মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম তদন্তে নামছে দুদক
অর্থ পাচার করে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন এমন ১৫ জনের নাম পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এদের মধ্যে সাতজন রাজনীতিবিদ, সাতজন ব্যবসায়ী এবং একজন পেশাজীবী আছেন। এই ১৫ জন সম্পর্কে বিস্তারিত এবং অন্যদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে দুদকের একটি দল মালয়েশিয়ায় তদন্তে যাচ্ছে। উপপরিচালক জুলফিকার আলীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচার ও সেকেন্ড হোমের মালিকদের নিয়ে কাজ করছেন। সম্প্রতি অনুসন্ধান টিম কমিশনের কাছে এ সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। তাতেই সন্দেহভাজন অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেয়া হয়েছে। এতে বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সম্পর্কেও আভাস দেয়া হয়। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) অর্থ পাচারকারীদের নিয়ে কাজে দুদককে সহায়তা দেয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। এ বিষয়ে আগামী জুলাই মাসে দুদক ও এফবিআইর মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে পারে। দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, এ নিয়ে একটা টিম কাজ করছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট দফদতরের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হচ্ছে। দলটি কবে নাগাদ মালয়েশিয়া যেতে পারে এমন প্রশ্নে দুদক সচিব বলেন, এখনও বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। পরে এ বিষয়ে বলা যাবে। জানা গেছে, গত এক যুগে অন্তত ৩ হাজার ৩৪৫ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম সুবিধা নিয়েছেন। এতে পাচার হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। মালয়েশিয়া সরকার ২০০২ সালে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্প শুরু করে। ওই বছর কোনো বাংলাদেশি এ সুবিধা না নিলেও ২০০৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৯১ জন সেকেন্ড হোম সুবিধা নিয়েছেন।
তালিকাভুক্ত বাংলাদেশিরা দেশ থেকে টাকা সরিয়ে সেকেন্ড হোমে বিনিয়োগ করেছেন; যা সরাসরি মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধের শামিল। ১৯৪৭ সালের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্টের ৫(১) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কেউই দেশ থেকে টাকা বিদেশে পাঠাতে পারেন না। দুদক বলছে, দেশের বাইরে অর্থ পাচার ঠেকাতে তারা মডেল কেস হিসেবে মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। এজন্য মালয়েশিয়ায় গিয়ে তদন্তের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। সূত্র জানায়, দুদক টিম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর থেকে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে। সেই তথ্যের পাশাপাশি সুনির্দিষ্টভাবে নামের তালিকাও চেয়েছে। অর্থ পাচারে জড়িত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সন্দেহভাজন কতজনের নাম আছে তাও চেয়েছে দুদক। অনুসন্ধান টিমের সঙ্গে যুক্ত এমন কর্মকর্তাদের কাছে নামের তালিকা আছে। তবে তারা এখনই এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। এ ধরনের এক কর্মকর্তা বলেন, সন্দেহের ভিত্তিতে ১৫ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য হাতে আসার আগেই নাম প্রকাশ করা হলে অনুসন্ধানে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এর আগে ২০১৪ সালে মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করে দুদক। তখন অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার সরকারের কাছে সেকেন্ড হোমধারীদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে এমএলএআর (মিচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট) পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ওই দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, এভাবে ঢালাও তথ্য চাইলে দেয়া সম্ভব নয়। কোনো ব্যক্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য চাইলে তা দেয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে, যে ১৫ জনের নাম দুদকের হাতে এসেছে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রক্ষিত সন্দেহভাজনদের নামের বিষয়েও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাবে। দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা এ সংক্রান্ত তথ্য আনার একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু মালয়েশিয়া থেকে তেমন সাড়া মেলেনি। তবে টিম যদি এ ব্যাপারে সোচ্চার হয় এবং অর্থ পাচারকারীদের নাম সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, তবে হয়তো তথ্য মিলবে। দুদকের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, মালয়েশিয়া হচ্ছে দুর্নীতিবাজদের স্বর্গরাজ্য। সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ করতে তেমন কোনো বাধা নেই। সেকেন্ড হোম করতেও বাধা নেই। যারা ওই দেশে বাড়ি-গাড়ি বা ব্যবসা করছেন, কোন পথে সেই টাকা নিয়ে যাচ্ছেন সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই দুদক টিম এবার বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যারা মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর কাজে কনসালটেন্সির সঙ্গে জড়িত এমন অন্তত এক ডজন লোককে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান রিপোর্টে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, এসব ইমিগ্রেশন কনসালটেন্সি ফার্মের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা তাও অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়েছে। দুদক নিজ থেকে অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি এফবিআইয়ের সহযোগিতাও চেয়েছে। সম্প্রতি এফবিআইয়ের এক কর্মকর্তা ডেভিড জে. ইটন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের সঙ্গে তার দফতরে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় অর্থ পাচারসহ সন্ত্রাস ও জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়টি আলোচিত হয়। পরে এফবিআই থেকে দুদকের কাজে সহায়তা দেয়ার আশ্বাসও দেয়া হয়। জানা গেছে, আগামী জুলাইয়ে এ বিষয়ে দু’পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মানি লন্ডারিং অপরাধ দমনে এফবিআইর সহযোগিতা চেয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে অর্থ পাচার হচ্ছে। এটা বন্ধ করা দরকার। তিনি বলেন, আন্তঃদেশীয় মানি লন্ডারিং রোধেও দুদকের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ দেখিয়ে এমওইউ স্বাক্ষর করতে চায় এফবিআই।
No comments