বিকল্প পদ্ধতিতে পার পেয়ে যাচ্ছেন বড় ঋণখেলাপিরা
বিকল্প পদ্ধতিতে পার পেয়ে যাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা। ব্যাংকারদের যোগসাজশে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ঋণ সমন্বয় করার পাশাপাশি খেলাপিরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছেন। তারা আদালতে রিট করে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম স্থাগিত করিয়ে নিচ্ছেন। এ সুবাদে তারা ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ নিয়মাচারকে পাশ কাটিয়ে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণের সুযোগ নিচ্ছেন। শুধু এটিই নয়, বছরের পর বছর শত শত কোটি টাকার ঋণ পরিশোধের দায় থেকেও তারা নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। এভাবে চার শতাধিক বড় ঋণ গ্রহীতা ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হওয়া থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা যেমন কমছে, তেমনি ব্যাংকের আয় ও মূলধনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ থেকে নিষ্কৃতি পেতে ব্যাংকাররা ঋণখেলাপিদের ঋণ না দেয়ার আইন চেয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। গত সোমবার খেলাপি ঋণ বেশি এমন ২০ ব্যাংকের এমডির সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠকে ব্যাংকাররা এ দাবি জানিয়েছেন। জানা গেছে, ব্যাংকিং খাত থেকে খেলাপিঋণ দূরীভূত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৩ সালে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে। খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে এবং নতুন করে কেউ ঋণ খেলাপি না হন সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক দু’টি পদ্ধতি গ্রহণ করে। এ দু’টি পদক্ষেপ ছিল আইনগত পদক্ষেপ এবং পদ্ধতিগত পদক্ষেপ। আইনগত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হয় ব্যাংক কোম্পানি আইন ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এর মাধ্যমে।
আর পদ্ধতিগত হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ব্যাংকের ঋণ নিয়মিত মনিটরিং করে। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে খেলাপি ঋণ পরিবীক্ষণ করে এবং ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজন মোতাবেক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। আইনগত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯৩কে সংশোধন করে। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৭ ধারা মোতাবেক কোনো ঋণখেলাপিকে নতুন করে ঋণ দেয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোন ব্যাংক থেকে কি পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, ঋণ নিয়ে ঠিক মতো পরিশোধ করা হয়েছে কি না, অথবা গ্রাহক খেলাপি কি না তার তথ্য মজুদ করে রাখে। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির তথ্য মোতাবেক গ্রাহক যদি ঋণ খেলাপি হয়ে থাকে তাহলে তাকে ঋণ প্রদান থেকে বিরত থাকে। অপর দিকে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২ এর মতে জাতীয় নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনে কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ কারণে নির্বাচনের সময় সম্ভাব্য প্রার্থী ঋণ খেলাপি হলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে। অনেকে একটি নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়ন করে। এ কারণে কোনো ব্যাংক গ্রাহককে ঋণ দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ঋণ খেলাপি কি না তার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে যাচাইবাছাই করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের ঋণ তথ্য দিয়ে ব্যাংক ও নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে থাকে। জানা গেছে, ৫০ হাজার টাকার ওপরে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন এমন গ্রাহকের ঋণতথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাধারণত প্রতি মাসে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ১ কোটি টাকা বা এর ওপরে ঋণ গ্রহীতাদের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি সংগ্রহ করে। আর ৫০ হাজার টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাদের তথ্য প্রতি তিন মাস অন্তর সংগ্রহ করা হয়। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এরকম ২০ লাখ ঋণগ্রহীতার তথ্য মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বড় বড় ঋণখেলাপিরা এখন উচ্চ আদালতে রিট করে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে সমায়িক সময়ের জন্য স্থাগিতাদেশ নিচ্ছেন।
এর ফলে ব্যাংকের ঋণ আদায় বাড়ছে না, বরং ক্ষেত্র বিশেষ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আবার ওই একই ব্যক্তি অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিচ্ছেন। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এমনও অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের উচ্চ আদালতে যেতে প্ররোচিত করছেন। ওই সূত্র জানিয়েছে, ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ঋণ সমন্বয় করা হচ্ছে অহরহ। যে ব্যাংকেই তদন্ত করা হচ্ছে ওই ব্যাংকেই এমন অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের পর সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন উদ্বেগের বিষয় হলো, গ্রাহকরা উচ্চ আদালতে গিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বেগ প্রকাশ করে খেলাপিদের আটকাতে বিকল্প পদ্ধতি বের করার উদ্যোগ নিচ্ছে। উচ্চ আদালতে রিট করে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে সাময়িক সময়ের জন্য স্থাগিতাদেশ নিলেও তারা জন্য এ সময়ের মধ্যে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা না নিতে পারেন তার পদ্ধতি খোঁজা হচ্ছে। গত সোমাবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে বৈঠকে ঋণখেলাপিরা যেন ঋণ না পান সেজন্য নতুন আইন চান ব্যাংকাররা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। আবার পরিচালনা পর্ষদ মুনাফা বাড়ানোর চাপ দিচ্ছে এমডিদের ওপর। কিন্তু এমডিরা এ বিষয়ে একেবারে যে অসহায় তা কেউ বুঝতে চাইছে না। কারণ বড় বড় ঋণখেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ের জন্য পদক্ষেপ নিতে গেলেই তারা উচ্চ আদালতে রিট করছেন। আবার অনেক সময় বড় বড় ঋণখেলাপিরা রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে ঋণ নবায়ন করতে বলেন। খেলাপিদের আটকাতে ব্যাংক থেকে নবায়ন না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকে তদবির করে বড় বড় খেলাপি বিশেষ বিবেচনায় ঋণ নবায়ন করে নিচ্ছেন। এভাবে বড় বড় ঋণখেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ের হার একেবারেই শূন্যে নেমে গেছে।
No comments