সবার সামনে যে চ্যালেঞ্জ by ইনাম আহমেদ চৌধুরী
সিটি
করপোরেশন নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে নিজ নিজ
দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির তিনজন
শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকের লেখা প্রকাশ করছে প্রথম আলো। গত সোম ও মঙ্গলবার
জাতীয় পার্টির গোলাম মোহাম্মদ কাদের এবং আওয়ামী লীগের নূহ–উল–আলম লেনিনের
নিবন্ধ প্রকাশের পর আজ ছাপা হলো বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ
চৌধুরীর লেখা ঢাকা ও চট্টগ্রামে আসন্ন পৌর নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক দলগুলো,
সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্যই চ্যালেঞ্জ নয়, আমার মনে হয় এটা জাতি ও
রাষ্ট্রকে নিয়ে একটি সামগ্রিক চ্যালেঞ্জ। এর সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও
গ্রহণোপযোগী অনুষ্ঠানই জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব ও অগ্রযাত্রার পরবর্তী
স্তরে নিয়ে যেতে পারে। নির্বাচনে কে জেতে, তার চেয়ে অনেক বড় প্রশ্ন
হচ্ছে, কীভাবে জেতে।
দুর্ভাগ্যবশত, এযাবৎ যেসব চিহ্ন, সংকেত বা পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে, তা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের অতীব প্রশ্নবিদ্ধ সাধারণ নির্বাচন, যেখানে অধিকাংশ সাংসদই অনির্বাচিত এবং অন্যদেরও ভোট প্রাপ্তি ছিল খুবই কম, জন্ম দিয়েছে প্রতিবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের। এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে সরকারের দমন-পীড়ন নীতি এবং বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির সুযোগে সন্ত্রাসীরা যে কীভাবে সক্রিয় ও বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে, তা আমরা লক্ষ করেছি।
দেখেছি, বাস্তবসম্মত ও সত্যিকার অর্থে সন্ত্রাস দমনে এবং রাজনৈতিকভাবে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে সরকার ও সরকারি দলের অনীহা, অপারগতা বা অসামর্থ্য। সরকারি দলের (এখানে আমি ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি ও জাসদকেও অন্তর্ভুক্ত ধরছি) একটিমাত্র ইচ্ছাই প্রবল, কী করে আর কতকাল ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতাধর হিসেবে থাকা যায়। তাই সমস্যা সমাধানের একটিমাত্র পন্থা ‘সংলাপ’ শব্দটিতেও তাদের এতটা ঘোর আপত্তি। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন তাদের সেই সুযোগ দিচ্ছে—সংলাপ ছাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন–প্রক্রিয়ায় বিএনপি ও তার সহযোগী বিরোধী দলগুলোর মোকাবিলা করা। কিন্তু এই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নির্বাচন কমিশন বা সরকার কোনো আলাপ-আলোচনা, অন্ততপক্ষে ঘর গোছানোর ন্যূনতম সময় দেওয়ার ব্যবস্থা রেখে নির্ধারিত করেনি। বরং পুলিশপ্রধানের সুপারিশ মোতাবেকই হয়েছে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ। গোড়াতেই গলদ।
বিএনপি বিগত সব সিটি নির্বাচনেই অংশ নিয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী জিতেছেন। সুতরাং নীতিগতভাবে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিএনপির জন্য একটি স্বাভাবিক কার্যক্রম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহ প্রদানের বদলে সরকার বিএনপি এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভীত, আতঙ্কিত, সন্ত্রস্ত করারই চেষ্টা করছে, যাতে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন। মিছে অজুহাত এবং অকারণে বিএনপির হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদ হয়েছেন গুম। উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ। তাঁর এবং আরও অনেকের গাড়ি পোড়ানো, কার্যালয় তালাবদ্ধ, মহাসচিবসহ প্রায় সব সক্রিয় নেতা-কর্মী কারারুদ্ধ বা হুলিয়াপ্রাপ্ত। দলীয় নেত্রী নিজেই নিগৃহীত ও অবরুদ্ধ। পারস্পরিক যোগাযোগ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাস্তব অর্থে প্রায় নিষিদ্ধ। এমতাবস্থায়ও বিএনপি সিটি নির্বাচনে বাছাই করা প্রার্থীকে ঘোষিত সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক। সরকারি দল প্রাজ্ঞ ও সুবিবেচক হলে তো এই সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করা উচিত এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া যাতে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে গ্রহণযোগ্য ও প্রশ্নাতীত হতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধানে সচেষ্ট থাকা উচিত। সরকারি দলগুলোর নেতাদের, মন্ত্রীদের, এমনকি কতিপয় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ডে তা মোটেই মনে হচ্ছে না। বরং সেগুলো হচ্ছে বিপরীতধর্মী।
নির্বাচনে যে প্রথম থেকেই আচরণবিধি লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তা অনস্বীকার্য। প্রার্থীরা শহর দুটির বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেছেন অসংখ্য বিলবোর্ড। নির্দেশ সত্ত্বেও অনেকগুলো এখনো অপসারিত হয়নি। মন্ত্রীদের অনেকেই তো প্রকাশ্যে এবং প্রচার করেই নির্বাচনী কর্মকাণ্ড ও তৎপরতায় অংশ নিচ্ছেন। জনৈক মন্ত্রী তো ঘোষণাই করেছেন, ‘যেকোনো উপায়েই হোক না কেন, আমাদের নির্বাচনে জিততেই হবে।’ তাঁরা কেউ কি কর্মীদের এমনকি ভোটারদের নিয়েও সভা-সমিতি করেছেন? এমতাবস্থায়, এমনকি একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা কর্তৃক প্রতিবেদন দেওয়া সত্ত্বেও, নির্বাচন কমিশন একদম নিশ্চুপ। তারা কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাই নিচ্ছে না, শাস্তিমূলক তো দূরের কথা। এগুলো শুধু গর্হিত নয়, শাস্তিযোগ্য নির্বাচন আইন ভঙ্গের অপরাধ। তবু কেনো প্রতিকার নেই।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে আবার ঘোষণা করা হয়েছে, কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে হুলিয়া থাকলে এবং তিনি দৃষ্টিগোচর হলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। বিএনপির প্রায় সব সক্রিয় নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধেই তো আজেবাজে কারণে জারি আছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। সক্রিয় হলে আরও জারি হবে। এমতাবস্থায় শুধু মেয়র পদপ্রার্থী নয়, অধিকাংশ প্রার্থীর তো মাঠে নামাই অসম্ভব। তা ছাড়া নির্বাচনে সহায়তাকারী, পোলিং এজেন্ট পাওয়া তো হয়ে দাঁড়াবে দুষ্কর। কোথায় ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’, শুধু ‘ফিল্ড’ই তো পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
প্রতিপক্ষকে চাপে রেখে যেনতেন প্রকারে যদি আওয়ামী লীগ তাদের মনোনীত প্রার্থীর বিজয় ঘোষণা করাতে সমর্থ হয় এবং এ প্রক্রিয়ায় যদি বর্তমানের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশন তাদের যথারীতি সহযোগিতা করে যায়, তাহলে নির্বাচনটি শুধু যে অফলপ্রসূ হবে তা নয়, সরকারের অধীন নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে বিরূপ ও অগ্রহণযোগ্য মনোভাব দেশে-বিদেশে রয়েছে, তা দৃঢ়তর হবে। তাহলে তো সরকারি দলের কোনো ফায়দাই হচ্ছে না। উপরন্তু সরকারি সংস্থাগুলো ও নির্বাচন কমিশন জনশত্রুতে পরিণত হতে পারে। মোগলরা সারা ভারতবর্ষ সফলভাবে শাসন করে গেছেন কয়েক শতাব্দী। বলা হয়ে থাকে, একক ভৌগোলিক ইউনিট হিসেবে ভারতের প্রতিষ্ঠা এবং এর সমাজ-সংস্কৃতির ভিত রচনা মোগল সম্রাটদের এবং তাঁদের প্রশাসনের অনবদ্য ও অমর কীর্তি। এই মহান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর লিখিত আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’য় উল্লেখ আছে, তাঁর উত্তরাধিকারী প্রিয় পুত্র হুমায়ুনের প্রতি তাঁর প্রদত্ত একটি উপদেশ। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রিয় পুত্র, তুমি যদি দীর্ঘকাল এ দেশে ফলপ্রসূ রাজত্ব করতে চাও, তাহলে পরাজিত শত্রুর সঙ্গে তিক্ত বিরোধিতায় লিপ্ত না হয়ে তার সঙ্গে সদ্ভাব সৃষ্টি কোরো।’
রাষ্ট্রক্ষমতা এখন আওয়ামী লীগের করায়ত্ত। সুতরাং একটি বশংবদ নির্বাচনী কমিশনের পদলেহিতায় তাদের পক্ষে প্রতিপক্ষকে বিভিন্ন দিকে ঘায়েল করে বিজয়ের ঘোষণা অর্জন যে সম্ভব হতে পারে, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। তাই এবারও যদি তা-ই হয়, তাহলে নির্বাচনই যে আসলে অগ্রহণযোগ্য হবে তা নয়, দেশে-বিদেশে কেউ একে সুস্থ মস্তিষ্কে মেনে নেবেন না। আজ তাই প্রশ্ন, সরকারি দল কি এটা অনুধাবন ও উপলব্ধি করতে পারবে?
এই মহাপরীক্ষার দিনে যে সংস্থাটির নিজ ভূমিকা যথার্থরূপে পালন করার কথা এবং যার কর্তব্যপরায়ণতা ও সক্ষমতার ওপর সাফল্য-ব্যর্থতা বহুলাংশে নির্ভরশীল, সেই নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় ও দায়িত্ববান হয়ে উঠতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি অকেজো, অথর্ব, অপটু এবং একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা হিসেবে দুর্নাম কুড়িয়েছে। এটাকে পরিবর্তন করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু তা তো এখন সম্ভব নয়। আমরা আশা করব, দেশ-জাতি এমনকি নিজেদের আপন স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের বোধোদয় হবে।
আমরা পার্শ্ববর্তী দেশগুলো, ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা, এমনকি নেপাল-ভুটানেও নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। পাকিস্তানের বিগত নির্বাচন সফল করতে পেরেছিল নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্য ভূমিকা। ভারতে গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য যে সংস্থা এবং যার কার্যক্রম বহুলাংশে কৃতিত্বের দাবিদার, তা হচ্ছে নিরপেক্ষ কর্মক্ষম দুর্নীতিমুক্ত নির্বাচন কমিশন এবং নিরপেক্ষ প্রশাসন। আমাদের নির্বাচন কমিশনের ওপর অনেক দায়িত্ব রয়েছে, তাদের ওপর অনেক ক্ষমতাও অর্পিত রয়েছে। তারা যদি তাদের নিরপেক্ষতা বা কর্মক্ষমতা কিছুটাও দেখাতে পারত এবং হাস্যকরভাবে একটি পদলেহী বশংবদের ভূমিকা পালন না করতে চাইত, তাহলে আমার কাছে মনে হয় সারা দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং জটিল সমস্যার অবসান বা সমাধান হতে পারত। অথচ একটি সাংবিধানিক স্বাধীন কমিশন হিসেবে কোনো কাজেই তারা সেই প্রবণতা দেখাচ্ছে না। বিএনপি দলের অনেক নেতাই এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন।
নির্বাচনে যখন বিএনপি অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে, দলটাকেও সুসংহত এবং যথাসম্ভব সক্রিয় হতে হবে। এ ব্যাপারে যখন অন্যায় প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা বা বিরোধিতার সৃষ্টি সরকারি দল করবে, কিংবা কারচুপি এবং বিধিবহির্ভূত অন্যায় কর্মকাণ্ডের আশ্রয় গ্রহণ করবে, তা জাগ্রত ও সচেতন জনসমাজের চোখে ধরা পড়বে। তাহলে সরকারিভাবে যে ফলাফলই ঘোষণা করা হোক না কেন, ওইজাতীয় কর্মকাণ্ডজনিত তথাকথিত বিজয় সম্পূর্ণ নিরর্থক হয়ে দাঁড়াবে। সে অবস্থায় পরাজিত হলেও সত্যিকারভাবে তা নৈতিক ও রাজনৈতিক বিজয় হয়ে দাঁড়াবে।
সন্ত্রাস ও সহিংস কর্মকাণ্ড সর্বদাই পরিত্যাজ্য। উসকানির মুখেও তা পরিহার করতে কিংবা সে রকম কিছু করার সুযোগ না দিতে সচেতন থাকতে হবে। সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। জাতির জন্য তা সম্পূর্ণ ধ্বংসাত্মক। সব দলকেই ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসবিরোধী প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে। আগামী পৌর নির্বাচন জাতিকে একটি মহাসুযোগ দিচ্ছে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার মূল দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। আমরা আশা করব, তারা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী: অর্থনীতিবিদ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
দুর্ভাগ্যবশত, এযাবৎ যেসব চিহ্ন, সংকেত বা পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে, তা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের অতীব প্রশ্নবিদ্ধ সাধারণ নির্বাচন, যেখানে অধিকাংশ সাংসদই অনির্বাচিত এবং অন্যদেরও ভোট প্রাপ্তি ছিল খুবই কম, জন্ম দিয়েছে প্রতিবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের। এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে সরকারের দমন-পীড়ন নীতি এবং বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির সুযোগে সন্ত্রাসীরা যে কীভাবে সক্রিয় ও বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে, তা আমরা লক্ষ করেছি।
দেখেছি, বাস্তবসম্মত ও সত্যিকার অর্থে সন্ত্রাস দমনে এবং রাজনৈতিকভাবে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে সরকার ও সরকারি দলের অনীহা, অপারগতা বা অসামর্থ্য। সরকারি দলের (এখানে আমি ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি ও জাসদকেও অন্তর্ভুক্ত ধরছি) একটিমাত্র ইচ্ছাই প্রবল, কী করে আর কতকাল ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতাধর হিসেবে থাকা যায়। তাই সমস্যা সমাধানের একটিমাত্র পন্থা ‘সংলাপ’ শব্দটিতেও তাদের এতটা ঘোর আপত্তি। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন তাদের সেই সুযোগ দিচ্ছে—সংলাপ ছাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন–প্রক্রিয়ায় বিএনপি ও তার সহযোগী বিরোধী দলগুলোর মোকাবিলা করা। কিন্তু এই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নির্বাচন কমিশন বা সরকার কোনো আলাপ-আলোচনা, অন্ততপক্ষে ঘর গোছানোর ন্যূনতম সময় দেওয়ার ব্যবস্থা রেখে নির্ধারিত করেনি। বরং পুলিশপ্রধানের সুপারিশ মোতাবেকই হয়েছে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ। গোড়াতেই গলদ।
বিএনপি বিগত সব সিটি নির্বাচনেই অংশ নিয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী জিতেছেন। সুতরাং নীতিগতভাবে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিএনপির জন্য একটি স্বাভাবিক কার্যক্রম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহ প্রদানের বদলে সরকার বিএনপি এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভীত, আতঙ্কিত, সন্ত্রস্ত করারই চেষ্টা করছে, যাতে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন। মিছে অজুহাত এবং অকারণে বিএনপির হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদ হয়েছেন গুম। উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ। তাঁর এবং আরও অনেকের গাড়ি পোড়ানো, কার্যালয় তালাবদ্ধ, মহাসচিবসহ প্রায় সব সক্রিয় নেতা-কর্মী কারারুদ্ধ বা হুলিয়াপ্রাপ্ত। দলীয় নেত্রী নিজেই নিগৃহীত ও অবরুদ্ধ। পারস্পরিক যোগাযোগ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাস্তব অর্থে প্রায় নিষিদ্ধ। এমতাবস্থায়ও বিএনপি সিটি নির্বাচনে বাছাই করা প্রার্থীকে ঘোষিত সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক। সরকারি দল প্রাজ্ঞ ও সুবিবেচক হলে তো এই সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করা উচিত এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া যাতে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে গ্রহণযোগ্য ও প্রশ্নাতীত হতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধানে সচেষ্ট থাকা উচিত। সরকারি দলগুলোর নেতাদের, মন্ত্রীদের, এমনকি কতিপয় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ডে তা মোটেই মনে হচ্ছে না। বরং সেগুলো হচ্ছে বিপরীতধর্মী।
নির্বাচনে যে প্রথম থেকেই আচরণবিধি লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তা অনস্বীকার্য। প্রার্থীরা শহর দুটির বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেছেন অসংখ্য বিলবোর্ড। নির্দেশ সত্ত্বেও অনেকগুলো এখনো অপসারিত হয়নি। মন্ত্রীদের অনেকেই তো প্রকাশ্যে এবং প্রচার করেই নির্বাচনী কর্মকাণ্ড ও তৎপরতায় অংশ নিচ্ছেন। জনৈক মন্ত্রী তো ঘোষণাই করেছেন, ‘যেকোনো উপায়েই হোক না কেন, আমাদের নির্বাচনে জিততেই হবে।’ তাঁরা কেউ কি কর্মীদের এমনকি ভোটারদের নিয়েও সভা-সমিতি করেছেন? এমতাবস্থায়, এমনকি একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা কর্তৃক প্রতিবেদন দেওয়া সত্ত্বেও, নির্বাচন কমিশন একদম নিশ্চুপ। তারা কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাই নিচ্ছে না, শাস্তিমূলক তো দূরের কথা। এগুলো শুধু গর্হিত নয়, শাস্তিযোগ্য নির্বাচন আইন ভঙ্গের অপরাধ। তবু কেনো প্রতিকার নেই।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে আবার ঘোষণা করা হয়েছে, কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে হুলিয়া থাকলে এবং তিনি দৃষ্টিগোচর হলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। বিএনপির প্রায় সব সক্রিয় নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধেই তো আজেবাজে কারণে জারি আছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। সক্রিয় হলে আরও জারি হবে। এমতাবস্থায় শুধু মেয়র পদপ্রার্থী নয়, অধিকাংশ প্রার্থীর তো মাঠে নামাই অসম্ভব। তা ছাড়া নির্বাচনে সহায়তাকারী, পোলিং এজেন্ট পাওয়া তো হয়ে দাঁড়াবে দুষ্কর। কোথায় ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’, শুধু ‘ফিল্ড’ই তো পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
প্রতিপক্ষকে চাপে রেখে যেনতেন প্রকারে যদি আওয়ামী লীগ তাদের মনোনীত প্রার্থীর বিজয় ঘোষণা করাতে সমর্থ হয় এবং এ প্রক্রিয়ায় যদি বর্তমানের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশন তাদের যথারীতি সহযোগিতা করে যায়, তাহলে নির্বাচনটি শুধু যে অফলপ্রসূ হবে তা নয়, সরকারের অধীন নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে বিরূপ ও অগ্রহণযোগ্য মনোভাব দেশে-বিদেশে রয়েছে, তা দৃঢ়তর হবে। তাহলে তো সরকারি দলের কোনো ফায়দাই হচ্ছে না। উপরন্তু সরকারি সংস্থাগুলো ও নির্বাচন কমিশন জনশত্রুতে পরিণত হতে পারে। মোগলরা সারা ভারতবর্ষ সফলভাবে শাসন করে গেছেন কয়েক শতাব্দী। বলা হয়ে থাকে, একক ভৌগোলিক ইউনিট হিসেবে ভারতের প্রতিষ্ঠা এবং এর সমাজ-সংস্কৃতির ভিত রচনা মোগল সম্রাটদের এবং তাঁদের প্রশাসনের অনবদ্য ও অমর কীর্তি। এই মহান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর লিখিত আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’য় উল্লেখ আছে, তাঁর উত্তরাধিকারী প্রিয় পুত্র হুমায়ুনের প্রতি তাঁর প্রদত্ত একটি উপদেশ। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রিয় পুত্র, তুমি যদি দীর্ঘকাল এ দেশে ফলপ্রসূ রাজত্ব করতে চাও, তাহলে পরাজিত শত্রুর সঙ্গে তিক্ত বিরোধিতায় লিপ্ত না হয়ে তার সঙ্গে সদ্ভাব সৃষ্টি কোরো।’
রাষ্ট্রক্ষমতা এখন আওয়ামী লীগের করায়ত্ত। সুতরাং একটি বশংবদ নির্বাচনী কমিশনের পদলেহিতায় তাদের পক্ষে প্রতিপক্ষকে বিভিন্ন দিকে ঘায়েল করে বিজয়ের ঘোষণা অর্জন যে সম্ভব হতে পারে, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। তাই এবারও যদি তা-ই হয়, তাহলে নির্বাচনই যে আসলে অগ্রহণযোগ্য হবে তা নয়, দেশে-বিদেশে কেউ একে সুস্থ মস্তিষ্কে মেনে নেবেন না। আজ তাই প্রশ্ন, সরকারি দল কি এটা অনুধাবন ও উপলব্ধি করতে পারবে?
এই মহাপরীক্ষার দিনে যে সংস্থাটির নিজ ভূমিকা যথার্থরূপে পালন করার কথা এবং যার কর্তব্যপরায়ণতা ও সক্ষমতার ওপর সাফল্য-ব্যর্থতা বহুলাংশে নির্ভরশীল, সেই নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় ও দায়িত্ববান হয়ে উঠতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি অকেজো, অথর্ব, অপটু এবং একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা হিসেবে দুর্নাম কুড়িয়েছে। এটাকে পরিবর্তন করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু তা তো এখন সম্ভব নয়। আমরা আশা করব, দেশ-জাতি এমনকি নিজেদের আপন স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের বোধোদয় হবে।
আমরা পার্শ্ববর্তী দেশগুলো, ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা, এমনকি নেপাল-ভুটানেও নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। পাকিস্তানের বিগত নির্বাচন সফল করতে পেরেছিল নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্য ভূমিকা। ভারতে গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য যে সংস্থা এবং যার কার্যক্রম বহুলাংশে কৃতিত্বের দাবিদার, তা হচ্ছে নিরপেক্ষ কর্মক্ষম দুর্নীতিমুক্ত নির্বাচন কমিশন এবং নিরপেক্ষ প্রশাসন। আমাদের নির্বাচন কমিশনের ওপর অনেক দায়িত্ব রয়েছে, তাদের ওপর অনেক ক্ষমতাও অর্পিত রয়েছে। তারা যদি তাদের নিরপেক্ষতা বা কর্মক্ষমতা কিছুটাও দেখাতে পারত এবং হাস্যকরভাবে একটি পদলেহী বশংবদের ভূমিকা পালন না করতে চাইত, তাহলে আমার কাছে মনে হয় সারা দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং জটিল সমস্যার অবসান বা সমাধান হতে পারত। অথচ একটি সাংবিধানিক স্বাধীন কমিশন হিসেবে কোনো কাজেই তারা সেই প্রবণতা দেখাচ্ছে না। বিএনপি দলের অনেক নেতাই এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন।
নির্বাচনে যখন বিএনপি অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে, দলটাকেও সুসংহত এবং যথাসম্ভব সক্রিয় হতে হবে। এ ব্যাপারে যখন অন্যায় প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা বা বিরোধিতার সৃষ্টি সরকারি দল করবে, কিংবা কারচুপি এবং বিধিবহির্ভূত অন্যায় কর্মকাণ্ডের আশ্রয় গ্রহণ করবে, তা জাগ্রত ও সচেতন জনসমাজের চোখে ধরা পড়বে। তাহলে সরকারিভাবে যে ফলাফলই ঘোষণা করা হোক না কেন, ওইজাতীয় কর্মকাণ্ডজনিত তথাকথিত বিজয় সম্পূর্ণ নিরর্থক হয়ে দাঁড়াবে। সে অবস্থায় পরাজিত হলেও সত্যিকারভাবে তা নৈতিক ও রাজনৈতিক বিজয় হয়ে দাঁড়াবে।
সন্ত্রাস ও সহিংস কর্মকাণ্ড সর্বদাই পরিত্যাজ্য। উসকানির মুখেও তা পরিহার করতে কিংবা সে রকম কিছু করার সুযোগ না দিতে সচেতন থাকতে হবে। সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। জাতির জন্য তা সম্পূর্ণ ধ্বংসাত্মক। সব দলকেই ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসবিরোধী প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে। আগামী পৌর নির্বাচন জাতিকে একটি মহাসুযোগ দিচ্ছে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার মূল দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। আমরা আশা করব, তারা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী: অর্থনীতিবিদ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
No comments