বিএনপি নেতাদের তথ্য তালাশ চিঠি দিয়ে
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করছে সরকার। সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে তথ্য চেয়ে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) অফিসিয়ালি চিঠি পাঠিয়েছে। রীতিমতো তিন পৃষ্ঠার ফরম ছেপে ৩২টি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হয়েছে। কোথাও রাজনৈতিক পরিচয়ের কথা উল্লেখ না থাকলেও চিঠিতে যাদের নাম রয়েছে তারা সবাই বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়। সূত্র বলছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে প্রায় দু’মাস আগে এসবির পক্ষ থেকে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রথমে রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত বিএনপির প্রথম ও দ্বিতীয় সারির নেতাদের কাছে তালিকা করে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। সেখানে একটি চিঠিতে বিএনপি ছাড়াও ঢাকার গুলশান ও বারিধারা এলাকায় বসবাসরত সরকারবিরোধী আরও দু-একটি দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের নাম ছিল। এদিকে যুগান্তরের হাতে এবার যে তালিকাটি এসেছে তা এসবি থেকে ইস্যু করা হয়েছে ১০ এপ্রিল। এতে যে ৩৭ জনের নামের তালিকা রয়েছে তাদের প্রত্যেকেই বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং কেউ কেউ দলের সিনিয়র নেতা। তালিকায় আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাড. খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ সাবেক বেশ কয়েকজন এমপি। সিটি এসবির পক্ষ থেকে থানা পুলিশের মাধ্যমে পাঠানো ফরমে কেবল বাপ-দাদা’র নাম ঠিকানাই নয়, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং কত টাকার মালিক থেকে শুরু করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, গাড়ির নম্বর, রাজনৈতিক পরিচয়, মামলার হিসাব- এমনকি চারিত্রিক কোনো ক্রটি কিংবা বদঅভ্যাস আছে কিনা তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কেউ কেউ এ প্রশ্নমালার উত্তর দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, এটি তো স্পষ্ট যে, বিএনপি এতটাই জনপ্রিয়তা রয়েছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী এমপির জামানত হারাতে হবে। তারা রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার কারণে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। মামলা-হামলা দিয়ে বিএনপিকে মোকাবেলা করছে। দলের জনপ্রিয় নেতাদের টার্গেট করে মামলার পর এখন তাদের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে বলে শোনা যাচ্ছে। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ভীতি ছড়াতেই ভবিষ্যতে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে এসব করা হতে পারে। তিনি বলেন, কিন্তু এসব করেও পার পাওয়া যাবে না। সব স্বৈরাচারী সরকারের বৈশিষ্ট্য এ রকম হয়। শেষ পর্যন্ত জনরোষে তাদের বিদায় নিতে হয়। স্বৈরাচারী এই সরকারেরও একদিন বিচার হবে। সেদিন বেশি দূরে নয়। এ বিষয়ে জানতে চিঠি স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তা সিটি এসবির সহকারী পুলিশ সুপার মতিউর রহমানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। পরে ওই ফোন নম্বরে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। জানতে চাইলে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে যে কোনো নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু কারও কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে তারা কোনো তথ্য নিতে পারেন না। এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। ঢাকা সিটি এসবির আর্কাইভস্ বিভাগের একজন সহকারী পুলিশ সুপার স্বাক্ষরিত হালনাগাদ তথ্য প্রেরণ সংক্রান্ত ওই চিঠিটি ১০ এপ্রিল দেয়া হয় সিটি এসবির বিভিন্ন জোনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে। ১৮৫ (১৮)/আর্কাইভস্ (পিএফ) নং স্মারকের ওই চিঠিতে রাজধানীর মোট ৩৭ জন বিএনপি নেতা সম্পর্কে ৩২টি সুনির্দিষ্ট প্রশ্নমালার পাশাপাশি অসংখ্য তথ্য নিয়ে জানাতে বলা হয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে। উত্তরের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট নেতার এক কপি ছবিও দিতে বলা হয় সেখানে। যে নেতাদের তালিকা ওই চিঠিতে দেয়া হয়েছে তাদের নাম-ঠিকানার পাশাপাশি আরও অনেক কিছু জানাতে বলা হয়েছে। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে জন্ম তারিখ ও জন্মস্থান, উচ্চতা ও গায়ের রং, শারীরিক গঠন ও শনাক্তকরণ চিহ্ন, শিক্ষাগত যোগ্যতার পূর্ণ বিবরণ,
বৈবাহিক অবস্থা, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নম্বর-ইস্যু উত্তীর্ণের তারিখ, চাকরিজীবী হলে যোগদান-বর্তমান পদ-সর্বশেষ পদোন্নতির তারিখ, ব্যবসায়ী হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা-ব্যবসার ধরন-ব্যবসায় যোগদানের তারিখ ও বিনিয়োগের পরিমাণ, বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ও উৎস, আয়কর সংক্রান্ত তথ্য, রাজনৈতিক পরিচিতি, দলের নাম-যোগদানের তারিখ, পূর্ব ও বর্তমান পদ, পূর্ব ও বর্তমান কর্মকাণ্ড, নির্বাচন করলে তার নাম, কোন দলের প্রার্থী-ফলাফল। এছাড়াও জানতে চাওয়া হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মামলা-জিডি-গ্রেফতার-জেলজীবন-সাজা-খালাস সংক্রান্ত বিবরণ, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের অবস্থানগত ঠিকানা-মূল্যমান এবং মালিকানায় থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট-ক্রেডিট কার্ড-ইন্স্যুরেন্স পলিসি নম্বর, নিজ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের গাড়ি থাকলে তার নম্বর, ঘনিষ্ঠ মিত্র ও শত্রুদের নাম-ঠিকানাসহ বন্ধুত্ব এবং শত্রুতার কারণ, বন্ধুদের পেশাগত বর্ণনা-ঠিকানা-গাড়ির নম্বর, আলোচ্য বন্ধু বা শত্রুর সঙ্গে কারও রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক সম্পর্ক থাকলে তার বর্ণনা, চারিত্রিক দুর্বলতা ও বদ অভ্যাসের (যদি থাকে) বর্ণনা, পারিবারিক বৃত্তান্ত, শিল্প সাহিত্য অর্থনীতি বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়-আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকলে তার বর্ণনা, স্থানীয় প্রভাব ও প্রতিপত্তি এবং দুর্নীতি-চরমপন্থী-জঙ্গিবাদ-নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত তথ্যাদি থাকলে তার বর্ণনা। মোট ৩টি পৃষ্ঠায় ৩২টি মূল প্রশ্নের সঙ্গে আরও কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে এসব তথ্যের উত্তর দিতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিএনপি নেতাদের। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী যে ৩৭ জনের তথ্য চাওয়া হয়েছে, তারা হলেন (এসবির তালিকার ক্রমানুসারে) সাবেক মন্ত্রী পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া আসনের নেতা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নূরুল ইসলাম মঞ্জু, পিরোজপুর সদরের বিএনপি নেতা লিয়াকত আলী শেখ বাদশা, পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার বিএনপি নেতা মো. শাহজাহান খান, একই জেলার কলাপাড়া উপজেলার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় প্রচার-প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেন, বরিশালের উজিরপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি সরদার সরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু, বরিশালের গৌরনদী উপজেলা নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহান, বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার নেতা ব্রিগেডিয়ার (অব.) আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক এবং বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি আকন কুদ্দুসুর রহমান, বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট হাসিনা আহম্মেদ, কেন্দ্রীয় নেতা জাকারিয়া তাহের সুমন, মাজেদা আহসান, কুমিল্লা জেলার সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নেতা হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াসিন, বিএনপি নেতা এসএম আলাউদ্দিন ভূইয়া, কেন্দ্রীয় বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মোবাশ্বর আলম ভূইয়া, সৈয়দ আবদাল আহম্মেদ, কাজী আনোয়ার হোসেন, এসএকে একরামুজ্জামান, তকদির হোসেন মো. জসিম, ইঞ্জিঃ মো. খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামল,
আলহাজ ডা. মো. জালাল উদ্দিন, এমএ হান্নান, লায়ন মো. হারুনুর রশিদ, রোটারি মাহবুবুর রহমান শামিম, চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহম্মেদ মানিক, রাশেদা বেগম হিরা, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি শফিউল বারী বাবু, লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মো. আবুল খায়ের ভূইয়া, নাজিম উদ্দিন আহম্মেদ, মো. সাহাবুদ্দিন সাবু, রেহানা আক্তার রানু, এএনএম আবেদ রাজা, মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে হাজী মুজিব, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল মনসুর সাখাওয়াত হোসেন জীবন, এসএম ফয়সাল, ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি মিঞা আহম্মেদ কিবরিয়া এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। বিএনপির বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, রাজধানী ঢাকার কোনো আসনে নির্বাচন না করলেও এদের প্রত্যেকে দলের প্রভাবশালী নেতা। উল্লিখিত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাবেক এমপি-মন্ত্রী এবং বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক। কয়েকজন দলের বড় মাপের ডোনার হিসেবেও পরিচিত। এদের বেশিরভাগই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। নিরাপত্তাজনিত কারণে এসবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সামনে না গিয়ে মোবাইল ফোনে প্রশ্নের উত্তর দেয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিংবা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিষয়ক প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি দিইনি। সরাসরি অস্বীকার করার পাশাপাশি এসব তথ্য জানার কোনো আইনগত ভিত্তি তাদের আছে কিনা সেই প্রশ্নও করেছি। অবশ্য তারা বিষয়টি নিয়ে খুব একটা চাপাচাপি করেনি। কেন এবং কী কারণে এসব তথ্য নেয়া হচ্ছে জিজ্ঞাসা করা হলে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা এসবির কর্মকর্তা সঠিক কোনো উত্তর দেননি।’
বিএনপির আরেক নেতা কেন্দ্রীয় প্রচার প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘কেবল এসব প্রশ্নের উত্তর নয়, আমার গ্রামের বাড়ি কলাপাড়ায় গিয়ে সেখানে থাকা আমার পৈতৃক বাড়ির ছবি পর্যন্ত তুলে এনেছেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। স্পেশাল ব্রাঞ্চের পাশাপাশি সরকারের আরও বেশ কয়েকটি সংস্থা বিভিন্ন সময়ে ফোন করে কিংবা সরাসরি বাসায় গিয়েও নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে। কেন এবং কী কারণে এসব জিজ্ঞাসা সেসব ব্যাপারে অবশ্য কিছুই বলছে না তারা।’ ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মিঞা আহম্মেদ কিবরিয়া বলেন, ‘কী করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এসব তথ্য কেন জানতে চাইছে পুলিশ সেটাও স্পষ্ট নয়। নিজের আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’ মোবশ্বর আলম ভুঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, এসবির পক্ষ থেকে তাকে ফোন করে তথ্য চাওয়া হয়। মামলা এবং আয়কর সংক্রান্ত কিছু তথ্য জানতে চাইলে আমি তাদের তা দিয়েছি। তবে কী কারণে এসব তথ্য নেয়া হয়েছে তা তার জানা নেই। জাকারিয়া তাহের সুমনও তথ্য দিয়েছেন বলে যুগান্তরকে জানান। জানতে চাইলে রেহেনা আক্তার রানু বলেন, এখনও কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তবে যেসব তথ্য চাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে তা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
No comments