রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য by আলী ইমাম মজুমদার
রাষ্ট্রপতি
সম্প্রতি নিজ জেলা কিশোরগঞ্জ সফরকালে বলেছেন, ‘রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে
চলে গেছে।’ তিনি আরও বলেছেন, এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এবং এ অবস্থা
থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এমনই কথা বলেছেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিও।
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্যে আমাদের রাজনীতিতে
ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিক মাত্রায় অংশগ্রহণের বিষয়টিকে বেদনাহত বলে
উল্লেখ করেন। তিনি এটাও বলেন যে উন্নত দেশগুলোর আইনপ্রণেতাদের সিংহভাগ
আইনের ছাত্র। আর আমাদের দেশে ঘটে চলছে এর বিপরীত ঘটনা। চলমান রাজনীতির এ
দিকটির সুবিধাভোগীরা ছাড়া দেশে রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধান বিচারপতির
বক্তব্যের বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ নেই।
রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার হাতিয়ার। রাজনীতিবিদেরাই হন দলের নীতিনির্ধারক, আইনপ্রণেতা কিংবা মন্ত্রী। তাঁরাই হন সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান। আমাদের উপমহাদেশে আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। তখন দুটি প্রধান দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ছিলেন মূলত আইনজীবীরা। সমাজের অন্য পেশাজীবীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থাকলেও মূল ভূমিকায় আইনজীবীরাই থাকতেন। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরাও অবশ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করতেন দলগুলোকে। তাঁদের কেউ কেউ দলের নীতিনির্ধারণী পদ, আইনপ্রণেতা বা মন্ত্রী হয়েছেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তবে তুলনামূলক বিচারে তা ছিল অতি স্বল্প অনুপাতে। ছাত্রজীবনেই আইন পড়ে ওকালতি ও পাশাপাশি রাজনীতি করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন কেউ কেউ। সেভাবেই তাঁরা পেশা বা রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে সক্রিয়ও থাকতেন।
তখন ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা সন্তুষ্ট ছিলেন নিজ অবস্থানে। তবে রাজনৈতিক দল বা নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপনে একটি সুসম্পর্ক রাখার প্রয়োজন তাঁরা সব সময়ই অনুধাবন করে এসেছেন। আর রাজনৈতিক নেতারাও এ বিষয়ে তাঁদের বিমুখ করতেন না। গরজটা ছিল উভয় পক্ষেরই। দল চালাতে, নির্বাচন করতে টাকা লাগে। তা জোগান দিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরাই। এ ধরনের সম্পর্কের সুফল নিতেও ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা স্বাভাবিকভাবেই সচেষ্ট ছিলেন। রাষ্ট্রশক্তির শুভেচ্ছা তাঁদের প্রয়োজন হয়। আর সে শুভেচ্ছা আসতে পারে ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিকের কাছ থেকে। বিরোধী দলও কোনো সময়ে ক্ষমতায় চলে আসতে পারে, এটাও তাঁদের অনেকেই বিবেচনায় রাখেন। আর সে বিবেচনা থেকেই বিস্তার ঘটান সম্পর্ক।
রাষ্ট্র পরিচালনা একটি ব্যাপক বিষয়। এর তিনটি প্রধান অঙ্গের দুটি হলো নির্বাহী বিভাগ ও জাতীয় সংসদ। সংসদীয় ব্যবস্থায় এ দুটি একে অন্যের পরিপূরক। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব মূলত সরকারের। তাদের সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার স্বার্থ বিবেচনায় নিতে হয়। সরকার গঠিত হয় জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সাংসদদের মধ্য থেকে। তাঁরা সংসদের কাছে জবাবদিহিও করেন। সরকার পরিচালনার জন্য আইন প্রণয়ন, করারোপ ও অর্থ বরাদ্দের কর্তৃত্ব জাতীয় সংসদের। রাজনীতিবিদেরা সমাজের সব স্তরের মানুষের চাহিদা সম্পর্কে অবগত। অনেক দেশেই তাঁদের অনেকে আইন পেশা থেকে আসেন। আমাদের ঐতিহ্যও তা-ই ছিল। আর আইন পেশা থেকে না এলেও তরুণ বয়স থেকে সারাক্ষণ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে জনগণের প্রত্যাশা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণাই থাকে তাঁদের। যেমনটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কিংবা মাওলানা ভাসানীর মতো নেতাদের।
তরুণ বয়স থেকে সারাক্ষণ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে জনগণের প্রত্যাশা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণাই থাকে তাঁদের। যেমনটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কিংবা মাওলানা ভাসানীর মতো নেতাদের তবে রাজনীতিতে এবং মূলত জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রবল আধিক্য রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে তাঁদের প্রতি অতিরিক্ত আনুকূল্য দেখানোর ঝুঁকি থাকে। একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে গত সময়ে কয়েকটি নির্বাচনের তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, ১৯৫৪, ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে নির্বাচিত সাংসদদের মাঝে ব্যবসায়ীদের অনুপাত ছিল যথাক্রমে ৪, ১৩, ৩৪, ৪৮, ৫১ ও ৬৩। তাহলে এতে কোনো ভিন্নমত পোষণের সুযোগ নেই যে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের হাতে ক্রমবর্ধমান হারে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে। অন্য পেশাজীবীরা ক্রমান্বয়ে চলে যাচ্ছেন প্রান্তিক অবস্থানে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা সমাজের অত্যন্ত আবশ্যকীয় ও সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁরা ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করেন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সে বিনিয়োগের সুফলও ভোগ করেন বটে। তবে এর সুফল বহুমাত্রিক। প্রধানত কর্মসংস্থান হয়। তা ছাড়া, বিনিয়োগের ফলে দেশের ব্যাংক, বিমা, পরিবহন অবকাঠামোসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধির ধারা দেখা দেয়। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বেড়ে যায় ভোগ। এতে উৎপাদন ও আমদানি বাড়ে। সরকার আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক পায়। এ শ্রেণিটিকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। আজ দেশে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে, এতে তাঁদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। সে ভূমিকা জোরদার করতে সরকার তাঁদের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেয়। তবে নীতিনির্ধারণে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ভূমিকার জন্য কোনো কোনো আনুকূল্যের মাত্রা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
আর রাজনীতিতে তাঁদের প্রবেশের বিষয়? তাঁরা জোর করে এ অবস্থানে আসেননি। ক্ষেত্রবিশেষে ডেকে আনা হয়েছে। রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এখানে অসংগত হবে না। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর দুটি সামরিক শাসনকালে ক্ষমতাসীনেরা নতুন রাজনৈতিক দল গড়তে গিয়ে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের একটি অংশকে রাজনীতিতে টেনে এনেছেন। আবার তখনকার নির্বাচনগুলোও ছিল মূলত নিয়ন্ত্রিত এবং কোনোটা ভোটারবিহীন। তাই নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজন হতো না। আবার অনেক পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদকে নিজের দলে নিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে বেশুমার ঋণ দিয়ে ব্যবসায়ী বানিয়ে ফেলা হয়। সে অগ্রযাত্রা আর থেমে রইল না। ১৯৯০-এর পটপরিবর্তনের পরেও রাজনীতি ক্রমান্বয়ে তাঁদের হাতেই যাচ্ছে। এর জন্য অবশ্য নিন্দুকেরা মনোনয়ন-বাণিজ্য নামের একটি অনাসৃষ্টির কথা বলে থাকেন।
সেটা যা-ই হোক, প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা যে আজ রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন, এটা তো তথ্যই বলে দিচ্ছে। আরেকটি দিক, ভালো ছাত্রদের রাজনীতির প্রতি অনীহা এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থ রাজনীতির প্রতিকূল পরিবেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় না আজ প্রায় সিকি শতাব্দী। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও একই রকম। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও বেশ কিছু নেতা এসে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এখনো কেউ কেউ রাখছেন। তবে তাঁদের প্রকৃত উত্তরসূরি নেই বললে ভুল হবে না। তাহলে রাজনীতিবিদ আসবেন কোথা থেকে, এটা কি আমাদের সত্যিকারের রাজনীতিকেরা চিন্তা করেন না! রাজনীতিবিদ হঠাৎ করে হওয়া যায় না। এর জন্য অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে পথ পাড়ি দিতে হয়। এ অবস্থায় রাজনীতিকের শূন্যস্থান পূরণ করতে নিয়ে আসা হচ্ছে ব্যবসায়ী এবং সামরিক ও বেসামরিক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের। অবশ্য রাজনীতি করার অধিকার সবারই আছে। অধিকার আছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারও। তবে দেশের প্রধান দুটো দল এ বিষয়ে কোনো সচেতন উদ্যোগ না নিয়ে বরং বিপরীত ধারাতে চলছে বললে অত্যুক্তি হবে না। দেশকে বিরাজনীতিকরণের দায় তাদের ওপরও আসে।
রাষ্ট্রপতি প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে। কিন্তু তা করতে হলে দেশের চলমান রাজনীতিকে নিয়ে আসতে হবে একটি মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থানে। নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও অপরিহার্য। দলগুলোর মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। থাকবে না শত্রুতা এবং অকারণে চরিত্র হননের প্রচেষ্টা। এমনটা করা গেলে দেশের সব শ্রেণি, পেশার উৎকৃষ্ট লোকেরাই রাজনীতিতে আসবেন। তাঁরা তাঁদের শ্রম ও মেধায় উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি করবেন দেশ ও জাতিকে। আর এর বিপরীতটা কী হয়, তার নজির আমাদের সামনেই রয়েছে। রাজনীতিবিদেরা নির্বাসিত হতে চলেছেন রাজনীতি থেকে। চালকের আসনে ক্রমান্বয়ে অবস্থান নিচ্ছেন ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে বাণিজ্য করতে এসেছিল। কিন্তু তখনকার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ইত্যাদি সুযোগে তারা নিয়ে নেয় রাষ্ট্রক্ষমতা। সে সময়কার অবস্থার কথাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিবাজি-উৎসব’ কবিতায় লিখেছেন:
‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী
রাজদণ্ডরূপে।।’
এ বক্তব্য আজকের পরিপ্রেক্ষিতেও প্রাসঙ্গিক। আমরা কিন্তু চাই রাজদণ্ড থাকুক রাজনীতিবিদদের হাতেই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার হাতিয়ার। রাজনীতিবিদেরাই হন দলের নীতিনির্ধারক, আইনপ্রণেতা কিংবা মন্ত্রী। তাঁরাই হন সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান। আমাদের উপমহাদেশে আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। তখন দুটি প্রধান দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ছিলেন মূলত আইনজীবীরা। সমাজের অন্য পেশাজীবীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থাকলেও মূল ভূমিকায় আইনজীবীরাই থাকতেন। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরাও অবশ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করতেন দলগুলোকে। তাঁদের কেউ কেউ দলের নীতিনির্ধারণী পদ, আইনপ্রণেতা বা মন্ত্রী হয়েছেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তবে তুলনামূলক বিচারে তা ছিল অতি স্বল্প অনুপাতে। ছাত্রজীবনেই আইন পড়ে ওকালতি ও পাশাপাশি রাজনীতি করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন কেউ কেউ। সেভাবেই তাঁরা পেশা বা রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে সক্রিয়ও থাকতেন।
তখন ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা সন্তুষ্ট ছিলেন নিজ অবস্থানে। তবে রাজনৈতিক দল বা নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপনে একটি সুসম্পর্ক রাখার প্রয়োজন তাঁরা সব সময়ই অনুধাবন করে এসেছেন। আর রাজনৈতিক নেতারাও এ বিষয়ে তাঁদের বিমুখ করতেন না। গরজটা ছিল উভয় পক্ষেরই। দল চালাতে, নির্বাচন করতে টাকা লাগে। তা জোগান দিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরাই। এ ধরনের সম্পর্কের সুফল নিতেও ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা স্বাভাবিকভাবেই সচেষ্ট ছিলেন। রাষ্ট্রশক্তির শুভেচ্ছা তাঁদের প্রয়োজন হয়। আর সে শুভেচ্ছা আসতে পারে ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিকের কাছ থেকে। বিরোধী দলও কোনো সময়ে ক্ষমতায় চলে আসতে পারে, এটাও তাঁদের অনেকেই বিবেচনায় রাখেন। আর সে বিবেচনা থেকেই বিস্তার ঘটান সম্পর্ক।
রাষ্ট্র পরিচালনা একটি ব্যাপক বিষয়। এর তিনটি প্রধান অঙ্গের দুটি হলো নির্বাহী বিভাগ ও জাতীয় সংসদ। সংসদীয় ব্যবস্থায় এ দুটি একে অন্যের পরিপূরক। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব মূলত সরকারের। তাদের সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার স্বার্থ বিবেচনায় নিতে হয়। সরকার গঠিত হয় জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সাংসদদের মধ্য থেকে। তাঁরা সংসদের কাছে জবাবদিহিও করেন। সরকার পরিচালনার জন্য আইন প্রণয়ন, করারোপ ও অর্থ বরাদ্দের কর্তৃত্ব জাতীয় সংসদের। রাজনীতিবিদেরা সমাজের সব স্তরের মানুষের চাহিদা সম্পর্কে অবগত। অনেক দেশেই তাঁদের অনেকে আইন পেশা থেকে আসেন। আমাদের ঐতিহ্যও তা-ই ছিল। আর আইন পেশা থেকে না এলেও তরুণ বয়স থেকে সারাক্ষণ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে জনগণের প্রত্যাশা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণাই থাকে তাঁদের। যেমনটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কিংবা মাওলানা ভাসানীর মতো নেতাদের।
তরুণ বয়স থেকে সারাক্ষণ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে জনগণের প্রত্যাশা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণাই থাকে তাঁদের। যেমনটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কিংবা মাওলানা ভাসানীর মতো নেতাদের তবে রাজনীতিতে এবং মূলত জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রবল আধিক্য রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে তাঁদের প্রতি অতিরিক্ত আনুকূল্য দেখানোর ঝুঁকি থাকে। একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে গত সময়ে কয়েকটি নির্বাচনের তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, ১৯৫৪, ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে নির্বাচিত সাংসদদের মাঝে ব্যবসায়ীদের অনুপাত ছিল যথাক্রমে ৪, ১৩, ৩৪, ৪৮, ৫১ ও ৬৩। তাহলে এতে কোনো ভিন্নমত পোষণের সুযোগ নেই যে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের হাতে ক্রমবর্ধমান হারে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে। অন্য পেশাজীবীরা ক্রমান্বয়ে চলে যাচ্ছেন প্রান্তিক অবস্থানে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা সমাজের অত্যন্ত আবশ্যকীয় ও সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁরা ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করেন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সে বিনিয়োগের সুফলও ভোগ করেন বটে। তবে এর সুফল বহুমাত্রিক। প্রধানত কর্মসংস্থান হয়। তা ছাড়া, বিনিয়োগের ফলে দেশের ব্যাংক, বিমা, পরিবহন অবকাঠামোসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধির ধারা দেখা দেয়। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বেড়ে যায় ভোগ। এতে উৎপাদন ও আমদানি বাড়ে। সরকার আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক পায়। এ শ্রেণিটিকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। আজ দেশে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে, এতে তাঁদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। সে ভূমিকা জোরদার করতে সরকার তাঁদের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেয়। তবে নীতিনির্ধারণে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ভূমিকার জন্য কোনো কোনো আনুকূল্যের মাত্রা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
আর রাজনীতিতে তাঁদের প্রবেশের বিষয়? তাঁরা জোর করে এ অবস্থানে আসেননি। ক্ষেত্রবিশেষে ডেকে আনা হয়েছে। রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এখানে অসংগত হবে না। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর দুটি সামরিক শাসনকালে ক্ষমতাসীনেরা নতুন রাজনৈতিক দল গড়তে গিয়ে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের একটি অংশকে রাজনীতিতে টেনে এনেছেন। আবার তখনকার নির্বাচনগুলোও ছিল মূলত নিয়ন্ত্রিত এবং কোনোটা ভোটারবিহীন। তাই নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজন হতো না। আবার অনেক পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদকে নিজের দলে নিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে বেশুমার ঋণ দিয়ে ব্যবসায়ী বানিয়ে ফেলা হয়। সে অগ্রযাত্রা আর থেমে রইল না। ১৯৯০-এর পটপরিবর্তনের পরেও রাজনীতি ক্রমান্বয়ে তাঁদের হাতেই যাচ্ছে। এর জন্য অবশ্য নিন্দুকেরা মনোনয়ন-বাণিজ্য নামের একটি অনাসৃষ্টির কথা বলে থাকেন।
সেটা যা-ই হোক, প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা যে আজ রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন, এটা তো তথ্যই বলে দিচ্ছে। আরেকটি দিক, ভালো ছাত্রদের রাজনীতির প্রতি অনীহা এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থ রাজনীতির প্রতিকূল পরিবেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় না আজ প্রায় সিকি শতাব্দী। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও একই রকম। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও বেশ কিছু নেতা এসে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এখনো কেউ কেউ রাখছেন। তবে তাঁদের প্রকৃত উত্তরসূরি নেই বললে ভুল হবে না। তাহলে রাজনীতিবিদ আসবেন কোথা থেকে, এটা কি আমাদের সত্যিকারের রাজনীতিকেরা চিন্তা করেন না! রাজনীতিবিদ হঠাৎ করে হওয়া যায় না। এর জন্য অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে পথ পাড়ি দিতে হয়। এ অবস্থায় রাজনীতিকের শূন্যস্থান পূরণ করতে নিয়ে আসা হচ্ছে ব্যবসায়ী এবং সামরিক ও বেসামরিক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের। অবশ্য রাজনীতি করার অধিকার সবারই আছে। অধিকার আছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারও। তবে দেশের প্রধান দুটো দল এ বিষয়ে কোনো সচেতন উদ্যোগ না নিয়ে বরং বিপরীত ধারাতে চলছে বললে অত্যুক্তি হবে না। দেশকে বিরাজনীতিকরণের দায় তাদের ওপরও আসে।
রাষ্ট্রপতি প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে। কিন্তু তা করতে হলে দেশের চলমান রাজনীতিকে নিয়ে আসতে হবে একটি মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থানে। নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও অপরিহার্য। দলগুলোর মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। থাকবে না শত্রুতা এবং অকারণে চরিত্র হননের প্রচেষ্টা। এমনটা করা গেলে দেশের সব শ্রেণি, পেশার উৎকৃষ্ট লোকেরাই রাজনীতিতে আসবেন। তাঁরা তাঁদের শ্রম ও মেধায় উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি করবেন দেশ ও জাতিকে। আর এর বিপরীতটা কী হয়, তার নজির আমাদের সামনেই রয়েছে। রাজনীতিবিদেরা নির্বাসিত হতে চলেছেন রাজনীতি থেকে। চালকের আসনে ক্রমান্বয়ে অবস্থান নিচ্ছেন ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে বাণিজ্য করতে এসেছিল। কিন্তু তখনকার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ইত্যাদি সুযোগে তারা নিয়ে নেয় রাষ্ট্রক্ষমতা। সে সময়কার অবস্থার কথাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিবাজি-উৎসব’ কবিতায় লিখেছেন:
‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী
রাজদণ্ডরূপে।।’
এ বক্তব্য আজকের পরিপ্রেক্ষিতেও প্রাসঙ্গিক। আমরা কিন্তু চাই রাজদণ্ড থাকুক রাজনীতিবিদদের হাতেই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
No comments