চেয়ারম্যান ও পরিচালকের ঋণ জালিয়াতি
নজিরবিহীন ঋণ জালিয়াতি করেছেন পূবালী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান ও পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুব। তারা নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে ২৬ বছর আগে ঋণ নিয়ে তা আজও পুরোপুরি পরিশোধ করেননি। অথচ খাতা-কলমে তাদেরকে খেলাপিও দেখানো হয়নি। নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে এতদিন এই ঋণ নিয়মিত দেখানো হয়েছে। আমদানিকৃত পণ্যের বিপরীতে দেয়া ঋণসহ (লিম) সুদ-আসল মিলে বর্তমানে পূবালী ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। উপরন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে আলোচিত ঋণটি পরিশোধের মেয়াদ আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্ষদ। এ ছাড়া সূত্র জানায়, সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে টানা ২০ বছর পরিচালক হিসেবে বহাল আছেন বর্তমান চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শনে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণভাবে সুশাসনের পরিপন্থী। এ জন্য ব্যাংকটির ঋণ কমিটি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পরিদর্শক দলের মতে, এসব ঋণ আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই।
তাই ঋণগুলো খেলাপি দেখিয়ে এর বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ এবং প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখানে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি অপরাধ করেছে ব্যাংক। প্রথমত, জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংকের পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং পরিচালক করা হয়। দ্বিতীয়ত, খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ না করে আইনের লঙ্ঘন করা হয়েছে। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। এখানে কোটি কোটি মানুষের আমানতের বিষয় জড়িত। এ ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিচারহীনতার কারণে অনিয়ম থামছে না। এখন পর্যন্ত বড় কোনো ব্যাংক কেলেঙ্কারির উল্লেখযোগ্য শাস্তি হয়নি। পূবালী ব্যাংকে যা হচ্ছে, এটাও তার অংশ। তিনি বলেন, শীর্ষ ঋণখেলাপির কোনো বিচার হয়নি। তাদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি উঠেছিল। কিন্তু সেটা আজও বাস্তবায়ন করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হস্তে এসব কিছু দমন করার আহ্বান জানান তিনি। জানা গেছে, ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে সম্প্রতি আদালতের নির্দেশে পূবালী ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শক দল পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিদর্শক দলের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৯০ সালের ১ অক্টোবর পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান ও পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুবের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান চন্দ্রা স্পিনিং মিলসের নামে সাড়ে ৪ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। ৩০ বছরের পুরনো যন্ত্রপাতির মূল্যকে উদ্যোক্তার পুঁজি ধরে ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা থেকে ঋণটি ছাড় করা হয়েছে। এর পর থেকে গত ২৬ বছর ধরে নানা ঋণে রূপান্তরিত, নতুন ঋণ অনুমোদন এবং আগের ঋণটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ফান্ডেড (পরিশোধিত ঋণ) ও নন-ফান্ডেড (পরিশোধীয় ঋণ) মিলে বর্তমানে সাড়ে ৪ কোটি টাকার সে ঋণ সুবিধাটি ৭০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ না করে মেয়াদ বাড়ানো হয় ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৪ সালে ৩ কোটি টাকার সিসি ঋণ (ক্যাশ ক্রেডিট) এবং এলসি (ঋণপত্র) সীমা নবায়ন করা হয়। একই সঙ্গে ৯০ দিন মেয়াদের আরও দেড় কোটি টাকা (লিম ঋণ) পরিশোধ না হওয়ায় সময় এক বছর বাড়ানো হয়। ১৯৯৫ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তি থাকার পরও ঋণগুলো নবায়ন করা হয়। ১৯৯৬ সালে প্রকল্প ঋণ হিসাবটি (টার্ম লোন) মেয়াদি ঋণ ১ কোটি থেকে সাড়ে ৭ কোটি টাকা এবং লিম ও সিসি হিসাবগুলো ২ কোটি থেকে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকায় রূপান্তর করা হয় এবং ১৯৯৭ সাল থেকে কিস্তিগুলো পুনর্নির্ধারণ করা হয়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো পূর্বানুমোদন ছিল না।
১৯৯৭ সালে আগের টার্ম লোন ও সিসি লোন একীভূত করে ১০ বছর মেয়াদে প্রায় ১২ কোটি টাকার একটি নতুন টার্ম লোন সৃষ্টি করা হয়। যদিও সময়ে সময়ে মেয়াদোত্তীর্ণ বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া সিসি, এলসি ও লিম সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এত দিন ধরে চলা ঘটনাটি কিভাবে সবার চোখ এড়ালো, এটি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এর দায় অনেকে এড়াতে পারবেন না। জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুব যুগান্তরকে বলেন, ‘আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চন্দ্রা স্পিনিং মিলসের বাস্তব অবস্থা জানতে চেয়েছেন। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতের জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এর বাইরে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’ তবে এ বিষয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে বারবার মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফোন করার কারণ উল্লেখ করে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ১৯৯৮ সালে ৩ কোটি টাকার চলতি ঋণ সুবিধা অব্যাহত রেখে একই বছর প্রকল্প ঋণটি পুনঃতফসিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন প্রকল্প ঋণ হিসাবটি খেলাপি থাকার পরও অনৈতিকভাবে চলতি ঋণ নবায়ন করা হয়। এ সময় পরিচালকরা ঋণখেলাপি থাকায় মো. ইয়াকুব ও হাবিবুর রহমানের পূবালী ব্যাংকের পরিচালক পদ শূন্য ঘোষিত হয়। ওই সময়ে ইয়াকুব ও হাবিবুর রহমান চন্দ্রা স্পিনিং মিলসের পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করে সব শেয়ার বেনামি তৃতীয় পক্ষের কাছে অবৈধভাবে হস্তান্তর করেন। খেলাপি ঋণ থাকার পরও অব্যাহত লোকসানে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পরিবর্তনে পূবালী ব্যাংকের সে সময়ের সিদ্ধান্ত ঋণ শৃঙ্খলার পরিপন্থী ছিল বলে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে। এরপর ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক বছর ওডি (ওভার ড্রাফট), সিসি, এলসি, এলটিআর (বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঋণ) এবং বিজি (ব্যাংক গ্যারান্টি) সীমা নবায়ন ও মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০১০ সালে ৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা খেলাপিযোগ্য প্রথমে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এবং পরে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ ছাড়া সিসি, এলসি, বিজি এবং এলটিআর সীমা সাড়ে ২৮ কোটি টাকা নবায়ন ও মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০১১ সালে ৫ কোটি টাকার একটি এলটিআর ঋণ অধিগ্রহণ এবং চলতি ও ডিমান্ড লোন (চাহিবা মাত্র পরিশোধীয় ঋণ) বাবদ সাড়ে ৫৪ কোটি টাকা নবায়ন ও মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০১২ সালের তৈরি সাড়ে ২২ কোটি টাকার ৫টি মেয়াদোত্তীর্ণ এলটিআর হিসাব ৫ বছর মেয়াদে এবং পরবর্তী সময়ে ওই মেয়াদি ঋণ ২০২০ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ ছাড়া সাড়ে ৫৬ কোটি টাকার চলতি ও ডিমান্ড লোন সীমা নবায়ন ও মেয়াদ বাড়ানো হয়। এর বাইরে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আগের চলতি ও ডিমান্ড লোন সীমা নবায়ন করা হয়। ২০১৫ সালে ৭টি মেয়াদোত্তীর্ণ এলটিআর হিসাব ৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা টার্ম লোনে রূপান্তর করা হয়। যার মেয়াদ ২০১৭ সাল পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত পূবালী ব্যাংক পর্ষদের ১০৯২তম সভায় সিসি, ওডি, এলসি, এলটিআর ও বিজি সীমা সাড়ে ৫৪ কোটি টাকার মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৭ সাল পর্যন্ত। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনসাপেক্ষে টার্ম লোন ৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা, ডিমান্ড লোন সাড়ে ২২ কোটি টাকা, ডিমান্ড লোন ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকার মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়িয়ে কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা পেছানো হয়েছে ২০২০ পর্যন্ত। এর বাইরে ৩ কোটি ৯২ লাখ টাকার ২টি এলটিআর হিসাবের সময়সীমা ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যা ব্যাংকিং নিয়মের পরিপন্থী। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই অনেক আগের খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা ও পর্ষদের যোগসাজশে মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়মিত দেখানো হচ্ছে বলে প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে। এ ছাড়া ২০১০ সাল থেকে ১৮০ দিনে পরিশোধযোগ্য এলটিআর ঋণগুলো টার্ম লোনে রূপান্তরিত করা শুরু হয়। গত বছর পর্যন্ত টার্ম লোনের পুঞ্জীভূত বকেয়া ৩১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। বর্তমানে দুই পরিচালক ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড মিলে ৭০ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা ভোগ করছেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ফান্ডেড ৬৭ কোটি ২২ লাখ টাকা এবং নন-ফান্ডেড ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যাংকের পাওনা থাকলেও এসব টাকা তারা ফেরত দিচ্ছেন না।
রূপান্তরিত এলটিআরগুলোর বিপরীতে কোনো পণ্য নেই। বিষয়টি নিয়ে পূবালী ব্যাংকের কোনো মনিটরিংও নেই। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যোগসাজশ করে শুধু ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে ঋণ হিসাবগুলো নিয়মিত দেখাচ্ছে। অথচ চন্দ্রা স্পিনিং মিলস কখনও পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারেনি। সব সময় লোকসানি প্রতিষ্ঠান ছিল। এরপরও প্রতিষ্ঠানটিকে একের পর এক ঋণ সুবিধা দিয়ে আমানতকারীদের আমানতের অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক দল মনে করে। প্রতি প্রান্তিকে পরিচালকদের ঋণের তথ্য জানাতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। কিন্তু দুই পরিচালকের ঋণের বিষয়টি গত ১৫ বছর গোপন করা হয়েছে বলে একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ তাদের ঋণের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো রিপোর্ট করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার নং ১৫/২০১২ অনুযায়ী ঋণ পরিশোধের সময়সীমা শেষ হয়েছে। ঋণটি নিয়মিত করার ক্ষেত্রে বোর্ডসভায় দু’জন পরিচালক নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন। এরপরও এসব ঋণের মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ সম্পূর্ণরূপে সুশাসন পরিপন্থী বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ব্যাংকটির ১০ জন পরিচালককে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক স্থগিতাদেশে তাও আটকে দেয়া হয়। নিয়মানুযায়ী দুই মেয়াদে ৬ বছর পরিচালক থাকার বিধান থাকলেও ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান টানা ২০ বছর এবং পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুব ১৫ বছর পরিচালক পদে রয়েছেন। দীর্ঘদিন পরিচালক নির্বাচন হয়নি। এবারও পরিচালক নির্বাচন হয়নি বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
No comments