ভাড়াটে মস্তান দিয়ে যাত্রী শায়েস্তা
অভিযানের তৃতীয় দিনেও লোকাল বাসগুলো ডাইরেক্ট নামে চলাচল করছে। এসব বাসের যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে সিটিং বাসের ভাড়া। কেউ যাতে ভাড়া নিয়ে সমস্যা তৈরি করতে না পারে সেজন্য বাসে ভাড়াটে মস্তান নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীকল্যাণ সমিতির নেতারা। মঙ্গলবার ঢাকায় ৭০ ভাগ বাস, মিনিবাস রাস্তায় নামেনি। ফলে এদিনও যাত্রীদের ভোগান্তি অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে নারী, শিশু ও অসুস্থ রোগীরা পড়েছেন চরম বিপাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা নারী-শিশুদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে সিএনজি অটোরিকশায় ও ট্যাক্সিক্যাব ব্যবহার করেছেন। অঘোষিত বাস ধর্মঘটে সিএনজি অটোরিকশা এবং ট্যাক্সিক্যাবগুলোর রমরমা অবস্থা চলছে। মিটার তোয়াক্কা না করে যাত্রীদের কাছ থেকে ২-৩ গুণ বেশি ভাড়া আদায় করছে। কোনো বাসে ভাড়ার চার্ট দেখা যায়নি। ৭২ ঘণ্টা ধরে নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করলেও তা নিরসনে মোবাইল কোর্ট ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ঘোষণা দেয়ার পরও রাস্তায় গাড়ি না নামানোর কারণে বিআরটিএ কারও রুট পারমিট বাতিল করেনি। ১৫ এপ্রিল পরিবহন মালিক সমিতি রাজধানীতে বাস-মিনিবাসে ‘সিটিং সার্ভিস, গেটলক সার্ভিস’ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য রোববার থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু হয়। এ অভিযান কেন্দ্র করে গণপরিবহনে নৈরাজ্য শুরু হয়। রবি ও সোমবারের মতো মঙ্গলবারও রাজধানীর বিভিন্ন রুটে সরেজমিন দেখা গেছে, অনেক রুটে সিটিং সার্ভিস, গেটলক সার্ভিস লেখা গাড়ি চলাচল করছে। তবে বাসগুলোতে যাত্রী ঠাসা ছিল।
লোকাল বাসগুলো ডাইরেক্ট নামে চলাচল করতে দেখা গেছে। এসব লোকাল বাসের হেলপার ও কন্ডাক্টরদের ডাইরেক্ট বলে যাত্রী ডাকতে শোনা গেছে। বাসগুলোতে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে যাতায়াত করলেও ভাড়া দিয়েছেন সিটিং বা গেটলক সার্ভিসের সমান। কেন বাসে ভাড়ার চার্ট নেই। যাত্রীরা জানে না কিলোটিমার প্রতি ভাড়া কত টাকা। মিরপুর থেকে মতিঝিল কত কিলোমিটার, সে অনুযায়ী কত টাকা ভাড়া হওয়ার কথা। তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে কত টাকা। বাসে ভাড়ার তালিকা রাখার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশই তা মানছে না। পরিবহন মালিকরা যে যার ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। বাস-মিনিবাস দূরত্বভেদে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করছে। অতিরিক্ত ভাড়া দিতে অস্বীকার এবং ন্যায্য ভাড়া প্রদান করতে গিয়ে অনেক যাত্রীকেই পরিবহন শ্রমিকদের হাতে নাজেহাল হতে হচ্ছে। যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, এমন নৈরাজ্যের মধ্যেও পরিবহন ব্যবসায়ীরা যাত্রী শায়েস্তা করতে বাস ও রাস্তায় মস্তান নামিয়েছে। যাত্রীদের অভিযোগ, সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ায় চালকের ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে বাস দাঁড় করাচ্ছে। এতে তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে দেরি হচ্ছে। এসবের প্রতিবাদ করতে গেলেই তারা বলছেন, সিটিং সার্ভিস বন্ধ, টাকা উঠাতে যখন তখন লোক উঠানো-নামানো হবে। ঠাসা বাসেও একের পর এক লোক উঠাচ্ছে-নামাচ্ছে চালক-কনডাক্টররা।বিআরটিএর ভাড়া আদায় ও নৈরাজ্য বন্ধ করার কথা থাকলেও তারা অনেকটাই নীরব ভূমিকা পালন করছে। ফলে অভিযান এখন লোক দেখানোতে পরিণত হয়েছে। দুপুরে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েও সাধারণ যাত্রীদের অধিকাংশই বাস-মিনিবাস পাচ্ছিলেন না। ২০-২৫ মিনিট পরপর একটি বাস কিংবা মিনিবাস এলেও ভেতরে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ফলে অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দরজায় ঝুলে যাতায়াত করেন।
গাজীপুরগামী যাত্রী বকুল রানী দাস তার ৭ বছরের শিশু সন্তান সুখি দাসকে নিয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কোনো বাস-মিনিবাসে উঠতে পারেননি। বকুল রানী জানান, তার স্বামী বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বাড়িতে ১ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। তাদের দেখতে ও ঋণ করা টাকা আনতে বাড়ি যাচ্ছেন। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে তীব্র রোদে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছিলেন সিরাজুল ইসলাম ও রফিকুল ইসলাম নামে দুই ভাই। সিরাজুল ইসলাম জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ১১ দিন চিকিৎসার পর বাবাকে নিয়ে আবদুল্লাহপুরের বাড়িতে যাওয়ার জন্য এ মোড়ে (শাহবাগ মোড়) এসে বিপাকে পড়ছেন। বাসের নাগাল পাচ্ছেন, কিন্তু ভিড় থাকায় উঠতে পারছেন না। শাহবাগ থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত সিএনজির ভাড়া চাচ্ছে ৬শ’ টাকা। মিরপুর ১১ নম্বর যেতে আশরাফুল ইসলাম ও রিনা আক্তার দম্পতি এক কনডাক্টরের সঙ্গে তর্ক করছিলেন। কিছুটা রেগে কনডাক্টর বলছিলেন, ‘পারলে ভেতরে ঢোকেন, দরজায় দাঁড়াইতে পারছি না, ভেতরে ঢুকবেন কী করে।’ সিরাজুল ইসলাম বলছিলেন, এটা কোন দেশ, যাত্রীদের দুর্ভোগ দেখার কেউ নেই? পরিবহন মালিকরা যা ইচ্ছে তাই করবে। এখন তো বেশি ভাড়া দিয়েও যাতায়াত করা যাচ্ছে না। বাংলামোটর ফ্লাইওভারের দু’পাশে যাত্রীদের জটলা লেগে আছে। শাহবাগ মোড় কিংবা কারওয়ান বাজার হয়ে আসা বাস-মিনিবাসের কোনোটাই খালি নেই। ফলে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা ডাকাডাকি কিংবা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেও চালকরা গাড়ি দাঁড় করাচ্ছে না। একই অবস্থা কারওয়ান বাজার মোড় এলাকায়ও।
লাব্বাইক ঢাকা মেট্রো-ব ১১-৯৭৫৭ বাসের চালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, তাদের শতাধিক বাসের মধ্যে ১৬-১৭টি বাস চলছে। মাওয়া কিংবা যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকেই বাসগুলোতে যাত্রী ভরে যাচ্ছে, ফলে রাস্তায় কোনো যাত্রী উঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ফার্মগেট এলাকায় বাস-মিনিবাসের অপেক্ষায় শত শত যাত্রী অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। মঙ্গলবার সকাল থেকেই এ ব্যস্ততম স্ট্যান্ডটিতে বাস-মিনিবাস সংকট দেখা দেয়। সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে নারী, শিশু এবং এই এলাকায় বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে পড়–য়া শত শত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। শাহনাজ পারভীন তার মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকী আশাকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছিলেন। শিক্ষার্থী আশা জানান, তারা মিরপুর শাহআলী মাজার এলাকায় থাকেন। সকালে সিএনজি দিয়ে এসেছেন, এখন বাসের অপেক্ষা করছেন। মিরপুর রুটের ২-৩টি বাসের দেখা মিললেও ওঠা সম্ভব ছিল না। মিরপুর ১০ নম্বর চৌরাস্তা এলাকায় বাসের ভিড় নেই। নেই হাঁকডাকও। কিছুটা স্বস্তিতে সময় কাটাতে দেখা গেছে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। হেমায়েতপুর থেকে আসা মধুমতি বাস থেকে ৩-৪ জন যাত্রী ১০ নম্বর মোড়ে নামেন। তাদের মধ্যে ইকবাল হোসেন জানান, হেমায়েতপুর থেকে ১০ নম্বরে আসতে প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে ১০ টাকা বেশি দিতে হয়েছে। ভয়ে কনডাক্টরের সঙ্গে কথা বলেননি। প্রতিবাদ করতে গেলেই মার খেতে হবে। প্রজাপতি পরিবহনের সুপারভাইজার কবির হোসেন বলেন, তাদের ৯০টি বাস রয়েছে,
রোববার থেকে মাত্র ১৫-১৬টি বাস চলাচল করছে। অধিকাংশ সিটিং সার্ভিস ছিল, যা এখন বন্ধ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাসগুলো নামানো হবে বলে তিনি জানান। উত্তরা-আজিমপুর পথে ফাগুন পরিবহনের ৩৫টি বাস চলাচল করতে, এখন চলছে মাত্র ৬টি। জানালেন বাসের সুপারভাইজার মো. রাজু আহমেদ। মহাখালী বাসস্ট্যান্ড ও রেলগেট এলাকায় বাসের জন্য যাত্রীদের হা-হুতাশ করতে দেখা গেছে। রেলগেটের পূর্বপাশে রাস্তার আইল্যান্ডে বসে ২ মেয়ে ও এক নাতনিকে নিয়ে বাসের অপেক্ষা করছিলেন শ্বাসকষ্টে ভোগা গোপাল বণিক নামের এক বৃদ্ধ। গোপাল বণিক জানান, তার মেয়ে ও নাতনি অসুস্থ, মহাখালী যক্ষ্মা হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন। বাড়ি গাজীপুর। বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষা করলেও বাস পাচ্ছেন না, পেলেও তা আবার খালি নেই। খানিকটা সামনে আমতলী এলাকা। আমতলী এলাকায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীরা। হঠাৎ কোনো একটি বাস দাঁড়ালেও ১-২ জন যাত্রী উঠতে পারছেন। একই অবস্থা কাকলী মোড় ও কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায়ও। একই অবস্থা দেখা গেছে গুলিস্তান, দৈনিক বাংলা মোড়, মতিঝিল শাপলা চত্বর, পল্টন, নয়াপল্টন, আইডিয়াল স্কুল, পুলিশলাইন, কাকরাইল মোড়েও। অপরদিকে নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, আজিমপুর, কলাবাগান এলাকায়ও বাসের সংকটে যাত্রীরা দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে।
যাত্রী শায়েস্তায় রাস্তায় মস্তান : যাত্রী জিম্মির পর এবার শায়েস্তা করতে বাসে ও রাজপথের বিভিন্ন পয়েন্টে মস্তান নামানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করা হয়। এতে বলা হয়, বাড়তি ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন তুললে যাত্রীদের অপদস্থসহ শরীরে আঘাত করা হচ্ছে। বাসে ও রাস্তায় থাকা মস্তানরা সাধারণ যাত্রীদের হুমকি-ধমকিও দিচ্ছে। সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, রোববার থেকে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী যানবাহনের প্রায় ৪০ শতাংশ রাস্তায় নামানো হয়নি। এতে সাধারণ যাত্রীসহ নারী, শিশু ও বয়স্করা অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন। সিটিং সার্ভিস বন্ধের নামে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ ধর্মঘটে যেসব বাস জড়িত, তাদের রুট পারমিট বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
No comments