স্বপ্ন দেখতে হবে বড়, নিজের জন্য নয়, সবার জন্য -বিশেষ সাক্ষাৎকারে: কৈলাস সত্যার্থী by কামাল আহমেদ
আজ
আন্তর্জাতিক শিশুশ্রমবিরোধী দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর হিসাব
অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে শিশু শ্রমিক রয়েছে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ, যার
প্রায় অর্ধেকই রয়েছে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায়। সম্প্রতি ঢাকায়
এসেছিলেন ২০১৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী কৈলাস সত্যার্থী।
পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি এ পুরস্কার পান। ভারতে
দাসত্বমূলক শিশুশ্রমের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে
সংগ্রাম পরিচালনার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি এ পুরস্কার পান। ঢাকায় অবস্থানকালে
তাঁর মুখোমুখি হয় প্রথম আলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর পরামর্শক সম্পাদক কামাল আহমেদ
প্রথম আলো : আপনি ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুশ্রম পুরোপুরিভাবে দূর করার লক্ষ্য ঠিক করার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে, ২০০০ সালে বিশ্বনেতারা যখন সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি ঠিক করেছিলেন, তখন শিশুদের উন্নয়নে বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের পরও দেখা গেছে যে গত ১৫ বছরে মাত্র ৩৩ শতাংশ শিশুকে শ্রমনির্ভরতা থেকে মুক্ত করা গেছে। তাহলে আগামী ১৫ বছরে কীভাবে এত বড় লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে?
কৈলাস সত্যার্থী : দেখুন, আমি বারবারই বলে আসছি যে শিশুকে প্রথমে শিশু হিসেবে বেড়ে ওঠার অধিকারটি দিতে হবে। এটা ঠিক যে আমরা তা দিতে পারিনি। প্রতিটি শিশুর শিশুর মতো বাঁচার অধিকার রয়েছে, তার হাসার অধিকার, খেলার অধিকার। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষার অধিকার। কোটি কোটি শিশুকে আমরা সেটা দিতে পারিনি। এক দিক দিয়ে এটা একটা অগ্রগতি যে এখন আমরা সামনে এগোনোর কথা বলছি—টেকসই উন্নয়নের কর্মসূচি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস— এসডিজি) চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে শিশুশ্রমের অবসান ঘটিয়ে শতভাগ শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলছি। এটা অবশ্যই সম্ভব। কেন এটাকে আমি সম্ভব বলছি? তার কারণ হলো ১৯৮৯ সালে যখন আমি দাসত্বমূলক শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করি, তখন কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে চাননি যে এটা সম্ভব। তখন বিষয়টি কোনো ইস্যু ছিল না। সেই কাজটি শুরুর সময়ে যতটা অসাধ্য মনে হয়েছিল পরে কিন্তু ততটা থাকেনি। অনেকটাই এগোনো গেছে। কুড়ি বছর আগে বিশ্বে ২৬ কোটি শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করত, যা এখন কমেছে ৩৩ শতাংশের বেশি। আবার স্কুলে যেতে পারত না এমন শিশুর সংখ্যা ছিল ২৩ কোটি, এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে।
প্রথম আলো : শিশুশ্রম অবসানে অগ্রগতি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আমাদের অঞ্চল—ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল তথা দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো কোটি কোটি শিশুকে কাজ করতে হচ্ছে অর্থনৈতিক কারণে।
কৈলাস সত্যার্থী : আমি এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত নই। অগ্রগতি হয়েছে, যদিও অনেকে (মিলিয়নস) এখনো শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে। শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমছে, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুর সংখ্যা কমছে। অবস্থা বদলাচ্ছে। ভোক্তারা সচেতন হচ্ছে এবং তারা দেখতে চায় যে তারা যে পণ্য কিনছে তা তৈরিতে শিশুশ্রম ব্যবহৃত হয়নি। তবে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা বা পণ্য বয়কটের মতো পদক্ষেপের বদলে আমি এমন একটি সমাধানের চেষ্টা করছি, যা হবে অংশীদারিমূলক। আমরা যদি শুধু বলি যে শিশুশ্রম খারাপ, শিশুশ্রমের পণ্য বয়কট করুন, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না। শিশুর পরিবার বা তার বাবা-মায়ের জন্য এ ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুর বদলে সেখানে তাদের বাবা-মায়ের বা অভিভাবকের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মক্ষম বাবা-মাকে কাজ না দিয়ে তাঁদের বাচ্চাদের দিয়ে কাজ করানো কোনো নীতি হতে পারে না। সে জন্য যেসব শিল্পে তাদের নিয়োগ করা হয়, সেখানে বিষয়টি বদলানো প্রয়োজন।
প্রথম আলো : শিশুশ্রম অবসানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? ভোটের হিসাব-নিকাশে শিশু অধিকারের বিষয়টি কি সব সময় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে না?
কৈলাস সত্যার্থী : রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সাধারণত বর্তমান নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এখানে ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িত। সুতরাং, তাঁদের এ বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্বে এখনো ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত। এদের মধ্যে সাড়ে আট কোটি আছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, যেটাকে আমরা বলি সবচেয়ে খারাপ শিশুশ্রম। আমরা আমাদের নিজেদের বাচ্চাদের কথা ভাবার সময় ভাবি যে তারা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু গরিব মানুষের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ভাবি ওরা কষ্ট করতে করতে ঠিক হয়ে যাবে। এই দ্বৈত মানসিকতা বদলাতে হবে।
প্রথম আলো : শিশু অধিকারের পক্ষে ভূমিকা রাখার জন্য আপনার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তি কি রাজনীতিকদের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলেছে?
কৈলাস সত্যার্থী : অবশ্যই। এখন অনেক ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সরকারগুলো—বিশ্বের নানা প্রান্তে সরকারগুলোর মধ্যে বেশ আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। আমার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি মাত্র কয়েক মাসের ঘটনা। কিন্তু ইতিমধ্যেই অনেক সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামাসহ অনেক দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী টেকসই উন্নয়নসূচিতে শিশু অধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন।
প্রথম আলো : এই উপমহাদেশে ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কি শিশু অধিকারের প্রসার ঘটানোর পথে কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
কৈলাস সত্যার্থী : আমি রাজনৈতিকভাবে কখনোই কোনো উদ্যোগ নিইনি এবং কখনো রাজনৈতিকভাবে চেষ্টা করব না। তবে আমি বিশ্বাস করি মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। ভারতে আমি শুরু করেছিলাম ১৯৮১-তে এবং তার পরে আমি পাকিস্তানেও গিয়েছি, যেখানে কাজ করাটা ছিল কঠিন। তারপর আমি বাংলাদেশেও কাজ করেছি। আমি কুড়ি বছর ধরেই বাংলাদেশে আসছি এবং মূলত প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কাজ করছি। বাংলাদেশে তো অনেক অগ্রগতি হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলে-মেয়ের সংখ্যাসাম্য এসেছে ২০০৫ সালে। এখন মাধ্যমিকেও এসেছে। শতভাগ শিশুর শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া টেকসই উন্নয়নের কথা ভাবা যায় না। এখন সেদিকেই এগোতে হবে।
প্রথম আলো : শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে আপনাকে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে শ্রমদাসত্ব থেকে মুক্ত করার চেষ্টায় আপনি শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এ রকম কঠিন কোনো অভিজ্ঞতার কথা কি আমাদের পাঠকদের জন্য বলতে পারেন?
কৈলাস সত্যার্থী : বেশ কয়েকবারই এ রকম ঝুঁকির মুখে পড়েছি। এর মধ্যে দিল্লিতে সার্কাস থেকে কয়েকজনকে উদ্ধারের একটি ঘটনা ছিল খুবই গুরুতর। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু মেয়ের অভিভাবকেরা এসেছিলেন তাঁদের বাচ্চাদের উদ্ধার করা যায় কি না, সে জন্য আমাদের সাহায্য চাইতে। সেখানে নেপালের কিছু মেয়েশিশুও ছিল। আমরা যখন সেই সার্কাস থেকে ওই সব বাচ্চাকে উদ্ধারের জন্য গিয়েছিলাম, তখন সেখানে পুলিশও উপস্থিত ছিল। ছিলেন একজন ক্যামেরাম্যানও। যখন আমরা কথা বলছিলাম, তখন তিনি ছবি তুলছিলেন। সার্কাসের মালিক ও তাঁর লোকজন প্রথমে সেই ক্যামেরাম্যানের ওপর চড়াও হয়। এরপর তারা আমাদের ওপর হামলা চালায়।
প্রথম আলো : পুলিশ কিছু করল না?
কৈলাস সত্যার্থী : পুলিশ তো তাদের সাহায্য করছিল। তারা যখন আমার ওপর চড়াও হয়, তখন আমার ছেলে আমাকে রক্ষার চেষ্টা করলে তারা তাকেও পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে। আমাদের আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে পথচারীরা আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই দিন আমরা ওই সব বাচ্চাকে উদ্ধার করতে পারিনি। সেদিন আমরা একটি মেয়েকে কোনোমতে গাড়িতে তুলে নিতে পেরেছিলাম। সেই মেয়েটির মা পরে আদালতের শরণাপন্ন হলে আদালত ওই সার্কাস কোম্পানিতে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন এবং সেখানে ২৫টি মেয়েকে পাওয়া যায়। পরে আরও ১২ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের শিশুদের জন্য আপনার প্রধান বার্তাটি কী হবে?
কৈলাস সত্যার্থী : আমার বার্তা হচ্ছে থ্রি ডি—ড্রিম, ডিসকভার অ্যান্ড ডু (স্বপ্ন দেখা, জ্ঞান অন্বেষণ বা জানা এবং করা)। আমি বলব স্বপ্ন দেখতে হবে বড়। শুধু নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য, সারা বিশ্বের জন্য। শুধু নিজের জন্য স্বপ্ন দেখলে নিজের সমৃদ্ধি হতে পারে কিন্তু সমাজের সমৃদ্ধি না-ও হতে পারে। তাই সবার জন্য স্বপ্ন দেখতে হবে। জানতে হবে এবং জানার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর নিজে কাজ না করে অন্যের কাছ থেকে ভালো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশার মানে হচ্ছে অন্যের মুখাপেক্ষী থাকা। নিজের স্বপ্ন নিজে বাস্তবায়ন করতে পারার চেয়ে আনন্দ আর তৃপ্তির কিছু হতে পারে না। তবে আমাদেরও মনে রাখতে হবে যে শিশুদের শিশুর মতো ভাবতে দিতে হবে।
প্রথম আলো : এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
কৈলাস সত্যার্থী : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : আপনি ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুশ্রম পুরোপুরিভাবে দূর করার লক্ষ্য ঠিক করার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে, ২০০০ সালে বিশ্বনেতারা যখন সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি ঠিক করেছিলেন, তখন শিশুদের উন্নয়নে বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের পরও দেখা গেছে যে গত ১৫ বছরে মাত্র ৩৩ শতাংশ শিশুকে শ্রমনির্ভরতা থেকে মুক্ত করা গেছে। তাহলে আগামী ১৫ বছরে কীভাবে এত বড় লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে?
কৈলাস সত্যার্থী : দেখুন, আমি বারবারই বলে আসছি যে শিশুকে প্রথমে শিশু হিসেবে বেড়ে ওঠার অধিকারটি দিতে হবে। এটা ঠিক যে আমরা তা দিতে পারিনি। প্রতিটি শিশুর শিশুর মতো বাঁচার অধিকার রয়েছে, তার হাসার অধিকার, খেলার অধিকার। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষার অধিকার। কোটি কোটি শিশুকে আমরা সেটা দিতে পারিনি। এক দিক দিয়ে এটা একটা অগ্রগতি যে এখন আমরা সামনে এগোনোর কথা বলছি—টেকসই উন্নয়নের কর্মসূচি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস— এসডিজি) চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে শিশুশ্রমের অবসান ঘটিয়ে শতভাগ শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলছি। এটা অবশ্যই সম্ভব। কেন এটাকে আমি সম্ভব বলছি? তার কারণ হলো ১৯৮৯ সালে যখন আমি দাসত্বমূলক শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করি, তখন কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে চাননি যে এটা সম্ভব। তখন বিষয়টি কোনো ইস্যু ছিল না। সেই কাজটি শুরুর সময়ে যতটা অসাধ্য মনে হয়েছিল পরে কিন্তু ততটা থাকেনি। অনেকটাই এগোনো গেছে। কুড়ি বছর আগে বিশ্বে ২৬ কোটি শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করত, যা এখন কমেছে ৩৩ শতাংশের বেশি। আবার স্কুলে যেতে পারত না এমন শিশুর সংখ্যা ছিল ২৩ কোটি, এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে।
প্রথম আলো : শিশুশ্রম অবসানে অগ্রগতি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আমাদের অঞ্চল—ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল তথা দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো কোটি কোটি শিশুকে কাজ করতে হচ্ছে অর্থনৈতিক কারণে।
কৈলাস সত্যার্থী : আমি এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত নই। অগ্রগতি হয়েছে, যদিও অনেকে (মিলিয়নস) এখনো শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে। শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমছে, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুর সংখ্যা কমছে। অবস্থা বদলাচ্ছে। ভোক্তারা সচেতন হচ্ছে এবং তারা দেখতে চায় যে তারা যে পণ্য কিনছে তা তৈরিতে শিশুশ্রম ব্যবহৃত হয়নি। তবে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা বা পণ্য বয়কটের মতো পদক্ষেপের বদলে আমি এমন একটি সমাধানের চেষ্টা করছি, যা হবে অংশীদারিমূলক। আমরা যদি শুধু বলি যে শিশুশ্রম খারাপ, শিশুশ্রমের পণ্য বয়কট করুন, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না। শিশুর পরিবার বা তার বাবা-মায়ের জন্য এ ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুর বদলে সেখানে তাদের বাবা-মায়ের বা অভিভাবকের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মক্ষম বাবা-মাকে কাজ না দিয়ে তাঁদের বাচ্চাদের দিয়ে কাজ করানো কোনো নীতি হতে পারে না। সে জন্য যেসব শিল্পে তাদের নিয়োগ করা হয়, সেখানে বিষয়টি বদলানো প্রয়োজন।
প্রথম আলো : শিশুশ্রম অবসানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? ভোটের হিসাব-নিকাশে শিশু অধিকারের বিষয়টি কি সব সময় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে না?
কৈলাস সত্যার্থী : রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সাধারণত বর্তমান নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এখানে ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িত। সুতরাং, তাঁদের এ বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্বে এখনো ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত। এদের মধ্যে সাড়ে আট কোটি আছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, যেটাকে আমরা বলি সবচেয়ে খারাপ শিশুশ্রম। আমরা আমাদের নিজেদের বাচ্চাদের কথা ভাবার সময় ভাবি যে তারা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু গরিব মানুষের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ভাবি ওরা কষ্ট করতে করতে ঠিক হয়ে যাবে। এই দ্বৈত মানসিকতা বদলাতে হবে।
প্রথম আলো : শিশু অধিকারের পক্ষে ভূমিকা রাখার জন্য আপনার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তি কি রাজনীতিকদের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলেছে?
কৈলাস সত্যার্থী : অবশ্যই। এখন অনেক ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সরকারগুলো—বিশ্বের নানা প্রান্তে সরকারগুলোর মধ্যে বেশ আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। আমার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি মাত্র কয়েক মাসের ঘটনা। কিন্তু ইতিমধ্যেই অনেক সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামাসহ অনেক দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী টেকসই উন্নয়নসূচিতে শিশু অধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন।
প্রথম আলো : এই উপমহাদেশে ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কি শিশু অধিকারের প্রসার ঘটানোর পথে কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
কৈলাস সত্যার্থী : আমি রাজনৈতিকভাবে কখনোই কোনো উদ্যোগ নিইনি এবং কখনো রাজনৈতিকভাবে চেষ্টা করব না। তবে আমি বিশ্বাস করি মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। ভারতে আমি শুরু করেছিলাম ১৯৮১-তে এবং তার পরে আমি পাকিস্তানেও গিয়েছি, যেখানে কাজ করাটা ছিল কঠিন। তারপর আমি বাংলাদেশেও কাজ করেছি। আমি কুড়ি বছর ধরেই বাংলাদেশে আসছি এবং মূলত প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কাজ করছি। বাংলাদেশে তো অনেক অগ্রগতি হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলে-মেয়ের সংখ্যাসাম্য এসেছে ২০০৫ সালে। এখন মাধ্যমিকেও এসেছে। শতভাগ শিশুর শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া টেকসই উন্নয়নের কথা ভাবা যায় না। এখন সেদিকেই এগোতে হবে।
প্রথম আলো : শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে আপনাকে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে শ্রমদাসত্ব থেকে মুক্ত করার চেষ্টায় আপনি শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এ রকম কঠিন কোনো অভিজ্ঞতার কথা কি আমাদের পাঠকদের জন্য বলতে পারেন?
কৈলাস সত্যার্থী : বেশ কয়েকবারই এ রকম ঝুঁকির মুখে পড়েছি। এর মধ্যে দিল্লিতে সার্কাস থেকে কয়েকজনকে উদ্ধারের একটি ঘটনা ছিল খুবই গুরুতর। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু মেয়ের অভিভাবকেরা এসেছিলেন তাঁদের বাচ্চাদের উদ্ধার করা যায় কি না, সে জন্য আমাদের সাহায্য চাইতে। সেখানে নেপালের কিছু মেয়েশিশুও ছিল। আমরা যখন সেই সার্কাস থেকে ওই সব বাচ্চাকে উদ্ধারের জন্য গিয়েছিলাম, তখন সেখানে পুলিশও উপস্থিত ছিল। ছিলেন একজন ক্যামেরাম্যানও। যখন আমরা কথা বলছিলাম, তখন তিনি ছবি তুলছিলেন। সার্কাসের মালিক ও তাঁর লোকজন প্রথমে সেই ক্যামেরাম্যানের ওপর চড়াও হয়। এরপর তারা আমাদের ওপর হামলা চালায়।
প্রথম আলো : পুলিশ কিছু করল না?
কৈলাস সত্যার্থী : পুলিশ তো তাদের সাহায্য করছিল। তারা যখন আমার ওপর চড়াও হয়, তখন আমার ছেলে আমাকে রক্ষার চেষ্টা করলে তারা তাকেও পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে। আমাদের আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে পথচারীরা আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই দিন আমরা ওই সব বাচ্চাকে উদ্ধার করতে পারিনি। সেদিন আমরা একটি মেয়েকে কোনোমতে গাড়িতে তুলে নিতে পেরেছিলাম। সেই মেয়েটির মা পরে আদালতের শরণাপন্ন হলে আদালত ওই সার্কাস কোম্পানিতে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন এবং সেখানে ২৫টি মেয়েকে পাওয়া যায়। পরে আরও ১২ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের শিশুদের জন্য আপনার প্রধান বার্তাটি কী হবে?
কৈলাস সত্যার্থী : আমার বার্তা হচ্ছে থ্রি ডি—ড্রিম, ডিসকভার অ্যান্ড ডু (স্বপ্ন দেখা, জ্ঞান অন্বেষণ বা জানা এবং করা)। আমি বলব স্বপ্ন দেখতে হবে বড়। শুধু নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য, সারা বিশ্বের জন্য। শুধু নিজের জন্য স্বপ্ন দেখলে নিজের সমৃদ্ধি হতে পারে কিন্তু সমাজের সমৃদ্ধি না-ও হতে পারে। তাই সবার জন্য স্বপ্ন দেখতে হবে। জানতে হবে এবং জানার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর নিজে কাজ না করে অন্যের কাছ থেকে ভালো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশার মানে হচ্ছে অন্যের মুখাপেক্ষী থাকা। নিজের স্বপ্ন নিজে বাস্তবায়ন করতে পারার চেয়ে আনন্দ আর তৃপ্তির কিছু হতে পারে না। তবে আমাদেরও মনে রাখতে হবে যে শিশুদের শিশুর মতো ভাবতে দিতে হবে।
প্রথম আলো : এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
কৈলাস সত্যার্থী : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
No comments