৫ বছরে ৬৪৭৮ বেওয়ারিশ লাশ by রুদ্র মিজান
প্রতিদিন
তিন থেকে চারটি বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যাচ্ছে রাজধানী ও এর আশপাশে। গত পাঁচ
বছরে ৬ হাজার ৪৭৮টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমান
মুফিদুল ইসলাম। অধিকাংশ লাশ ক্ষতবিক্ষত, গলিত ও গুলিবিদ্ধ। বুড়িগঙ্গা,
শীতলক্ষা থেকে উদ্ধার হচ্ছে হাত-পা বাঁধা লাশ। সুটকেসে বন্দি লাশ মিলছে
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। এসব লাশের ৮০ ভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার। পরিচয় না
মেলার কারণে এসব হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদ্ধারের কোন সুযোগ থাকছে না। বেওয়ারিশ
হিসেবেই দাফন করা হচ্ছে রাজধানীর দুটি কবরস্থানে। রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধির
সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যাও। ওই সময়ে রাজনৈতিক শত্রুতা ছাড়াও
অপরাধীরা সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। রাজনৈতিক সহিংসতার পরপরই বাড়ে
‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের সংখ্যা। ওই সময় থেকেই বিভিন্ন থানা, ডিবি, র্যাব
কার্যালয় থেকে হাসপাতালের লাশ কাটা ঘর পর্যন্ত নিখোঁজদের খোঁজ করেন তাদের
স্বজনরা। এই খোঁজ চলতেই থাকে। তাদের অনেকে কখনও স্বজনের লাশ খুঁজে পান।
আবার অনেকেই হারানো স্বজনের খোঁজ পান না।
৫ই জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে গত জানুয়ারি মাসে শুরু হয় রাজনৈতিক সহিংসতা। সহিংসতা শুরুর পর থেকে প্রায় দিনই অজ্ঞাত গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে বিভিন্নস্থানে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্যানুসারে প্রতি দুই দিনে একজন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। গত জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ১৭ জন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তাদের পরিচয় পাওয়া গেলেও র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর অনেকেরই কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। জানুয়ারি মাসে ১৪ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৭ জন নিখোঁজ হন। তারা আদৌ বেঁচে আছেন নাকি নেই তা জানেন না স্বজনরা। যদি বেঁচে না থাকেন বেওয়ারিশ হিসেবে তাদের দাফন করা হয়েছে কি-না তাও নিশ্চিত না।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যায়। আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায় বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যাও। ওই বছর ১৪০৫টি বেওয়ারিশ লাশ বেশি পাওয়া যায়। যা আগের বছরগুলোর চেয়ে কয়েক শ’ (রানা প্লাজায় নিহতদের লাশ ব্যতীত) বেশি। একইভাবে ৫ই জানুয়ারির এক বছর পূর্তি উপলক্ষে চলতি বছরের শুরুতে রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যায়। সূত্রমতে, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৭২৭টি লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। তার আগে ২০১৩ সালে ১৪৩০টি লাশ দাফন করা হয়। এরমধ্যে রানাপ্লাজা দুর্ঘটনার কারণে নিহত বেওয়ারিশ ২৯১ লাশ বাদ দিলে ওই বছরে অন্যান্য বেওয়ারিশ লাশ ছিল ১১৩৯টি।
রাজনৈতিক সহিংসতা ছাড়াও বস্তাবন্দি, ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার হয় প্রায়ই। গত ২৭শে আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টায় ডেমরা আমুলিয়া আতিক মার্কেটসংলগ্ন সড়ক থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ডেমরা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আহাদ আলী জানান, ওই যুবকের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। পুলিশের ধারণা, ওই অজ্ঞাত যুবককে দুর্বৃত্তরা অন্য কোথাও হত্যা করে লাশ সেখানে ফেলে গেছে। তার আগে গত ২৪শে জুন সকালে ওয়ারী থানার রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাংলাদেশ বয়েজ ক্লাবের সামনে থেকে বস্তাবন্দি কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, কিশোরীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৬ই মার্চ রাজধানীর বনানীর কাকলী এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসের ভেতরে থাকা ট্রাভেল ব্যাগ থেকে একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। ৯ই মার্চ রাজধানীর তুরাগ এলাকায় এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, সকাল সাড়ে সাতটায় তুরাগের দৌড় এলাকার বেড়িবাঁধের পুরাতন স্লুইস গেটের সামনে থেকে ওই যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার দুই কানে গুলির চিহ্ন ছিল।
গত জুলাই মাসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ৮৫ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ৯টি লাশ গ্রহণ করে। তার আগে জুন মাসে ঢামেক হাসপাতাল থেকে ৯৫টি এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে আটটি লাশ গ্রহণ করে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। পাঁচ বছরের সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম এরকম বেওয়ারিশ ৬ হাজার ৪৭৮ লাশ দাফন করেছে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর মতে, লাশ শনাক্তে পুলিশের যথাযথ পদক্ষেপ না থাকায় বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বাড়ছে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। একস্থানে হত্যার পর অন্যস্থানে লাশ ফেলে পার পেয়ে যাচ্ছে তারা।
আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের সহকারী পরিচালক (সার্ভিসেস) মো. আবদুল হালিম মানবজমিনকে জানান, পুলিশ বেওয়ারিশ ঘোষণা করলে আঞ্জুমান তা দাফন করার দায়িত্ব নেয়। মূলত ঢাকা ও আশপাশ থেকে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত লাশগুলোই তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরমধ্যে অধিকাংশ লাশই ক্ষতবিক্ষত ও গলিত অবস্থায় থাকে। বেওয়ারিশ লাশগুলো রাজধানীর জুরাইন ও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সূত্রমতে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৭২৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৭৪, ফেব্রুয়ারিতে ১০৮, মার্চে ১০৯, এপ্রিলে ৮৯, মে মাসে ১২০, জুনে ১১৭ ও জুলাইয়ে ১১০টি। ২০১৪ সালে ১৪০৫টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে এই প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ১০৩, ফেব্রুয়ারিতে ১০৯, মার্চে ১১৯, এপ্রিলে ১২০, মে মাসে ১৩১, জুনে ১০৭, জুলাইয়ে ১১৬, আগস্টে ১১০, সেপ্টেম্বরে ১১৮, অক্টোবরে ১৪৪, নভেম্বরে ১১৫ ও ডিসেম্বরে ১১৩টি। ২০১৩ সালে ১৪৩০টি লাশ দাফন করে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৯২, ফেব্রুয়ারিতে ৮৫, মার্চে ৯০, এপ্রিলে ৭২, মে মাসে ৩৬৭, জুনে ৮৮, জুলাইয়ে ১১৩, আগস্টে ৯৯, সেপ্টেম্বরে ৮৯, অক্টোবরে ১৩৮, নভেম্বরে ১০২ ও ডিসেম্বরে ৯৫টি। ২০১২ সালে ১২৪৮টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়। জানুয়ারিতে ১১৫, ফেব্রুয়ারিতে ৮৩, মার্চে ৯৭, এপ্রিলে ৭৭, মে মাসে ৯০, জুনে ৮৪, জুলাইয়ে ১১৩, আগস্টে ১২৮, সেপ্টেম্বরে ১১০, অক্টোবরে ১১৫, নভেম্বরে ১৪৫ ও ডিসেম্বরে ৯০টি। ২০১১ সালে ১১৯১টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে এই প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৮৮, ফেব্রুয়ারিতে ৮৮, মার্চে ৯০, এপ্রিলে ৮৬, মে মাসে ১০৬, জুনে ৯৮, জুলাইয়ে ১২৭, আগস্টে ১০৯, সেপ্টেম্বরে ১১১, অক্টোবরে ১০০, নভেম্বরে ১১২ ও ডিসেম্বরে ৭৬টি।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে ১৩৭, ফেব্রুয়ারিতে ১৪৮, মার্চে ১২৯, এপ্রিলে ১২২, মে মাসে ১০২, জুনে ৬৮, জুলাইয়ে ৫০, আগস্টে ৮৪, সেপ্টেম্বরে ৮৬, অক্টোবরে ১০৭, নভেম্বরে ১০১, ডিসেম্বরে ৭০টি লাশসহ ওই বছরে ১২০৪টি লাশ দাফন করে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম।
সূত্রমতে, বর্তমানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া লাশের মধ্যে বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। রাজধানী ও আশপাশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে অন্তত এক সপ্তাহ হাসপাতাল মর্গে লাশ সংরক্ষণ করা হয়। পরে পরিচয় শনাক্ত না হলে পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষ বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ সময় লাশ উদ্ধারের তারিখ, স্থান ও সংশ্লিষ্ট থানার নাম দেয়া হয় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামকে। পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে এই সূত্র ধরেই আঞ্জুমানের সাহায্যে কবর শনাক্ত করা হয়।
বেওয়ারিশ লাশ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, বেওয়ারিশ লাশের আলোকচিত্র রাখা হয়। পরবর্তীতে পুলিশের গেজেটে ছবি প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া খুন বা দুর্ঘটনার শিকার লাশের মতোই প্রতিটি বেওয়ারিশ লাশেরই সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত হয়। তারপরও অধিকাংশ লাশেরই পরিচয় পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, মানুষের স্থানান্তরের কারণে পরিচয় পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তরা দায় থেকে বাঁচতেই হয়তো বিকৃত করে এক এলাকার লাশ অন্য এলাকায় ফেলে যায় বলে মনে করেন তিনি। তবে রাজনৈতিক সহিংসতায় বেওয়ারিশ লাশ বৃদ্ধি সম্পর্কে মুনতাসিরুল ইসলাম জানান পরিসংখ্যানটি তার জানা নেই।
রাষ্ট্র কোনভাবেই বেওয়ারিশ লাশের দায় এড়াতে পারে না জানিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে তদন্ত করে তাদের পরিচয় বের করা। হত্যাকাণ্ডে মৃতদের ক্ষেত্রে দায়ীদের শাস্তির মুখোমুখি করা। সংশ্লিষ্টরা তা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলেই দুষ্কৃতিকারীরা সুযোগ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে বেওয়ারিশদের ছবি প্রকাশ করলে ভাল হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
৫ই জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে গত জানুয়ারি মাসে শুরু হয় রাজনৈতিক সহিংসতা। সহিংসতা শুরুর পর থেকে প্রায় দিনই অজ্ঞাত গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে বিভিন্নস্থানে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্যানুসারে প্রতি দুই দিনে একজন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। গত জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ১৭ জন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তাদের পরিচয় পাওয়া গেলেও র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর অনেকেরই কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। জানুয়ারি মাসে ১৪ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৭ জন নিখোঁজ হন। তারা আদৌ বেঁচে আছেন নাকি নেই তা জানেন না স্বজনরা। যদি বেঁচে না থাকেন বেওয়ারিশ হিসেবে তাদের দাফন করা হয়েছে কি-না তাও নিশ্চিত না।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যায়। আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায় বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যাও। ওই বছর ১৪০৫টি বেওয়ারিশ লাশ বেশি পাওয়া যায়। যা আগের বছরগুলোর চেয়ে কয়েক শ’ (রানা প্লাজায় নিহতদের লাশ ব্যতীত) বেশি। একইভাবে ৫ই জানুয়ারির এক বছর পূর্তি উপলক্ষে চলতি বছরের শুরুতে রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যায়। সূত্রমতে, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৭২৭টি লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। তার আগে ২০১৩ সালে ১৪৩০টি লাশ দাফন করা হয়। এরমধ্যে রানাপ্লাজা দুর্ঘটনার কারণে নিহত বেওয়ারিশ ২৯১ লাশ বাদ দিলে ওই বছরে অন্যান্য বেওয়ারিশ লাশ ছিল ১১৩৯টি।
রাজনৈতিক সহিংসতা ছাড়াও বস্তাবন্দি, ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার হয় প্রায়ই। গত ২৭শে আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টায় ডেমরা আমুলিয়া আতিক মার্কেটসংলগ্ন সড়ক থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ডেমরা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আহাদ আলী জানান, ওই যুবকের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। পুলিশের ধারণা, ওই অজ্ঞাত যুবককে দুর্বৃত্তরা অন্য কোথাও হত্যা করে লাশ সেখানে ফেলে গেছে। তার আগে গত ২৪শে জুন সকালে ওয়ারী থানার রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাংলাদেশ বয়েজ ক্লাবের সামনে থেকে বস্তাবন্দি কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, কিশোরীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৬ই মার্চ রাজধানীর বনানীর কাকলী এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসের ভেতরে থাকা ট্রাভেল ব্যাগ থেকে একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। ৯ই মার্চ রাজধানীর তুরাগ এলাকায় এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, সকাল সাড়ে সাতটায় তুরাগের দৌড় এলাকার বেড়িবাঁধের পুরাতন স্লুইস গেটের সামনে থেকে ওই যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার দুই কানে গুলির চিহ্ন ছিল।
গত জুলাই মাসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ৮৫ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ৯টি লাশ গ্রহণ করে। তার আগে জুন মাসে ঢামেক হাসপাতাল থেকে ৯৫টি এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে আটটি লাশ গ্রহণ করে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। পাঁচ বছরের সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম এরকম বেওয়ারিশ ৬ হাজার ৪৭৮ লাশ দাফন করেছে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর মতে, লাশ শনাক্তে পুলিশের যথাযথ পদক্ষেপ না থাকায় বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বাড়ছে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। একস্থানে হত্যার পর অন্যস্থানে লাশ ফেলে পার পেয়ে যাচ্ছে তারা।
আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের সহকারী পরিচালক (সার্ভিসেস) মো. আবদুল হালিম মানবজমিনকে জানান, পুলিশ বেওয়ারিশ ঘোষণা করলে আঞ্জুমান তা দাফন করার দায়িত্ব নেয়। মূলত ঢাকা ও আশপাশ থেকে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত লাশগুলোই তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরমধ্যে অধিকাংশ লাশই ক্ষতবিক্ষত ও গলিত অবস্থায় থাকে। বেওয়ারিশ লাশগুলো রাজধানীর জুরাইন ও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সূত্রমতে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৭২৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৭৪, ফেব্রুয়ারিতে ১০৮, মার্চে ১০৯, এপ্রিলে ৮৯, মে মাসে ১২০, জুনে ১১৭ ও জুলাইয়ে ১১০টি। ২০১৪ সালে ১৪০৫টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে এই প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ১০৩, ফেব্রুয়ারিতে ১০৯, মার্চে ১১৯, এপ্রিলে ১২০, মে মাসে ১৩১, জুনে ১০৭, জুলাইয়ে ১১৬, আগস্টে ১১০, সেপ্টেম্বরে ১১৮, অক্টোবরে ১৪৪, নভেম্বরে ১১৫ ও ডিসেম্বরে ১১৩টি। ২০১৩ সালে ১৪৩০টি লাশ দাফন করে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৯২, ফেব্রুয়ারিতে ৮৫, মার্চে ৯০, এপ্রিলে ৭২, মে মাসে ৩৬৭, জুনে ৮৮, জুলাইয়ে ১১৩, আগস্টে ৯৯, সেপ্টেম্বরে ৮৯, অক্টোবরে ১৩৮, নভেম্বরে ১০২ ও ডিসেম্বরে ৯৫টি। ২০১২ সালে ১২৪৮টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়। জানুয়ারিতে ১১৫, ফেব্রুয়ারিতে ৮৩, মার্চে ৯৭, এপ্রিলে ৭৭, মে মাসে ৯০, জুনে ৮৪, জুলাইয়ে ১১৩, আগস্টে ১২৮, সেপ্টেম্বরে ১১০, অক্টোবরে ১১৫, নভেম্বরে ১৪৫ ও ডিসেম্বরে ৯০টি। ২০১১ সালে ১১৯১টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে এই প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৮৮, ফেব্রুয়ারিতে ৮৮, মার্চে ৯০, এপ্রিলে ৮৬, মে মাসে ১০৬, জুনে ৯৮, জুলাইয়ে ১২৭, আগস্টে ১০৯, সেপ্টেম্বরে ১১১, অক্টোবরে ১০০, নভেম্বরে ১১২ ও ডিসেম্বরে ৭৬টি।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে ১৩৭, ফেব্রুয়ারিতে ১৪৮, মার্চে ১২৯, এপ্রিলে ১২২, মে মাসে ১০২, জুনে ৬৮, জুলাইয়ে ৫০, আগস্টে ৮৪, সেপ্টেম্বরে ৮৬, অক্টোবরে ১০৭, নভেম্বরে ১০১, ডিসেম্বরে ৭০টি লাশসহ ওই বছরে ১২০৪টি লাশ দাফন করে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম।
সূত্রমতে, বর্তমানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া লাশের মধ্যে বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। রাজধানী ও আশপাশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে অন্তত এক সপ্তাহ হাসপাতাল মর্গে লাশ সংরক্ষণ করা হয়। পরে পরিচয় শনাক্ত না হলে পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষ বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ সময় লাশ উদ্ধারের তারিখ, স্থান ও সংশ্লিষ্ট থানার নাম দেয়া হয় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামকে। পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে এই সূত্র ধরেই আঞ্জুমানের সাহায্যে কবর শনাক্ত করা হয়।
বেওয়ারিশ লাশ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, বেওয়ারিশ লাশের আলোকচিত্র রাখা হয়। পরবর্তীতে পুলিশের গেজেটে ছবি প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া খুন বা দুর্ঘটনার শিকার লাশের মতোই প্রতিটি বেওয়ারিশ লাশেরই সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত হয়। তারপরও অধিকাংশ লাশেরই পরিচয় পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, মানুষের স্থানান্তরের কারণে পরিচয় পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তরা দায় থেকে বাঁচতেই হয়তো বিকৃত করে এক এলাকার লাশ অন্য এলাকায় ফেলে যায় বলে মনে করেন তিনি। তবে রাজনৈতিক সহিংসতায় বেওয়ারিশ লাশ বৃদ্ধি সম্পর্কে মুনতাসিরুল ইসলাম জানান পরিসংখ্যানটি তার জানা নেই।
রাষ্ট্র কোনভাবেই বেওয়ারিশ লাশের দায় এড়াতে পারে না জানিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে তদন্ত করে তাদের পরিচয় বের করা। হত্যাকাণ্ডে মৃতদের ক্ষেত্রে দায়ীদের শাস্তির মুখোমুখি করা। সংশ্লিষ্টরা তা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলেই দুষ্কৃতিকারীরা সুযোগ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে বেওয়ারিশদের ছবি প্রকাশ করলে ভাল হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
No comments