জাতীয় নির্বাচন হবে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ সাধারণ ভোটাররাও। নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর বাকি থাকতে বড় দুই দলের প্রস্তুতি দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে- এমনটা ধরে নিয়েই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এখন থেকেই মাঠ নিজেদের দখলে রাখতে চাইছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে কিনা, এ নিয়ে দু’দলেই রয়েছে সংশয়। কয়েক বছর ধরেই মাঠ পুরোপুরি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দলটির সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠ ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অপরদিকে নির্বাচনের আগে মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে কিনা, তা নিয়ে বিএনপিতেও নানা সংশয় আছে। এক্ষেত্রে ভোটের আগে নির্বাচনী মাঠ যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, ফল তাদের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ মাঠের পরিস্থিতি ভোটে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অতীতে এমনটাই ঘটেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, তা খোদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়েছে।
জানিয়েছেন, আগামীতে তিনি অংশগ্রহণমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চান। দলটির নীতিনির্ধারকরাও তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে সেরকম বার্তাই দিচ্ছেন। বিগত ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে দলটিও যে স্বস্তিতে রয়েছে, তেমনটা বলা যাবে না। প্রকাশ্যে যাই বলুক, নৈতিকতার দিক থেকে তাদের অবস্থান বেশ দুর্বল। তাই ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন করা হলে দল হিসেবেও আওয়ামী লীগকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। এ দফা পার পাওয়া গেলেও পরবর্তী সময়ে দেশে-বিদেশে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আর এবার চাইলেও একতরফা নির্বাচন করার সুযোগও নেই। কারণ শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবেই। এছাড়া কারণ যাই হোক না কেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করার জন্য এখন থেকে দেশি-বিদেশি নানা চাপও ভেতরে ভেতরে অব্যাহত আছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরের পর অনেকেই মনে করছেন, ২০১৪ সালের মতো আগামী নির্বাচনে প্রভাবশালী বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো কোনো দলের পক্ষে প্রকাশ্যে কোনো সমর্থন নাও জানাতে পারে। সে কারণে সরকারি দল আওয়ামী লীগ মনে করছে, একটি তমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন সবার জন্য অপেক্ষা করছে। তাই ভোটের হিসাব করতে গিয়ে এখন হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনের সঙ্গে আপস করতেও দ্বিধা করছে না সরকারি দল। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, সব পক্ষকে আস্থায় এনে আগামী জাতীয় নির্বাচন করার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এক ধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে একাধিক বক্তব্যে বলেছেন, আগামী নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে এবং বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। নির্বাচনকালীন মাঠ দখলের বিষয়ে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী আবুল মকসুদ যুগান্তরকে বলেন, টানা ২ মেয়াদে সরকারে থাকলে যে কোনো দলের অবস্থান শক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড এবং দলটির নেতাদের আচরণ বলে দিচ্ছে, তারা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের চিরাচরিত সমর্থকদের ওপরও আস্থা রাখতে পারছেন না। যে কারণে এমন শক্তিকে কাছে টানছেন, যারা আদর্শিক এবং রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বিরোধী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাইছে। সে লক্ষ্যে এখন থেকেই মাঠ দখলের কাজও শুরু করেছে। বেতন বাড়িয়ে এবং ঘন ঘন অন্যায্য পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনও হাতে রাখতে চাইছে। কিন্তু বাস্তবতা হল, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারাও যে আওয়ামী লীগের পাশে থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আওয়ামী লীগ দলের অভ্যন্তরের সমস্যা দূর করাসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরোধী শক্তির সঙ্গেও আপস করছে। কিন্তু মূল সমস্যার সমাধানের দিকে যাচ্ছে না। আসল সমস্যা হল ফায়দার রাজনীতি, আইনের শাসনের অভাব এবং দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন।
সুবিধার জন্য দলীয় লোকজনরা একে অপরের বিরুদ্ধে লাগছে, অনেক ক্ষেত্রে অন্যায়কারীদের বিচার না হওয়ায় অন্যরা উৎসাহিত হচ্ছে। এভাবে পরিস্থিতি খারাপ দিকে গড়াচ্ছে। মাঠ দখলের জন্য যতই প্রস্তুতি নিক, যদি শেষ মুহূর্তে প্রশাসন পক্ষে না থাকে তাহলে সেটা দুরূহ হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বলেন, আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড, নেতাদের বক্তব্য স্পষ্ট করে তুলছে যে, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। আর সরকার বিএনপিকে সে নির্বাচনে চাইছে। কিন্তু কথা হল, আওয়ামী লীগ যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চাইছে। আর সেজন্য চরম বিপক্ষের শক্তির সঙ্গেও হাত মেলাচ্ছে, প্রশাসনকে হাতে রাখার মেকানিজমও করছে। এসবের মাধ্যমে আগে যেমন মনে করা হতো, সহজেই আগামী নির্বাচনে জিততে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ, সেই ধারণায় চিড় ধরছে। আর যত দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। বিএনপি মাঠে নামছে। এ দলটির রিজার্ভ ভোটও আছে। তা ছাড়া সরকারবিরোধী সেন্টিমেন্ট জনগণের মধ্যে প্রবল। আর প্রশাসন এখন সরকারকে যে রকম সমর্থন ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, সেটা তফসিল ঘোষণার পর না দিলে আওয়ামী লীগের পক্ষে মাঠ দখলে রাখা কঠিন হবে। দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা এবং কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি আওয়ামী সমর্থকদের অনেকে ভালোভাবে নেয়নি। নির্বাচনী মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল হিসেবে এ আপসকামিতা উল্টো দলটির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করেন। তাদের মতে, বর্তমানে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ক্ষমতাসীনদের যে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তফসিল ঘোষণার পর তা নাও থাকতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। আওয়ামী লীগের হাত ধরেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে।
শেখ হাসিনা কোনো অন্যায়ের কাছে আপস করেননি, দুর্র্নীতি ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এ দেশের মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে, আগামী নির্বাচনে তারা নৌকাকেই ভোট দেবে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সরকার ইতিমধ্যে জাতিকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন উপহার দিয়েছে, আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনও উপহারও দেবে। আমরা আশা করি, বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনপ্রিয়তার পরীক্ষা দেবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সিনিয়র নেতা যুগান্তরকে বলেন, সারা দেশে একশ্রেণীর নেতাকর্মীদের বেপরোয়া চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ক্ষমতা অপব্যবহারে সাধারণ ভোটাররা ক্ষুব্ধ। তবে বিলম্বে হলেও বিষয়টি হাইকমান্ডও বুঝতে পেরেছে। তাই এখন থেকে নেতাদের লাগাম টেনে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। বিতর্কিত এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নেতাদের ডেকে কঠোর হুশিয়ারি দেয়া হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানোর চেষ্টা চলছে। অপর দিকে, বিএনপিও যে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে সেটা বলা যাবে না। সরকারবিরোধী কয়েক দফা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে সাংগঠনিকভাবে দলটি পর্যুদস্ত। মামলা-হামলায় নেতাকর্মীরা এখনও অনেকে এলাকা ছাড়া। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী মাঠ তারা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে মাঠপর্যায়ে দলটির ব্যাপক জনসমর্থনকে বাড়তি সুবিধা হিসেবে দেখছেন অনেকেই। আগামী নির্বাচনে নিজ দলের ভোটার সমর্থক ছাড়াও সরকারবিরোধী বড় একটি অংশের সমর্থন তারা পাবে। এ পরিস্থিতিতে বর্তমানে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাদী কর্মকর্তারা রাতারাতি ভোল পাল্টাতে পারেন। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নেয়াই বিএনপির বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে পরিস্থিতিও দ্রুত পাল্টাতে থাকবে। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের উদাহরণ টেনে তারা বলেন, ওই সময় অনেকেই বলেছিলেন, দেশে বিএনপি বলতে কিছু নেই। কিন্তু নির্বাচনে দলটির জনপ্রিয়তা প্রমাণ হয়েছে। মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংশয়ের কিছুই নেই।
জনগণই বিএনপির পক্ষে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। এ জন্য প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু পরিবেশ। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও উৎসবমুখর হবে। এটাই আমরা চাই। সেজন্য প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। আমরা সেই দাবিটিই জানিয়ে আসছি। নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো সাংগঠনিক অবস্থায় বিএনপি নেই- ক্ষমতাসীনদের এমন দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাহলে সরকারি দলের তো দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। নির্বাচনে জয়ী হওয়া তাদের জন্য সহজ হবে। ফখরুল ইসলাম কলেন, ‘অপেক্ষা করেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হোক। তখন দেখা যাবে মাঠ কাদের দখলে থাকে।’ তিনি বলেন, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে এখন বিএনপিকে মাঠে নামতে না দিয়ে ক্ষমতাসীনরা ভাবছেন পুরো মাঠ তাদের দখলে। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। সময় সব কিছু বলে দেবে। এই নেতার দাবি, নির্বাচন হলে বিএনপির পক্ষে জনেস্রাত নামবে এবং নির্বাচনে ভোটবিপ্লব হবে। সেই ভয়েই সরকার সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে ভয় পাচ্ছে।
No comments