চড়া দামে বিদ্যুৎ কেনার দ্বারা পূরণ হতে পারে? ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল ভেঙে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে আসা এবং তাকে তাদের রাষ্ট্রপতি ভবনে অতিথি হিসেবে সম্মানিত করতে ভারতের কোনো ক্ষতি বা অসুবিধা নেই। এর জন্য বাংলাদেশকে তাদের কিছুই প্রকৃতপক্ষে দিতে হয়নি। কিন্তু যেখানে প্রকৃত দেয়ার ব্যাপার আছে সেখানে তো বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। তিস্তার পানির হিস্যা নিয়ে কোনো এজেন্ডা দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার সময় থাকেনি। তারা শুধু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক অফলপ্রসূ আলোচনায় বসিয়েছেন! এর থেকে বেশি আর কী? মমতা ব্যানার্জি সোজা জানিয়ে দিয়েছেন, তিস্তায় পানি নেই। যেটুকু আছে সেটা থেকে পশ্চিমবঙ্গের চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশকে কিছু দেয়া সম্ভব নয়!! এসব জবাবের মধ্যে যে ঔদ্ধত্য আছে এটা কি অস্বীকার করা যায়? মোট কথা, প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তা হল, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে লেনদেনের যে অসম সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে চলছে তার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত হাত চিৎ করে বাংলাদেশের কাছে যা চেয়েছে, বাংলাদেশ হাত উপুড় করে ভারতকে তা-ই দিয়ে এসেছে। এ সফরের সময়েও তা-ই হয়েছে। কাজেই এই সফরের ফলে বাংলাদেশের যে কিছু লাভ হয়নি এবং অর্জন হিসেবে যে কিছু দেখা যায়নি, এটা ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে। এই হতাশা এমনকি আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোট সরকারের একটা বড় অংশকেও আচ্ছন্ন করেছে। এ বিষয়টি লক্ষ্য করেই যে রেওয়াজ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার সময় বিমানবন্দরে তার জন্য রাজকীয় সংবর্ধনার ব্যবস্থা স্থগিত রাখা হয়েছে এটা মনে করা কি অসঙ্গত হবে? আগামী সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে এখন সরকারি ও সংসদীয় বিরোধী দলগুলো চাঙ্গা হচ্ছে। কিন্তু নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন সত্ত্বেও নির্বাচনের ওপর যে অনাস্থা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছে, তা দূর হয়েছে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের জনবিচ্ছিন্নতা যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে পূর্ববর্তী নির্বাচনের মতো নির্বাচন কমিশন ও পুলিশকে ব্যবহার করা তাদের নির্বাচন জয়ের জন্য এখন আরও প্রয়োজনীয় হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারের কাজ করা সম্ভব হবে কিনা এটা স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু যে কোনো বিদ্যমান সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক ভোটের যে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে তাতে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর যে বৃদ্ধি পেয়েছে তার লক্ষণ চারদিকে ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের জনগণ পরস্পরের বন্ধু। দুই দেশের জনগণই চান উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভালো হোক, উন্নত হোক। কিন্তু জনগণ ও সরকার তো এক জিনিস নয়। ভারতে এখন যে সরকার ক্ষমতায় আছে এবং পূর্ববর্তী যেসব সরকার ক্ষমতায় থেকেছে, তাদের বাংলাদেশ নীতির মধ্যে জনগণের এই প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। উপরন্তু ভারত সরকার দুই দেশের সম্পর্ক মোচড় দিয়ে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যে, ভারত হয়েছে লেনেওয়ালা! আর বাংলাদেশ হয়েছে দেনেওয়ালা!! দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে লেনদেনের এই সম্পর্ক যে দেনেওয়ালা দেশের জনগণকে লেনেওয়ালা দেশের সরকারের প্রতি বিরূপ করবে, তার প্রতি বিক্ষুব্ধ করবে এটাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর এ পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা চলে। কিন্তু ভারতের আচরণ থেকে মনে হয় এসব পরোয়া করার কোনো প্রয়োজন তাদের নেই। কিন্তু ভারত এটা পরোয়া না করলেও বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের দিক থেকে এটা উপেক্ষার ব্যাপার নয়। উপেক্ষা তাদের বিপদকে যে আরও বাড়িয়ে তুলবে, আগামী নির্বাচন যদি মোটামুটি নিরপেক্ষ হয় তাহলে তাদেরকে যে জনগণের নেতিবাচক ভোটের তুফানের মুখোমুখি হতে হবে এতে সন্দেহ নেই। সেই তুফানকে নির্বাচন কমিশন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ বা পুলিশ ব্যবহারের মাধ্যমে মোকাবেলা করে ২০১৪ সালের মতো ফল লাভ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে, এর থেকে অবাস্তব চিন্তা আর কী হতে পারে?
২৯.০৪.২০১৭
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.