জঙ্গি দমনে সরকার কতটা আন্তরিক? by জায়েদুল আহসান
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খান কামাল সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক
স্টেটের (আইএস) অস্তিত্ব নেই। তাঁর কথা অনুযায়ী হয়তো এখন পর্যন্ত সংগঠন
হিসেবে আইএসের কোনো শাখার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। যেমন ১০ বছর আগে দেশে
আল-কায়েদার কোনো শাখার অস্তিত্ব মেলেনি। তখনো জঙ্গিদের অস্তিত্ব ছিল, এখনো
আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন বলছেন, দেশে আইএস নেই। কিন্তু গত বছরের
সেপ্টেম্বরে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব সম্পর্কে
আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিল। সামিউন নামে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ
নাগরিককে ঢাকায় গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের তৎকালীন উপকমিশনার
মাসুদুর রহমান বলেছিলেন, আটক সামিউন সিরিয়ায় আইএসের সদস্য হিসেবে যুদ্ধ
করেছেন। তঁার মুঠোফোনের এসএমএস থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে৷ গত ২৪ মে রাতে
আইএসের সঙ্গে জড়িত আমিনুল ইসলাম বেগ ও সাকিব বিন কামাল নামের দুজনকে
গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে
জানান, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা আইএসের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে
তাদের সংগঠন তৈরি, সদস্য সংগ্রহ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার চেষ্টা
চালাচ্ছিল। তারা জেএমবির সদস্য হলেও বাংলাদেশে আইএসের শাখা খুলে তাদের
মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল।
গোয়েন্দারা এ পর্যন্ত ৩০ জনের মতো আইএস জঙ্গিকে আটক করতে পেরেছে বলে জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতির ছেলে যেমন আছেন, তেমনি সাবেক সেনা কর্মকর্তার ছেলেও রয়েছেন। বেশ কজন সিরিয়ায় যুদ্ধ করতেও চলে গেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নারীও আছেন বলে ডিএমপির মুখপাত্র জানিয়েছেন। প্রতিটি গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলন করে গোয়েন্দা পুলিশ বা পুলিশের মুখপাত্র বলতেন, আইএসের সঙ্গে যুক্ত জঙ্গিরা বাংলাদেশ থেকে সদস্য সংগ্রহ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃতরা বাংলাদেশে যে আইএসের শাখা খোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন, সেটিও তাঁরা বলেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়তো বলতে চেয়েছেন, দেশে জঙ্গি আছে ঠিকই, তবে আইএসের কোনো শাখা নেই। গত ৩১ মে মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে গোয়েন্দা পুলিশ সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে জঙ্গি আবদুল্লা আল গালিবকে। পুলিশের তথ্য হচ্ছে, গালিব আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সহসমন্বয়ক। এর আগে তিনি হিযবুত তাহ্রীর ও জেএমবির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এই তিনটি সংগঠনই নিষিদ্ধঘোষিত। সম্প্রতি গালিব ‘জুনুদ আত-তাওহিদ ওআল খিলাফা’ নামে সশস্ত্র জিহাদি সংগঠন খুলে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁর লক্ষ্য আইএসের আদলে বাংলাদেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। কয়েকজন সদস্য সংগ্রহ করে তাদের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন তিনি। এমনকি গালিব আইএসের হয়ে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য একাধিকবার তুরস্কে যাওয়ার চেষ্টাও করেছেন।
এখন সরকারের পক্ষ থেকে যদি বলা হয়, দেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই, তাহলে সত্যকেই অস্বীকার করা হবে। জঙ্গিরা আগে কোন সংগঠন করত বা এখন কোন সংগঠন করে, সেটা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। একসময় যে জঙ্গি আল-কায়েদাকে মনেপ্রাণে ধারণ করত, এখন সেই জঙ্গি আইএসকেই আদর্শ মনে করে।
সরকার জঙ্গি দমনে নানা কমিটি, কমিশন অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু সরকারের সংস্থাগুলো জঙ্গি দমনে কতটা সক্রিয়?
আওয়ামী লীগ সব সময় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের কথা বলে আসছে। বিএনপি-জামায়াত জোট জঙ্গি থাকার কথা স্বীকারই করেনি, এখনো করছে না। আজ টানা সাত বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এ সময়ে সরকার বিএনপি-জামায়াতের মতো জঙ্গিবাদ বিস্তারে পৃষ্ঠপোষকতা করেনি, সেটি ঠিক। কিন্তু প্রতিরোধে কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে? হিযবুত তাওহীদ আর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করতেই এক বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সরকার আনুষ্ঠানিক অনেক সিদ্ধান্তই নিয়েছে, কিন্তু ফলাফল তেমন দৃশ্যমান হয়নি। নাগরিক হিসেবে আমাদের উদ্বেগ ওখানেই।
সরকার ২০০৯ সালের এপ্রিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কমিটি করেছে। একই বছর সন্ত্রাসবিরোধী আইন পাস হয়েছে। ২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন হয়েছে। ওই বছরের জুলাই মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার কমিটির অধীনে চার সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করেছে। ২০১৪ সালে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে সভাপতি করে জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধানে একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়।
গঠনের পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের আগস্টে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কমিটি আইনশৃঙ্খলা সংস্থাসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতি জঙ্গি দমনবিষয়ক অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি নির্দেশনা ছিল পাঠ্যসূচিতে জঙ্গিবাদবিরোধী লেখা অন্তর্ভুক্ত করার, মাদ্রাসার বইগুলোর সঙ্গে কোরআন ও হাদিসের কী কী বৈপরীত্য রয়েছে, তা চিহ্নিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল জঙ্গিবাদবিরোধী তথ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং জঙ্গিবাদের নেতিবাচক দিক এবং এর প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যাতে প্রতি মাসে একটি করে জঙ্গিবাদবিরোধী নাটক প্রচার করে, সে ব্যবস্থা নিতেও তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি নির্দেশ ছিল। কিন্তু অধিকাংশ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি।
শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধানে যে টাস্কফোর্স হয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেটিরও সদস্য। জঙ্গি তৎপরতা রোধে নিবিড় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি, আইনানুগ কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা এই টাস্কফোর্সের। টাস্কফোর্সের কর্মকাণ্ডের অগ্রগতিই বা কী?
র্যাব ২০০৪ সাল থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ১০৯ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে জামিন পেয়েছে ২৬৪ জন। তাদের ৯১ জনেরই হদিস নেই। ঠিক তেমনি পুলিশ আটক করেছে ২ হাজার ৫৪৩ জনকে। তাদের অনেকেই জামিনে বের হয়েছে। জামিন পাওয়ার পর তারা কী করছে এবং মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে কি না, এসব বিষয় তদারক করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একজন যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে বিশেষ সেল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এখন পর্যন্ত সেই সেলের খবর নেই।
প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স। এই জঙ্গিরা তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছে বারবার। তিনি সম্প্রতি জাতিসংঘেও জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সব রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানান তিনি।
এরই মধ্যে যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্কে চলে এসেছে, তা তো প্রমাণিত। ১৯৯৯ সালে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলায় ১০ জনকে হত্যার সময় সরকারযন্ত্র ভাবেনি, এই দেশে বিদেশি কানেকশনে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটতে পারে। আশির দশকে যারা এ দেশ থেকে আফগানিস্তানে গিয়ে যুদ্ধ করেছিল, তারাই ১৯৯২ সালে দেশে ফিরে হরকাতুল জিহাদ বা হুজি নামে সংগঠন তৈরি করে পরবর্তী এক দশকে একের পর এক বোমা হামলা চালিয়েছে। আজ যারা আইএসের হয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে গেছে, তারা ফিরে এসে যেন আরেকটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করতে না পারে, সে রকম কোনো প্রস্তুতি কি আমাদের আছে?
নাইন-ইলেভেনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ফোর্স। ২০০৮ সালের মুম্বাইয়ে তাজ হোটেলে জঙ্গি আক্রমণের পর ভারতে হয়েছে সুপার কমান্ডো বাহিনী, পাকিস্তানে আছে এলিট ফোর্স, শ্রীলঙ্কায় আছে স্পেশাল টাস্কফোর্স, মালয়েশিয়ায় রয়েছে পিজিকে ও জার্মানিতে আছে জিএসজি।
২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর সারদা পুলিশ একাডেমির শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে জঙ্গিবাদ দমনের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘ন্যাশনাল পুলিশ ব্যুরো অব কাউন্টার টেররিজম ইউনিট’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিন বছর পার হচ্ছে, এখনো হয়নি সেই ইউনিট।
সরকার জঙ্গি দমনে নানা কমিটি, কমিশন অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু সরকারের সংস্থাগুলো জঙ্গি দমনে কতটা সক্রিয়? জঙ্গি দমনে নেওয়া সরকারের উদ্যোগে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাদেরও চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
জায়েদুল আহসান: সাংবাদিক।
গোয়েন্দারা এ পর্যন্ত ৩০ জনের মতো আইএস জঙ্গিকে আটক করতে পেরেছে বলে জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতির ছেলে যেমন আছেন, তেমনি সাবেক সেনা কর্মকর্তার ছেলেও রয়েছেন। বেশ কজন সিরিয়ায় যুদ্ধ করতেও চলে গেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নারীও আছেন বলে ডিএমপির মুখপাত্র জানিয়েছেন। প্রতিটি গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলন করে গোয়েন্দা পুলিশ বা পুলিশের মুখপাত্র বলতেন, আইএসের সঙ্গে যুক্ত জঙ্গিরা বাংলাদেশ থেকে সদস্য সংগ্রহ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃতরা বাংলাদেশে যে আইএসের শাখা খোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন, সেটিও তাঁরা বলেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়তো বলতে চেয়েছেন, দেশে জঙ্গি আছে ঠিকই, তবে আইএসের কোনো শাখা নেই। গত ৩১ মে মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে গোয়েন্দা পুলিশ সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে জঙ্গি আবদুল্লা আল গালিবকে। পুলিশের তথ্য হচ্ছে, গালিব আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সহসমন্বয়ক। এর আগে তিনি হিযবুত তাহ্রীর ও জেএমবির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এই তিনটি সংগঠনই নিষিদ্ধঘোষিত। সম্প্রতি গালিব ‘জুনুদ আত-তাওহিদ ওআল খিলাফা’ নামে সশস্ত্র জিহাদি সংগঠন খুলে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁর লক্ষ্য আইএসের আদলে বাংলাদেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। কয়েকজন সদস্য সংগ্রহ করে তাদের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন তিনি। এমনকি গালিব আইএসের হয়ে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য একাধিকবার তুরস্কে যাওয়ার চেষ্টাও করেছেন।
এখন সরকারের পক্ষ থেকে যদি বলা হয়, দেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই, তাহলে সত্যকেই অস্বীকার করা হবে। জঙ্গিরা আগে কোন সংগঠন করত বা এখন কোন সংগঠন করে, সেটা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। একসময় যে জঙ্গি আল-কায়েদাকে মনেপ্রাণে ধারণ করত, এখন সেই জঙ্গি আইএসকেই আদর্শ মনে করে।
সরকার জঙ্গি দমনে নানা কমিটি, কমিশন অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু সরকারের সংস্থাগুলো জঙ্গি দমনে কতটা সক্রিয়?
আওয়ামী লীগ সব সময় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের কথা বলে আসছে। বিএনপি-জামায়াত জোট জঙ্গি থাকার কথা স্বীকারই করেনি, এখনো করছে না। আজ টানা সাত বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এ সময়ে সরকার বিএনপি-জামায়াতের মতো জঙ্গিবাদ বিস্তারে পৃষ্ঠপোষকতা করেনি, সেটি ঠিক। কিন্তু প্রতিরোধে কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে? হিযবুত তাওহীদ আর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করতেই এক বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সরকার আনুষ্ঠানিক অনেক সিদ্ধান্তই নিয়েছে, কিন্তু ফলাফল তেমন দৃশ্যমান হয়নি। নাগরিক হিসেবে আমাদের উদ্বেগ ওখানেই।
সরকার ২০০৯ সালের এপ্রিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কমিটি করেছে। একই বছর সন্ত্রাসবিরোধী আইন পাস হয়েছে। ২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন হয়েছে। ওই বছরের জুলাই মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার কমিটির অধীনে চার সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করেছে। ২০১৪ সালে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে সভাপতি করে জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধানে একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়।
গঠনের পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের আগস্টে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কমিটি আইনশৃঙ্খলা সংস্থাসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতি জঙ্গি দমনবিষয়ক অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি নির্দেশনা ছিল পাঠ্যসূচিতে জঙ্গিবাদবিরোধী লেখা অন্তর্ভুক্ত করার, মাদ্রাসার বইগুলোর সঙ্গে কোরআন ও হাদিসের কী কী বৈপরীত্য রয়েছে, তা চিহ্নিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল জঙ্গিবাদবিরোধী তথ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং জঙ্গিবাদের নেতিবাচক দিক এবং এর প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যাতে প্রতি মাসে একটি করে জঙ্গিবাদবিরোধী নাটক প্রচার করে, সে ব্যবস্থা নিতেও তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি নির্দেশ ছিল। কিন্তু অধিকাংশ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি।
শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধানে যে টাস্কফোর্স হয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেটিরও সদস্য। জঙ্গি তৎপরতা রোধে নিবিড় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি, আইনানুগ কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা এই টাস্কফোর্সের। টাস্কফোর্সের কর্মকাণ্ডের অগ্রগতিই বা কী?
র্যাব ২০০৪ সাল থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ১০৯ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে জামিন পেয়েছে ২৬৪ জন। তাদের ৯১ জনেরই হদিস নেই। ঠিক তেমনি পুলিশ আটক করেছে ২ হাজার ৫৪৩ জনকে। তাদের অনেকেই জামিনে বের হয়েছে। জামিন পাওয়ার পর তারা কী করছে এবং মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে কি না, এসব বিষয় তদারক করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একজন যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে বিশেষ সেল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এখন পর্যন্ত সেই সেলের খবর নেই।
প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স। এই জঙ্গিরা তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছে বারবার। তিনি সম্প্রতি জাতিসংঘেও জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সব রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানান তিনি।
এরই মধ্যে যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্কে চলে এসেছে, তা তো প্রমাণিত। ১৯৯৯ সালে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলায় ১০ জনকে হত্যার সময় সরকারযন্ত্র ভাবেনি, এই দেশে বিদেশি কানেকশনে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটতে পারে। আশির দশকে যারা এ দেশ থেকে আফগানিস্তানে গিয়ে যুদ্ধ করেছিল, তারাই ১৯৯২ সালে দেশে ফিরে হরকাতুল জিহাদ বা হুজি নামে সংগঠন তৈরি করে পরবর্তী এক দশকে একের পর এক বোমা হামলা চালিয়েছে। আজ যারা আইএসের হয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে গেছে, তারা ফিরে এসে যেন আরেকটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করতে না পারে, সে রকম কোনো প্রস্তুতি কি আমাদের আছে?
নাইন-ইলেভেনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ফোর্স। ২০০৮ সালের মুম্বাইয়ে তাজ হোটেলে জঙ্গি আক্রমণের পর ভারতে হয়েছে সুপার কমান্ডো বাহিনী, পাকিস্তানে আছে এলিট ফোর্স, শ্রীলঙ্কায় আছে স্পেশাল টাস্কফোর্স, মালয়েশিয়ায় রয়েছে পিজিকে ও জার্মানিতে আছে জিএসজি।
২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর সারদা পুলিশ একাডেমির শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে জঙ্গিবাদ দমনের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘ন্যাশনাল পুলিশ ব্যুরো অব কাউন্টার টেররিজম ইউনিট’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিন বছর পার হচ্ছে, এখনো হয়নি সেই ইউনিট।
সরকার জঙ্গি দমনে নানা কমিটি, কমিশন অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু সরকারের সংস্থাগুলো জঙ্গি দমনে কতটা সক্রিয়? জঙ্গি দমনে নেওয়া সরকারের উদ্যোগে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাদেরও চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
জায়েদুল আহসান: সাংবাদিক।
No comments