বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে পুলিশের বক্তব্যে বিস্ময় by শরিফুজ্জামান
বিচারবহির্ভূত
হত্যাকাণ্ড ও কথিত বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে এত দিন একধরনের রাখঢাক থাকলেও পুলিশ
এর যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করায় বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন
শ্রেণি-পেশার মানুষ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে। তাঁদের কেউ বিষয়টিকে
অনভিপ্রেত, কেউ দুঃখজনক, কেউবা অবিশ্বাস্য বলে মন্তব্য করেছেন।
আত্মরক্ষার কারণ দেখিয়ে এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্তকে ঢাল হিসেবে নিয়ে পুলিশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করে না, এমন বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। ২ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অধিকার ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বিচারবহির্ভূত হত্যার তথ্য এবং এ-সংক্রান্ত বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করে। পুলিশের দাবি, ওই সংগঠন দুটির বক্তব্য দেশের বিদ্যমান আইনের পরিপন্থী, যা আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল।
‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পুলিশ করেনি’—এমন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়ায় পর এ নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের একজন সহকারী মহাপরিদর্শকের সই করা ওই বক্তব্যে বলা হয়, যারা পুলিশ বা সাধারণ মানুষের প্রাণ হরণ করবে তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানোর আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকৃত রয়েছে বাংলাদেশের আইনে।
তবে আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করলেও বন্ধুকযুদ্ধের ঘটনাগুলো প্রকৃতপক্ষে আত্মরক্ষার কারণে ঘটছে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের পর একই ধরনের গল্প তুলে ধরায় এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও অবিশ্বাস রয়েছে।
দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নিয়ে নিয়মিত তথ্য প্রকাশ করে আইন ও সালিস কেন্দ্র, অধিকার, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন।
গত ৩০ জুন আইন ও সালিস কেন্দ্রের ষাণ্মাসিক পরিসংখ্যান (জানুয়ারি-জুন ১৫) বলছে, এই সময়ে র্যা ব ও পুলিশ বাহিনীর হাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ৭২ জন। এদের মধ্যে ৪০ জন পুলিশের সঙ্গে, ২২ জন র্যা বের সঙ্গে, বাকিরা অন্য বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন।
অন্যদিকে অধিকারের ষাণ্মাসিক প্রতিবেদন (জানুয়ারি-জুন ১৫) বলেছে, গত ছয় মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হওয়া ১০৮ জনের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে ৬৬ জন। এদের মধ্যে ৩৯ জন পুলিশের হাতে, ১৪ জন র্যা বের হাতে, বাকিরা অন্য বাহিনীর হাতে মারা গেছে বলে ওই সংগঠনের অভিযোগ।
৩১ জুলাই অধিকারের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জুলাই মাসে দেশে ১৫ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে পুলিশের হাতে ১১, র্যা ব ও আনসারের হাতে চারজন মারা যাওয়ার অভিযোগ তুলেছে সংগঠনটি।
পুলিশের বিবৃতিতে অধিকারের ওই প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বলা হয়, গত জুলাই মাসে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের কোনো ঘটনাকে ম্যাজিস্ট্রেট এবং আদালত বিচারবহির্ভূত বলেননি। এ প্রসঙ্গে প্রশাসনের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আরও বলা হয়, আত্মরক্ষার অধিকার সঠিকভাবে পুলিশ প্রয়োগ করছে কি না বা অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে কি না, তা অনুসন্ধান করেন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বাধীন নির্বাহী কমিটি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করছে না, এমন দাবি অবিশ্বাস্য বলে মত দেন আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, ‘আমরা তো পুলিশের কাছে জবাবদিহি চাই। কিন্তু তারা এর বদলে যে বক্তব্য দিয়েছে, তা অনভিপ্রেত।’
সুলতানা কামাল বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো পুলিশকে দায়ী করছে না, অভিযুক্ত করছে। কিন্তু এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব পুলিশেরই। তাঁর মতে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তদন্তে যদি প্রমাণ হয়েও থাকে যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়নি, তাহলে সেই তথ্য জানার অধিকার নাগরিকের রয়েছে। কিন্তু এতগুলো ঘটনা ঘটল, একটি তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না।
বিচারবহির্ভূত হত্যা সম্পর্কে মানবাধিকার সংগঠনের কথা বলার যৌক্তিকতা সম্পর্কে সুলতানা কামাল আরও বলেন, আইনের শাসনের ব্যত্যয় হলে মানবাধিকার সংগঠন কেন, যেকোনো নাগরিককেই কথা বলতে হবে; বরং কথা না বলাটাই নৈতিকতাবিরোধী।
অধিকারের ষাণ্মাসিক প্রতিবেদনে সরকারকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিচারের সম্মুখীন করার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া তাদের দায়মুক্তি রোধে সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়।
এই সুপারিশের জবাবে অধিকার ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের এ-সংক্রান্ত বক্তব্যকে বেআইনি ও নিছক নাশকতামূলক প্রচারণা বলে উল্লেখ করেছে পুলিশ। সংস্থা দুটির বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হত্যাকাণ্ডের দায়ভার চাপানোর অভিযোগ তুলে বলা হয়েছে, এর ফলে পুলিশের কাজ বিতর্কিত হচ্ছে এবং পুলিশের ভাবমূর্তি জনসমক্ষে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, এটা মানহানিকর এবং তা ফৌজদারি অপরাধের শামিল।
পুলিশ আরও জানায়, বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে এ দেশের আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থাকে বিতর্কিতভাবে পৃথিবীর মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়। এতে বিদেশের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি, বিদেশি বিনিয়োগ এবং রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা নাশকতামূলক কাজ হিসেবে বিবেচ্য বলে পুলিশ মনে করে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া এসব বক্তব্য ও যুক্তি হাস্যকর। রাষ্ট্র অস্ত্র দিয়েছে বলে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করা সমর্থনযোগ্য নয়। তাঁর মতে, পুলিশের ঝুঁকির বিষয়টি মেনে নেওয়া হলেও প্রায় সব ঘটনায় ক্ষমতার প্রয়োগ বেশি করা হচ্ছে। তা ছাড়া প্রতিটি ঘটনার ধরন, বিবরণ বা গল্প একই, যা অবিশ্বাস্য।
ড. ইফতেখারের মতে, ম্যাজিস্ট্রেট যে তদন্ত করেন, তা পুলিশের একধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই হয়; বরং অস্ত্র উদ্ধার বা আসামি ধরতে যাওয়ার আগে পুলিশই ম্যাজিস্ট্রেট বা তৃতীয় পক্ষের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে। নইলে একমাত্র পুলিশ ও অভিযুক্তের উপস্থিতিতে যে কথিত বন্দুকযুদ্ধ হয়, তার বিবরণ কেউ সত্য বলে মেনে নেবে না।
এদিকে পুলিশের ব্যাখ্যা সম্পর্কে উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেসি করেছেন, সচিবালয়ে এমন তিন কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা গত সোমবার জানতে চাওয়া হয়। ওই সব কর্মকর্তা জানান, এ ধরনের ঘটনায় সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। বন্দুকযুদ্ধের পর সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় সেখানে র্যা ব-পুলিশের বাইরে কারও কিছু বলার থাকে না। তা ছাড়া তদন্তের নামে যা কিছু হয়, সবকিছুতেই পুলিশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপ থাকে। এর ফলে একজন ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনার যথার্থতা প্রমাণ করতে সক্ষম হন না।
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তদন্ত হওয়ার কথা বলা হলেও আসলে তা সুষ্ঠু হওয়ার সুযোগ নেই। ত্রুটিপূর্ণ বিচারব্যবস্থায় এ ধরনের ঘটনার তদন্ত ও বিচার করা কঠিন। তাঁর মতে, অপরাধীরা ক্ষেত্রবিশেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করে থাকে, এটা সত্য। কিন্তু প্রায় সব ঘটনায় এক পক্ষ মারা যাচ্ছে, আরেক পক্ষ অক্ষত থাকছে—এর বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু?
তবে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছে, দেশে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় এতগুলো মানুষ মারা গেল কিন্তু পুলিশ বেঠিক বা বেআইনি কাজ করেছে বা বাড়াবাড়ি করেছে, এমন কথা কেউ বলেনি।
‘ক্রসফায়ারে মৃত্যু’র ঘটনায় প্রশাসনিক তদন্তে প্রতিটি ক্ষেত্রে গুলিবর্ষনের ঘটনা সঠিক রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ প্রবিধান (পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল-পিআরবি) অনুযায়ী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের তদন্তের বাধ্যবাধকতা থাকায় ক্রসফায়ার মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি ঘটনার ক্ষেত্রে ঘটনাটি যথার্থ নয় বলে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিবেদন দেননি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তদন্তকারীরা কি এ থেকে নিজেদের দায় এড়াতে পারেন?
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বিতর্কিত ও সমালোচিত বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদে ‘এলিট ফোর্স’ হিসেবে র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যা ব প্রতিষ্ঠার পর। সে সময় প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এসব বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিল। সে সময় তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ক্ষমতায় এলে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চালাতে দেবে না।
কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত ঠিক একই পদ্ধতিতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে। প্রথম কয়েক বছর র্যা বের বিরুদ্ধে প্রায় এককভাবে ক্রসফায়ারের অভিযোগ ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে র্যা বের চেয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেই এ ধরনের অভিযোগ বেশি উঠছে।
অধিকারের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে এসে বিচারবহির্ভূতভাবে সন্দেহভাজনদের হত্যা করাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের দায়মুক্তিমূলক বক্তব্য তাদের এ কাজে আরও উৎসাহিত করছে।
২০১৪ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া র্যা ব নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন, যাঁর শাসনামলেই র্যা ব সৃষ্টি ও বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু হয়। তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন এবং এ ধরনের হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন তাঁরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চান। এমনকি পুলিশের বৈধ ক্ষমতাও অবৈধভাবে ব্যবহার করতে চান। আবার বিরোধী দলে গেলে তাদেরই টনক নড়ে। জনস্বার্থের বদলে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দলীয় ও ক্ষুদ্রস্বার্থে ক্ষমতার এই অপব্যবহার বন্ধ হওয়া উচিত।
এদিকে, দ্য অবজারভেটরি নামে জেনেভা ও প্যারিসভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন পুলিশের এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে মঙ্গলবার বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়, পুলিশের এই বক্তব্য বাংলাদেশের নিরপেক্ষ সুশীল সমাজের ওপর নতুন আঘাত, যা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। ওই সংগঠনের মতে, বেসরকারি সংগঠন কর্তৃক সরকারের কর্মকাণ্ডের যাচাই-বাছাই আইনের শাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ নয়।
পুলিশ যেভাবেই বলুক, কোনো যুক্তিতেই বিচারবহির্ভূত হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়, এমনকি চোর বা ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে কাউকে হত্যা করাও গর্হিত অন্যায়। সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব অপরাধের শাস্তি বিচারের মাধ্যমেই নিশ্চিত করতে হবে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আত্মরক্ষার কারণ দেখিয়ে এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্তকে ঢাল হিসেবে নিয়ে পুলিশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করে না, এমন বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। ২ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অধিকার ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বিচারবহির্ভূত হত্যার তথ্য এবং এ-সংক্রান্ত বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করে। পুলিশের দাবি, ওই সংগঠন দুটির বক্তব্য দেশের বিদ্যমান আইনের পরিপন্থী, যা আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল।
‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পুলিশ করেনি’—এমন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়ায় পর এ নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের একজন সহকারী মহাপরিদর্শকের সই করা ওই বক্তব্যে বলা হয়, যারা পুলিশ বা সাধারণ মানুষের প্রাণ হরণ করবে তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানোর আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকৃত রয়েছে বাংলাদেশের আইনে।
তবে আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করলেও বন্ধুকযুদ্ধের ঘটনাগুলো প্রকৃতপক্ষে আত্মরক্ষার কারণে ঘটছে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের পর একই ধরনের গল্প তুলে ধরায় এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও অবিশ্বাস রয়েছে।
দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নিয়ে নিয়মিত তথ্য প্রকাশ করে আইন ও সালিস কেন্দ্র, অধিকার, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন।
গত ৩০ জুন আইন ও সালিস কেন্দ্রের ষাণ্মাসিক পরিসংখ্যান (জানুয়ারি-জুন ১৫) বলছে, এই সময়ে র্যা ব ও পুলিশ বাহিনীর হাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ৭২ জন। এদের মধ্যে ৪০ জন পুলিশের সঙ্গে, ২২ জন র্যা বের সঙ্গে, বাকিরা অন্য বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন।
অন্যদিকে অধিকারের ষাণ্মাসিক প্রতিবেদন (জানুয়ারি-জুন ১৫) বলেছে, গত ছয় মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হওয়া ১০৮ জনের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে ৬৬ জন। এদের মধ্যে ৩৯ জন পুলিশের হাতে, ১৪ জন র্যা বের হাতে, বাকিরা অন্য বাহিনীর হাতে মারা গেছে বলে ওই সংগঠনের অভিযোগ।
৩১ জুলাই অধিকারের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জুলাই মাসে দেশে ১৫ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে পুলিশের হাতে ১১, র্যা ব ও আনসারের হাতে চারজন মারা যাওয়ার অভিযোগ তুলেছে সংগঠনটি।
পুলিশের বিবৃতিতে অধিকারের ওই প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বলা হয়, গত জুলাই মাসে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের কোনো ঘটনাকে ম্যাজিস্ট্রেট এবং আদালত বিচারবহির্ভূত বলেননি। এ প্রসঙ্গে প্রশাসনের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আরও বলা হয়, আত্মরক্ষার অধিকার সঠিকভাবে পুলিশ প্রয়োগ করছে কি না বা অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে কি না, তা অনুসন্ধান করেন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বাধীন নির্বাহী কমিটি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করছে না, এমন দাবি অবিশ্বাস্য বলে মত দেন আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, ‘আমরা তো পুলিশের কাছে জবাবদিহি চাই। কিন্তু তারা এর বদলে যে বক্তব্য দিয়েছে, তা অনভিপ্রেত।’
সুলতানা কামাল বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো পুলিশকে দায়ী করছে না, অভিযুক্ত করছে। কিন্তু এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব পুলিশেরই। তাঁর মতে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তদন্তে যদি প্রমাণ হয়েও থাকে যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়নি, তাহলে সেই তথ্য জানার অধিকার নাগরিকের রয়েছে। কিন্তু এতগুলো ঘটনা ঘটল, একটি তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না।
বিচারবহির্ভূত হত্যা সম্পর্কে মানবাধিকার সংগঠনের কথা বলার যৌক্তিকতা সম্পর্কে সুলতানা কামাল আরও বলেন, আইনের শাসনের ব্যত্যয় হলে মানবাধিকার সংগঠন কেন, যেকোনো নাগরিককেই কথা বলতে হবে; বরং কথা না বলাটাই নৈতিকতাবিরোধী।
অধিকারের ষাণ্মাসিক প্রতিবেদনে সরকারকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিচারের সম্মুখীন করার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া তাদের দায়মুক্তি রোধে সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়।
এই সুপারিশের জবাবে অধিকার ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের এ-সংক্রান্ত বক্তব্যকে বেআইনি ও নিছক নাশকতামূলক প্রচারণা বলে উল্লেখ করেছে পুলিশ। সংস্থা দুটির বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হত্যাকাণ্ডের দায়ভার চাপানোর অভিযোগ তুলে বলা হয়েছে, এর ফলে পুলিশের কাজ বিতর্কিত হচ্ছে এবং পুলিশের ভাবমূর্তি জনসমক্ষে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, এটা মানহানিকর এবং তা ফৌজদারি অপরাধের শামিল।
পুলিশ আরও জানায়, বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে এ দেশের আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থাকে বিতর্কিতভাবে পৃথিবীর মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়। এতে বিদেশের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি, বিদেশি বিনিয়োগ এবং রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা নাশকতামূলক কাজ হিসেবে বিবেচ্য বলে পুলিশ মনে করে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া এসব বক্তব্য ও যুক্তি হাস্যকর। রাষ্ট্র অস্ত্র দিয়েছে বলে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করা সমর্থনযোগ্য নয়। তাঁর মতে, পুলিশের ঝুঁকির বিষয়টি মেনে নেওয়া হলেও প্রায় সব ঘটনায় ক্ষমতার প্রয়োগ বেশি করা হচ্ছে। তা ছাড়া প্রতিটি ঘটনার ধরন, বিবরণ বা গল্প একই, যা অবিশ্বাস্য।
ড. ইফতেখারের মতে, ম্যাজিস্ট্রেট যে তদন্ত করেন, তা পুলিশের একধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই হয়; বরং অস্ত্র উদ্ধার বা আসামি ধরতে যাওয়ার আগে পুলিশই ম্যাজিস্ট্রেট বা তৃতীয় পক্ষের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে। নইলে একমাত্র পুলিশ ও অভিযুক্তের উপস্থিতিতে যে কথিত বন্দুকযুদ্ধ হয়, তার বিবরণ কেউ সত্য বলে মেনে নেবে না।
এদিকে পুলিশের ব্যাখ্যা সম্পর্কে উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেসি করেছেন, সচিবালয়ে এমন তিন কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা গত সোমবার জানতে চাওয়া হয়। ওই সব কর্মকর্তা জানান, এ ধরনের ঘটনায় সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। বন্দুকযুদ্ধের পর সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় সেখানে র্যা ব-পুলিশের বাইরে কারও কিছু বলার থাকে না। তা ছাড়া তদন্তের নামে যা কিছু হয়, সবকিছুতেই পুলিশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপ থাকে। এর ফলে একজন ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনার যথার্থতা প্রমাণ করতে সক্ষম হন না।
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তদন্ত হওয়ার কথা বলা হলেও আসলে তা সুষ্ঠু হওয়ার সুযোগ নেই। ত্রুটিপূর্ণ বিচারব্যবস্থায় এ ধরনের ঘটনার তদন্ত ও বিচার করা কঠিন। তাঁর মতে, অপরাধীরা ক্ষেত্রবিশেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করে থাকে, এটা সত্য। কিন্তু প্রায় সব ঘটনায় এক পক্ষ মারা যাচ্ছে, আরেক পক্ষ অক্ষত থাকছে—এর বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু?
তবে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছে, দেশে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় এতগুলো মানুষ মারা গেল কিন্তু পুলিশ বেঠিক বা বেআইনি কাজ করেছে বা বাড়াবাড়ি করেছে, এমন কথা কেউ বলেনি।
‘ক্রসফায়ারে মৃত্যু’র ঘটনায় প্রশাসনিক তদন্তে প্রতিটি ক্ষেত্রে গুলিবর্ষনের ঘটনা সঠিক রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ প্রবিধান (পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল-পিআরবি) অনুযায়ী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের তদন্তের বাধ্যবাধকতা থাকায় ক্রসফায়ার মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি ঘটনার ক্ষেত্রে ঘটনাটি যথার্থ নয় বলে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিবেদন দেননি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তদন্তকারীরা কি এ থেকে নিজেদের দায় এড়াতে পারেন?
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বিতর্কিত ও সমালোচিত বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদে ‘এলিট ফোর্স’ হিসেবে র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যা ব প্রতিষ্ঠার পর। সে সময় প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এসব বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিল। সে সময় তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ক্ষমতায় এলে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চালাতে দেবে না।
কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত ঠিক একই পদ্ধতিতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে। প্রথম কয়েক বছর র্যা বের বিরুদ্ধে প্রায় এককভাবে ক্রসফায়ারের অভিযোগ ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে র্যা বের চেয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেই এ ধরনের অভিযোগ বেশি উঠছে।
অধিকারের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে এসে বিচারবহির্ভূতভাবে সন্দেহভাজনদের হত্যা করাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের দায়মুক্তিমূলক বক্তব্য তাদের এ কাজে আরও উৎসাহিত করছে।
২০১৪ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া র্যা ব নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন, যাঁর শাসনামলেই র্যা ব সৃষ্টি ও বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু হয়। তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন এবং এ ধরনের হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন তাঁরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চান। এমনকি পুলিশের বৈধ ক্ষমতাও অবৈধভাবে ব্যবহার করতে চান। আবার বিরোধী দলে গেলে তাদেরই টনক নড়ে। জনস্বার্থের বদলে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দলীয় ও ক্ষুদ্রস্বার্থে ক্ষমতার এই অপব্যবহার বন্ধ হওয়া উচিত।
এদিকে, দ্য অবজারভেটরি নামে জেনেভা ও প্যারিসভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন পুলিশের এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে মঙ্গলবার বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়, পুলিশের এই বক্তব্য বাংলাদেশের নিরপেক্ষ সুশীল সমাজের ওপর নতুন আঘাত, যা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। ওই সংগঠনের মতে, বেসরকারি সংগঠন কর্তৃক সরকারের কর্মকাণ্ডের যাচাই-বাছাই আইনের শাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ নয়।
পুলিশ যেভাবেই বলুক, কোনো যুক্তিতেই বিচারবহির্ভূত হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়, এমনকি চোর বা ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে কাউকে হত্যা করাও গর্হিত অন্যায়। সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব অপরাধের শাস্তি বিচারের মাধ্যমেই নিশ্চিত করতে হবে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
No comments