রাজনীতিজীবীদের দিনবদল ও দলবদল by সৈয়দ আবুল মকসুদ
দলবদল
দোষের নয়, অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপারও নয়। কোনো দল থেকে কিছু
নেতা-কর্মী বেরিয়ে গিয়ে যদি নতুন সংগঠন করেন, তাতেও কোনো অস্বাভাবিকতা
নেই। তা-ই যদি হতো, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো থাকত মাত্র দুটি দল:
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ। কয়েক বছর আগে একবার শুনলাম দিনবদলের কথা। সেটা
সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন লেখালেখি হচ্ছে দলবদল নিয়ে। সেটা মাত্র শুরু
হয়েছে, সম্পন্ন হতে আরও কিছু সময়ের দরকার।
অনেক দিন যাবৎ সম্পাদকীয় পাতার সমসাময়িক বিষয়ের একজন লেখক হিসেবে রাজনীতিজীবীদের দলবদল আমি আন্তরিকভাবে সমর্থন করি। যদি শুনি আওয়ামী লীগের মধ্যে যাঁরা অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাস করেন, তাঁদের কয়েকজন নেতা তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে সিপিবি অফিসে গিয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেছেন, সেটা হবে খুশির খবর। অথবা যদি টিভি চ্যানেলগুলোতে সন্ধ্যার খবরে দেখি বিএনপির লাগাতারে অবিশ্বাসী কয়েকজন প্রগতিশীল শীর্ষ নেতা বাসদ কার্যালয়ে গিয়ে খালেকুজ্জামানের হাতে একগুচ্ছ তাজা রজনীগন্ধা ও গ্ল্যাডিওলাস দিয়ে বাসদে যোগ দিচ্ছেন, তা হবে স্বাগত জানানোর মতো সংবাদ। সুতরাং দলবদল হলেই তা কোনো দুঃসংবাদও নয়, অস্বাভাবিক ব্যাপারও নয়।
উদ্বেগ অথবা বিবেচনার বিষয় হলো, দলবদলটা করছেন কে, কোন দল থেকে কোন দলে যাচ্ছেন এবং তা করছেন কোন সময়। রাজনীতিজীবীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন মানুষ, তাঁরা কারও চাকর নন। তাঁরা কোনো দলে থাকতেও পারেন, এক দল থেকে অন্য দলে যেতে পারেন, এমনকি দলীয় রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিয়ে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ও নেমে যেতে পারেন। তাতে যদি তাঁদের আমদানি দ্রব্যে কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কোনো রাজনীতিজীবী যদি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে অতীতের বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে হপ্তায় তিন দিন বিভিন্ন কাগজে কলাম লিখতে থাকেন, তাতেও বাড়তে পারে দেশবাসীর রাজনৈতিক চেতনা ও জ্ঞানভান্ডার। ওটাই হতে পারে সবচেয়ে বড় দেশ উদ্ধারের কাজ, সহজতরও বটে। সহজতর এ জন্য যে নিজের হাতে বলপয়েন্ট কলম দিয়ে লেখার ঝামেলা নেই, সহকারীকে মিনিট বিশেক ডিকটেকশন দিলেই খাড়া করা সম্ভব একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ।
৫ জানুয়ারির বিশেষ নির্বাচনের পর থেকে গত দেড় বছরে বিএনপি-জামায়াতের ১৯ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। ‘গত দেড় বছরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এ রকম যোগদানের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৬২টি।’ [প্রথম আলো, ১১ জুলাই] বাংলাদেশে রাজনীতিজীবীর সংখ্যা যে বেশুমার, তা এই যোগদানের ঘটনা থেকে প্রমাণিত হলো। প্রথম আলোতে শরিফুজ্জামানের ওই প্রতিবেদন থেকে যা জানা যায়নি, ঘটেনি বলেই লেখা হয়নি, তা হলো বিএনপি-জামায়াতের আর কত নেতা আর কোন কোন দলে যোগ দিয়েছেন।
দলবদল বলতে বোঝায় এ-দল থেকে ও-দলে গিয়ে যোগদান করা। তাৎপর্যের বিষয় হলো, যোগদানের ব্যাপারটি ঘটেছে একতরফাভাবে। এই সময়ে নীতিগত কারণে অথবা ক্ষুব্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের কেউ বিএনপি-জামায়াতে যোগ দেননি। বিএনপি-জামায়াতের দুই ঘাটের তীর থেকে দলে দলে নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগের তরিতে উঠে পড়াটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যোগ করল নতুন মাত্রা। এত দিন যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ভারতপন্থী-পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ভেদাভেদ ছিল, এই দলবদলে তা ঘুচে যাওয়ার প্রক্রিয়াটির সূচনা হলো। ধারণা করি, ২০১৯-এর আগেই বাংলার মাটির রাজনৈতিক স্লোগানও বদলে যাবে। জয় বাংলা ও বাংলাদেশ জিন্দাবাদ সমন্বয় করে ‘জয়-জিন্দা-বাংলা’ গোছের কিছু চালু হবে। আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর জামায়াতে ইসলামীও স্টেডিয়াম থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত সড়কে ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দেবে না। তারা আর বছর পাঁচেক ক্ষমতায় থাকতে পারলে অনুচ্চ স্বরে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এর বদলে পাকিস্তানি আদলে ‘বাংলাদেশ পায়েন্দাবাদ’ স্লোগান প্রবর্তন করত বলে ধারণা করি।
মলম পার্টি থেকে অজ্ঞান পার্টিতে যোগদান আর বিএনপি-জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান এক জিনিস নয়। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে কেউ কোনো দল ছেড়ে দেওয়া এক কথা, আর এক দল ছেড়ে দিয়ে ঘটা করে আর এক দলে যোগদান আর এক কথা। কেউ যখন কোনো দলের ছায়ার নিচে আশ্রয় নেন তখন সেই দলের নীতি-আদর্শ-কর্মসূচি সবকিছুতে পূর্ণ আস্থা স্থাপন করেই তা করেন। কেউ এ কথা বলেন না যে যোগ আমি বিপদে পড়ে আত্মরক্ষার জন্য দিলাম বটে, তবে আমি আপনাদের দলের নীতি-আদর্শ পুরোপুরি নয়, আট আনার মতো বিশ্বাস করি।
যে ১৯-২০ হাজার রাজনীতিজীবী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা আগে ইসলামি/মুসলিম জাতীয়তাবাদের ঝান্ডা নিয়ে ঘুরতেন, এখন থেকে তাঁরা তুলে ধরবেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা। আগে তাঁরা চক্ষু নিমীলিত করে শুনতেন পাকিস্তানি কাওয়ালদের কাওয়ালি, এখন থেকে হাতে তাল ঠুকে তাঁরা শুনবেন কবিগুরুর ‘তুমি যেও না এখনই, এখনো আছে রজনী’। আগে তাঁরা নাভি বের করে নিতম্ব দুলিয়ে নাচের ব্যাপারটায় ঘোর আপত্তি তুলতেন, এখন ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে গিয়ে কথাকলি বা ভরতনাট্যম উপভোগ করবেন। এত দিন নীলো ও সাবিহার পুরোনো ছবিগুলো না দেখলে মন ভরত না, এখন শিল্পা শেঠি, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, মল্লিকা শেরাওয়াতের ফিল্ম ছাড়া মন ভরবে না। আগে তাঁরা রাস্তাঘাটে মেয়েদের বেলেল্লার মতো বেপর্দাভাবে চলাফেরা নাজায়েজ বলতেন, এখন তাঁরা আওয়ামী লীগের নারীনীতির পক্ষে বক্তৃতা দেবেন। দলবদলের দুদিন আগেও তাঁরা ভারতের নাম শুনলে চোখ লাল করতেন, এখন থেকে তাঁরা করবেন মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের তারিফ। আগে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি শুনলেই তাঁরা খুশিতে কান খাড়া করতেন, এখন পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ৩০ লাখ নিহত হওয়ার কথা যেকোনো বক্তৃতায় শ্রোতাদের অনিবার্যভাবে স্মরণ করিয়ে দেবেন। আগে শেখ মুজিবের দুঃশাসনের কথা প্রতিদিন মানুষকে মনে করিয়ে দিতেন, এখন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণের আগে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ কথাগুলো যোগ করতে ভুল করবেন না, যদি নিজের ও বাবার নামটি ভুলে যান তবু।
দলবদল শুধু জেল-জুলুম-ক্রসফায়ার থেকে বাঁচা নয়, টেন্ডারের ভাগ পাওয়া নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারি দলের মনোনয়ন পাওয়াও নয়—অতীতের নীতি-আদর্শ ও বিশ্বাসের খোলনলচে বদলে পুরোনো দেহে নতুন জীবন পাওয়া।
ব্রাহ্ম মতাবলম্বী রবিঠাকুর একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন, তাই তিনি মনটা উতলা হলে গাইতেন: ‘ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা/ প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে।/ যায় যেন মোর সকল গভীর আশা/ প্রভু, তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে।।’ রাজনীতিতে এই ধারণা অচল। বহুদলীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যই হলো বহু দল ও মতাদর্শের সহ-অবস্থান।
সব মতাদর্শ জনগণের মধ্যে প্রচারের সমান সুযোগ। তার ভেতর থেকে বেশির ভাগ মানুষ যেটা গ্রহণ করবে সেটাই প্রাধান্য পাবে।
আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে অথবা ভয়-ভীতিবশত এক দিকে ধাবিত হলে গণতন্ত্রকে যে শুধু কবর দেওয়া হয় তা-ই নয়, দেশে রাজনীতি বলেও কিছু থাকে না।
আগেই বলেছি, দল থেকে চলে যাওয়া, অন্য দলে যোগ দেওয়া অথবা নতুন দল গঠন করা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
বরং বহুদলীয় গণতন্ত্রে সেটা খুবই স্বাভাবিক। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠন করেছিলেন রামমনোহর লোহিয়ারা। মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছিলেন মাওলানা ভাসানী ও তাঁর অনুসারীরা। সেই আওয়ামী লীগ যখন কেন্দ্রে ও পূর্ব বাংলায় ক্ষমতায়, তখন আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ভাসানী ও বামপন্থীরা গঠন করেন ১৯৫৭-তে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। শেখ মুজিব ভাসানীকে কতভাবে অনুরোধ করেছেন দল ছেড়ে না যেতে। মাওলানা বলেছেন, দ্যাখো, এটা আদর্শগত ব্যাপার। তোমরা তোমাদের মতো থাকো, আমরা আমাদের মতো রাজনীতি করি। ভিন্ন সংগঠনে নেতৃত্ব দিলেও ভাসানী-মুজিবের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ভারতে দল পরিবর্তন বা নতুন দল গঠন আরও ব্যাপক। সে জন্যই গণতন্ত্র প্রাণবন্ত ও টেকসই। মোরারজি দেশাইরা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে গঠন করেন ভারতীয় জনতা দল। গঠিত হয়েছে আরও কত দল, যেমন: রাষ্ট্রীয় জনতা দল, তৃণমূল কংগ্রেস, জনতা দল ইউনাইটেড, জনতা দল সমতা প্রভৃতি।
পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে যে রাজনীতিজীবীর সংখ্যা বেশি, তা দলবদলের ঘটনা থেকে বোঝা যায়। সবাই বনপোড়া হরিণের মতো ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে সরকারি দলের দিকে। দেশে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতা বা রাজনীতিবিদ থাকলে এমনটি হতো না। ক্ষমতাসীন দল হোক বা বিরোধী দল হোক, কোনো বড় দল থেকে নীতি-আদর্শের প্রশ্নে বেরিয়ে গিয়ে জনগণের প্রয়োজনে, জাতীয় স্বার্থে, গণতন্ত্র রক্ষায় কোনো নতুন সংগঠন গড়ে তোলা দল ভাঙা নয়। ভাসানী, লোহিয়া, দেশাই, ভিপি সিং, লালু প্রসাদ—কেউই দল ভাঙেননি, নতুন দল গঠন করেছেন গণতন্ত্রের স্বার্থে।
কোনো দেশ থেকে রাজনীতিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সম্পূর্ণ বিরাজনীতি করার বিভিন্ন ধাপ আছে। প্রথমত, রাজনীতিকদের সুবিধাবাদী করে রাজনীতিজীবীতে পরিণত করা। তারপর আমলাদের ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা ও অনাবশ্যক প্রমোশন দিয়ে সুবিধাভোগী বানিয়ে বশে রাখা। বিভিন্ন পেশাজীবীকে কিনে ফেলা। জীবনের অন্য যেকোনো বিষয়ের চেয়ে ক্রিকেট খেলাকে দিয়ে যুবসমাজকে শান্ত রাখা। একই সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা ও জেল–জুলুমের ভয় দেখিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করা অথবা দলে টেনে আনা। বর্তমান দলবদলের মহাযজ্ঞে প্রমাণিত হলো প্রবঞ্চনা, স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদিতায় বাঙালি পৃথিবীতে অদ্বিতীয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
অনেক দিন যাবৎ সম্পাদকীয় পাতার সমসাময়িক বিষয়ের একজন লেখক হিসেবে রাজনীতিজীবীদের দলবদল আমি আন্তরিকভাবে সমর্থন করি। যদি শুনি আওয়ামী লীগের মধ্যে যাঁরা অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাস করেন, তাঁদের কয়েকজন নেতা তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে সিপিবি অফিসে গিয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেছেন, সেটা হবে খুশির খবর। অথবা যদি টিভি চ্যানেলগুলোতে সন্ধ্যার খবরে দেখি বিএনপির লাগাতারে অবিশ্বাসী কয়েকজন প্রগতিশীল শীর্ষ নেতা বাসদ কার্যালয়ে গিয়ে খালেকুজ্জামানের হাতে একগুচ্ছ তাজা রজনীগন্ধা ও গ্ল্যাডিওলাস দিয়ে বাসদে যোগ দিচ্ছেন, তা হবে স্বাগত জানানোর মতো সংবাদ। সুতরাং দলবদল হলেই তা কোনো দুঃসংবাদও নয়, অস্বাভাবিক ব্যাপারও নয়।
উদ্বেগ অথবা বিবেচনার বিষয় হলো, দলবদলটা করছেন কে, কোন দল থেকে কোন দলে যাচ্ছেন এবং তা করছেন কোন সময়। রাজনীতিজীবীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন মানুষ, তাঁরা কারও চাকর নন। তাঁরা কোনো দলে থাকতেও পারেন, এক দল থেকে অন্য দলে যেতে পারেন, এমনকি দলীয় রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিয়ে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ও নেমে যেতে পারেন। তাতে যদি তাঁদের আমদানি দ্রব্যে কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কোনো রাজনীতিজীবী যদি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে অতীতের বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে হপ্তায় তিন দিন বিভিন্ন কাগজে কলাম লিখতে থাকেন, তাতেও বাড়তে পারে দেশবাসীর রাজনৈতিক চেতনা ও জ্ঞানভান্ডার। ওটাই হতে পারে সবচেয়ে বড় দেশ উদ্ধারের কাজ, সহজতরও বটে। সহজতর এ জন্য যে নিজের হাতে বলপয়েন্ট কলম দিয়ে লেখার ঝামেলা নেই, সহকারীকে মিনিট বিশেক ডিকটেকশন দিলেই খাড়া করা সম্ভব একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ।
৫ জানুয়ারির বিশেষ নির্বাচনের পর থেকে গত দেড় বছরে বিএনপি-জামায়াতের ১৯ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। ‘গত দেড় বছরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এ রকম যোগদানের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৬২টি।’ [প্রথম আলো, ১১ জুলাই] বাংলাদেশে রাজনীতিজীবীর সংখ্যা যে বেশুমার, তা এই যোগদানের ঘটনা থেকে প্রমাণিত হলো। প্রথম আলোতে শরিফুজ্জামানের ওই প্রতিবেদন থেকে যা জানা যায়নি, ঘটেনি বলেই লেখা হয়নি, তা হলো বিএনপি-জামায়াতের আর কত নেতা আর কোন কোন দলে যোগ দিয়েছেন।
দলবদল বলতে বোঝায় এ-দল থেকে ও-দলে গিয়ে যোগদান করা। তাৎপর্যের বিষয় হলো, যোগদানের ব্যাপারটি ঘটেছে একতরফাভাবে। এই সময়ে নীতিগত কারণে অথবা ক্ষুব্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের কেউ বিএনপি-জামায়াতে যোগ দেননি। বিএনপি-জামায়াতের দুই ঘাটের তীর থেকে দলে দলে নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগের তরিতে উঠে পড়াটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যোগ করল নতুন মাত্রা। এত দিন যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ভারতপন্থী-পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ভেদাভেদ ছিল, এই দলবদলে তা ঘুচে যাওয়ার প্রক্রিয়াটির সূচনা হলো। ধারণা করি, ২০১৯-এর আগেই বাংলার মাটির রাজনৈতিক স্লোগানও বদলে যাবে। জয় বাংলা ও বাংলাদেশ জিন্দাবাদ সমন্বয় করে ‘জয়-জিন্দা-বাংলা’ গোছের কিছু চালু হবে। আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর জামায়াতে ইসলামীও স্টেডিয়াম থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত সড়কে ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দেবে না। তারা আর বছর পাঁচেক ক্ষমতায় থাকতে পারলে অনুচ্চ স্বরে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এর বদলে পাকিস্তানি আদলে ‘বাংলাদেশ পায়েন্দাবাদ’ স্লোগান প্রবর্তন করত বলে ধারণা করি।
মলম পার্টি থেকে অজ্ঞান পার্টিতে যোগদান আর বিএনপি-জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান এক জিনিস নয়। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে কেউ কোনো দল ছেড়ে দেওয়া এক কথা, আর এক দল ছেড়ে দিয়ে ঘটা করে আর এক দলে যোগদান আর এক কথা। কেউ যখন কোনো দলের ছায়ার নিচে আশ্রয় নেন তখন সেই দলের নীতি-আদর্শ-কর্মসূচি সবকিছুতে পূর্ণ আস্থা স্থাপন করেই তা করেন। কেউ এ কথা বলেন না যে যোগ আমি বিপদে পড়ে আত্মরক্ষার জন্য দিলাম বটে, তবে আমি আপনাদের দলের নীতি-আদর্শ পুরোপুরি নয়, আট আনার মতো বিশ্বাস করি।
যে ১৯-২০ হাজার রাজনীতিজীবী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা আগে ইসলামি/মুসলিম জাতীয়তাবাদের ঝান্ডা নিয়ে ঘুরতেন, এখন থেকে তাঁরা তুলে ধরবেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা। আগে তাঁরা চক্ষু নিমীলিত করে শুনতেন পাকিস্তানি কাওয়ালদের কাওয়ালি, এখন থেকে হাতে তাল ঠুকে তাঁরা শুনবেন কবিগুরুর ‘তুমি যেও না এখনই, এখনো আছে রজনী’। আগে তাঁরা নাভি বের করে নিতম্ব দুলিয়ে নাচের ব্যাপারটায় ঘোর আপত্তি তুলতেন, এখন ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে গিয়ে কথাকলি বা ভরতনাট্যম উপভোগ করবেন। এত দিন নীলো ও সাবিহার পুরোনো ছবিগুলো না দেখলে মন ভরত না, এখন শিল্পা শেঠি, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, মল্লিকা শেরাওয়াতের ফিল্ম ছাড়া মন ভরবে না। আগে তাঁরা রাস্তাঘাটে মেয়েদের বেলেল্লার মতো বেপর্দাভাবে চলাফেরা নাজায়েজ বলতেন, এখন তাঁরা আওয়ামী লীগের নারীনীতির পক্ষে বক্তৃতা দেবেন। দলবদলের দুদিন আগেও তাঁরা ভারতের নাম শুনলে চোখ লাল করতেন, এখন থেকে তাঁরা করবেন মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের তারিফ। আগে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি শুনলেই তাঁরা খুশিতে কান খাড়া করতেন, এখন পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ৩০ লাখ নিহত হওয়ার কথা যেকোনো বক্তৃতায় শ্রোতাদের অনিবার্যভাবে স্মরণ করিয়ে দেবেন। আগে শেখ মুজিবের দুঃশাসনের কথা প্রতিদিন মানুষকে মনে করিয়ে দিতেন, এখন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণের আগে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ কথাগুলো যোগ করতে ভুল করবেন না, যদি নিজের ও বাবার নামটি ভুলে যান তবু।
দলবদল শুধু জেল-জুলুম-ক্রসফায়ার থেকে বাঁচা নয়, টেন্ডারের ভাগ পাওয়া নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারি দলের মনোনয়ন পাওয়াও নয়—অতীতের নীতি-আদর্শ ও বিশ্বাসের খোলনলচে বদলে পুরোনো দেহে নতুন জীবন পাওয়া।
ব্রাহ্ম মতাবলম্বী রবিঠাকুর একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন, তাই তিনি মনটা উতলা হলে গাইতেন: ‘ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা/ প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে।/ যায় যেন মোর সকল গভীর আশা/ প্রভু, তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে।।’ রাজনীতিতে এই ধারণা অচল। বহুদলীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যই হলো বহু দল ও মতাদর্শের সহ-অবস্থান।
সব মতাদর্শ জনগণের মধ্যে প্রচারের সমান সুযোগ। তার ভেতর থেকে বেশির ভাগ মানুষ যেটা গ্রহণ করবে সেটাই প্রাধান্য পাবে।
আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে অথবা ভয়-ভীতিবশত এক দিকে ধাবিত হলে গণতন্ত্রকে যে শুধু কবর দেওয়া হয় তা-ই নয়, দেশে রাজনীতি বলেও কিছু থাকে না।
আগেই বলেছি, দল থেকে চলে যাওয়া, অন্য দলে যোগ দেওয়া অথবা নতুন দল গঠন করা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
বরং বহুদলীয় গণতন্ত্রে সেটা খুবই স্বাভাবিক। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠন করেছিলেন রামমনোহর লোহিয়ারা। মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছিলেন মাওলানা ভাসানী ও তাঁর অনুসারীরা। সেই আওয়ামী লীগ যখন কেন্দ্রে ও পূর্ব বাংলায় ক্ষমতায়, তখন আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ভাসানী ও বামপন্থীরা গঠন করেন ১৯৫৭-তে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। শেখ মুজিব ভাসানীকে কতভাবে অনুরোধ করেছেন দল ছেড়ে না যেতে। মাওলানা বলেছেন, দ্যাখো, এটা আদর্শগত ব্যাপার। তোমরা তোমাদের মতো থাকো, আমরা আমাদের মতো রাজনীতি করি। ভিন্ন সংগঠনে নেতৃত্ব দিলেও ভাসানী-মুজিবের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ভারতে দল পরিবর্তন বা নতুন দল গঠন আরও ব্যাপক। সে জন্যই গণতন্ত্র প্রাণবন্ত ও টেকসই। মোরারজি দেশাইরা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে গঠন করেন ভারতীয় জনতা দল। গঠিত হয়েছে আরও কত দল, যেমন: রাষ্ট্রীয় জনতা দল, তৃণমূল কংগ্রেস, জনতা দল ইউনাইটেড, জনতা দল সমতা প্রভৃতি।
পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে যে রাজনীতিজীবীর সংখ্যা বেশি, তা দলবদলের ঘটনা থেকে বোঝা যায়। সবাই বনপোড়া হরিণের মতো ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে সরকারি দলের দিকে। দেশে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতা বা রাজনীতিবিদ থাকলে এমনটি হতো না। ক্ষমতাসীন দল হোক বা বিরোধী দল হোক, কোনো বড় দল থেকে নীতি-আদর্শের প্রশ্নে বেরিয়ে গিয়ে জনগণের প্রয়োজনে, জাতীয় স্বার্থে, গণতন্ত্র রক্ষায় কোনো নতুন সংগঠন গড়ে তোলা দল ভাঙা নয়। ভাসানী, লোহিয়া, দেশাই, ভিপি সিং, লালু প্রসাদ—কেউই দল ভাঙেননি, নতুন দল গঠন করেছেন গণতন্ত্রের স্বার্থে।
কোনো দেশ থেকে রাজনীতিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সম্পূর্ণ বিরাজনীতি করার বিভিন্ন ধাপ আছে। প্রথমত, রাজনীতিকদের সুবিধাবাদী করে রাজনীতিজীবীতে পরিণত করা। তারপর আমলাদের ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা ও অনাবশ্যক প্রমোশন দিয়ে সুবিধাভোগী বানিয়ে বশে রাখা। বিভিন্ন পেশাজীবীকে কিনে ফেলা। জীবনের অন্য যেকোনো বিষয়ের চেয়ে ক্রিকেট খেলাকে দিয়ে যুবসমাজকে শান্ত রাখা। একই সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা ও জেল–জুলুমের ভয় দেখিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করা অথবা দলে টেনে আনা। বর্তমান দলবদলের মহাযজ্ঞে প্রমাণিত হলো প্রবঞ্চনা, স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদিতায় বাঙালি পৃথিবীতে অদ্বিতীয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments