সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের অর্থ পাচার by জব্বার আল নাঈম
জব্বার আল নাঈম |
সম্প্রতি
দেশ ও বিদেশের আলোচিত ব্যবসায়ী প্রিন্স মুসা বিন শমসের রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি
দমন সংস্থার কাছে নিজেই সুইস ব্যাংকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে এই ৫ বিলিয়ন
ডলার থাকার কথা স্বীকার করেছেন। ৭ বিলিয়ন ডলার অর্থের অনুসন্ধান করতে গিয়ে
আরো ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদককে জনাব মুসা জানিয়েছেন, সুইস ব্যাংকে তার কেবল একটিমাত্র অ্যাকাউন্ট
রয়েছে। তবে এ অ্যাকাউন্টে সাত বিলিয়ন নয়, বর্তমানে মোট জমা ১২ বিলিয়ন ডলার।
যা বাংলাদেশি টাকায় ৯৩ হাজার কোটি টাকার (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা হিসেবে)
সমপরিমাণ।
সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের এরকম অনেক গল্প আছে, অভিযোগ আছে। কেবলমাত্র দুর্নীতবাজরাই সুইস ব্যাংকে টাকা পাচার করে, এমন একটি সাধারণ ধারণা রয়েছে জনমনে স্পষ্ট। দেশে অসংখ্য ব্যাংক থাকার পরও সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া মতো দেশে অর্থ পাচার কেন হয়? আর কারা সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার করে?
তবে সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশী নাগরিকরা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে ব্যাপকভাবে অর্থ পাচার করছে। তবে, এদের অধিকাংশই রাজনৈতিক ব্যক্তি। এ পাচার রোধে সরকার চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যর্থ হচ্ছে কেন? এখানে তো রাষ্ট্র আছে, রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট নীতি আছে। সরকার আছে। আছে প্রশাসন। এতকিছুর পরও আমাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কারণগুলো সনাক্তকরণ সম্ভব হয় না কেন? সম্ভাবনার একটা সীমা নিয়ে গত এক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সামান্য উদ্যোগ নিয়েছিল, যদিও সে উদ্যোগ ঝুলে আছে উদ্যোগের খাতায়। সময়ের টেবিলে সেই হিসাব চিৎকার করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ তথা সুইস ব্যাংকে টাকা পাচার হওয়া কমার বদলে মাল্টিকালার ঢঙে বাংলাদেশী টাকায় সুইস ব্যাংকের পেট মোটা হচ্ছে।
অর্থ পাচারের কারণগুলো নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনীতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা অর্থ পাচারের বড় কারণ। ১৯ জুন বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) প্রকাশিত ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৪’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশী নাগরিকদের ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ অর্থ বেশি জমা হয়েছে। পাঁচ বছরের হিসাবে এ পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি। যে খতিয়ান দেখে আমরা বারবার বিস্মিত হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, সরকার নির্বাচনের বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা এই পাচারের জন্য দেশে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকাকে দায়ী করছেন বারবার। আমরা দেখছি, বিগত কয়েক বছর ধরে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বিনিয়োগের যে হার রয়েছে, তার চাইতে সঞ্চয়ের হার বেশি। এই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ কাজি খলীকুজ্জামান জানান, ‘দেশে বিনিয়োগের তুলনায় সঞ্চয়ের হার ২-৩ শতাংশ বেশি। টাকাতো আর মানুষ বালিশের তলায় রাখে না। তাই পাচার করা।’ আর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম মনে করেন, প্রত্যাশামাফিক বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকাই অর্থ পাচারের বড় কারণ। জনাব আজিজুল ইসলামের কথা অযৌক্তিক নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বাণিজ্যিক ভাবে সমান সুযোগ না দিলে বিনিয়োগে ভয় পেয়ে নিরাপদ অবস্থানে হাঁটতে চায়। সমীক্ষায় দেখা যায়, সুইস একাউন্টে জমা টাকার মালিকগণ সরকারের প্রতিপক্ষের তুলনায় সরকার পক্ষের লোক বেশি। তাতে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। বিভিন্ন জায়গায় আমি বলে থাকি, তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পকেট ভারী করে অবৈধ মালিকানায় বা নামে বেনামে ব্যাংক ব্যালেন্স ও বাড়ি- গাড়ি করা। ক্রাইসিস মোমেন্টে বিদেশে পাড়ি দিয়ে বিলাশ বহুল লাইফ লিড করা এবং ছেলেমেয়েদের সেখানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো। এত ছোট দেশের সমীকরণ সরকারের পক্ষে অসম্ভব কিছু বলে মনে হয় না। সরকারের আন্তরিকতায় বিদেশ থেকে অনেকের টাকা দেশে এসেছে। এটাও জানি, নিয়মের বাইরে অতিরিক্ত টাকা পাচার বন্ধ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা।
পাচার হওয়া অর্থ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ জানান ভিন্ন কথা, সুইস ব্যাংকের এ রিপোর্ট সম্পূর্ণ নয়। এভাবে গোপন তথ্য প্রকাশের বিধান নেই। তবুও এন্টি মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার খতিয়ে দেখতে পারে। যেন ভবিষ্যতে এমনটি না হয়। এ ধরনের অপরাধে কি ধরনের শাস্তি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পৃথিবীর কোথাও এমন রিপোর্ট প্রকাশ কিংবা শাস্তির নজির নেই। দেশের অর্থ এভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার তৎপরতা আমাদের অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত নয়? এ ক্ষেত্রে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু তেমন ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, অর্থ পাচার রোধে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেই। সরকার সত্যি সত্যিই অর্থ পাচার রোধ করতে চায় কিনা, সে ব্যাপারেও সন্দেহ রয়েছে। সন্দেহের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘অর্থ পাচার রোধ শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের একার চাওয়ার ব্যাপার নয়। বিষয়টি রাজনৈতিক।’ সাধারণ মানুষের সাথে সুর মিলিয়ে ড. দেব প্রিয়র প্রশ্ন, অর্থ পাচার কারা করে? অবশ্যই রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী লোকেরা। দেখার বিষয় যে সরকার তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে চায় কিনা। তিনি আরও বলেন, ‘দেশে যখন নির্বাচন আসে তখনই অর্থ পাচার অনেক বেড়ে যায়। রাজনীতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা এ পাচারের বড় কারণ।’ প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ্য যে, যেসব দেশের সাথে সুইস ব্যাংকের এমওইউ রয়েছে, সেসব দেশ সুইস ব্যাংক থেকে তথ্য আনতে পারে। এই সুযোগটি বিশ্বের অন্যান্য দেশ কাজে লাগায়। সম্প্রতি কাজে লাগিয়েছে ভারত। যে কারণে ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকে ভারতের অর্থ পাচার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমেছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন নয়? ভারত এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির গ্রাফ আঁকতে আঁকতে। কিন্তু বাংলাদেশ সুইস ব্যাংকের সাথে এমওইউ করতে পারেনি। এই যে না পারার ভেতরে সরকারের দক্ষতা ও সক্ষমতার অভাব প্রতীয়মান হয়।
খতিয়ানের দিকে চোখ নিলে সুইস ব্যাংকে ১২ বছরের মধ্যে ২০১৩ সালেই বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বেশি আমানত জমা। যার পরিমাণ ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্রাঁ, স্থানীয় মুদ্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১২ সালে ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্রাঁ বা ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে বাংলাদেশীদের আমানত বেড়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ ফ্রাঁ বা ১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। তবে কোনো বাংলাদেশী তার নাগরিকত্ব গোপন রেখে আমানত রেখেছে তা এই প্রতিবেদনে আসেনি। একইভাবে স্বর্ণালঙ্কার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না। প্রতিবেদন দেখা গেছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশীদের আমানত ২০০২ সালে ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ ফ্রাঁ। ২০০৪ সালে ৪ কোটি ১০ লাখ, ২০০৫ সালে ৯ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৬ সালে ১২ কোটি ৪০ লাখ, ২০০৭ সালে ২৪ কোটি ৩০ লাখ, ২০০৮ সালে ১০ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৯ সালে ১৪ কোটি ৯০ লাখ এবং ২০১০ সালে ২৩ কোটি ৬০ লাখ ফ্রাঁ। এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে ভারতের ১৯৫ কোটি ফ্রাঁ, পাকিস্তান ১০১ কোটি, শ্রীলঙ্কা ৮ কোটি ২০ লাখ, নেপাল ৮ কোটি ৪৮ লাখ, মিয়ানমার ১ কোটি, মালদ্বীপ ১ কোটি ৩০ লাখ. আফগানিস্তান ১ কোটি ২১ লাখ এবং ভুটান ৫৬ হাজার ফ্রাঁ’র আমানত জমা আছে। প্রতিবেদন হিসাব অনুসারে ২০১৩ সালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আমানত কমলেও বাংলাদেশের বেড়েছে। ২০১৩ সালে সুইস ব্যাংকে বিদেশীদের মোট আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি ফ্রাঁ। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি ফ্রাঁ। এ হিসাবে ব্যাংকগুলোর মোট আমানত কমেছে ৬ হাজার কোটি ফ্রাঁ। ২০০৯ সালে ছিল ১ হাজার ৩৩ হাজার কোটি ফ্রাঁ, ২০১০ সালে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি এবং ২০১১ সালে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি।
আমরা মনে করি বিদেশে অর্থ পাচার রোধে এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- দেশে বিনিয়োগের কাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টি, রাজনীতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দূর করা, এ ছাড়া নিরাপত্তা শঙ্কা দূর করাও বিশেষভাবে প্রয়োজন। তবে এই বিষয়গুলো অর্জন করতে হলে সরকারকে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে অনেক সংকট। এই সংকট দূরীকরণে সরকার সঙ্গত ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়। আমাদের প্রধান প্রধান ঘাটতি গুলোর দিকে নজর দিয়ে কর্মসূচী সফলভাবে সম্পূর্ন করা। সরকার সকল ধরনের পাচার (যদিও এখন মানব পাচার সরকারের সামনে বড় একটা ইস্যু) রোধ করতে পারলে দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব। সরকারকে বিভিন্ন সেক্টরে বারবার সফলতায় উত্তরণ ঘটিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছতে হবে। যাতে পাঁচ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনকে সরকার মুছতে পারে। এখানে ব্যর্থ হওয়া চলবে না।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের এরকম অনেক গল্প আছে, অভিযোগ আছে। কেবলমাত্র দুর্নীতবাজরাই সুইস ব্যাংকে টাকা পাচার করে, এমন একটি সাধারণ ধারণা রয়েছে জনমনে স্পষ্ট। দেশে অসংখ্য ব্যাংক থাকার পরও সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া মতো দেশে অর্থ পাচার কেন হয়? আর কারা সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার করে?
তবে সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশী নাগরিকরা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে ব্যাপকভাবে অর্থ পাচার করছে। তবে, এদের অধিকাংশই রাজনৈতিক ব্যক্তি। এ পাচার রোধে সরকার চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যর্থ হচ্ছে কেন? এখানে তো রাষ্ট্র আছে, রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট নীতি আছে। সরকার আছে। আছে প্রশাসন। এতকিছুর পরও আমাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কারণগুলো সনাক্তকরণ সম্ভব হয় না কেন? সম্ভাবনার একটা সীমা নিয়ে গত এক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সামান্য উদ্যোগ নিয়েছিল, যদিও সে উদ্যোগ ঝুলে আছে উদ্যোগের খাতায়। সময়ের টেবিলে সেই হিসাব চিৎকার করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ তথা সুইস ব্যাংকে টাকা পাচার হওয়া কমার বদলে মাল্টিকালার ঢঙে বাংলাদেশী টাকায় সুইস ব্যাংকের পেট মোটা হচ্ছে।
অর্থ পাচারের কারণগুলো নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনীতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা অর্থ পাচারের বড় কারণ। ১৯ জুন বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) প্রকাশিত ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৪’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশী নাগরিকদের ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ অর্থ বেশি জমা হয়েছে। পাঁচ বছরের হিসাবে এ পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি। যে খতিয়ান দেখে আমরা বারবার বিস্মিত হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, সরকার নির্বাচনের বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা এই পাচারের জন্য দেশে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকাকে দায়ী করছেন বারবার। আমরা দেখছি, বিগত কয়েক বছর ধরে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বিনিয়োগের যে হার রয়েছে, তার চাইতে সঞ্চয়ের হার বেশি। এই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ কাজি খলীকুজ্জামান জানান, ‘দেশে বিনিয়োগের তুলনায় সঞ্চয়ের হার ২-৩ শতাংশ বেশি। টাকাতো আর মানুষ বালিশের তলায় রাখে না। তাই পাচার করা।’ আর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম মনে করেন, প্রত্যাশামাফিক বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকাই অর্থ পাচারের বড় কারণ। জনাব আজিজুল ইসলামের কথা অযৌক্তিক নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বাণিজ্যিক ভাবে সমান সুযোগ না দিলে বিনিয়োগে ভয় পেয়ে নিরাপদ অবস্থানে হাঁটতে চায়। সমীক্ষায় দেখা যায়, সুইস একাউন্টে জমা টাকার মালিকগণ সরকারের প্রতিপক্ষের তুলনায় সরকার পক্ষের লোক বেশি। তাতে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। বিভিন্ন জায়গায় আমি বলে থাকি, তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পকেট ভারী করে অবৈধ মালিকানায় বা নামে বেনামে ব্যাংক ব্যালেন্স ও বাড়ি- গাড়ি করা। ক্রাইসিস মোমেন্টে বিদেশে পাড়ি দিয়ে বিলাশ বহুল লাইফ লিড করা এবং ছেলেমেয়েদের সেখানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো। এত ছোট দেশের সমীকরণ সরকারের পক্ষে অসম্ভব কিছু বলে মনে হয় না। সরকারের আন্তরিকতায় বিদেশ থেকে অনেকের টাকা দেশে এসেছে। এটাও জানি, নিয়মের বাইরে অতিরিক্ত টাকা পাচার বন্ধ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা।
পাচার হওয়া অর্থ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ জানান ভিন্ন কথা, সুইস ব্যাংকের এ রিপোর্ট সম্পূর্ণ নয়। এভাবে গোপন তথ্য প্রকাশের বিধান নেই। তবুও এন্টি মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার খতিয়ে দেখতে পারে। যেন ভবিষ্যতে এমনটি না হয়। এ ধরনের অপরাধে কি ধরনের শাস্তি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পৃথিবীর কোথাও এমন রিপোর্ট প্রকাশ কিংবা শাস্তির নজির নেই। দেশের অর্থ এভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার তৎপরতা আমাদের অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত নয়? এ ক্ষেত্রে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু তেমন ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, অর্থ পাচার রোধে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেই। সরকার সত্যি সত্যিই অর্থ পাচার রোধ করতে চায় কিনা, সে ব্যাপারেও সন্দেহ রয়েছে। সন্দেহের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘অর্থ পাচার রোধ শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের একার চাওয়ার ব্যাপার নয়। বিষয়টি রাজনৈতিক।’ সাধারণ মানুষের সাথে সুর মিলিয়ে ড. দেব প্রিয়র প্রশ্ন, অর্থ পাচার কারা করে? অবশ্যই রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী লোকেরা। দেখার বিষয় যে সরকার তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে চায় কিনা। তিনি আরও বলেন, ‘দেশে যখন নির্বাচন আসে তখনই অর্থ পাচার অনেক বেড়ে যায়। রাজনীতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা এ পাচারের বড় কারণ।’ প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ্য যে, যেসব দেশের সাথে সুইস ব্যাংকের এমওইউ রয়েছে, সেসব দেশ সুইস ব্যাংক থেকে তথ্য আনতে পারে। এই সুযোগটি বিশ্বের অন্যান্য দেশ কাজে লাগায়। সম্প্রতি কাজে লাগিয়েছে ভারত। যে কারণে ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকে ভারতের অর্থ পাচার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমেছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন নয়? ভারত এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির গ্রাফ আঁকতে আঁকতে। কিন্তু বাংলাদেশ সুইস ব্যাংকের সাথে এমওইউ করতে পারেনি। এই যে না পারার ভেতরে সরকারের দক্ষতা ও সক্ষমতার অভাব প্রতীয়মান হয়।
খতিয়ানের দিকে চোখ নিলে সুইস ব্যাংকে ১২ বছরের মধ্যে ২০১৩ সালেই বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বেশি আমানত জমা। যার পরিমাণ ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্রাঁ, স্থানীয় মুদ্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১২ সালে ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্রাঁ বা ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে বাংলাদেশীদের আমানত বেড়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ ফ্রাঁ বা ১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। তবে কোনো বাংলাদেশী তার নাগরিকত্ব গোপন রেখে আমানত রেখেছে তা এই প্রতিবেদনে আসেনি। একইভাবে স্বর্ণালঙ্কার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না। প্রতিবেদন দেখা গেছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশীদের আমানত ২০০২ সালে ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ ফ্রাঁ। ২০০৪ সালে ৪ কোটি ১০ লাখ, ২০০৫ সালে ৯ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৬ সালে ১২ কোটি ৪০ লাখ, ২০০৭ সালে ২৪ কোটি ৩০ লাখ, ২০০৮ সালে ১০ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৯ সালে ১৪ কোটি ৯০ লাখ এবং ২০১০ সালে ২৩ কোটি ৬০ লাখ ফ্রাঁ। এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে ভারতের ১৯৫ কোটি ফ্রাঁ, পাকিস্তান ১০১ কোটি, শ্রীলঙ্কা ৮ কোটি ২০ লাখ, নেপাল ৮ কোটি ৪৮ লাখ, মিয়ানমার ১ কোটি, মালদ্বীপ ১ কোটি ৩০ লাখ. আফগানিস্তান ১ কোটি ২১ লাখ এবং ভুটান ৫৬ হাজার ফ্রাঁ’র আমানত জমা আছে। প্রতিবেদন হিসাব অনুসারে ২০১৩ সালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আমানত কমলেও বাংলাদেশের বেড়েছে। ২০১৩ সালে সুইস ব্যাংকে বিদেশীদের মোট আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি ফ্রাঁ। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি ফ্রাঁ। এ হিসাবে ব্যাংকগুলোর মোট আমানত কমেছে ৬ হাজার কোটি ফ্রাঁ। ২০০৯ সালে ছিল ১ হাজার ৩৩ হাজার কোটি ফ্রাঁ, ২০১০ সালে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি এবং ২০১১ সালে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি।
আমরা মনে করি বিদেশে অর্থ পাচার রোধে এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- দেশে বিনিয়োগের কাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টি, রাজনীতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দূর করা, এ ছাড়া নিরাপত্তা শঙ্কা দূর করাও বিশেষভাবে প্রয়োজন। তবে এই বিষয়গুলো অর্জন করতে হলে সরকারকে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে অনেক সংকট। এই সংকট দূরীকরণে সরকার সঙ্গত ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়। আমাদের প্রধান প্রধান ঘাটতি গুলোর দিকে নজর দিয়ে কর্মসূচী সফলভাবে সম্পূর্ন করা। সরকার সকল ধরনের পাচার (যদিও এখন মানব পাচার সরকারের সামনে বড় একটা ইস্যু) রোধ করতে পারলে দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব। সরকারকে বিভিন্ন সেক্টরে বারবার সফলতায় উত্তরণ ঘটিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছতে হবে। যাতে পাঁচ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনকে সরকার মুছতে পারে। এখানে ব্যর্থ হওয়া চলবে না।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
No comments