নতুন 'জিন্নাহ' ওয়াইসির হাতেই ভারতীয় রাজনীতির নতুন সমীকরণ!
তার
নাম আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। অনেকে তাকে বলে ভারতের নতুন 'জিন্নাহ'। ভারতের
দুর্দশাগ্রস্ত মুসলমানদের নতুন মুখপাত্র হিসেবেও অনেকে তাকে অভিহিত করে।
বিহারের আসন্ন নির্বাচনেও তাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এখানে এ নিয়ে
সেমন্তী ঘোষের লেখা আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি হুবহু প্রকাশ
করা হলো।
তাঁকে নিয়ে বিজেপির আশা পূর্ণ হবে কি
এমআইএম-এর কট্টর ইসলামি নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি তেলঙ্গানা ও মহারাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে এ বার বিহার বিধানসভা নির্বাচনে। মুসলিমদের প্রতি বঞ্চনা ও বৈষম্যের ধুয়ো তুলে তিনি বিহারের নতুন ‘আইডেন্টিটি রাজনীতি’র মুখ।
উত্তর-পূর্ব বিহারের ছোট শহর কিষানগঞ্জ। জেলাটারও ওই নাম, যার পশ্চিম ও উত্তরে তিন জেলা, আরারিয়া, পূর্ণিয়া, কাটিহার। চার জেলা মিলিয়ে বিহারের ‘সীমাঞ্চল’। রাজ্যের তো বটেই, গোটা দেশেরই অতি পশ্চাৎপদ অঞ্চলের তালিকায় মহাসমারোহে জায়গা করে নিয়েছে এই সীমাঞ্চল। সাচার কমিটি রিপোর্ট তা-ই বলছে। অন্যান্য সমীক্ষা বা মিডিয়া রিপোর্টেও সেটাই উঠে এসেছে। পড়াশোনার সুযোগ, চাকরিবাকরি দূরস্থান, জীবনযাপনের স্বাভাবিক শর্তগুলিও এখানে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তবু অক্টোবরের বিহার বিধানসভা ভোটে একটা বিরাট ভূমিকা নিতে চলেছে সীমাঞ্চল : এ বারের ভোটের সম্ভাব্য ‘গেম-চে়ঞ্জার’ আসাদুদ্দিন ওয়াইসির সাধের তুরুপের তাস।
তাঁকে নিয়ে বিজেপির আশা পূর্ণ হবে কি
এমআইএম-এর কট্টর ইসলামি নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি তেলঙ্গানা ও মহারাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে এ বার বিহার বিধানসভা নির্বাচনে। মুসলিমদের প্রতি বঞ্চনা ও বৈষম্যের ধুয়ো তুলে তিনি বিহারের নতুন ‘আইডেন্টিটি রাজনীতি’র মুখ।
উত্তর-পূর্ব বিহারের ছোট শহর কিষানগঞ্জ। জেলাটারও ওই নাম, যার পশ্চিম ও উত্তরে তিন জেলা, আরারিয়া, পূর্ণিয়া, কাটিহার। চার জেলা মিলিয়ে বিহারের ‘সীমাঞ্চল’। রাজ্যের তো বটেই, গোটা দেশেরই অতি পশ্চাৎপদ অঞ্চলের তালিকায় মহাসমারোহে জায়গা করে নিয়েছে এই সীমাঞ্চল। সাচার কমিটি রিপোর্ট তা-ই বলছে। অন্যান্য সমীক্ষা বা মিডিয়া রিপোর্টেও সেটাই উঠে এসেছে। পড়াশোনার সুযোগ, চাকরিবাকরি দূরস্থান, জীবনযাপনের স্বাভাবিক শর্তগুলিও এখানে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তবু অক্টোবরের বিহার বিধানসভা ভোটে একটা বিরাট ভূমিকা নিতে চলেছে সীমাঞ্চল : এ বারের ভোটের সম্ভাব্য ‘গেম-চে়ঞ্জার’ আসাদুদ্দিন ওয়াইসির সাধের তুরুপের তাস।
হায়দরাবাদের কট্টর ইসলামি
নেতা ওয়াইসি। তাঁর দল অল-ইন্ডিয়া-মজলিস-এ-ইত্তেহাদ-আল-মুসলিমিন, সংক্ষেপে,
এআইএমআইএম এই প্রথম বার তেলঙ্গানা আর মহারাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে এসেছে
বিহারে, ভোটে লড়তে। এত দিন এই দলের নামের ‘অল ইন্ডিয়া’ অংশটা নেহাত
আলংকারিক ছিল। এত দিনে দেখা যাচ্ছে, শব্দবন্ধটা কেবল মুখের কথা নয়, এদের
সামনে একটা বড় অ্যাজেন্ডা। হায়দরাবাদের ঘাঁটিতে নিজেকে আটকে না রেখে
এআইএমআইএম ক্রমে গোটা দেশের ‘মুসলিম দল’ হতে চায়, তাই এর সামনে প্রথমে
বিহার, তার পর পশ্চিমবঙ্গ। কালে-দিনে দেশের এক ও অনন্য মুসলিম দলের মাথায়
থাকবেন ‘সোল স্পোকসম্যান’ আসাদুদ্দিন ওয়াইসি। (কারও কি মনে পড়ছে
ত্রিশ-চল্লিশের দশকের মুসলিম লিগের কথা?) যোগেন্দ্র যাদবের মতে যিনি ‘এই
মূহূর্তে গোটা দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক লোক’ সেই ওয়াইসি এক বিন্দু সংশয়ের
জায়গা না রেখেই পরিষ্কার বলে দিচ্ছেন, তাঁর উদ্দেশ্য মুসলিম আইডেন্টিটি-র
কার্ডটা খেলা। অন্য কোনও দলের হয়ে নয়, একটা ‘মুসলিম দলীয় রাজনীতি’র জন্যই।
‘এই দেশে শিখদের অকালি দল হতে পারে, তামিল দ্রাবিড়রা দ্রাবিড় পার্টি তৈরি
করতে পারে, মরাঠি মান্নুস-দের পার্টি হতে পারে, কেবল মুসলিমদের পার্টি
হলেই যত দোষ?’ মুসলিম পার্টির ব্যাপারটা যে অনেকেই পছন্দ করছেন না, সেটাও
ওয়াইসির কাছে খুব সুবিধেজনক। ওখান থেকেই তিনি প্রমাণ টানেন যে, মুসলিমদের
ভারতে আলাদা রকম নিচু চোখে দেখা হয়: ‘সকলেই আইডেন্টিটি পলিটিকস করে। কিন্তু
আমি যে-ই মুসলিম অধিকারের কথা বলি, আপনাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে! এটা
দ্বিচারিতা নয়?’ একের পর এক সাক্ষাৎকারে নিয়মিত এই মন্তব্য তাঁর।
চৌকস রাজনীতিক ওয়াইসি বিহারের মাঠে নেমেই বুঝে নিয়েছেন, তাঁর ফোকাস হবে কিষানগঞ্জ। তাই আর সব ছেড়ে কেবল সীমাঞ্চলেই এ বার প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। বিহারে যদি ক্রমে একটা উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল হতে হয়, তবে এটাই শুরুর সিঁড়ি। সবচেয়ে বেশি মুসলিম বসতি এই অঞ্চলে। কিষানগঞ্জের সত্তর শতাংশ মুসলমান। সীমাঞ্চলের বাকি তিন জেলায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ। ইতিহাস বলছে, বিহারের অধিকাংশ তারকা মুসলিম নেতারা এখানেই লড়াই করেছেন, ভোটে জিতে নেতা হয়েছেন। কংগ্রেসের সাংবাদিক সাংসদ এম জে আকবর, জনতা দলের সৈয়দ শাহাবুদ্দিন, ভারতীয় জনতা পার্টির অতি-বিজ্ঞাপিত মুসলিম মুখ শাহনওয়াজ হোসেন, সকলেই কিষানগঞ্জ হয়ে পার্লামেন্টে গিয়েছেন। বিহারের বাকি অংশে মুসলিম বসতি ছড়ানো ছিটানো। সুতরাং সেখানে সংখ্যায় ভোট যদি-বা টানা যায়, আসন পাওয়া মুশকিল। তাই গত ১৬ অগস্ট ওয়াইসি কিষানগঞ্জে একটা জব্বর সমাবেশ করলেন। সাড়া-ফেলে-দেওয়া ভিড় হল, সুবাগ্মী ওয়াইসির বক্তৃতা শুনতে এলেন আধ লক্ষ লোক। অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা বলছেন, এ জায়গায় নির্বাচনী সভায় এত ভিড় কয়েক দশকে দেখা যায়নি। ওয়াইসির সে দিনের বক্তৃতা ইউটিউবে ইতিমধ্যে লাখ-দুই ‘হিট’ পেয়েছে। এবং হোয়াটসঅ্যাপ-এ সেটা আজও ঘুরেই চলেছে।
এত দিন কাকে ভোট দিতেন কিষানগঞ্জের মুসলিমরা? কার কাছ থেকে ভোট কেড়ে আনতে চান ওয়াইসি? এখানেই রাজনীতির একটা প্যাঁচ লুকিয়ে থাকার ঘোর সম্ভাবনা। সাধারণত বিহারি মুসলিম ভোট কংগ্রেস, লালুপ্রসাদ যাদবের আরজেডি এবং নীতীশ কুমারের জেডিইউ-এর মধ্যে ভাগাভাগি হয়, দলিত রাজনীতির মধ্যে অনেকাংশে ঢুকে যান দলিত মুসলিমরা। কিষানগঞ্জ এত দিন ছিল নীতীশ কুমারের ঘাঁটি। সুতরাং এখানে মুসলিম ভোট কাটাকাটি হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জেডিইউ। আর গোটা রাজ্যের মুসলিম ভোট কাটাকাটি হলে তিনটি দলের ভোট-বাক্সেই ধস নামবে। লাভটা স্পষ্টত বিজেপি-র। ফলে যুক্তি বলছে, ওয়াইসি-র বিহার আগমনের পিছনে নিশ্চয়ই নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের ব্রেনওয়েভ। ‘ভোট-কটবা’ হিসেবেই আনা হয়েছে তাঁকে। পুরনো ছক। বিপক্ষের ভোট যাতে ছিটিয়ে যায়, তার ব্যবস্থা। হাতের কাছে ওয়াইসির মতো এত ‘ভাল’ অস্ত্র, এবং বিহারের মুসলিম বাসিন্দাদের মধ্যে এত বড় ক্ষোভের ফাঁক থাকতে মোদীরা তার সদ্ব্যবহার করে নীতীশ-লালুকে পর্যুদস্ত করতে চাইবেন, এ তো সহজ অঙ্ক। হাতে পেনসিলও দরকার নেই!
এটা ঘটনা যে পশ্চাৎপদতার দিক দিয়ে বিহারে সীমা়ঞ্চলের আজও জুড়ি নেই। ফলে মানুষের মনে পুঞ্জ পুঞ্জ ক্ষোভ। কংগ্রেস বা জনতা দলের রাজনীতিকরা ভোটের জন্য মুসলিমদের ব্যবহার করছেন, কাজের কাজ কিছুই করেননি, বেশির ভাগ জায়গায় সেটা প্রমাণ করা অতি সহজ কাজ। এত সত্ত্বেও অবশ্য নীতীশ কুমার এখানে যথেষ্ট জনপ্রিয়, তাঁর শাসনকালে অল্প হলেও পরিবর্তন এসেছে। সেটা ওয়াইসি জানেন বলে প্রথম থেকেই ‘বৃহত্তর মুসলিম বঞ্চনা’র গল্পটার উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। ইয়াকুব মেমনের কথা বেশি বেশি বলেছেন। এ দেশে কেন ‘শুধু’ মুসলিমদেরই ফাঁসি হয়, প্রশ্ন তুলেছেন। বিজেপি নেতারা সারা ক্ষণ ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে পারলে ‘আল্লা’র নামে প্রচারে দোষ কী, সেই প্রশ্নও তুলেছেন। একের পর এক জনসভায় এমআইএম-এর নেতারা আশ্চর্য নৈপুণ্যে মিশিয়ে দিয়েছেন— এক দিকে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং অন্য দিকে মুসলিম হিসেবে ‘উপেক্ষিত’ হওয়ার জ্বালা। এখানে যে স্কুল নেই বলে পড়াশোনা হয় না, কোনও শিল্প, ক্ষুদ্রশিল্প বা ব্যবসা নেই বলে চাকরি হয় না, কিংবা সেচের বন্দোবস্ত নেই বলে চাষবাসটাও ঠিকঠাক হয় না, এ সব তো ওয়াইসিরাই আজ নতুন বললেন না, দশকের পর দশক বিভিন্ন দলের নেতারা এসে এই সব বলেই ভোট চেয়ে গিয়েছেন। পেয়েছেনও। কিন্তু আজ এমআইএম যে ভাবে ক্ষণে ক্ষণে ‘মুসলিম’ শব্দটি উচ্চারণ করছে, প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে গোটা ভারতের জলে-হাওয়ায় আইনব্যবস্থায় বিচারব্যবস্থায় ‘মুসলিম-বিদ্বেষ’ গিজগিজ করছে, এটা সীমাঞ্চলের মুসলমানদের কাছে একেবারে নতুন। তাঁরা এত দিন জানতেন, নীতীশ-লালু সীমাঞ্চলে তেমন সফল হননি। কিন্তু নীতীশ-লালু যে ধর্মবৈষম্যের কারণেই সীমাঞ্চলকে গুরুত্ব দেননি, ওয়াইসির কাছেই তাঁরা প্রথম শুনলেন। এমন করে কেউ তাঁদের বোঝাননি, এমন করে তাঁদের মূল বিশ্বাসের নাড়িটি ধরে টান দেননি। দেশের ‘মিসিং মুসলমান’-দের ‘পরিত্রাতা’ হতে চান ওয়াইসি। এটাই তাঁর জনসংযোগ টেকনিক। পশ্চিমবঙ্গেও তাঁরা কাজ শুরু করেছেন ২০১৬-র নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে। সেখানেও নিশ্চয় এই টেকনিক দেখা যাবে।
চৌকস রাজনীতিক ওয়াইসি বিহারের মাঠে নেমেই বুঝে নিয়েছেন, তাঁর ফোকাস হবে কিষানগঞ্জ। তাই আর সব ছেড়ে কেবল সীমাঞ্চলেই এ বার প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। বিহারে যদি ক্রমে একটা উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল হতে হয়, তবে এটাই শুরুর সিঁড়ি। সবচেয়ে বেশি মুসলিম বসতি এই অঞ্চলে। কিষানগঞ্জের সত্তর শতাংশ মুসলমান। সীমাঞ্চলের বাকি তিন জেলায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ। ইতিহাস বলছে, বিহারের অধিকাংশ তারকা মুসলিম নেতারা এখানেই লড়াই করেছেন, ভোটে জিতে নেতা হয়েছেন। কংগ্রেসের সাংবাদিক সাংসদ এম জে আকবর, জনতা দলের সৈয়দ শাহাবুদ্দিন, ভারতীয় জনতা পার্টির অতি-বিজ্ঞাপিত মুসলিম মুখ শাহনওয়াজ হোসেন, সকলেই কিষানগঞ্জ হয়ে পার্লামেন্টে গিয়েছেন। বিহারের বাকি অংশে মুসলিম বসতি ছড়ানো ছিটানো। সুতরাং সেখানে সংখ্যায় ভোট যদি-বা টানা যায়, আসন পাওয়া মুশকিল। তাই গত ১৬ অগস্ট ওয়াইসি কিষানগঞ্জে একটা জব্বর সমাবেশ করলেন। সাড়া-ফেলে-দেওয়া ভিড় হল, সুবাগ্মী ওয়াইসির বক্তৃতা শুনতে এলেন আধ লক্ষ লোক। অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা বলছেন, এ জায়গায় নির্বাচনী সভায় এত ভিড় কয়েক দশকে দেখা যায়নি। ওয়াইসির সে দিনের বক্তৃতা ইউটিউবে ইতিমধ্যে লাখ-দুই ‘হিট’ পেয়েছে। এবং হোয়াটসঅ্যাপ-এ সেটা আজও ঘুরেই চলেছে।
এত দিন কাকে ভোট দিতেন কিষানগঞ্জের মুসলিমরা? কার কাছ থেকে ভোট কেড়ে আনতে চান ওয়াইসি? এখানেই রাজনীতির একটা প্যাঁচ লুকিয়ে থাকার ঘোর সম্ভাবনা। সাধারণত বিহারি মুসলিম ভোট কংগ্রেস, লালুপ্রসাদ যাদবের আরজেডি এবং নীতীশ কুমারের জেডিইউ-এর মধ্যে ভাগাভাগি হয়, দলিত রাজনীতির মধ্যে অনেকাংশে ঢুকে যান দলিত মুসলিমরা। কিষানগঞ্জ এত দিন ছিল নীতীশ কুমারের ঘাঁটি। সুতরাং এখানে মুসলিম ভোট কাটাকাটি হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জেডিইউ। আর গোটা রাজ্যের মুসলিম ভোট কাটাকাটি হলে তিনটি দলের ভোট-বাক্সেই ধস নামবে। লাভটা স্পষ্টত বিজেপি-র। ফলে যুক্তি বলছে, ওয়াইসি-র বিহার আগমনের পিছনে নিশ্চয়ই নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের ব্রেনওয়েভ। ‘ভোট-কটবা’ হিসেবেই আনা হয়েছে তাঁকে। পুরনো ছক। বিপক্ষের ভোট যাতে ছিটিয়ে যায়, তার ব্যবস্থা। হাতের কাছে ওয়াইসির মতো এত ‘ভাল’ অস্ত্র, এবং বিহারের মুসলিম বাসিন্দাদের মধ্যে এত বড় ক্ষোভের ফাঁক থাকতে মোদীরা তার সদ্ব্যবহার করে নীতীশ-লালুকে পর্যুদস্ত করতে চাইবেন, এ তো সহজ অঙ্ক। হাতে পেনসিলও দরকার নেই!
এটা ঘটনা যে পশ্চাৎপদতার দিক দিয়ে বিহারে সীমা়ঞ্চলের আজও জুড়ি নেই। ফলে মানুষের মনে পুঞ্জ পুঞ্জ ক্ষোভ। কংগ্রেস বা জনতা দলের রাজনীতিকরা ভোটের জন্য মুসলিমদের ব্যবহার করছেন, কাজের কাজ কিছুই করেননি, বেশির ভাগ জায়গায় সেটা প্রমাণ করা অতি সহজ কাজ। এত সত্ত্বেও অবশ্য নীতীশ কুমার এখানে যথেষ্ট জনপ্রিয়, তাঁর শাসনকালে অল্প হলেও পরিবর্তন এসেছে। সেটা ওয়াইসি জানেন বলে প্রথম থেকেই ‘বৃহত্তর মুসলিম বঞ্চনা’র গল্পটার উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। ইয়াকুব মেমনের কথা বেশি বেশি বলেছেন। এ দেশে কেন ‘শুধু’ মুসলিমদেরই ফাঁসি হয়, প্রশ্ন তুলেছেন। বিজেপি নেতারা সারা ক্ষণ ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে পারলে ‘আল্লা’র নামে প্রচারে দোষ কী, সেই প্রশ্নও তুলেছেন। একের পর এক জনসভায় এমআইএম-এর নেতারা আশ্চর্য নৈপুণ্যে মিশিয়ে দিয়েছেন— এক দিকে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং অন্য দিকে মুসলিম হিসেবে ‘উপেক্ষিত’ হওয়ার জ্বালা। এখানে যে স্কুল নেই বলে পড়াশোনা হয় না, কোনও শিল্প, ক্ষুদ্রশিল্প বা ব্যবসা নেই বলে চাকরি হয় না, কিংবা সেচের বন্দোবস্ত নেই বলে চাষবাসটাও ঠিকঠাক হয় না, এ সব তো ওয়াইসিরাই আজ নতুন বললেন না, দশকের পর দশক বিভিন্ন দলের নেতারা এসে এই সব বলেই ভোট চেয়ে গিয়েছেন। পেয়েছেনও। কিন্তু আজ এমআইএম যে ভাবে ক্ষণে ক্ষণে ‘মুসলিম’ শব্দটি উচ্চারণ করছে, প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে গোটা ভারতের জলে-হাওয়ায় আইনব্যবস্থায় বিচারব্যবস্থায় ‘মুসলিম-বিদ্বেষ’ গিজগিজ করছে, এটা সীমাঞ্চলের মুসলমানদের কাছে একেবারে নতুন। তাঁরা এত দিন জানতেন, নীতীশ-লালু সীমাঞ্চলে তেমন সফল হননি। কিন্তু নীতীশ-লালু যে ধর্মবৈষম্যের কারণেই সীমাঞ্চলকে গুরুত্ব দেননি, ওয়াইসির কাছেই তাঁরা প্রথম শুনলেন। এমন করে কেউ তাঁদের বোঝাননি, এমন করে তাঁদের মূল বিশ্বাসের নাড়িটি ধরে টান দেননি। দেশের ‘মিসিং মুসলমান’-দের ‘পরিত্রাতা’ হতে চান ওয়াইসি। এটাই তাঁর জনসংযোগ টেকনিক। পশ্চিমবঙ্গেও তাঁরা কাজ শুরু করেছেন ২০১৬-র নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে। সেখানেও নিশ্চয় এই টেকনিক দেখা যাবে।
বিদ্যুৎতরঙ্গ বওয়ানো বক্তৃতা, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিভিশন:
এই সবের সমাহার মনে করিয়ে দিচ্ছে গত বছরের লোকসভা নির্বাচনের আর এক নেতার
কথা। নরেন্দ্র মোদীর মতো এক পদ্ধতিতেই তরুণ প্রজন্মকে নতুন আবেগ আর আশার
ঝলকে ভাসাতে চাইছেন ওয়াইসি। মোদীর মতোই, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় ছোট শহরেই
ওয়াইসির সমর্থন বেশি। কিন্তু একটা দুর্বলতা তিনি কাটাতে পারছেন না। মোদীর
মতো তাঁর গুজরাত মডেল নেই, বস্তুত কোনও মডেলই নেই। কোনও রকম সরকারি ক্ষমতা
হাতে না থাকলে প্রসাদ বিতরণের রাজনীতিটা করা যায় না, কেবল স্লোগান-নির্ভর
হয়েই থাকতে হয়। ভারতীয় সমাজ, বিশেষত বিহার বা উত্তরপ্রদেশের সমাজ কিন্তু
সহজে এই বিতরণী রাজনীতি থেকে বার হতে পারে না, বার বার দেখা গিয়েছে। এ নিয়ে
সমীক্ষা হয়েছে, গবেষণা হয়েছে। ‘পেট্রনেজ’-অধ্যুষিত উত্তর ভারতে হাতে
ক্ষমতা না থাকলে ভোটে বড় সাফল্য মেলা কঠিন বলেই দেখা গিয়েছে, যে সব মুসলিম
দল নিজেদের আঞ্চলিক ঘাঁটি ছেড়ে বাইরের প্রদেশে নির্বাচনে লড়েছে, তারা
মোটেও সফল হয়নি। ২০০৭ সালে অসমের ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট বা ইউডিএফ
উত্তরপ্রদেশে পঞ্চাশ জন প্রার্থী দিয়েও এক জনকেও জেতাতে পারেনি। কাঞ্চন
গুপ্ত-র গবেষণা বলছে, এই কারণেই বহুজনসমাজ পার্টি কেবল উত্তরপ্রদেশে সফল,
আর কোথাও নয়, এমনকী কাঁসিরামের নিজের রাজ্য পঞ্জাবেও না। উত্তরপ্রদেশে চট
করে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার সুযোগ হয়েছিল বলেই বিএসপি-র সেখানে দ্রুত উন্নতি।
প্রশ্ন হল, বিহারে কোনও ‘পেট্রনেজ’ বিতরণ ছাড়াই কেবল ইসলামের হাঁকডাক
দিয়ে কত দূর যেতে পারবেন ওয়াইসি?
ওয়াইসি-র ইসলাম-ডাক নীতীশের উন্নয়ন-ডাককে কতটা বেগ দিতে পারে, এ বারের বিহার ভোটে সেটার বড় পরীক্ষা হতে চলেছে। এই পরীক্ষা ওয়াইসি-র পক্ষেও, বিহারি তথা ভারতীয় সমাজের পক্ষেও। হাজার হোক, না মেনে উপায় নেই, সীমাঞ্চল তথা বিহারের অনেকটাতেই উন্নয়নের যজ্ঞটাও তো অতীব নাম-কা-বাস্তে। এখনও ১৭ লক্ষ কিষানগঞ্জবাসীর জন্য দুটি মাত্র কলেজ। একটি কলেজে দু’হাজার ছাত্রের জন্য মাত্র এক জন শিক্ষক। গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও সরবরাহ নেই। বাৎসরিক বন্যার ত্রাণ নেই। সত্যিকারের উন্নয়ন কাকে বলে, সেটা বাস্তবে তো নয়ই, স্বপ্নেও দেখার স্পর্ধা করেন না এঁরা। পিছিয়ে-থাকা’দের স্বপ্ন ও বাস্তবের ফাঁক গলেই এত দিন দেশ জুড়ে বিজয়রথ চালাচ্ছে জাত-রাজনীতি। ওয়াইসিদের রাজনীতিও নির্ঘাত তা-ই চালাবে। অদূর ভবিষ্যতে।
ওয়াইসি-র ইসলাম-ডাক নীতীশের উন্নয়ন-ডাককে কতটা বেগ দিতে পারে, এ বারের বিহার ভোটে সেটার বড় পরীক্ষা হতে চলেছে। এই পরীক্ষা ওয়াইসি-র পক্ষেও, বিহারি তথা ভারতীয় সমাজের পক্ষেও। হাজার হোক, না মেনে উপায় নেই, সীমাঞ্চল তথা বিহারের অনেকটাতেই উন্নয়নের যজ্ঞটাও তো অতীব নাম-কা-বাস্তে। এখনও ১৭ লক্ষ কিষানগঞ্জবাসীর জন্য দুটি মাত্র কলেজ। একটি কলেজে দু’হাজার ছাত্রের জন্য মাত্র এক জন শিক্ষক। গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও সরবরাহ নেই। বাৎসরিক বন্যার ত্রাণ নেই। সত্যিকারের উন্নয়ন কাকে বলে, সেটা বাস্তবে তো নয়ই, স্বপ্নেও দেখার স্পর্ধা করেন না এঁরা। পিছিয়ে-থাকা’দের স্বপ্ন ও বাস্তবের ফাঁক গলেই এত দিন দেশ জুড়ে বিজয়রথ চালাচ্ছে জাত-রাজনীতি। ওয়াইসিদের রাজনীতিও নির্ঘাত তা-ই চালাবে। অদূর ভবিষ্যতে।
No comments