নির্বাচনকালীন সরকার: হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ- সব দল নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার হতে পারে
আগামী
নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন
রূপরেখা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। দশম সংসদে অর্ধেকের
বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সাংসদদের বৈধতার বিষয়ে এক
মামলায় আদালত একটি পর্যবেক্ষণে এই রূপরেখা দেন। এতে নির্বাচনকালে
প্রধানমন্ত্রীসহ যেকোনো মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নাকচ করার ক্ষমতা নির্বাচন
কমিশনকে দেওয়ার পক্ষেও যুক্তি দিয়েছেন আদালত।
২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পরে উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এই প্রথম দুটি নির্দিষ্ট রূপকল্প পাওয়া গেল। আদালতের রায়ের এই পর্যবেক্ষণের বিষয়ে রাজনীতিবিদ এবং আইন বিশেষজ্ঞরা অনেকেই সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
আর কেউ কেউ তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করতে চাননি। যাঁরা সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন তাঁরা বলছেন যে এই পর্যবেক্ষণ এ কথাই প্রমাণ করে যে দেশে রাজনৈতিক সংকট রয়েছে এবং এর সমাধান প্রয়োজন।
২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে দুটি পৃথক রিট হয়েছিল। ২০১৪ সালের ১৯ জুন ওই দুটি রিট খারিজ করে দেন বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ। সম্প্রতি তার পূর্ণাঙ্গ রায় বেরিয়েছে। এই মামলায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, মাহমুদুল ইসলাম, রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও বদিউল আলম মজুমদার।
‘খন্দকার আবদুস সালাম বনাম বাংলাদেশ’ এবং ‘শাহরিয়ার মজিদ বনাম বাংলাদেশ’ শীর্ষক দুটি রিট নিষ্পত্তি করে আগামী নির্বাচন কীভাবে হতে পারে সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ প্রদানকে আদালত তাঁদের ভাষায় ‘অন্তর্গতভাবে প্রাসঙ্গিক’ বিবেচনা করেছেন। তবে আইনজ্ঞদের অনেকেই এ ধরনের পর্যবেক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, রিট আবেদনটি হয়েছিল ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বৈধতার প্রশ্নে। হাইকোর্ট বলে দিয়েছেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে তিনি বলেন, দেশে যে রাজনৈতিক সংকট আছে এবং তার যে সমাধান প্রয়োজন, সেটি উচ্চ আদালতও অনুভব করছেন। যদিও তিনি মনে করেন, এটি নির্বাহী বিভাগের বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, নির্বাচন ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে একটি ঝামেলা যে রয়েই গেছে তার প্রমাণ বিচার বিভাগ থেকে বিভিন্ন সময়ে আদেশ নির্দেশ ও পর্যবেক্ষণ দেওয়া। তিনি মনে করেন, হাইকোর্ট তাঁর মত দিয়েছেন, এটি যে পালন করতেই হবে তা নয়।
হাইকোর্ট বেঞ্চ তাঁদের রায়ে প্রথম রূপরেখা হিসেবে উল্লেখ করেন, নির্বাচনকালে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা যেতে পারে। সংসদের মেয়াদ পুরো হলে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সংসদ ভেঙে যাওয়ার দিন থেকে ৯০ দিনের জন্য সব দল থেকে ৫০ জন নতুন মন্ত্রী নেওয়া হবে। বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে মন্ত্রীর সংখ্যা ঠিক হবে।
রায়ে আরও বলা হয়, ‘উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান সংসদ বয়কট করার কারণে বিএনপি ও জামায়াত একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তী সরকারে কোনো মন্ত্রী দিতে পারবে না। জাতীয় পার্টি গত নির্বাচনে ৭ ভাগ ভোট পেয়েছে, সেই অনুপাতে তারা মন্ত্রিত্ব পাবে। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানের ৫৬(২) অনুচ্ছেদের আওতায় বয়কটকারী দলগুলো সর্বোচ্চ পাঁচজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী দিতে পারবে। সম্ভাব্য বিতর্ক এড়াতে স্বরাষ্ট্র, অর্থ, পররাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দপ্তর লটারির মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। নির্বাচন কমিশনকে প্রধানমন্ত্রীসহ যেকোনো মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ‘জোরালো কারণ’ দেখিয়ে প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নাকচ করার ক্ষমতা দিতে হবে।
দ্বিতীয় রূপরেখা হিসেবে বলা হয়, কোনো নির্বাচনে বিজয়ী দল প্রথম চার বছর দেশ শাসন করবে। এরপর প্রধান বিরোধী দল শেষ এক বছর দেশ চালাবে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রাপ্ত মোট ভোটের অন্তত অর্ধেক সমান ভোট প্রধান বিরোধী দলকে পেতে হবে। কোনো নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল তা না পেলে তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের পাঁচ বছরের দেশ শাসনের ম্যান্ডেট মেনে নিতে হবে। তবে নির্বাচনকালে প্রথম রূপকল্পমতে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রথম বিকল্প সংবিধান সংশোধন ছাড়াই চলবে। কিন্তু দ্বিতীয় বিকল্পের জন্য সংবিধান সংশোধন লাগতে পারে। কারণ, এক বছরের জন্য যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর নির্ভরশীল হতে না হয়।
রায়ে বলা হয় যে আমাদের সাংবিধানিক স্কিমে ভোট প্রদানের অধিকার সরাসরি সাংবিধানিক অধিকার বলে প্রতীয়মান হয় না। নির্বাচন ও ভোট-সংক্রান্ত ১২২ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয় যে এই বিধানগুলো একজন নাগরিকের ওপর ভোট প্রদানের বিষয়টিকে কোনো কর্তব্য হিসেবে চাপিয়ে দেয় না। বরং ভোট দেওয়া না দেওয়া নাগরিকের স্বেচ্ছাধীন রাখা হয়েছে।
রায়ে বলা হয় যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১৯ ধারার আওতায় নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ দশম সংসদ নির্বাচনে কোনো ভোটকেন্দ্র, পোলিং এজেন্ট বা ভোটারদের উপস্থিতির প্রশ্ন ছিল না। সুতরাং আরপিওর ১৯ ধারা সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে না। এতে বলা হয়, আমাদের আইনি গণ্ডিতে একটি ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনুষ্ঠিত হতে পারে। আরপিওর ১৯ ধারা না থাকলে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ হতে পারত উল্লেখ করে রায়ে বলা হয় যে এর ফলে পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়তে পারত।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে বলা হয়, এই মামলায় ৩০০ আসনের নয়, ১৫৩ আসনের এমপি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আবেদনকারী ও তিন অ্যামিকাস কিউরি (কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, বদিউল আলম মজুমদার) বলেছেন, ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। ভোট কারচুপি ও সহিংসতা ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি বেআইনি নয় বলা হলেও নীতির প্রশ্নে, রুচির প্রশ্নে ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে এটি চরম প্রশ্নবিদ্ধ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিবিরোধী ওই নির্বাচন নিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতরাই প্রশ্ন তুলতে পারতেন। বিরোধীরা কেন, অনির্বাচিত সাংসদেরাই যদি এই প্রশ্ন তুলতেন তাহলে তাঁদের আত্মসম্মানবোধের দৃঢ় পরিচয় পাওয়া যেত।
রায়ে বলা হয়, যারা নির্বাচন বয়কট করেছে তাদের উচিত ছিল নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের দাবিকে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) নির্বাচনী ইশতেহারের এক নম্বর দফায় অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু তারা নির্বাচনে না এসে বরং তা প্রতিহত করতে সচেষ্ট হয়েছে। তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য হরতাল দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সরকারের পদত্যাগ চেয়ে তারা একটি উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নিয়ে সংঘাতমূলক রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে। তারা অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞ করেছে। অনেক গাছ কেটেছে, মসজিদ ও বাজার ধ্বংস করেছে এবং পবিত্র কোরআন ও অন্যান্য বই পুড়িয়েছে। বাসে যাত্রীদের হত্যা করেছে।
হাইকোর্টের এ রায়ে ব্যালটে না ভোট প্রথা চালুর পক্ষে অভিমত দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা বিষয়ে হাইকোর্টের দুটি ফর্মুলা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, এই পর্যবেক্ষণের আইনগত ভিত্তি নেই। তাই এটি গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতাও নেই।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধান হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। তাতেই বলা আছে, কার কী কাজ এবং নির্বাহী বিভাগ কীভাবে পরিচালিত হবে। এর বাইরে কেউ কোনো মত বা পর্যবেক্ষণ দিলেও তা গ্রহণের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
শাহদীন মালিক বলেন, সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে যেমন বিভিন্ন মত দেওয়া হয়, এটি তেমনই একটি মত বা পর্যবেক্ষণ বলে মনে হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে তিনি তাৎক্ষণিক মন্তব্য করতে চান না। এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার আগে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।
২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পরে উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এই প্রথম দুটি নির্দিষ্ট রূপকল্প পাওয়া গেল। আদালতের রায়ের এই পর্যবেক্ষণের বিষয়ে রাজনীতিবিদ এবং আইন বিশেষজ্ঞরা অনেকেই সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
আর কেউ কেউ তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করতে চাননি। যাঁরা সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন তাঁরা বলছেন যে এই পর্যবেক্ষণ এ কথাই প্রমাণ করে যে দেশে রাজনৈতিক সংকট রয়েছে এবং এর সমাধান প্রয়োজন।
২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে দুটি পৃথক রিট হয়েছিল। ২০১৪ সালের ১৯ জুন ওই দুটি রিট খারিজ করে দেন বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ। সম্প্রতি তার পূর্ণাঙ্গ রায় বেরিয়েছে। এই মামলায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, মাহমুদুল ইসলাম, রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও বদিউল আলম মজুমদার।
‘খন্দকার আবদুস সালাম বনাম বাংলাদেশ’ এবং ‘শাহরিয়ার মজিদ বনাম বাংলাদেশ’ শীর্ষক দুটি রিট নিষ্পত্তি করে আগামী নির্বাচন কীভাবে হতে পারে সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ প্রদানকে আদালত তাঁদের ভাষায় ‘অন্তর্গতভাবে প্রাসঙ্গিক’ বিবেচনা করেছেন। তবে আইনজ্ঞদের অনেকেই এ ধরনের পর্যবেক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, রিট আবেদনটি হয়েছিল ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বৈধতার প্রশ্নে। হাইকোর্ট বলে দিয়েছেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে তিনি বলেন, দেশে যে রাজনৈতিক সংকট আছে এবং তার যে সমাধান প্রয়োজন, সেটি উচ্চ আদালতও অনুভব করছেন। যদিও তিনি মনে করেন, এটি নির্বাহী বিভাগের বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, নির্বাচন ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে একটি ঝামেলা যে রয়েই গেছে তার প্রমাণ বিচার বিভাগ থেকে বিভিন্ন সময়ে আদেশ নির্দেশ ও পর্যবেক্ষণ দেওয়া। তিনি মনে করেন, হাইকোর্ট তাঁর মত দিয়েছেন, এটি যে পালন করতেই হবে তা নয়।
হাইকোর্ট বেঞ্চ তাঁদের রায়ে প্রথম রূপরেখা হিসেবে উল্লেখ করেন, নির্বাচনকালে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা যেতে পারে। সংসদের মেয়াদ পুরো হলে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সংসদ ভেঙে যাওয়ার দিন থেকে ৯০ দিনের জন্য সব দল থেকে ৫০ জন নতুন মন্ত্রী নেওয়া হবে। বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে মন্ত্রীর সংখ্যা ঠিক হবে।
রায়ে আরও বলা হয়, ‘উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান সংসদ বয়কট করার কারণে বিএনপি ও জামায়াত একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তী সরকারে কোনো মন্ত্রী দিতে পারবে না। জাতীয় পার্টি গত নির্বাচনে ৭ ভাগ ভোট পেয়েছে, সেই অনুপাতে তারা মন্ত্রিত্ব পাবে। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানের ৫৬(২) অনুচ্ছেদের আওতায় বয়কটকারী দলগুলো সর্বোচ্চ পাঁচজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী দিতে পারবে। সম্ভাব্য বিতর্ক এড়াতে স্বরাষ্ট্র, অর্থ, পররাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দপ্তর লটারির মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। নির্বাচন কমিশনকে প্রধানমন্ত্রীসহ যেকোনো মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ‘জোরালো কারণ’ দেখিয়ে প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নাকচ করার ক্ষমতা দিতে হবে।
দ্বিতীয় রূপরেখা হিসেবে বলা হয়, কোনো নির্বাচনে বিজয়ী দল প্রথম চার বছর দেশ শাসন করবে। এরপর প্রধান বিরোধী দল শেষ এক বছর দেশ চালাবে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রাপ্ত মোট ভোটের অন্তত অর্ধেক সমান ভোট প্রধান বিরোধী দলকে পেতে হবে। কোনো নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল তা না পেলে তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের পাঁচ বছরের দেশ শাসনের ম্যান্ডেট মেনে নিতে হবে। তবে নির্বাচনকালে প্রথম রূপকল্পমতে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রথম বিকল্প সংবিধান সংশোধন ছাড়াই চলবে। কিন্তু দ্বিতীয় বিকল্পের জন্য সংবিধান সংশোধন লাগতে পারে। কারণ, এক বছরের জন্য যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর নির্ভরশীল হতে না হয়।
রায়ে বলা হয় যে আমাদের সাংবিধানিক স্কিমে ভোট প্রদানের অধিকার সরাসরি সাংবিধানিক অধিকার বলে প্রতীয়মান হয় না। নির্বাচন ও ভোট-সংক্রান্ত ১২২ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয় যে এই বিধানগুলো একজন নাগরিকের ওপর ভোট প্রদানের বিষয়টিকে কোনো কর্তব্য হিসেবে চাপিয়ে দেয় না। বরং ভোট দেওয়া না দেওয়া নাগরিকের স্বেচ্ছাধীন রাখা হয়েছে।
রায়ে বলা হয় যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১৯ ধারার আওতায় নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ দশম সংসদ নির্বাচনে কোনো ভোটকেন্দ্র, পোলিং এজেন্ট বা ভোটারদের উপস্থিতির প্রশ্ন ছিল না। সুতরাং আরপিওর ১৯ ধারা সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে না। এতে বলা হয়, আমাদের আইনি গণ্ডিতে একটি ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনুষ্ঠিত হতে পারে। আরপিওর ১৯ ধারা না থাকলে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ হতে পারত উল্লেখ করে রায়ে বলা হয় যে এর ফলে পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়তে পারত।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে বলা হয়, এই মামলায় ৩০০ আসনের নয়, ১৫৩ আসনের এমপি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আবেদনকারী ও তিন অ্যামিকাস কিউরি (কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, বদিউল আলম মজুমদার) বলেছেন, ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। ভোট কারচুপি ও সহিংসতা ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি বেআইনি নয় বলা হলেও নীতির প্রশ্নে, রুচির প্রশ্নে ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে এটি চরম প্রশ্নবিদ্ধ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিবিরোধী ওই নির্বাচন নিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতরাই প্রশ্ন তুলতে পারতেন। বিরোধীরা কেন, অনির্বাচিত সাংসদেরাই যদি এই প্রশ্ন তুলতেন তাহলে তাঁদের আত্মসম্মানবোধের দৃঢ় পরিচয় পাওয়া যেত।
রায়ে বলা হয়, যারা নির্বাচন বয়কট করেছে তাদের উচিত ছিল নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের দাবিকে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) নির্বাচনী ইশতেহারের এক নম্বর দফায় অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু তারা নির্বাচনে না এসে বরং তা প্রতিহত করতে সচেষ্ট হয়েছে। তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য হরতাল দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সরকারের পদত্যাগ চেয়ে তারা একটি উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নিয়ে সংঘাতমূলক রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে। তারা অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞ করেছে। অনেক গাছ কেটেছে, মসজিদ ও বাজার ধ্বংস করেছে এবং পবিত্র কোরআন ও অন্যান্য বই পুড়িয়েছে। বাসে যাত্রীদের হত্যা করেছে।
হাইকোর্টের এ রায়ে ব্যালটে না ভোট প্রথা চালুর পক্ষে অভিমত দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা বিষয়ে হাইকোর্টের দুটি ফর্মুলা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, এই পর্যবেক্ষণের আইনগত ভিত্তি নেই। তাই এটি গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতাও নেই।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধান হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। তাতেই বলা আছে, কার কী কাজ এবং নির্বাহী বিভাগ কীভাবে পরিচালিত হবে। এর বাইরে কেউ কোনো মত বা পর্যবেক্ষণ দিলেও তা গ্রহণের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
শাহদীন মালিক বলেন, সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে যেমন বিভিন্ন মত দেওয়া হয়, এটি তেমনই একটি মত বা পর্যবেক্ষণ বলে মনে হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে তিনি তাৎক্ষণিক মন্তব্য করতে চান না। এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার আগে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।
No comments