বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজন আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি

একুশ শতকে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে মূলত সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের ওপর। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে শিক্ষিত যুবকদের নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য করার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর, জাপান, চীন, তাইওয়ান ও কোরিয়ায় অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবসমাজ মুখ্য ভূমিকা রাখছে। আমাদের গ্যাস ছাড়া তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, মানবসম্পদই আমাদের বড় সম্পদ। এই মানবসম্পদই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির চালিকাশক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। ১৯৭১ সালে দেশটি যখন স্বাধীন হয়, তখন মাত্র ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখন আছে ৩৮টি। সরকার উচ্চশিক্ষাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি অনুদানের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমতে থাকায় ভবিষ্যতে বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে না। অন্যদিকে ১৯৯৩ সালে ১৪৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮৫। ২৩ বছরের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে: বর্তমানে সংখ্যাটি তিন লাখের বেশি। ভবিষ্যতে আরও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান উন্নত নয়, আন্তর্জাতিক মানের নয়।
এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। নইলে এ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে; বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনে সক্ষম না-ও হতে পারে। কাজেই উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত সনাতন পাঠদান পদ্ধতির পরিবর্তন নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি। আমি পাঠদান শুরু করি অসচেতনভাবে শিক্ষাগুরুদের পাঠদান রীতি অনুকরণ করে, বেশির ভাগ নবীন শিক্ষক যেভাবে শুরু করেন। এটা বলা যায় যে সনাতন পাঠদান পদ্ধতি একুশ শতকের জন্য উপযুক্ত গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে পারছে না, গ্র্যাজুয়েটরা কর্মজীবনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করছেন না। শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তক থেকে পড়ানো নয়, কিংবা শ্রেণিকক্ষে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থেকে শিক্ষকের কথা শোনা নয়। প্রশ্ন-উত্তর পর্ব না থাকায় এবং পাঠদান পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে শিক্ষকনির্ভর হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শক্তি অর্জনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। বর্তমানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষককেন্দ্রিক পাঠদান পদ্ধতির পরিবর্তে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পাঠদান পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে। এই পদ্ধতিতে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকেন।
শিক্ষক তাঁর ক্লাসের শিক্ষার্থীরা কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্বল ও কোন কোন ক্ষেত্রে শক্ত তা ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করে থাকেন। ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্টের জনপ্রিয় টেস্টগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি যেমন (১) কনসেপ্ট টেস্ট, (২) পোর্টফলিও এবং (৩) মাডি টেস্ট। একটি কথা বলা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। শিক্ষকেরা ছাত্র পড়ানোর জন্য বেতন পান, কিন্তু আমাদের অনেকেই আর্থিক প্রাপ্তি ছাড়াই গবেষণার কাজে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে থাকেন। অধ্যাপকেরা তাঁদের গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাপ্ত নতুন ধ্যানধারণা নিয়ে দারুণ উৎসাহ দেখিয়ে থাকেন, পক্ষান্তরে তাঁদের পাঠদান-সম্পর্কিত নতুন পদ্ধতি নিয়ে মোটেই আগ্রহ দেখাতে দেখি না। এ অবস্থার পরিবর্তন হতে হবে। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পাঠদান পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ই পঠিত বিষয়বস্তু নিয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকেন। গ্রুপ ওয়ার্ককে উৎসাহিত করা হয়। তবে বড় আকারের ক্লাসে শিক্ষকের পক্ষে ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে—বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিক্ষককেন্দ্রিক পাঠদান পদ্ধতিতে এক শিক্ষার্থী বিষয়বস্তু বোঝার ব্যাপারে অন্য শিক্ষার্থীর ওপর নির্ভর করেন না। কিছু শিক্ষার্থী এই পদ্ধতি পছন্দ করতে পারেন। আমরা দুই পদ্ধতির সমন্বয়ে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পারি। আমরা ক্লাস টেস্ট এবং এক বা দুটি পরীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমে কোর্সে শিক্ষার্থীদের গ্রেড নির্ধারণ করে থাকি।
পরীক্ষার খারাপ দিক নিয়ে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হয়। ফলে তাঁদের মুখস্থনির্ভর হতে হয়। অনেক শিক্ষাবিদ মনে করেন, উত্তরের জন্য সময় নির্ধারণ বিষয়টি শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায় না, এটা প্রশাসনিক বিষয় হতে পারে। মূলত প্রশাসনিক সুবিধা ও নকল করাকে কঠিন করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়ে থাকতে পারে। পরীক্ষার প্রশ্নগুলো কোর্স শিক্ষক প্রণয়ন করে থাকেন, তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে প্রস্তুত করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। ওপেন বুক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করতে হয় না, তবে সময়ের সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। কোন প্রশ্নের উত্তর কোন বইয়ের কোন অংশে পাওয়া যাবে, তা জানা না থাকলে বিভিন্ন বই ঘাঁটাঘাঁটিতে সময় নষ্ট হয়। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা অনেক সময় পান এবং উত্তরের জন্য তাঁদের মুখস্থনির্ভর হতে হয় না। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় পান, বিভিন্ন সোর্স থেকে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন এবং সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ করার সময় পান। ফলে বিশ্লেষণ ও উদ্ভাবন করার ক্ষমতা অর্জন করতে থাকেন। উল্লেখযোগ্য ত্রুটি হচ্ছে,
অনেক শিক্ষার্থী সমাধানের চেষ্টা না করে অন্য কোনো শিক্ষার্থীর সমাধান নকল করেন। এসব কারণে প্রজেক্টের মাধ্যমে মূল্যায়নের পদ্ধতি দিনে দিনে জনপ্রিয় হচ্ছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও অর্থনীতির চারটি স্তম্ভ হচ্ছে আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও উদ্ভাবন, ই-সার্ভিস ও ডিজিটালাইজেশন। শিক্ষার সব স্তরে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ইংরেজি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জাতির স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য বাংলা ভাষা ও অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিফলিত হতে হবে। বেশিসংখ্যক মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের কোর্স প্রতিটি প্রোগ্রামে পড়াতে হবে, এসব কোর্স শিক্ষার্থীদের সমাজসচেতন করে এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। শিক্ষা পদ্ধতিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। উন্নয়নশীল ও অধিকাংশ উন্নত দেশ সনাতন শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করে Outcome Based Education (OBE) গ্রহণ করেছে। মনে রাখতে হবে,
শিক্ষা একটি বিমূর্ত বিষয়, এর ধারণা গতিশীল। শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। মাত্র ৭১৯ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটারের দেশ সিঙ্গাপুর ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া থেকে আলাদা হওয়ার পর ৫০ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অকল্পনীয় উন্নতি সাধন করেছে। দেশটি তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রারম্ভিক পর্যায়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল-কলেজের আধুনিকায়নের ওপর জোর দিয়েছে; এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে। সিঙ্গাপুর শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রতিটি পর্যায়ে বিদেশি শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছে। ধীরগতির শিক্ষার্থীদের জন্য চার বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছরের বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে। কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিকল্প শিক্ষাধারা প্রবর্তন করেছে। প্রাকৃতিক সম্পদহীন এই দেশটি এখন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখার জন্য জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও অর্থনীতি গড়তে সচেষ্ট। আমাদেরও অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষাদান পদ্ধতি যুগোপযোগী করার সময় এসেছে।
এম এম শহিদুল হাসান: উপাচার্য, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
vc@ewubd.edu

No comments

Powered by Blogger.