আবদুল হাই বাচ্চুকে ধরার সাধ্য কার? সংবাদ বিশ্লেষণ: বেসিক ব্যাংকে অনিয়ম by শওকত হোসেন
বেসিক
ব্যাংকের বহুল আলোচিত সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে দায়মুক্তি
দেওয়ার সব আয়োজনই সম্পন্ন করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গতকাল মঙ্গলবার
দুদকের অনুসন্ধানী দল যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তাতে আবদুল হাই বাচ্চুর নাম
নেই। অনুসন্ধানী দলটি বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ৫৬ জনের বিরুদ্ধে
মামলা করার সুপারিশ করলেও আবদুল হাই বাচ্চুর কোনো দায় খুঁজে পাওয়া
যায়নি। অর্থাৎ প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনেই তাঁর নামটি রাখার সাহস পেল
না দুদক। এতটাই ক্ষমতাশালী আবদুল হাই বাচ্চু!
এখন তাহলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কী বলবেন? কারণ, অর্থমন্ত্রী গত ৮ জুলাই সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে আইনের আওতায় আনা হবে’। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ব্যাংকটিতে হরিলুট হয়েছে। আর এর পেছনে ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। তাঁর ব্যাংক-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণেই বেসিক ব্যাংক সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে। তাঁর ব্যাংক-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো সমস্যা হবে না।’
স্মরণ করা যেতে পারে, এর আগে গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী ‘হল-মার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘জালিয়াতদের ধরতে বাধা নিজের দলের লোক।’ অর্থমন্ত্রী কি এবার ওই সব দলের লোকদের নাম বলবেন?
আবদুল হাই বাচ্চুর ক্ষমতার উৎস এতটাই শক্ত যে কেউই তাঁকে স্পর্শ করতে পারছেন না। বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতি নিয়ে আলোচনা ও লেখালেখি শুরু হয়েছে ২০১২ সাল থেকেই। অর্থমন্ত্রী নিজেও গত ৮ জুলাইয়ের আগে কখনোই আবদুল হাই বাচ্চুর নাম উচ্চারণ করে সরাসরি তাঁকে দায়ী করেননি। তবে ইদানীং ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও দুদক অর্থমন্ত্রীর কথা আমলেই নিল না। বরং বলা যায়, দুদক প্রভাবশালীদের দায়মুক্তির যে কমিশনে পরিণত হয়েছে, তার আরেকটি উদাহরণ এই ঘটনা।
এর আগে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির জন্য সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে দায়মুক্তি দিয়েছিল দুদক। যুক্তি ছিল, হল-মার্ককে যে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণসুবিধা দেওয়া হয়েছিল, তা পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদিত ছিল না। ফলে পর্ষদ সদস্যদের দায় পায়নি দুদক। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে সবকিছুই করা হয়েছে পর্ষদের মাধ্যমে। আর এর সব ধরনের প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালেই দিয়েছিল দুদককে।
খুব সরাসরিই বলা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ দেওয়া পরিচালনা পর্ষদই ডুবিয়েছে বেসিক ব্যাংককে। ১৯৮৯ সালে ব্যংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিল্পসচিবই পদাধিকারবলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হতেন। পরিচালকও হতেন বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা। এই ধারা চলেছে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। সরকার মালিক থাকলেও একটি ব্যাংক যে ভালোভাবে চলতে পারে, তার উদাহরণ ছিল বেসিক ব্যাংক।
প্রতিষ্ঠার ২৮ বছর পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার ঠিক পরপরই বেসিক ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় প্রথম বড় পরিবর্তন আনা হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের বদলে নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের। আর তারপর থেকেই শুরু হয় বেসিক ব্যাংকের ভরাডুবি। এখন তাহলে প্রমাণ হচ্ছে যে ব্যাংকের অর্থ লুটপাটের জন্যই নীতির পরিবর্তন করা হয়েছিল।
বেসিক ব্যাংকের ভরাডুবির কারণ তিনটি। কাছের লোকদের ব্যাংকের চেয়ারম্যান বানানোর নীতি নেয় সরকার এবং সে অনুযায়ী নিয়োগ পান আবদুল হাই বাচ্চু। আবার দিনের পর দিন বেসিক ব্যাংক নিয়ে লেখালেখি হলেও অর্থমন্ত্রী তা আমলেই নেননি। যখন নিয়েছেন তখন আর বেসিক ব্যাংক বাঁচানোর পথ ছিল না। আর সর্বশেষ হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকও লুটপাট ঠেকাতে পারেনি।
সুতরাং বলা যায়, আবদুল হাই বাচ্চুর যেমন শাস্তি হওয়া দরকার, তেমনি দায় নিতে হবে সরকার, অর্থমন্ত্রীর ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। দায় তো কেউই নিচ্ছেই না, বরং প্রভাবশালী আবদুল হাই বাচ্চুর দায়মুক্তির সব আয়োজন করে দিচ্ছে সরকারেরই একটি সংস্থা দুদক। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর শক্তির উৎস কী?
আবদুল হাই বাচ্চু এরশাদ আমলে বাগেরহাট-মোল্লারহাট থেকে একবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর আওয়ামী লীগ সরকার গত মেয়াদে আসার পর তিনি প্রথম মেয়াদে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিন বছরের জন্য চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। ২০১২ সালে তাঁকে আবার দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়।
চেয়ারম্যান আবদুল হাইয়ের সময় বেসিক ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন সরকারেরই সাবেক একজন যুগ্ম সচিব এ কে এম রেজাউর রহমান। তিনি ২০১৩ সালের ১১ জুলাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমের কাছে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। তাতে আবদুল হাই বাচ্চুর নানা অনিয়মের বিবরণ দেওয়া ছিল। আবদুল হাই সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কাউকে পরোয়া করেন না তিনি। কার্যত ব্যাংকটি চলে এই চেয়ারম্যানের নির্দেশে। তিনি লোকবল নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি, সব ক্ষেত্রেই একচ্ছত্র প্রভাব রাখেন।’
সেই প্রভাবের নমুনাও আছে অনেক। যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদকে সরাসরি দায়ী করে একাধিকবার চিঠি দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়কে। বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম, জালিয়াতি ও দুর্নীতির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম চিঠিটি দেয় ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে। চিঠিতে বলা ছিল, ‘এর সব দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের। ব্যাংকের ঋণ শৃঙ্খলা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি বিরোধিতা করলেও বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ ঋণ অনুমোদন করে দেয়। ৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না।’
এরপরও অর্থ মন্ত্রণালয় বেসিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকটির অবস্থা আরও খারাপ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে ২০১৪ সালের ২৯ মে সরকারের কাছে সুপারিশ করে। এর আগে ২৬ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামকে দুই বছরের জন্য অপসারণ করে। আর এর পরদিন ঢাকার গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখার নতুন ঋণ অনুমোদন বন্ধের নির্দেশ দেয়।
এরপরও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভাঙেননি অর্থমন্ত্রী। বরং সে সময়ে অর্থমন্ত্রী পাল্টা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘পর্ষদ ভাঙা হলে দায়িত্ব (ব্যাংকটির) নেবে কে?’
এরপর পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে ২০১৪ সালের ৬ জুলাই পদত্যাগ করেন আবদুল হাই বাচ্চু। তিনি অর্থমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে পদত্যাগপত্র দিয়ে আসেন। এর দুই দিন পর সরকার ব্যাংকের গোটা পর্ষদও অবশ্য বাতিল করে দেয়। অর্থাৎ তাঁকে সম্মানজনক পদত্যাগেরই সুযোগ করে দেয় সরকার। কারণ পর্ষদ বাতিল হলে আবদুল হাই এমনিতেই চেয়ারম্যান থাকতে পারতেন না। সুতরাং তাঁকে অপসারণ করা হয়েছে—এ কথাটাও বলার সুযোগ রাখেনি সরকার।
২০০৮ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫ শতাংশেরও কম। আর এখন খেলাপি ঋণ প্রায় ৫৭ শতাংশ। কেবল তা-ই নয়, ব্যাংকটি চালাতে এখন দুই হাজার কোটি টাকার মূলধন দিতে হবে সরকারকে। এই অর্থ দেওয়া হবে সাধারণ মানুষের করের টাকা থেকে। এসবই হচ্ছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ফল।
প্রশ্ন হচ্ছে, এর দায় এখন কে কে নেবে?
এখন তাহলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কী বলবেন? কারণ, অর্থমন্ত্রী গত ৮ জুলাই সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে আইনের আওতায় আনা হবে’। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ব্যাংকটিতে হরিলুট হয়েছে। আর এর পেছনে ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। তাঁর ব্যাংক-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণেই বেসিক ব্যাংক সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে। তাঁর ব্যাংক-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো সমস্যা হবে না।’
স্মরণ করা যেতে পারে, এর আগে গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী ‘হল-মার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘জালিয়াতদের ধরতে বাধা নিজের দলের লোক।’ অর্থমন্ত্রী কি এবার ওই সব দলের লোকদের নাম বলবেন?
আবদুল হাই বাচ্চুর ক্ষমতার উৎস এতটাই শক্ত যে কেউই তাঁকে স্পর্শ করতে পারছেন না। বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতি নিয়ে আলোচনা ও লেখালেখি শুরু হয়েছে ২০১২ সাল থেকেই। অর্থমন্ত্রী নিজেও গত ৮ জুলাইয়ের আগে কখনোই আবদুল হাই বাচ্চুর নাম উচ্চারণ করে সরাসরি তাঁকে দায়ী করেননি। তবে ইদানীং ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও দুদক অর্থমন্ত্রীর কথা আমলেই নিল না। বরং বলা যায়, দুদক প্রভাবশালীদের দায়মুক্তির যে কমিশনে পরিণত হয়েছে, তার আরেকটি উদাহরণ এই ঘটনা।
এর আগে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির জন্য সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে দায়মুক্তি দিয়েছিল দুদক। যুক্তি ছিল, হল-মার্ককে যে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণসুবিধা দেওয়া হয়েছিল, তা পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদিত ছিল না। ফলে পর্ষদ সদস্যদের দায় পায়নি দুদক। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে সবকিছুই করা হয়েছে পর্ষদের মাধ্যমে। আর এর সব ধরনের প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালেই দিয়েছিল দুদককে।
খুব সরাসরিই বলা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ দেওয়া পরিচালনা পর্ষদই ডুবিয়েছে বেসিক ব্যাংককে। ১৯৮৯ সালে ব্যংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিল্পসচিবই পদাধিকারবলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হতেন। পরিচালকও হতেন বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা। এই ধারা চলেছে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। সরকার মালিক থাকলেও একটি ব্যাংক যে ভালোভাবে চলতে পারে, তার উদাহরণ ছিল বেসিক ব্যাংক।
প্রতিষ্ঠার ২৮ বছর পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার ঠিক পরপরই বেসিক ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় প্রথম বড় পরিবর্তন আনা হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের বদলে নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের। আর তারপর থেকেই শুরু হয় বেসিক ব্যাংকের ভরাডুবি। এখন তাহলে প্রমাণ হচ্ছে যে ব্যাংকের অর্থ লুটপাটের জন্যই নীতির পরিবর্তন করা হয়েছিল।
বেসিক ব্যাংকের ভরাডুবির কারণ তিনটি। কাছের লোকদের ব্যাংকের চেয়ারম্যান বানানোর নীতি নেয় সরকার এবং সে অনুযায়ী নিয়োগ পান আবদুল হাই বাচ্চু। আবার দিনের পর দিন বেসিক ব্যাংক নিয়ে লেখালেখি হলেও অর্থমন্ত্রী তা আমলেই নেননি। যখন নিয়েছেন তখন আর বেসিক ব্যাংক বাঁচানোর পথ ছিল না। আর সর্বশেষ হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকও লুটপাট ঠেকাতে পারেনি।
সুতরাং বলা যায়, আবদুল হাই বাচ্চুর যেমন শাস্তি হওয়া দরকার, তেমনি দায় নিতে হবে সরকার, অর্থমন্ত্রীর ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। দায় তো কেউই নিচ্ছেই না, বরং প্রভাবশালী আবদুল হাই বাচ্চুর দায়মুক্তির সব আয়োজন করে দিচ্ছে সরকারেরই একটি সংস্থা দুদক। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর শক্তির উৎস কী?
আবদুল হাই বাচ্চু এরশাদ আমলে বাগেরহাট-মোল্লারহাট থেকে একবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর আওয়ামী লীগ সরকার গত মেয়াদে আসার পর তিনি প্রথম মেয়াদে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিন বছরের জন্য চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। ২০১২ সালে তাঁকে আবার দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়।
চেয়ারম্যান আবদুল হাইয়ের সময় বেসিক ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন সরকারেরই সাবেক একজন যুগ্ম সচিব এ কে এম রেজাউর রহমান। তিনি ২০১৩ সালের ১১ জুলাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমের কাছে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। তাতে আবদুল হাই বাচ্চুর নানা অনিয়মের বিবরণ দেওয়া ছিল। আবদুল হাই সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কাউকে পরোয়া করেন না তিনি। কার্যত ব্যাংকটি চলে এই চেয়ারম্যানের নির্দেশে। তিনি লোকবল নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি, সব ক্ষেত্রেই একচ্ছত্র প্রভাব রাখেন।’
সেই প্রভাবের নমুনাও আছে অনেক। যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদকে সরাসরি দায়ী করে একাধিকবার চিঠি দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়কে। বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম, জালিয়াতি ও দুর্নীতির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম চিঠিটি দেয় ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে। চিঠিতে বলা ছিল, ‘এর সব দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের। ব্যাংকের ঋণ শৃঙ্খলা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি বিরোধিতা করলেও বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ ঋণ অনুমোদন করে দেয়। ৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না।’
এরপরও অর্থ মন্ত্রণালয় বেসিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকটির অবস্থা আরও খারাপ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে ২০১৪ সালের ২৯ মে সরকারের কাছে সুপারিশ করে। এর আগে ২৬ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামকে দুই বছরের জন্য অপসারণ করে। আর এর পরদিন ঢাকার গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখার নতুন ঋণ অনুমোদন বন্ধের নির্দেশ দেয়।
এরপরও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভাঙেননি অর্থমন্ত্রী। বরং সে সময়ে অর্থমন্ত্রী পাল্টা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘পর্ষদ ভাঙা হলে দায়িত্ব (ব্যাংকটির) নেবে কে?’
এরপর পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে ২০১৪ সালের ৬ জুলাই পদত্যাগ করেন আবদুল হাই বাচ্চু। তিনি অর্থমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে পদত্যাগপত্র দিয়ে আসেন। এর দুই দিন পর সরকার ব্যাংকের গোটা পর্ষদও অবশ্য বাতিল করে দেয়। অর্থাৎ তাঁকে সম্মানজনক পদত্যাগেরই সুযোগ করে দেয় সরকার। কারণ পর্ষদ বাতিল হলে আবদুল হাই এমনিতেই চেয়ারম্যান থাকতে পারতেন না। সুতরাং তাঁকে অপসারণ করা হয়েছে—এ কথাটাও বলার সুযোগ রাখেনি সরকার।
২০০৮ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫ শতাংশেরও কম। আর এখন খেলাপি ঋণ প্রায় ৫৭ শতাংশ। কেবল তা-ই নয়, ব্যাংকটি চালাতে এখন দুই হাজার কোটি টাকার মূলধন দিতে হবে সরকারকে। এই অর্থ দেওয়া হবে সাধারণ মানুষের করের টাকা থেকে। এসবই হচ্ছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ফল।
প্রশ্ন হচ্ছে, এর দায় এখন কে কে নেবে?
No comments