ভয়ঙ্কর খেলা
উত্তর
কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উনের অস্ত্রভাণ্ডারে খুব শিগগিরই যোগ হতে যাচ্ছে
দূরপাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প
দিচ্ছেন সামরিক জবাবের হুমকি। ফলে অকস্মাৎ পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি জাগ্রত
হয়েছে। বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। দু’পক্ষ থেকেই চলছে তীব্র বাগাড়ম্বর।
মার্কিন রণতরী ও পারমাণবিক সাবমেরিন নোঙর ফেলেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। সঙ্গে যোগ
দিয়েছে জাপানের রণতরী। কিন্তু টলেনি উত্তর কোরিয়া। গতকালও ক্ষেপণাস্ত্র
পরীক্ষা চালিয়েছে দেশটি। উৎক্ষেপণের কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্ষেপণাস্ত্রটি
বিস্ফোরিত হয়ে পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে বটে। কিন্তু পরীক্ষা করাটাই দেশটির নতি
না স্বীকার করার লক্ষণ। কিন্তু যুদ্ধের হুমকি আসলে কতটুকু গুরুতর?
জার্মানির প্রখ্যাত পত্রিকা দার স্পাইগেল এই প্রশ্নেরই জবাব দিতে চেয়েছে।
ম্যাথিউ ভন রোর, ক্রিস্টফ শিরম্যান, উইল্যান্ড উইগন্যার ও বার্নার্ড জ্যান্ড- দার স্পাইগেলের এই চার সাংবাদিকের লেখা এক বিশ্লেষণী নিবন্ধে বলা হয়, মহাপ্রলয়ের মহড়া অনেকদিন ধরেই চলছিল। প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর বিকালের শুরুর দিকে সাইরেন বেজে উঠে সিউলে। সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়ায় গাড়ি-ঘোড়া। বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা ব্যস্ত সড়ক মোড়ে অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হলদে বাহুবন্ধনী পরা স্বেচ্ছাসেবীরা পথচারীদের নিয়ে যান পার্শ্ববর্তী আশ্রয়স্থলে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী শহরে এমন আশ্রয়স্থলের সংখ্যা আছে কয়েকশ’।
প্রস্তুত সামরিক বাহিনীও। সিউল ও সীমান্তমুখী মহাসড়কের দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াচটাওয়ার। কয়েক কিলোমিটার অন্তর অন্তর সড়কের ওপর রাখা আছে কংক্রিটের তৈরি ভারী প্রতিবন্ধক। যুদ্ধ বাধলেই, স্বয়ংক্রিয় বিস্ফোরণ ঘটবে, আর সড়কের ওপর পড়ে যাবে এই প্রতিবন্ধক। ফলে আক্রমণকারীর এগুনোর পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।
উপকূলবর্তী সমুদ্র সৈকতেও পুঁতে রাখা আছে ট্যাংক-ফাঁদ আর কাঁটাতারের বেড়া। এসব কিছুই করা হয়েছে কোরিয়ান উপদ্বীপের দরিদ্র কিন্তু সামরিকভাবে শক্তিশালী উত্তরের হুমকি থেকে দক্ষিণাঞ্চলীয় অর্ধকে সুরক্ষিত রাখতে। সমস্ত সরঞ্জামই প্রতিরক্ষামূলক। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর আক্রমণের পরিকল্পনাও আছে। ‘কোরিয়া ম্যাসিভ পানিশমেন্ট অ্যান্ড রিটালিয়েশন’ বা সংক্ষেপে ‘কেএমপিআর’ নামে পরিচিত এই পরিকল্পনা। এর বিস্তারিত গোপন রাখা হয়েছে। কিন্তু সম্ভাব্য এক কোরিয়ান যুদ্ধের প্রথম দৃশ্যপট হবে এমন: উত্তর কোরিয়া হামলার আগেই দক্ষিণ কোরিয়া চেষ্টা করবে প্রতিপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণস্থলগুলো নিজেদের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করে দিতে। আর উত্তর কোরিয়ার যেসব ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট ফাঁক-ফোকর দিয়ে উৎক্ষিপ্ত হয়ে যাবে, সেগুলোকে ধ্বংস করতে গুলি ছুড়বে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। উত্তর কোরিয়া তাদের পদাতিক সৈন্যবাহিনীকে দক্ষিণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করানোর আগেই, দক্ষিণের বিশেষ বাহিনী পিয়ংইয়ং-এ ঢুকে শেষ করে দেবে একনায়ক কিম জং উনকে। মোটামুটি এটাই হলো কেএমপিআর পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাথমিক দৃশ্যপট।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই পরিকল্পনা প্রথমবারের মতো প্রকাশ করেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এশিয়ার সামরিক বিশেষজ্ঞরা এই পরিকল্পনা নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এখন এই দৃশ্যপটকে বরং বাস্তবই মনে হচ্ছে। ২০০৬ সালের পর কোরিয়ান উপদ্বীপ একটি সামরিক সংঘাতের এতটা নিকটবর্তী কখনই ছিল না বলে মন্তব্য করেছে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে চিন্তা করলে পরিস্থিতি এর চেয়ে সংবেদনশীল হতেই পারে না। পিয়ংইয়ং-এ ক্ষমতায় বসে আছেন কিম জং উন নামে এক একনায়ক। দৃশ্যত, তিনি নিজের শাসনক্ষমতার অস্তিত্বের স্বার্থে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু এই যুদ্ধে মারা যেতে পারে হাজার হাজার, এমনকি লাখ লাখ মানুষ। পৃথিবীর অপরপ্রান্ত ওয়াশিংটনের ক্ষমতার গদিতে বসে আছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। এই ভদ্রলোক গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বটে, কিন্তু দুনিয়ার সম্পর্কে তার জ্ঞান খুব কম। পারমাণবিক অস্ত্রের কোড ছাড়াও, তার হাতে আছে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট, যেটি তিনি ব্যবহার করেন অবোধ ব্যক্তির মতো। সিরিয়া ও আফগানিস্তানে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, ক্রুজ মিসাইল কিংবা প্রকাণ্ড বোমা ফেলতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন না।
ফলে এই সংঘাত উস্কে দেয়ার জন্য কিম জং উনই একমাত্র দায়ী নন। হোয়াইট হাউসে বসে থাকা ওই লোকটিও এক্ষেত্রে অনুঘটক। এই দুই লোক তাবৎ দুনিয়ার মানুষের স্নায়ু নিয়ে খেলছেন।
ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণের তিন সপ্তাহ আগে নববর্ষের দিনে কিম জং উন ঘোষণা করেন যে, তার দেশ শিগগিরই আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করবে। এ ধরনের একটি রকেট পৌঁছে যেতে পারে উত্তর আমেরিকা মহাদেশেও। কিমের এই ঘোষণাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর উত্তর কোরিয়ার সরাসরি হামলার সবচেয়ে গুরুতর ও বিশ্বাসযোগ্য হুমকি। জবাবে ট্রাম্প এক টুইটে লিখেন, ‘এমনটা কখনই হবে না।’ ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ হলো পিয়ংইয়ং-এর পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার। কিন্তু পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে ট্রাম্প শুধু অনভিজ্ঞই নন, প্রায়ই তিনি আনাড়িপনার পরিচয় দেন। এর সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখা গেছে দুই সপ্তাহ আগে, যখন ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, সতর্কতার জন্য তিনি মার্কিন বিমানবাহী রণতরীকে তিনি উত্তর কোরিয়া অভিমুখে পাঠিয়েছেন। পরে অবশ্য দেখা যায় ওই রণতরী অস্ট্রেলিয়ার দিকে যাচ্ছিল একটি মহড়ায় অংশ নিতে। হতে পারে ট্রাম্প ধাপ্পাবাজি করেছেন, কিংবা কোনকিছু নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের এই কমান্ডার-ইন-চিফের অধীনে পরিস্থিতি কোনদিকে ঘুরে যেতে পারে।
বিভিন্ন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় জেরবার ট্রাম্প দৃশ্যত উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে বাগাড়ম্বরেই মনোযোগ সরানোর পথ বলে মনে করছেন। এক্ষেত্রে তিনি দৃশ্যত সফলও। তিনি যখন সিরিয়ায় এ মাসের শুরুতে ৫৯টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেন, তখন খোদ তার সমালোচকদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছেন ট্রাম্প।
ফলে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক প্রকল্প এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প- এ দুয়ের অর্থ হলো, ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ং-এর বিবাদ এক নতুন ও অনিশ্চিত পর্যায়ে পৌঁছেছে। অতীতে সংঘাতের এমন সমূহ ঝুঁকি সৃষ্টির নজির বেশ বিরল। আরো ভয়াবহ বিষয় হলো, কোরিয়ান উপদ্বীপে যেকোনো যুদ্ধ পারমাণবিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। জড়িয়ে পড়তে পারে কয়েকটি বৃহৎ আঞ্চলিক শক্তিধর রাষ্ট্র। এ যুদ্ধে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের চেয়েও বেশি পরিমাণ মানুষ শরণার্থী হবে।
চীনের তীব্র আপত্তির মুখেও দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন থাড আকাশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের কাজ শুরু হয়েছে। সংঘাতের আরো ইঙ্গিত পাওয়া গেছে এ সপ্তাহে। মঙ্গলবার, ইউএসএস মিশিগান নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ১৫০টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রধারী পারমাণবিক সাবমেরিন দক্ষিণ কোরিয়ায় থেমেছে। এটি মোতায়েন করা হয়েছে ২৫শে এপ্রিল, যেদিন উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। কর্মকর্তারা বলছেন, এটি স্রেফ রুটিন কাজ, কিন্তু পিয়ংইয়ং একে অন্যভাবে নিতে পারে। একই দিনে উত্তর কোরিয়াও এক বিশাল আর্টিলারি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। সেদিন অস্বাভাবিকভাবে ট্রাম্প সিনেটের প্রত্যেক সদস্যকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য জানাতে।
কোরিয়ান উপদ্বীপে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের বসবাস। এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, বিশ্বের তিন শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপান যদি কোনো সংঘাতে জড়িয়ে যায়, তবে বিশ্ব কেবল বিপর্যয়কর এক মানবিক পরিস্থতিই প্রত্যক্ষ করবে না, অর্থনৈতিক ধস হতে পারে বিশাল। এমনকি রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাহলে কি কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর পৃথিবী আরো একবার পারমাণবিক যুদ্ধের সম্মুখীন? উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্প থামাতে বছরের পর বছর বিপল কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর সামরিক সংঘাত কি অনিবার্য?
ওয়াশিংটন ডিসির উইড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের পারমাণবিক বিস্তার রোধকরণবিষয়ক বিশেষজ্ঞ রবার্ট লিটওয়াক বলেন, পারমাণবিক অস্ত্রের দিক থেকে এক যুগান্তকারী অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে উত্তর কোরিয়া। তিনি বলেন, দেশটি আগামী দুই-তিন বছরে আন্তঃমহাদেশী ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহার করা যাবে এমন ১০০টি পারমাণবিক ওয়্যারহেড তৈরি করতে চায়। লিটওয়াক বলেন, ‘দেশটি সফল হলে, সমীকরণ একেবারেই পাল্টে যাবে।’ শুধুমাত্র এ বছরই কিম জং উন পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালান। সর্বশেষটি ছিল গতকাল। যদিও এ পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এই পরীক্ষা করাটাই বিশ্বচাপের মুখে দেশটির অবাধ্যতা প্রমাণ করে।
মাত্র এক সপ্তাহ আগে জাতিসংঘে নিযুক্ত উত্তর কোরিয়ার উপ-রাষ্ট্রদূত হুমকি দিয়ে বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকি অব্যাহত রাখে, আর নিজের মোড়ালিপনার যুক্তি বহাল রাখে, তাহলে ‘যেকোনো মুহূর্তে পারমাণবিক যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে।’
পুরো সমীকরণে চীনের অবস্থান বেশ অদ্ভুত। মূলত, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তর কোরিয়ার একমাত্র বন্ধু চীন। যদিও কিম জং-উন মাঝেমাঝে চীনকেও ছেড়ে কথা বলেন না, তবুও একমাত্র এ দেশই উত্তর কোরিয়ার সহযোগী। চীনের প্রকাশ্যে অবস্থান হলো, উত্তর কোরিয়াকে তার পারমাণবিক প্রকল্প পরিত্যাগ করতে হবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধে সমর্থনও দিয়েছে চীন। কিন্তু ডনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, চীন উত্তর কোরিয়াকে নিবৃত করতে যথেষ্ট কাজ করছে না। তবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে সাক্ষাতের পর এ অবস্থান থেকে খানিকটা সরেছেন ট্রাম্প। তিনি এখন মনে করেন, চীন উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে খুবই চেষ্টা করছে। এমনকি উত্তর কোরিয়া গতকাল যে ব্যর্থ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে তা ‘চীন ও দেশটির খুবই শ্রদ্ধাভাজন প্রেসিডেন্টের প্রতি অসম্মানজনক’ বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প। চীনও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তবে সিএনএন’র খবর, পরিস্থিতি অন্যদিকে গড়ালে বসে থাকবে না চীনও। মার্কিন বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে চীনের সামরিক বাহিনী তাদের যুদ্ধবিমানকে সর্বোচ্চ প্রস্তুত রেখেছে।
উত্তর কোরিয়া অতীতে অনেকবারই যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে হুমকি দিয়েছে। কিম জং উন তার দেশকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করতে উদগ্রীব। তার আতঙ্ক ও ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা আছে। ফলে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগাম আঁচ পাওয়া যায়। কিন্তু ট্রাম্পের বেলায় নয়। প্রশ্ন হলো, তিনি প্রতিক্রিয়া দেখাবেন কীভাবে? যুদ্ধ ও শান্তির প্রসঙ্গ উঠলে ট্রাম্পের মুখ দিয়ে বেরোনো প্রতিটি বাক্য ও অসতর্ক শব্দই প্রাসঙ্গিক। আর ট্রাম্পের দিক থেকে এটাই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। তার অনভিজ্ঞতা, আত্মবড়াই এবং টুইটারে তাৎক্ষণিক উস্কানি দেওয়ার অভ্যেস - সব মিলিয়ে তিনি এমন একজন প্রেসিডেন্ট যিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না। আর এমন প্রেসিডেন্ট নিজেই নিরাপত্তা ঝুঁকি।
নিজের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় আমেরিকার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের কথা বারবার বলেছেন ট্রাম্প। আর এ দিয়ে তিনি আসলে সামরিক শক্তির কথাই বোঝাতেন তিনি। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমাদের আবার যুদ্ধ জেতা শুরু করতে হবে।’ এই বার্তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ট্রাম্প সম্প্রতি দেশের প্রতিরক্ষা বরাদ্দ ৫৪০০ কোটি ডলার বৃদ্ধি করার ঘোষণা দেন। তিনি সামরিক বাহিনী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে আরো স্বাধীনতা দিয়েছেন। আর এর ফলে মার্কিন বিমান হামলায় বেসামরিক মানুষ নিহতের ঘটনা সম্প্রতি বেড়েছে।
উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ৫ সপ্তাহ আগে তার এশিয়া সফরে বলেন, দেশটির পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সহিষ্ণুতার দিন ফুরিয়েছে। গত সপ্তাহে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স দক্ষিণ কোরিয়া সফরে গিয়ে প্রায় একই কথা বলেন। পেন্স সদর্পে ঘোষণা করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের লক্ষ্য নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা না চালালেই বরং উত্তর কোরিয়ার জন্য ভালো।
দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে অভিজ্ঞ নিরাপত্তা নীতি বিষয়ক কর্মকর্তার একজন ও আইনপ্রণেতা কিম জং ডাএ বলেন, ‘কিম জং উন কী চান, তা বোঝা সহজ। কিন্তু ট্রাম্পকে অনুমান করা যায় না।’ তিনি জানান, সিউল বিশেষভাবে যা নিয়ে উদ্বিগ্ন তা হলো আমেরিকা সম্ভবত কমান্ডো হামলা চালিয়ে কিম জং উনকে টার্গেট করতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে উদ্বিগ্ন এ সম্ভাবনা নিয়ে যে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার অনুমতি ছাড়াই উত্তর কোরিয়ায় হামলা চালাতে পারে।’
তবে ট্রাম্প যদি সত্যিই হামলা চালাতে চান, তাহলে তার হাতে উপায় থাকবে তিনটি। প্রথমত, পারমাণবিক শক্তিসমেত ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের আগেই যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালাতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে উৎক্ষেপণস্থল শনাক্ত করতে হবে। কিন্তু এ ধরণের স্থান আছে অনেক। সবগুলোকে একসঙ্গে ধ্বংস করাটা প্রায় অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার সকল পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে পারেন। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হলো প্রায় একই সময়ে সব হামলা চালাতে হবে। যদি এই হামলা কেঁচে যায়, তাহলে সমূহ ঝুঁকি রয়েছে যে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক হামলা চালাতে পারে। কিংবা দক্ষিণের বিরুদ্ধে প্রচলিত ধাঁচে হামলা চালাতে পারে পিয়ংইয়ং। তৃতীয় সম্ভাবনা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উত্তর কোরিয়া দখলে অভিযান শুরু করা। কিন্তু উত্তরের দিক থেকে রাসায়নিক হামলা চালানোর ঝুঁকি থাকায় এই সম্ভাবনা আগেই বাতিলের খাতায়।
কিন্তু সামরিক সংঘাত যদি এড়ানো সম্ভব হয়, ট্রাম্প ও কিম জং উন যদি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া না দেখান, আলোচনাই যদি হয় চূড়ান্ত পথ, তাহলে ট্রাম্প খুব একটা খারাপ অবস্থানে থাকবেন না। বিশ্বজুড়ে রাজনীতিবিদদের কাছে নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ট্রাম্প এক চিন্তার নাম। কিন্তু আলোচনার টেবিলে তার এই অনিশ্চয়তামাখা বৈশিষ্ট্যই বয়ে আনতে পারে সাফল্য। হয়তো, এ কারণেই ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছিলেন, এ দেশকে হতে হবে আরো কম অনুমানযোগ্য।
(মূল: জার্মানির দার স্পাইগেল। ছবি: লন্ডনের ফিনান্সিয়াল টাইমসের সৌজন্যে।)
ম্যাথিউ ভন রোর, ক্রিস্টফ শিরম্যান, উইল্যান্ড উইগন্যার ও বার্নার্ড জ্যান্ড- দার স্পাইগেলের এই চার সাংবাদিকের লেখা এক বিশ্লেষণী নিবন্ধে বলা হয়, মহাপ্রলয়ের মহড়া অনেকদিন ধরেই চলছিল। প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর বিকালের শুরুর দিকে সাইরেন বেজে উঠে সিউলে। সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়ায় গাড়ি-ঘোড়া। বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা ব্যস্ত সড়ক মোড়ে অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হলদে বাহুবন্ধনী পরা স্বেচ্ছাসেবীরা পথচারীদের নিয়ে যান পার্শ্ববর্তী আশ্রয়স্থলে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী শহরে এমন আশ্রয়স্থলের সংখ্যা আছে কয়েকশ’।
প্রস্তুত সামরিক বাহিনীও। সিউল ও সীমান্তমুখী মহাসড়কের দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াচটাওয়ার। কয়েক কিলোমিটার অন্তর অন্তর সড়কের ওপর রাখা আছে কংক্রিটের তৈরি ভারী প্রতিবন্ধক। যুদ্ধ বাধলেই, স্বয়ংক্রিয় বিস্ফোরণ ঘটবে, আর সড়কের ওপর পড়ে যাবে এই প্রতিবন্ধক। ফলে আক্রমণকারীর এগুনোর পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।
উপকূলবর্তী সমুদ্র সৈকতেও পুঁতে রাখা আছে ট্যাংক-ফাঁদ আর কাঁটাতারের বেড়া। এসব কিছুই করা হয়েছে কোরিয়ান উপদ্বীপের দরিদ্র কিন্তু সামরিকভাবে শক্তিশালী উত্তরের হুমকি থেকে দক্ষিণাঞ্চলীয় অর্ধকে সুরক্ষিত রাখতে। সমস্ত সরঞ্জামই প্রতিরক্ষামূলক। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর আক্রমণের পরিকল্পনাও আছে। ‘কোরিয়া ম্যাসিভ পানিশমেন্ট অ্যান্ড রিটালিয়েশন’ বা সংক্ষেপে ‘কেএমপিআর’ নামে পরিচিত এই পরিকল্পনা। এর বিস্তারিত গোপন রাখা হয়েছে। কিন্তু সম্ভাব্য এক কোরিয়ান যুদ্ধের প্রথম দৃশ্যপট হবে এমন: উত্তর কোরিয়া হামলার আগেই দক্ষিণ কোরিয়া চেষ্টা করবে প্রতিপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণস্থলগুলো নিজেদের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করে দিতে। আর উত্তর কোরিয়ার যেসব ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট ফাঁক-ফোকর দিয়ে উৎক্ষিপ্ত হয়ে যাবে, সেগুলোকে ধ্বংস করতে গুলি ছুড়বে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। উত্তর কোরিয়া তাদের পদাতিক সৈন্যবাহিনীকে দক্ষিণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করানোর আগেই, দক্ষিণের বিশেষ বাহিনী পিয়ংইয়ং-এ ঢুকে শেষ করে দেবে একনায়ক কিম জং উনকে। মোটামুটি এটাই হলো কেএমপিআর পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাথমিক দৃশ্যপট।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই পরিকল্পনা প্রথমবারের মতো প্রকাশ করেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এশিয়ার সামরিক বিশেষজ্ঞরা এই পরিকল্পনা নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এখন এই দৃশ্যপটকে বরং বাস্তবই মনে হচ্ছে। ২০০৬ সালের পর কোরিয়ান উপদ্বীপ একটি সামরিক সংঘাতের এতটা নিকটবর্তী কখনই ছিল না বলে মন্তব্য করেছে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে চিন্তা করলে পরিস্থিতি এর চেয়ে সংবেদনশীল হতেই পারে না। পিয়ংইয়ং-এ ক্ষমতায় বসে আছেন কিম জং উন নামে এক একনায়ক। দৃশ্যত, তিনি নিজের শাসনক্ষমতার অস্তিত্বের স্বার্থে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু এই যুদ্ধে মারা যেতে পারে হাজার হাজার, এমনকি লাখ লাখ মানুষ। পৃথিবীর অপরপ্রান্ত ওয়াশিংটনের ক্ষমতার গদিতে বসে আছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। এই ভদ্রলোক গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বটে, কিন্তু দুনিয়ার সম্পর্কে তার জ্ঞান খুব কম। পারমাণবিক অস্ত্রের কোড ছাড়াও, তার হাতে আছে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট, যেটি তিনি ব্যবহার করেন অবোধ ব্যক্তির মতো। সিরিয়া ও আফগানিস্তানে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, ক্রুজ মিসাইল কিংবা প্রকাণ্ড বোমা ফেলতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন না।
ফলে এই সংঘাত উস্কে দেয়ার জন্য কিম জং উনই একমাত্র দায়ী নন। হোয়াইট হাউসে বসে থাকা ওই লোকটিও এক্ষেত্রে অনুঘটক। এই দুই লোক তাবৎ দুনিয়ার মানুষের স্নায়ু নিয়ে খেলছেন।
ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণের তিন সপ্তাহ আগে নববর্ষের দিনে কিম জং উন ঘোষণা করেন যে, তার দেশ শিগগিরই আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করবে। এ ধরনের একটি রকেট পৌঁছে যেতে পারে উত্তর আমেরিকা মহাদেশেও। কিমের এই ঘোষণাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর উত্তর কোরিয়ার সরাসরি হামলার সবচেয়ে গুরুতর ও বিশ্বাসযোগ্য হুমকি। জবাবে ট্রাম্প এক টুইটে লিখেন, ‘এমনটা কখনই হবে না।’ ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ হলো পিয়ংইয়ং-এর পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার। কিন্তু পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে ট্রাম্প শুধু অনভিজ্ঞই নন, প্রায়ই তিনি আনাড়িপনার পরিচয় দেন। এর সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখা গেছে দুই সপ্তাহ আগে, যখন ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, সতর্কতার জন্য তিনি মার্কিন বিমানবাহী রণতরীকে তিনি উত্তর কোরিয়া অভিমুখে পাঠিয়েছেন। পরে অবশ্য দেখা যায় ওই রণতরী অস্ট্রেলিয়ার দিকে যাচ্ছিল একটি মহড়ায় অংশ নিতে। হতে পারে ট্রাম্প ধাপ্পাবাজি করেছেন, কিংবা কোনকিছু নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের এই কমান্ডার-ইন-চিফের অধীনে পরিস্থিতি কোনদিকে ঘুরে যেতে পারে।
বিভিন্ন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় জেরবার ট্রাম্প দৃশ্যত উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে বাগাড়ম্বরেই মনোযোগ সরানোর পথ বলে মনে করছেন। এক্ষেত্রে তিনি দৃশ্যত সফলও। তিনি যখন সিরিয়ায় এ মাসের শুরুতে ৫৯টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেন, তখন খোদ তার সমালোচকদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছেন ট্রাম্প।
ফলে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক প্রকল্প এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প- এ দুয়ের অর্থ হলো, ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ং-এর বিবাদ এক নতুন ও অনিশ্চিত পর্যায়ে পৌঁছেছে। অতীতে সংঘাতের এমন সমূহ ঝুঁকি সৃষ্টির নজির বেশ বিরল। আরো ভয়াবহ বিষয় হলো, কোরিয়ান উপদ্বীপে যেকোনো যুদ্ধ পারমাণবিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। জড়িয়ে পড়তে পারে কয়েকটি বৃহৎ আঞ্চলিক শক্তিধর রাষ্ট্র। এ যুদ্ধে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের চেয়েও বেশি পরিমাণ মানুষ শরণার্থী হবে।
চীনের তীব্র আপত্তির মুখেও দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন থাড আকাশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের কাজ শুরু হয়েছে। সংঘাতের আরো ইঙ্গিত পাওয়া গেছে এ সপ্তাহে। মঙ্গলবার, ইউএসএস মিশিগান নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ১৫০টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রধারী পারমাণবিক সাবমেরিন দক্ষিণ কোরিয়ায় থেমেছে। এটি মোতায়েন করা হয়েছে ২৫শে এপ্রিল, যেদিন উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। কর্মকর্তারা বলছেন, এটি স্রেফ রুটিন কাজ, কিন্তু পিয়ংইয়ং একে অন্যভাবে নিতে পারে। একই দিনে উত্তর কোরিয়াও এক বিশাল আর্টিলারি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। সেদিন অস্বাভাবিকভাবে ট্রাম্প সিনেটের প্রত্যেক সদস্যকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য জানাতে।
কোরিয়ান উপদ্বীপে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের বসবাস। এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, বিশ্বের তিন শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপান যদি কোনো সংঘাতে জড়িয়ে যায়, তবে বিশ্ব কেবল বিপর্যয়কর এক মানবিক পরিস্থতিই প্রত্যক্ষ করবে না, অর্থনৈতিক ধস হতে পারে বিশাল। এমনকি রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাহলে কি কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর পৃথিবী আরো একবার পারমাণবিক যুদ্ধের সম্মুখীন? উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্প থামাতে বছরের পর বছর বিপল কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর সামরিক সংঘাত কি অনিবার্য?
ওয়াশিংটন ডিসির উইড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের পারমাণবিক বিস্তার রোধকরণবিষয়ক বিশেষজ্ঞ রবার্ট লিটওয়াক বলেন, পারমাণবিক অস্ত্রের দিক থেকে এক যুগান্তকারী অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে উত্তর কোরিয়া। তিনি বলেন, দেশটি আগামী দুই-তিন বছরে আন্তঃমহাদেশী ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহার করা যাবে এমন ১০০টি পারমাণবিক ওয়্যারহেড তৈরি করতে চায়। লিটওয়াক বলেন, ‘দেশটি সফল হলে, সমীকরণ একেবারেই পাল্টে যাবে।’ শুধুমাত্র এ বছরই কিম জং উন পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালান। সর্বশেষটি ছিল গতকাল। যদিও এ পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এই পরীক্ষা করাটাই বিশ্বচাপের মুখে দেশটির অবাধ্যতা প্রমাণ করে।
মাত্র এক সপ্তাহ আগে জাতিসংঘে নিযুক্ত উত্তর কোরিয়ার উপ-রাষ্ট্রদূত হুমকি দিয়ে বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকি অব্যাহত রাখে, আর নিজের মোড়ালিপনার যুক্তি বহাল রাখে, তাহলে ‘যেকোনো মুহূর্তে পারমাণবিক যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে।’
পুরো সমীকরণে চীনের অবস্থান বেশ অদ্ভুত। মূলত, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তর কোরিয়ার একমাত্র বন্ধু চীন। যদিও কিম জং-উন মাঝেমাঝে চীনকেও ছেড়ে কথা বলেন না, তবুও একমাত্র এ দেশই উত্তর কোরিয়ার সহযোগী। চীনের প্রকাশ্যে অবস্থান হলো, উত্তর কোরিয়াকে তার পারমাণবিক প্রকল্প পরিত্যাগ করতে হবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধে সমর্থনও দিয়েছে চীন। কিন্তু ডনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, চীন উত্তর কোরিয়াকে নিবৃত করতে যথেষ্ট কাজ করছে না। তবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে সাক্ষাতের পর এ অবস্থান থেকে খানিকটা সরেছেন ট্রাম্প। তিনি এখন মনে করেন, চীন উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে খুবই চেষ্টা করছে। এমনকি উত্তর কোরিয়া গতকাল যে ব্যর্থ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে তা ‘চীন ও দেশটির খুবই শ্রদ্ধাভাজন প্রেসিডেন্টের প্রতি অসম্মানজনক’ বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প। চীনও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তবে সিএনএন’র খবর, পরিস্থিতি অন্যদিকে গড়ালে বসে থাকবে না চীনও। মার্কিন বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে চীনের সামরিক বাহিনী তাদের যুদ্ধবিমানকে সর্বোচ্চ প্রস্তুত রেখেছে।
উত্তর কোরিয়া অতীতে অনেকবারই যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে হুমকি দিয়েছে। কিম জং উন তার দেশকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করতে উদগ্রীব। তার আতঙ্ক ও ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা আছে। ফলে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগাম আঁচ পাওয়া যায়। কিন্তু ট্রাম্পের বেলায় নয়। প্রশ্ন হলো, তিনি প্রতিক্রিয়া দেখাবেন কীভাবে? যুদ্ধ ও শান্তির প্রসঙ্গ উঠলে ট্রাম্পের মুখ দিয়ে বেরোনো প্রতিটি বাক্য ও অসতর্ক শব্দই প্রাসঙ্গিক। আর ট্রাম্পের দিক থেকে এটাই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। তার অনভিজ্ঞতা, আত্মবড়াই এবং টুইটারে তাৎক্ষণিক উস্কানি দেওয়ার অভ্যেস - সব মিলিয়ে তিনি এমন একজন প্রেসিডেন্ট যিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না। আর এমন প্রেসিডেন্ট নিজেই নিরাপত্তা ঝুঁকি।
নিজের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় আমেরিকার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের কথা বারবার বলেছেন ট্রাম্প। আর এ দিয়ে তিনি আসলে সামরিক শক্তির কথাই বোঝাতেন তিনি। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমাদের আবার যুদ্ধ জেতা শুরু করতে হবে।’ এই বার্তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ট্রাম্প সম্প্রতি দেশের প্রতিরক্ষা বরাদ্দ ৫৪০০ কোটি ডলার বৃদ্ধি করার ঘোষণা দেন। তিনি সামরিক বাহিনী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে আরো স্বাধীনতা দিয়েছেন। আর এর ফলে মার্কিন বিমান হামলায় বেসামরিক মানুষ নিহতের ঘটনা সম্প্রতি বেড়েছে।
উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ৫ সপ্তাহ আগে তার এশিয়া সফরে বলেন, দেশটির পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সহিষ্ণুতার দিন ফুরিয়েছে। গত সপ্তাহে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স দক্ষিণ কোরিয়া সফরে গিয়ে প্রায় একই কথা বলেন। পেন্স সদর্পে ঘোষণা করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের লক্ষ্য নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা না চালালেই বরং উত্তর কোরিয়ার জন্য ভালো।
দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে অভিজ্ঞ নিরাপত্তা নীতি বিষয়ক কর্মকর্তার একজন ও আইনপ্রণেতা কিম জং ডাএ বলেন, ‘কিম জং উন কী চান, তা বোঝা সহজ। কিন্তু ট্রাম্পকে অনুমান করা যায় না।’ তিনি জানান, সিউল বিশেষভাবে যা নিয়ে উদ্বিগ্ন তা হলো আমেরিকা সম্ভবত কমান্ডো হামলা চালিয়ে কিম জং উনকে টার্গেট করতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে উদ্বিগ্ন এ সম্ভাবনা নিয়ে যে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার অনুমতি ছাড়াই উত্তর কোরিয়ায় হামলা চালাতে পারে।’
তবে ট্রাম্প যদি সত্যিই হামলা চালাতে চান, তাহলে তার হাতে উপায় থাকবে তিনটি। প্রথমত, পারমাণবিক শক্তিসমেত ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের আগেই যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালাতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে উৎক্ষেপণস্থল শনাক্ত করতে হবে। কিন্তু এ ধরণের স্থান আছে অনেক। সবগুলোকে একসঙ্গে ধ্বংস করাটা প্রায় অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার সকল পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে পারেন। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হলো প্রায় একই সময়ে সব হামলা চালাতে হবে। যদি এই হামলা কেঁচে যায়, তাহলে সমূহ ঝুঁকি রয়েছে যে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক হামলা চালাতে পারে। কিংবা দক্ষিণের বিরুদ্ধে প্রচলিত ধাঁচে হামলা চালাতে পারে পিয়ংইয়ং। তৃতীয় সম্ভাবনা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উত্তর কোরিয়া দখলে অভিযান শুরু করা। কিন্তু উত্তরের দিক থেকে রাসায়নিক হামলা চালানোর ঝুঁকি থাকায় এই সম্ভাবনা আগেই বাতিলের খাতায়।
কিন্তু সামরিক সংঘাত যদি এড়ানো সম্ভব হয়, ট্রাম্প ও কিম জং উন যদি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া না দেখান, আলোচনাই যদি হয় চূড়ান্ত পথ, তাহলে ট্রাম্প খুব একটা খারাপ অবস্থানে থাকবেন না। বিশ্বজুড়ে রাজনীতিবিদদের কাছে নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ট্রাম্প এক চিন্তার নাম। কিন্তু আলোচনার টেবিলে তার এই অনিশ্চয়তামাখা বৈশিষ্ট্যই বয়ে আনতে পারে সাফল্য। হয়তো, এ কারণেই ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছিলেন, এ দেশকে হতে হবে আরো কম অনুমানযোগ্য।
(মূল: জার্মানির দার স্পাইগেল। ছবি: লন্ডনের ফিনান্সিয়াল টাইমসের সৌজন্যে।)
No comments