অনিয়ম জালিয়াতি কি মিয়ানমারের নির্বাচন ব্যর্থ করে দেবে? by কায়কোবাদ মিলন
পঁচিশ
বছরের মধ্যে এই প্রথম মিয়ানমারে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ৮
নভেম্বর এই নির্বাচন। ভোট যদি সুষ্ঠু হয় এবং বড় বড় দলগুলো যদি এই নির্বাচন
মেনে নেয় সেটাই হবে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। আর এই ফলাফলের ভিত্তিতে ১৯৬০ দশকের
পর মিয়ানমার পাবে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার। নির্বাচনকে ঘিরে
মিয়ানমারের সর্বত্রই উত্তেজনা বিরাজ করছে। দেশজুড়েই চলছে প্রবল নির্বাচনী
আমেজ। এ দিকে মিয়ানমারের কিছু রাজনীতিক ও বিদেশী পর্যবেক্ষককে গত কয়েক
সপ্তাহ ধরেই উদ্বেগাকুল মনে হচ্ছে। তাদের আশঙ্কা, নির্বাচন কিছুতেই সুষ্ঠু ও
নিরপেক্ষ হবে না। এই মহলটি মনে করছে, মিয়ানমারের বহু নাগরিকই ভোটদানের
সুযোগ পাবেন না। তাদের উদ্বেগ, প্রবাসী মিয়ানমারের নাগরিকদের নিয়েও। যেমন,
প্রবাসী মিয়ানমারের নাগরিকদের ভোট প্রদান প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বেশ আগেই।
কিন্তু প্রবাসীদের মধ্যে ব্যালট পেপার যথেষ্ট পরিমাণ বিতরণ করা হলেও এখনো
অনেকে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করতে পারেননি।
অভিযোগ, ব্যালট পেপারের স্বল্পতার জন্যই এই সঙ্কট। মিয়ানমারের ভেতরেও কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশৃঙ্খলা লক্ষণীয়। মিয়ানমারের সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইট বেশির ভাগই সরকার নিয়ন্ত্রিত। স্বভাবতই সরকার নিয়ন্ত্রিত ওই গণমাধ্যমগুলো সরকারের গুণগান প্রচার ও দালালিতে মত্ত। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির তথাকথিত সাফল্য নিয়ে সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া নজিরবিহীনভাবে মুখর। এ দিকে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে বিরোধী দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে হামলার শিকার হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় ইরাওয়াদ্দি ডেলটা অঞ্চলের হামলার কথা। র্যাডিশন বৌদ্ধ মন্দির কর্তৃপক্ষ এবং তাদের সমর্থকেরা পিছু নিয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের। পশ্চিম মিয়ানমারের বহু মুসলমানকে তারা ঘরছাড়া করেছে। ক্যাম্পে অবস্থানরত মুসলমানদেরও তারা বাস্তুচ্যুত করেছে। বৌদ্ধ মন্দিরকেন্দ্রিক সমর্থকেরা বলতে গেলে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা মুসলমানদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বারণ করছে এবং ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এমনকি মুসলমানদের কল্যাণে যাতে কোনো প্রার্থী নির্বাচনী ইশতেহার প্রচার না করেন, সে ব্যাপারেও প্রভাব বিস্তার করা হচ্ছে। প্রবাসী ভোটারদের ব্যালট অপ্রতুলতার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এখন মিয়ানমারের অভ্যন্তরের যেসব এলাকায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান, সেখানকার নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়া নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। বিরোধপূর্ণ এসব এলাকায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কাচিন প্রদেশের কথাই ধরা যাক। এই অঞ্চলের বিদ্রোহীরা সরকারের সাথে অস্ত্র বিরতির চুক্তিতে সই করেনি। অথচ দেশের অন্য সব এলাকার সাথেই সরকারের অস্ত্র বিরতির চুক্তি হয়েছে। ফলে কাচিন এলাকায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন বা ভোটগ্রহণ কঠিন হবে। ফলে এসব ঘটনা ও প্রবণতা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া খুব কঠিন।
তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা, গণমাধ্যমের মতবিশেষের প্রতি সমর্থন এবং ভোট প্রদানের সীমিত সুযোগ সত্ত্বে¡ও মনে করা হচ্ছে, নির্বাচন সুষ্ঠুই হবে। বিশেষ করে প্রকৃত নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুই হবে এবং বিরোধী দলের ফলাফল বেশ ভালোই হবে। মোট কথা, পঁচিশ বছর পর অনুষ্ঠেয় মিয়নামারের নির্বাচন অনুষ্ঠানে কিছু সঙ্কট মোকাবেলা করতে হলেও নিরপেক্ষই হতে পারে নির্বাচন। সামাজিক বিরোধপূর্ণ দেশগুলোতে কিংবা নবীন গণতন্ত্রের দেশ- যেমন ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়ার অনুরূপ নির্বাচন হবে মিয়ানমারে। নির্বাচনী প্রচারণাকালে মিয়ানমারে যে পরিমাণ বিরোধ ও সহিংসতা হয়েছে তাতে প্রতীয়মান হয়- মিলিটারি ও ক্ষমতাসীন ইউএসডিপি যথেষ্ট সংখ্যক আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী এবং উচ্চাকাক্সক্ষী। নির্বাচনের দিন সামরিক বাহিনী ও ক্ষমতাসীন ইউএসডিপি জনগণের সাথে প্রতারণা করার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নামবে, এমনটিও মনে করার কারণ নেই।
তবে ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচন করতে গিয়ে কত গুলো সুবিধা পাচ্ছেন। প্রথমত, রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার কারণে তারা বাড়তি সুযোগ পাবেন। আবার তারা ক্ষমতায় ছিলেন যুগ যুগ ধরে। একই সাথে তারা বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে তারা সামরিক বাহিনী সমর্থিত দল। নির্বাচনী প্রচারণায় যেসব বিশৃঙ্খলা হয়েছে তার মূলেও কিন্তু সরকার সমর্থিতদের এই মনোভাব কাজ করেছে। এ দিকে ভোটার তালিকায় ত্রুটি এবং ভোট প্রদানে প্রতিবন্ধকতার আশঙ্কা সত্ত্বেও মিয়ানমারের জনগণ এনএলডির জয়লাভের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে এবং তারা বিপুলভাবে ভোট দিতে যাবে।
এ দিকে আশঙ্কার কথা হলো, গণমাধ্যম এক দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এই ঝোঁকটা ১৯৯০ সালের নির্বাচন সময়কালের চেয়ে বেশি। ’৯০ সালের নির্বাচনটাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছিল এবং এনএলডি ও তার মিত্ররা সেই নির্বাচনে ব্যাপক জয় পেয়েছিল। তবে আশার কথা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরা নির্বাচনকালে সারা দেশ পরিভ্রমণের অনুমতি লাভ করেছেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, নির্বাচনের দিন পরিস্থিতি শান্ত থাকবে এমনটি ধারণা করা হলেও মিয়ানমারের নির্বাচনের ওপর লক্ষ রেখে চলেছে এমন দেশগুলো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ত্রুটির কারণে উদ্বেগের অবসান ঘটার কোন কারণ দেখছে না । যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নরওয়েসহ যেসব দেশ মিয়ানমারের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে তাদের ধারণা, সামরিক শক্তির সাথে জোটবদ্ধ থেকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন শক্ত কাজ। সামরিক শক্তির সাথে গাঁটছড়া বেঁধে বিদেশীদের কাছ থেকে বড় অংকের বিনিয়োগ আদায় করাও কঠিন হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
Kaikobadmilan1955@gmail.com
অভিযোগ, ব্যালট পেপারের স্বল্পতার জন্যই এই সঙ্কট। মিয়ানমারের ভেতরেও কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশৃঙ্খলা লক্ষণীয়। মিয়ানমারের সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইট বেশির ভাগই সরকার নিয়ন্ত্রিত। স্বভাবতই সরকার নিয়ন্ত্রিত ওই গণমাধ্যমগুলো সরকারের গুণগান প্রচার ও দালালিতে মত্ত। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির তথাকথিত সাফল্য নিয়ে সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া নজিরবিহীনভাবে মুখর। এ দিকে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে বিরোধী দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে হামলার শিকার হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় ইরাওয়াদ্দি ডেলটা অঞ্চলের হামলার কথা। র্যাডিশন বৌদ্ধ মন্দির কর্তৃপক্ষ এবং তাদের সমর্থকেরা পিছু নিয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের। পশ্চিম মিয়ানমারের বহু মুসলমানকে তারা ঘরছাড়া করেছে। ক্যাম্পে অবস্থানরত মুসলমানদেরও তারা বাস্তুচ্যুত করেছে। বৌদ্ধ মন্দিরকেন্দ্রিক সমর্থকেরা বলতে গেলে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা মুসলমানদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বারণ করছে এবং ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এমনকি মুসলমানদের কল্যাণে যাতে কোনো প্রার্থী নির্বাচনী ইশতেহার প্রচার না করেন, সে ব্যাপারেও প্রভাব বিস্তার করা হচ্ছে। প্রবাসী ভোটারদের ব্যালট অপ্রতুলতার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এখন মিয়ানমারের অভ্যন্তরের যেসব এলাকায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান, সেখানকার নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়া নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। বিরোধপূর্ণ এসব এলাকায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কাচিন প্রদেশের কথাই ধরা যাক। এই অঞ্চলের বিদ্রোহীরা সরকারের সাথে অস্ত্র বিরতির চুক্তিতে সই করেনি। অথচ দেশের অন্য সব এলাকার সাথেই সরকারের অস্ত্র বিরতির চুক্তি হয়েছে। ফলে কাচিন এলাকায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন বা ভোটগ্রহণ কঠিন হবে। ফলে এসব ঘটনা ও প্রবণতা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া খুব কঠিন।
তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা, গণমাধ্যমের মতবিশেষের প্রতি সমর্থন এবং ভোট প্রদানের সীমিত সুযোগ সত্ত্বে¡ও মনে করা হচ্ছে, নির্বাচন সুষ্ঠুই হবে। বিশেষ করে প্রকৃত নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুই হবে এবং বিরোধী দলের ফলাফল বেশ ভালোই হবে। মোট কথা, পঁচিশ বছর পর অনুষ্ঠেয় মিয়নামারের নির্বাচন অনুষ্ঠানে কিছু সঙ্কট মোকাবেলা করতে হলেও নিরপেক্ষই হতে পারে নির্বাচন। সামাজিক বিরোধপূর্ণ দেশগুলোতে কিংবা নবীন গণতন্ত্রের দেশ- যেমন ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়ার অনুরূপ নির্বাচন হবে মিয়ানমারে। নির্বাচনী প্রচারণাকালে মিয়ানমারে যে পরিমাণ বিরোধ ও সহিংসতা হয়েছে তাতে প্রতীয়মান হয়- মিলিটারি ও ক্ষমতাসীন ইউএসডিপি যথেষ্ট সংখ্যক আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী এবং উচ্চাকাক্সক্ষী। নির্বাচনের দিন সামরিক বাহিনী ও ক্ষমতাসীন ইউএসডিপি জনগণের সাথে প্রতারণা করার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নামবে, এমনটিও মনে করার কারণ নেই।
তবে ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচন করতে গিয়ে কত গুলো সুবিধা পাচ্ছেন। প্রথমত, রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার কারণে তারা বাড়তি সুযোগ পাবেন। আবার তারা ক্ষমতায় ছিলেন যুগ যুগ ধরে। একই সাথে তারা বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে তারা সামরিক বাহিনী সমর্থিত দল। নির্বাচনী প্রচারণায় যেসব বিশৃঙ্খলা হয়েছে তার মূলেও কিন্তু সরকার সমর্থিতদের এই মনোভাব কাজ করেছে। এ দিকে ভোটার তালিকায় ত্রুটি এবং ভোট প্রদানে প্রতিবন্ধকতার আশঙ্কা সত্ত্বেও মিয়ানমারের জনগণ এনএলডির জয়লাভের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে এবং তারা বিপুলভাবে ভোট দিতে যাবে।
এ দিকে আশঙ্কার কথা হলো, গণমাধ্যম এক দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এই ঝোঁকটা ১৯৯০ সালের নির্বাচন সময়কালের চেয়ে বেশি। ’৯০ সালের নির্বাচনটাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছিল এবং এনএলডি ও তার মিত্ররা সেই নির্বাচনে ব্যাপক জয় পেয়েছিল। তবে আশার কথা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরা নির্বাচনকালে সারা দেশ পরিভ্রমণের অনুমতি লাভ করেছেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, নির্বাচনের দিন পরিস্থিতি শান্ত থাকবে এমনটি ধারণা করা হলেও মিয়ানমারের নির্বাচনের ওপর লক্ষ রেখে চলেছে এমন দেশগুলো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ত্রুটির কারণে উদ্বেগের অবসান ঘটার কোন কারণ দেখছে না । যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নরওয়েসহ যেসব দেশ মিয়ানমারের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে তাদের ধারণা, সামরিক শক্তির সাথে জোটবদ্ধ থেকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন শক্ত কাজ। সামরিক শক্তির সাথে গাঁটছড়া বেঁধে বিদেশীদের কাছ থেকে বড় অংকের বিনিয়োগ আদায় করাও কঠিন হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
Kaikobadmilan1955@gmail.com
No comments