আইএস-ত্যাগীদের গল্প
জঙ্গিগোষ্ঠী
আইএসে তরুণ-তরুণীদের যোগদানের বিষয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। তাদের জীবনের
ইতিহাস, ব্যাকগ্রাউন্ড ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা জানি। কিন্তু যারা আইএস
ছাড়ছে, তাদের সম্পর্কে খুব কমই আলোচনা হয়। ফিরে আসা এসব তরুণ-তরুণী যা
দেখেছেন আইএসের মাঝে, তা তারা পছন্দ করেননি। ফলে নিজ সঙ্গীদের ত্যাগ করে
আইএসের শিবির ছেড়ে পালিয়েছেন তারা। আইএসে বিদেশীদের যোগদানের যে প্রবাহ, তা
ঠেকাতে কাজে লাগতে পারে এদের অভিজ্ঞতা। জঙ্গিগোষ্ঠীটির অপপ্রচার প্রতিরোধে
এবং তাদের শঠতা ও মিথ্যা প্রকাশেও কাজে লাগানো যেতে পারে এদের। কিংস
কলেজের সিকিউরিটি স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক পিটার আর. নিউম্যান আইএস ছেড়ে
পালিয়ে আসা ৫৮ জনের খোঁজ পেয়েছেন। হয়তো সংখ্যাটি কম। কিন্তু যাদের মোহভঙ্গ
হয়েছে বা যারা আইএস ত্যাগ করতে প্রস্তুত, তাদের সংখ্যা অনেক। অনেকেই উপায়
খুঁজছেন পালাবার, কিন্তু পারছেন না। যে ৫৮ জনের খোঁজ পেয়েছেন নিউম্যান,
তাদের দুই-তৃতীয়াংশই পালিয়েছেন ২০১৫ সালে। আবার এক-তৃতীয়াংশ পালিয়েছেন
সদ্যসমাপ্ত গ্রীষ্মে। ফলে বলা যায়, ক্রমেই বাড়ছে আইএস ত্যাগ করা এসব
মানুষের সংখ্যা। এদের অভিজ্ঞতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। নিউম্যান সিএনএনে
লিখেছেন, এদের সবাই যে উদারপন্থি গণতন্ত্রের সমর্থক, তা নয়। এদের অনেকেই
আবার অপরাধ সংঘটন করেছেন। তাদের সবার মধ্যে মিল হলো, এক সময় আমাদের
প্রজন্মের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও সহিংস গোষ্ঠী আইএসের বড় ধরনের সমর্থক ছিলেন।
কিন্তু এখন এ দলছুট যুবকরাই হয়তো আইএসের সবচেয়ে বড় শত্রু । ৫৮ জনের দেয়া
স্বীকারোক্তির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আইএস ত্যাগ করার কারণ সবার ক্ষেত্রেই
পরিষ্কার নয়। সামগ্রিকভাবে এটা বলা যায়, তাদের গল্পে গ্রহণযোগ্যতা থাকে,
যখন তাদের বার্তার মধ্যে যুক্তি থাকে। ৫৮ জনের বর্ণনাকে চার ভাগে ভাগ করা
যায়, যেগুলো বেশ শক্ত। সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো, এ গোষ্ঠীটি সিরিয়ার অন্য
সরকার-বিরোধী সুন্নি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও লড়াই করছে। দলছুট সাবেক আইএসের
এসব সদস্যের মতে, সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের সরকার উৎখাত করা আইএসের
অগ্রাধিকার নয়। এছাড়া আসাদ সরকারের আক্রমণের শিকার বিভিন্ন সুন্নি গোষ্ঠীকে
সহায়তা বলতে গেলে করেইনি আইএস। তাদের বক্তব্য, সংগঠনটির মূল মনোযোগ রয়েছে
অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে ঝামেলায় জড়ানো। এছাড়া গোষ্ঠীটির নেতৃত্বের
মধ্যে গুপ্তচর আর বিশ্বাসঘাতকদের ব্যাপারে এক ধরনের ঘোর ধারণা কাজ করে।
আইএস ত্যাগকারীরা জানিয়েছেন, এ ধরনের জিহাদের জন্য তারা সিরিয়া বা ইরাকে
যাননি। আরেকটি বর্ণনায় এসেছে আইএসের নৃশংসতার বিষয়টি। অনেকেই পাশবিকতা ও
নিরীহ বেসামরিক মানুষদের ওপর গণহত্যা চালানোর বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। এছাড়া
জিম্মি বিদেশীদের দৈবচয়নের ভিত্তিতে খুন করা, গ্রামবাসীর সঙ্গে পদ্ধতিগত
অত্যাচার ও নিজেদের যোদ্ধাদেরই হত্যা করার যে বৈশিষ্ট্য আইএসের, তা-ও
বিতৃষ্ণার জন্ম দিয়েছে অনেকের মাঝে। তবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম
হত্যাকাণ্ড চালানোর কথা তাদের কারও মুখে শোনা যায়নি। সামগ্রিকভাবে নৃশংসতা
নিয়ে সাবেক এ চরমপন্থিদের উদ্বেগ কম, বরং নিজেদের সাম্প্রদায়িক
দৃষ্টিভঙ্গিতেই উদ্বেগ ফুটে উঠেছে বেশি। বিশেষ করে অন্য সুন্নিরা যখন
ভুক্তভোগী হয়েছে, তখনই ক্ষোভ দেখা গেছে বেশি। তিন নম্বর বিষয়টি ছিল
দুর্নীতি। তবে সবাই মনে করে না যে, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু
অনেকেই নেতাবিশেষের দুর্নীতির বিষয়টি মানতে পারেনি। আবার সিরিয়ান দলছুট
যারা, তারা বিদেশীদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, এটি
ইসলামের নায্যতা প্রতিপালনের নীতির আওতায় পড়েনি। অনেকে যুদ্ধের ভয়াবহতা
সহ্য করে নিতে চাইলেও কিন্তু অনায্য আচরণ, অসমতা ও বর্ণবাদ মেনে নেয়া সম্ভব
ছিল না। ভারতের একজন বললেন, এটি কোন পবিত্র যুদ্ধ নয়। এ ভারতীয়র বর্ণের
কারণে তাকে দিয়ে টয়লেট পরিষ্কার করানো হতো। চতুর্থ যে বর্ণনাটি দেখা গেছে
সিরিয়া-ফেরত এসব জিহাদীদের মুখে তা হলো, আইএসের অধীনে জীবন অত্যন্ত কঠোর ও
হতাশাজনক। অনেককে বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে আইএসে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পরে যখন
ওই প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন মোহভঙ্গ
ঘটে তাদের। আবার অন্য অনেকে বলছেন, যুদ্ধে পারদর্শিতা ও বীরত্ব ফলানোর
প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে তারা ত্যাগ করেছেন আইএস। অনেকের কাছে তাই আইএসের
দায়িত্ব ছিল ‘একঘেয়ে’।
এসব গল্পের মূল্য আছে। আইএস যে ঐক্যের কথা বলে, তার সম্পূর্ণ বিরোধী দলত্যাগীদের বক্তব্য। তাদের মতামত অন্যদেরও হয়তো অনুপ্রাণিত করতে পারে। অনেককে আইএস বা এটির মতো জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিতে অনুৎসাহিত করতে পারে। সরকার ও নাগরিক সমাজের উচিত এদের বক্তব্যের মূল্যকে স্বীকৃতি দেয়া। তারা যাতে আরও সহজে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করতে পারে, তার প্রক্রিয়া সহজতর করা। তবে প্রত্যেক দলত্যাগীই ভাল মানুষ হয়ে যায়নি। অনেকেই প্রকাশ্যে আসার জন্য প্রস্তুত নয়। কিন্তু তাদের বক্তব্য পরিষ্কার: আইএস মুসলিমদের সুরক্ষা দিচ্ছে না। বরং হত্যা করছে। এসব বক্তব্য শোনা উচিত।
এসব গল্পের মূল্য আছে। আইএস যে ঐক্যের কথা বলে, তার সম্পূর্ণ বিরোধী দলত্যাগীদের বক্তব্য। তাদের মতামত অন্যদেরও হয়তো অনুপ্রাণিত করতে পারে। অনেককে আইএস বা এটির মতো জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিতে অনুৎসাহিত করতে পারে। সরকার ও নাগরিক সমাজের উচিত এদের বক্তব্যের মূল্যকে স্বীকৃতি দেয়া। তারা যাতে আরও সহজে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করতে পারে, তার প্রক্রিয়া সহজতর করা। তবে প্রত্যেক দলত্যাগীই ভাল মানুষ হয়ে যায়নি। অনেকেই প্রকাশ্যে আসার জন্য প্রস্তুত নয়। কিন্তু তাদের বক্তব্য পরিষ্কার: আইএস মুসলিমদের সুরক্ষা দিচ্ছে না। বরং হত্যা করছে। এসব বক্তব্য শোনা উচিত।
No comments