পঁচাত্তরের নভেম্বর: পাল্টা অভ্যুত্থানে জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ by এইচ এম এ গাফফার
পঁচাত্তরের
৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল যখন বঙ্গবন্ধুর
খুনি চক্রকে উৎখাত করার উদ্যোগ নেন, তখন ২২তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের
অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফার। সে সময়ের
ঘটনাবলি ও তাঁর নিজের সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন এই লেখায়।
আগেই বলেছি, ৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পর থেকেই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা জাসদের সদস্য তথা ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামক অবৈধ গোপন দলের সৈনিকেরা একটি প্রতিবিপ্লব শুরু করে। তারা স্বাধীনতাযুদ্ধের ‘ঘোষক’ হিসেবে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে জেনারেল জিয়ার যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল, তা কাজে লাগিয়ে তাদের তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের পক্ষভুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিল। বস্তুত কর্নেল তাহের, হাসানুল হক ইনু প্রমুখেরা জেনারেল জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে নিজেদের জিম্মায় ঢাকা শহরের কোথাও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল জিয়ার প্রতি অনুগত কিছু সৈন্য তাঁকে ঘিরে রেখেছিল এবং নিরাপত্তা দিচ্ছিল। ফলে জিয়াকে গণবাহিনীর হেফাজতে যেতে হয়নি। এমতাবস্থায় বাধ্য হয়েই কর্নেল তাহের নিজেই মে. জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে যান এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ২৩ দফা দাবিদাওয়া তাঁর কাছে উত্থাপন করেন। ধারণা করা হয়, সেই সাক্ষাতের সময়ই কর্নেল তাহের বুঝতে পেরেছিলেন যে জিয়া তাঁর দলের, বিশেষত রাজনৈতিক দাবিদাওয়া মেনে নেবেন না, বরং জিয়া তাঁর নিজের ক্ষমতার ও সমর্থনের ভিত্তিকেই সংগঠিত করে তুলবেন। ষড়যন্ত্র ও নিরপরাধ সেনা অফিসারদের রক্তের পিচ্ছিল পথে জাসদের নেতারা ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল তখনই।
সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট থেকে দ্রুত খবর আসছিল যে সেখানকার কমান্ডাররা ও সাধারণ সৈনিকেরা জেনারেল জিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছে। ঢাকা সেনানিবাসেও জাসদের সদস্যরা বাদে ব্যাপকসংখ্যক সাধারণ সৈন্য জিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছিল। জাসদের মিথ্যা প্রচারণায় এবং আপন মা-ভাইদের কর্মকাণ্ডের কারণে ইতিমধ্যে জেনারেল খালেদ মোশাররফের মতো একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ভারতীয় এজেন্টরূপে ব্র্যান্ড হয়ে গিয়েছিলেন। ৭ নভেম্বর সকালেই খবর ছড়িয়ে পড়ল যে বঙ্গভবন থেকে মে. জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নাজমুল হুদা ও লে. কর্নেল হায়দার একটি জিপ গাড়ি নিয়ে সাভারের দিকে যাওয়ার পথে বিপ্লবীদের হাতে নিহত হয়েছেন। জানা যায় যে জেনারেল জিয়া এঁদের অক্ষত অবস্থায় ও সসম্মানে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা শিকার হয়েছিলেন একটি নির্মম হত্যাকাণ্ডের। তাঁদের নিহত হওয়ার বিষয়ে একাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়।
শোনা যায়, মোহাম্মদপুরের আসাদগেটের কাছে তাঁদের গাড়িটি নষ্ট হয়ে গেলে তাঁরা নির্মীয়মাণ জাতীয় সংসদ ভবনে অবস্থিত ১০ম ইস্ট বেঙ্গলে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পায়ে হেঁটে তাঁরা ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক লে. কর্নেল নওয়াজীশের অফিসে যান। উল্লেখ্য, এই রেজিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ২ নম্বর সেক্টরের অধীন ফেনীর বেলোনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। খালেদ মোশাররফ মনে করেছিলেন, যেহেতু এটি তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তাই তিনি সেখানে আশ্রয় পাবেন। একটি বর্ণনামতে, তাঁরা যখন নওয়াজীশের অফিসে যান, তখন উচ্ছৃঙ্খল বিপ্লবী সৈনিকেরা তাঁদের ঘিরে ধরে এবং তাঁদের ব্যাটালিয়নের গাড়ির গ্যারেজে নিয়ে যায়। শুনেছি তাঁদের তিনটি চেয়ারে বসানো হয় এবং তাঁদের জিজ্ঞেস করা হয় যে মৃত্যুর পূর্বে তাঁদের কোনো চাওয়া-পাওয়া আছে কি না! খালেদ তাঁর পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে ঘাতক সৈনিকদের অনুমতি নিয়ে ধূমপান করেন। সিগারেট খাওয়া শেষ হলে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘ওকে, আই অ্যাম রেডি।’ এরপর তাঁদের প্রথমে গুলি করে এবং পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
অন্য একটি বর্ণনামতে জানা যায়, জিয়ার অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ব্রিগেডিয়ার মীর শওকতের (পরে লে. জেনারেল) ব্যক্তিগত আদেশে লে. কর্নেল নওয়াজীশ তাঁদের হত্যার উদ্যোগ নেন। কথিত আছে, লে. কর্নেল নওয়াজীশের আদেশে ক্যাপ্টেন আসাদ ও ক্যাপ্টেন মনসুর তাঁদের হত্যায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই বর্ণনামতে, মূল হত্যাকারীদের আড়াল করার জন্যই হত্যায় ‘বিপ্লবী সৈনিক’দের জড়িয়ে গল্প ফাঁদা হয়েছিল।
৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে কর্নেল শাফায়াত জামিল বঙ্গভবন থেকে পালানোর সময় পাঁচিল থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে নিজের পা ভেঙে ফেললেন। তাঁকে আহত অবস্থায় সাধারণ মানুষ নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যায়। এ খবর জেনারেল জিয়ার কাছে পৌঁছালে তিনি তাঁকে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার আদেশ দেন এবং তাঁর কোনো ক্ষতি না করার নির্দেশ দেন। এরপর শাফায়াত জামিলকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা সিএমএইচে আনা হয় চিকিৎসার জন্য। এদিকে খালেদ মোশাররফসহ, হুদা ও হায়দারের লাশও ঢাকা সিএমএইচে আনা হলো। সারা দিন তাঁদের আত্মীয়স্বজন অনেক চেষ্টা করল মৃতদেহ দাফনের জন্য, কিন্তু তাঁদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হলো না। পরদিন সকাল ১০টায় খালেদের ছোট বোনের কাছে তাঁর লাশ হস্তান্তর করা হলো জানাজা ও দাফনের জন্য।
জেনারেল জিয়া গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির সদর দপ্তরকে নিজের দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। সেখানে মীর শওকতও ছিলেন। পরবর্তী সময়ে শুনেছি, একজন অফিসার যখন এসে খালেদের মৃতদেহ সিএমএইচে আনা হয়েছে এই মর্মে খবর আনেন, তখন মীর শওকত আলী হাসিমুখে বলেন, ‘হোয়ার আর দ্য আদার বার্ডস?’ কেউ এর কোনো উত্তর মীর শওকতকে দেয়নি।
পট পরিবর্তনের পর ফোর বেঙ্গলের সৈনিকেরা আমার নিরাপত্তার জন্য যারপর নাই চিন্তিত হয়ে পড়ল। সুবেদার ইদ্রিস মিয়ার সিদ্ধান্তে সৈনিকদের একটি সশস্ত্র দল আমাকে এসকর্ট করে নারায়ণগঞ্জে আদমজী জুট মিলে নিয়ে যায়। সৈনিকদের দাবির মুখে জেনারেল জিয়া নিজে প্রতিশ্রুতি দেন যে আমার কোনো শারীরিক বা চাকরির ক্ষতি করা হবে না।
এরপর আমি স্বেচ্ছায় অন্য অনেকের মতোই আমার সৈন্যদেরসহ অস্ত্র সমর্পণ করে বন্দিত্ব বরণ করলাম। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সব অফিসারকে প্রথমে গণভবনে এবং পরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে বন্দী করে রাখা হলো। গণভবনে বন্দী থাকাকালে মীর শওকত, কর্নেল মঞ্জুর (পরে মে. জেনারেল) এবং সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন র্যাঙ্কের ভিআইপিরা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। অনেকে অনেক সান্ত্বনার কথা বলতেন। তাঁদের মুখেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে আমাদের কোর্ট মার্শাল করা হবে।
আমরা তখন গণভবনে বন্দী। আমার পাশের রুমে বন্দী ছিলেন মেজর হাফিজ, ক্যাপ্টেন হাকিমুল্লাহ, মেজর ইকবাল ও ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম। তাঁরা এক রাতে বন্দিদশা থেকে পালালেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত প্রথম ইস্ট বেঙ্গলে পৌঁছে যেতে সক্ষম হন। ওই ব্যাটালিয়নের সৈনিকেরা এই পলাতক অফিসারদের নিজেদের জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। এ অবস্থায় কোনো উপায় না দেখে জিয়াউর রহমান নিজে হেলিকপ্টারে করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলে পৌঁছান। তিনি বহু অনুনয়-বিনয় করে সৈনিকদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তিনি আটক অফিসারদের কোনো ক্ষতি করবেন না।
কিন্তু খালেদ মোশাররফ, হুদা, হায়দারদের পরিণতির কথা মনে রেখে সৈনিকেরা তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পারছিল না। সৈনিকদের দাবির মুখে তিনি বাধ্য হলেন এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিতে যে ঢাকায় ফিরে তিনি সব আটক অফিসারের মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এরপরও সৈনিকেরা তাঁকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারা জিয়াউর রহমানকে বাধ্য করলেন মাথায় পবিত্র কোরআন শরিফ নিয়ে এ ব্যাপারে শপথ করতে। এভাবেই সৈনিকদের ও জিয়াউর রহমানের মধ্যে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি আপসরফা হয়েছিল।
এদিকে আমাদের তথাকথিত কোর্ট মার্শাল শুরু হলো ’৭৬ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাসে। আমাকে যখন কোর্ট মার্শালের চেয়ারম্যান কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) আবদুল লতিফের সামনে নেওয়া হলো, তখন আমি চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে ব্রিগেড কমান্ডারের লিখিত আদেশ পালন করা কি অন্যায়?’ তিনি বললেন, ‘অন্যায় নয়।’ আমি বললাম, ‘যদি অন্যায় না হয়, তাহলে আমার ব্রিগেড কমান্ডারের লিখিত আদেশ পালন করার জন্য আমাকে কি দোষী সাব্যস্ত করা যাবে? (আমি তাঁকে কর্নেল শাফায়াত জামিলের লিখিত আদেশের কপিটি দেখালাম) আমি মনে করি, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।’ কর্নেল লতিফ আমার নিকট থেকে পাওয়া কাগজটি হাতে নিয়ে পড়লেন এবং পরীক্ষা করলেন। এরপর তিনি কোর্ট মার্শাল মুলতবি করলেন এবং পরবর্তী শুনানির একটি তারিখ ঠিক করলেন। আশ্চর্যের বিষয়, সেই পরবর্তী শুনানির দিনটি আর কোনো দিন আসেনি।
জিয়াউর রহমান প্রথম ইস্ট বেঙ্গলে তাঁর দেওয়া কথা অনুসারে আমাদের আর কোনো বিচার করেননি। একদিন সন্ধ্যার পর ডিজিএফআই অফিসার্স মেসে কর্নেল শাফায়াত জামিল ছাড়া আমাদের সব বন্দী অফিসারকে জড়ো করা হলো এই বলে যে জেনারেল জিয়ার পক্ষ থেকে আমাদের মুক্তির সিদ্ধান্ত শোনানো হবে। এমন সময় মেজর জেনারেল এরশাদ, ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী ও ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর আহমেদ সেখানে উপস্থিত হলেন। জেনারেল এরশাদ একটি লিখিত আদেশ পাঠ করে শোনালেন যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (রাষ্ট্রপতি আবু সায়েম ততদিনে অপসারিত হয়েছেন) মে. জেনারেল জিয়াউর রহমান আমাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন এবং অনতিবিলম্বে আমাদের মুক্তি দেওয়া হবে। তবে আমাদের সামরিক বাহিনীর চাকরিতে বহাল রাখা হবে না। লে. কর্নেল এবং তার ওপরের র্যাঙ্কে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হলো এবং মেজর ও তাঁর নিচের র্যাঙ্কে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হলো। আমরা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এই ঘোষিত আদেশ শুনলাম এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিলাম সামরিক বাহিনী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার জন্য। বলা হলো, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যে ক্যান্টনমেন্টে যে যেখানে ছিলেন, সেখান থেকে বিদায় নিতে হবে।
জানতাম নতুন যে জীবন সামনে, সেখানে নতুন করেই শুরু করতে হবে সবকিছু, শূন্য থেকেই।
লে. কর্নেল (অব.) হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফার (বীর উত্তম): অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধকালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক। পরবর্তী সময়ে ২২তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক। জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী।
আগেই বলেছি, ৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পর থেকেই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা জাসদের সদস্য তথা ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামক অবৈধ গোপন দলের সৈনিকেরা একটি প্রতিবিপ্লব শুরু করে। তারা স্বাধীনতাযুদ্ধের ‘ঘোষক’ হিসেবে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে জেনারেল জিয়ার যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল, তা কাজে লাগিয়ে তাদের তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের পক্ষভুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিল। বস্তুত কর্নেল তাহের, হাসানুল হক ইনু প্রমুখেরা জেনারেল জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে নিজেদের জিম্মায় ঢাকা শহরের কোথাও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল জিয়ার প্রতি অনুগত কিছু সৈন্য তাঁকে ঘিরে রেখেছিল এবং নিরাপত্তা দিচ্ছিল। ফলে জিয়াকে গণবাহিনীর হেফাজতে যেতে হয়নি। এমতাবস্থায় বাধ্য হয়েই কর্নেল তাহের নিজেই মে. জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে যান এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ২৩ দফা দাবিদাওয়া তাঁর কাছে উত্থাপন করেন। ধারণা করা হয়, সেই সাক্ষাতের সময়ই কর্নেল তাহের বুঝতে পেরেছিলেন যে জিয়া তাঁর দলের, বিশেষত রাজনৈতিক দাবিদাওয়া মেনে নেবেন না, বরং জিয়া তাঁর নিজের ক্ষমতার ও সমর্থনের ভিত্তিকেই সংগঠিত করে তুলবেন। ষড়যন্ত্র ও নিরপরাধ সেনা অফিসারদের রক্তের পিচ্ছিল পথে জাসদের নেতারা ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল তখনই।
সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট থেকে দ্রুত খবর আসছিল যে সেখানকার কমান্ডাররা ও সাধারণ সৈনিকেরা জেনারেল জিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছে। ঢাকা সেনানিবাসেও জাসদের সদস্যরা বাদে ব্যাপকসংখ্যক সাধারণ সৈন্য জিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছিল। জাসদের মিথ্যা প্রচারণায় এবং আপন মা-ভাইদের কর্মকাণ্ডের কারণে ইতিমধ্যে জেনারেল খালেদ মোশাররফের মতো একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ভারতীয় এজেন্টরূপে ব্র্যান্ড হয়ে গিয়েছিলেন। ৭ নভেম্বর সকালেই খবর ছড়িয়ে পড়ল যে বঙ্গভবন থেকে মে. জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নাজমুল হুদা ও লে. কর্নেল হায়দার একটি জিপ গাড়ি নিয়ে সাভারের দিকে যাওয়ার পথে বিপ্লবীদের হাতে নিহত হয়েছেন। জানা যায় যে জেনারেল জিয়া এঁদের অক্ষত অবস্থায় ও সসম্মানে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা শিকার হয়েছিলেন একটি নির্মম হত্যাকাণ্ডের। তাঁদের নিহত হওয়ার বিষয়ে একাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়।
শোনা যায়, মোহাম্মদপুরের আসাদগেটের কাছে তাঁদের গাড়িটি নষ্ট হয়ে গেলে তাঁরা নির্মীয়মাণ জাতীয় সংসদ ভবনে অবস্থিত ১০ম ইস্ট বেঙ্গলে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পায়ে হেঁটে তাঁরা ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক লে. কর্নেল নওয়াজীশের অফিসে যান। উল্লেখ্য, এই রেজিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ২ নম্বর সেক্টরের অধীন ফেনীর বেলোনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। খালেদ মোশাররফ মনে করেছিলেন, যেহেতু এটি তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তাই তিনি সেখানে আশ্রয় পাবেন। একটি বর্ণনামতে, তাঁরা যখন নওয়াজীশের অফিসে যান, তখন উচ্ছৃঙ্খল বিপ্লবী সৈনিকেরা তাঁদের ঘিরে ধরে এবং তাঁদের ব্যাটালিয়নের গাড়ির গ্যারেজে নিয়ে যায়। শুনেছি তাঁদের তিনটি চেয়ারে বসানো হয় এবং তাঁদের জিজ্ঞেস করা হয় যে মৃত্যুর পূর্বে তাঁদের কোনো চাওয়া-পাওয়া আছে কি না! খালেদ তাঁর পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে ঘাতক সৈনিকদের অনুমতি নিয়ে ধূমপান করেন। সিগারেট খাওয়া শেষ হলে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘ওকে, আই অ্যাম রেডি।’ এরপর তাঁদের প্রথমে গুলি করে এবং পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
অন্য একটি বর্ণনামতে জানা যায়, জিয়ার অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ব্রিগেডিয়ার মীর শওকতের (পরে লে. জেনারেল) ব্যক্তিগত আদেশে লে. কর্নেল নওয়াজীশ তাঁদের হত্যার উদ্যোগ নেন। কথিত আছে, লে. কর্নেল নওয়াজীশের আদেশে ক্যাপ্টেন আসাদ ও ক্যাপ্টেন মনসুর তাঁদের হত্যায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই বর্ণনামতে, মূল হত্যাকারীদের আড়াল করার জন্যই হত্যায় ‘বিপ্লবী সৈনিক’দের জড়িয়ে গল্প ফাঁদা হয়েছিল।
৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে কর্নেল শাফায়াত জামিল বঙ্গভবন থেকে পালানোর সময় পাঁচিল থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে নিজের পা ভেঙে ফেললেন। তাঁকে আহত অবস্থায় সাধারণ মানুষ নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যায়। এ খবর জেনারেল জিয়ার কাছে পৌঁছালে তিনি তাঁকে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার আদেশ দেন এবং তাঁর কোনো ক্ষতি না করার নির্দেশ দেন। এরপর শাফায়াত জামিলকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা সিএমএইচে আনা হয় চিকিৎসার জন্য। এদিকে খালেদ মোশাররফসহ, হুদা ও হায়দারের লাশও ঢাকা সিএমএইচে আনা হলো। সারা দিন তাঁদের আত্মীয়স্বজন অনেক চেষ্টা করল মৃতদেহ দাফনের জন্য, কিন্তু তাঁদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হলো না। পরদিন সকাল ১০টায় খালেদের ছোট বোনের কাছে তাঁর লাশ হস্তান্তর করা হলো জানাজা ও দাফনের জন্য।
জেনারেল জিয়া গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির সদর দপ্তরকে নিজের দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। সেখানে মীর শওকতও ছিলেন। পরবর্তী সময়ে শুনেছি, একজন অফিসার যখন এসে খালেদের মৃতদেহ সিএমএইচে আনা হয়েছে এই মর্মে খবর আনেন, তখন মীর শওকত আলী হাসিমুখে বলেন, ‘হোয়ার আর দ্য আদার বার্ডস?’ কেউ এর কোনো উত্তর মীর শওকতকে দেয়নি।
পট পরিবর্তনের পর ফোর বেঙ্গলের সৈনিকেরা আমার নিরাপত্তার জন্য যারপর নাই চিন্তিত হয়ে পড়ল। সুবেদার ইদ্রিস মিয়ার সিদ্ধান্তে সৈনিকদের একটি সশস্ত্র দল আমাকে এসকর্ট করে নারায়ণগঞ্জে আদমজী জুট মিলে নিয়ে যায়। সৈনিকদের দাবির মুখে জেনারেল জিয়া নিজে প্রতিশ্রুতি দেন যে আমার কোনো শারীরিক বা চাকরির ক্ষতি করা হবে না।
এরপর আমি স্বেচ্ছায় অন্য অনেকের মতোই আমার সৈন্যদেরসহ অস্ত্র সমর্পণ করে বন্দিত্ব বরণ করলাম। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সব অফিসারকে প্রথমে গণভবনে এবং পরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে বন্দী করে রাখা হলো। গণভবনে বন্দী থাকাকালে মীর শওকত, কর্নেল মঞ্জুর (পরে মে. জেনারেল) এবং সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন র্যাঙ্কের ভিআইপিরা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। অনেকে অনেক সান্ত্বনার কথা বলতেন। তাঁদের মুখেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে আমাদের কোর্ট মার্শাল করা হবে।
আমরা তখন গণভবনে বন্দী। আমার পাশের রুমে বন্দী ছিলেন মেজর হাফিজ, ক্যাপ্টেন হাকিমুল্লাহ, মেজর ইকবাল ও ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম। তাঁরা এক রাতে বন্দিদশা থেকে পালালেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত প্রথম ইস্ট বেঙ্গলে পৌঁছে যেতে সক্ষম হন। ওই ব্যাটালিয়নের সৈনিকেরা এই পলাতক অফিসারদের নিজেদের জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। এ অবস্থায় কোনো উপায় না দেখে জিয়াউর রহমান নিজে হেলিকপ্টারে করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলে পৌঁছান। তিনি বহু অনুনয়-বিনয় করে সৈনিকদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তিনি আটক অফিসারদের কোনো ক্ষতি করবেন না।
কিন্তু খালেদ মোশাররফ, হুদা, হায়দারদের পরিণতির কথা মনে রেখে সৈনিকেরা তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পারছিল না। সৈনিকদের দাবির মুখে তিনি বাধ্য হলেন এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিতে যে ঢাকায় ফিরে তিনি সব আটক অফিসারের মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এরপরও সৈনিকেরা তাঁকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারা জিয়াউর রহমানকে বাধ্য করলেন মাথায় পবিত্র কোরআন শরিফ নিয়ে এ ব্যাপারে শপথ করতে। এভাবেই সৈনিকদের ও জিয়াউর রহমানের মধ্যে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি আপসরফা হয়েছিল।
এদিকে আমাদের তথাকথিত কোর্ট মার্শাল শুরু হলো ’৭৬ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাসে। আমাকে যখন কোর্ট মার্শালের চেয়ারম্যান কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) আবদুল লতিফের সামনে নেওয়া হলো, তখন আমি চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে ব্রিগেড কমান্ডারের লিখিত আদেশ পালন করা কি অন্যায়?’ তিনি বললেন, ‘অন্যায় নয়।’ আমি বললাম, ‘যদি অন্যায় না হয়, তাহলে আমার ব্রিগেড কমান্ডারের লিখিত আদেশ পালন করার জন্য আমাকে কি দোষী সাব্যস্ত করা যাবে? (আমি তাঁকে কর্নেল শাফায়াত জামিলের লিখিত আদেশের কপিটি দেখালাম) আমি মনে করি, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।’ কর্নেল লতিফ আমার নিকট থেকে পাওয়া কাগজটি হাতে নিয়ে পড়লেন এবং পরীক্ষা করলেন। এরপর তিনি কোর্ট মার্শাল মুলতবি করলেন এবং পরবর্তী শুনানির একটি তারিখ ঠিক করলেন। আশ্চর্যের বিষয়, সেই পরবর্তী শুনানির দিনটি আর কোনো দিন আসেনি।
জিয়াউর রহমান প্রথম ইস্ট বেঙ্গলে তাঁর দেওয়া কথা অনুসারে আমাদের আর কোনো বিচার করেননি। একদিন সন্ধ্যার পর ডিজিএফআই অফিসার্স মেসে কর্নেল শাফায়াত জামিল ছাড়া আমাদের সব বন্দী অফিসারকে জড়ো করা হলো এই বলে যে জেনারেল জিয়ার পক্ষ থেকে আমাদের মুক্তির সিদ্ধান্ত শোনানো হবে। এমন সময় মেজর জেনারেল এরশাদ, ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী ও ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর আহমেদ সেখানে উপস্থিত হলেন। জেনারেল এরশাদ একটি লিখিত আদেশ পাঠ করে শোনালেন যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (রাষ্ট্রপতি আবু সায়েম ততদিনে অপসারিত হয়েছেন) মে. জেনারেল জিয়াউর রহমান আমাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন এবং অনতিবিলম্বে আমাদের মুক্তি দেওয়া হবে। তবে আমাদের সামরিক বাহিনীর চাকরিতে বহাল রাখা হবে না। লে. কর্নেল এবং তার ওপরের র্যাঙ্কে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হলো এবং মেজর ও তাঁর নিচের র্যাঙ্কে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হলো। আমরা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এই ঘোষিত আদেশ শুনলাম এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিলাম সামরিক বাহিনী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার জন্য। বলা হলো, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যে ক্যান্টনমেন্টে যে যেখানে ছিলেন, সেখান থেকে বিদায় নিতে হবে।
জানতাম নতুন যে জীবন সামনে, সেখানে নতুন করেই শুরু করতে হবে সবকিছু, শূন্য থেকেই।
লে. কর্নেল (অব.) হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফার (বীর উত্তম): অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধকালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক। পরবর্তী সময়ে ২২তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক। জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী।
No comments