কেন এই নিষ্ক্রিয়তা, সমবেদনাহীনতা? by আলী রীয়াজ
‘আমরা
পুলিশ ও প্রক্টরকে ঘটনা জানালেও তাঁরা কেউ যথাসময়ে আসেননি। ছাত্র
ইউনিয়নের ছেলেরা পরে প্রক্টরের কার্যালয়ে গিয়ে দেখেন, “তিনি কম্পিউটারে
গেমস খেলছেন”।...সোহরাওয়ার্দী গেটে যখন এই ঘটনা ঘটছিল, তখন সেখানে পুলিশের
মাত্র দুজন সদস্য ছিলেন। টিএসসির ডাচ্-বাংলা বুথের দিকে পুলিশের বেশ
কয়েকজন সদস্য ছিলেন। আমরা তাঁদের এগিয়ে আসতে বললে তাঁরা তখন রাজি হননি।
ঘটনাস্থল থেকে আমরা দুজনকে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ পরে তাদের
ছেড়ে দিয়েছে বলে জানতে পারি।’ কার্যত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের
ভেতরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে বাংলা নববর্ষের দিনে নারীদের ওপরে
একাধিক যৌন নির্যাতনের ঘটনার সময়ে যাঁরা তা প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেছেন,
এটি তাঁদের ভাষ্য। এই হচ্ছে পুলিশ ও কর্তৃপক্ষের ভূমিকা।
আমরা কি একে দায়িত্ব পালনে অবহেলা বলব? একে কী আমরা নিষ্ক্রিয়তা বলব? বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আমি একে গাফিলতি বলতে নারাজ। পুলিশের কোনো গাফিলতি হয়নি, কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা হয়নি। আপনি আমার সঙ্গে একমত না হলে অভিজিৎ রায়ের হত্যার ঘটনার পর পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন পড়ে দেখতে পারেন। পুলিশের প্রতিবেদনে আছে পুলিশের গাফিলতি হয়নি। অভিজিতের হত্যার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদৌ কোনো তদন্ত করেছিল বলে শুনিনি। করলেও তাদের ফলাফল ভিন্ন হতো বলে মনে হয় না। বিশেষ করে এই খবর জানার পর যে ‘প্রক্টরের কার্যালয়ে গিয়ে [ছাত্ররা] দেখেন, তিনি কম্পিউটারে গেমস খেলছেন’। কম্পিউটার বা কম্পিউটারের বাইরের ‘গেমস’ খেলায় ব্যস্ত মানুষেরা কেবল তদন্তের কারণে দায়িত্ব নেবেন, এমন মনে করার মতো কারণ ঘটেনি।
আমরা কি একে দায়িত্ব পালনে অবহেলা বলব? একে কী আমরা নিষ্ক্রিয়তা বলব? বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আমি একে গাফিলতি বলতে নারাজ। পুলিশের কোনো গাফিলতি হয়নি, কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা হয়নি। আপনি আমার সঙ্গে একমত না হলে অভিজিৎ রায়ের হত্যার ঘটনার পর পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন পড়ে দেখতে পারেন। পুলিশের প্রতিবেদনে আছে পুলিশের গাফিলতি হয়নি। অভিজিতের হত্যার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদৌ কোনো তদন্ত করেছিল বলে শুনিনি। করলেও তাদের ফলাফল ভিন্ন হতো বলে মনে হয় না। বিশেষ করে এই খবর জানার পর যে ‘প্রক্টরের কার্যালয়ে গিয়ে [ছাত্ররা] দেখেন, তিনি কম্পিউটারে গেমস খেলছেন’। কম্পিউটার বা কম্পিউটারের বাইরের ‘গেমস’ খেলায় ব্যস্ত মানুষেরা কেবল তদন্তের কারণে দায়িত্ব নেবেন, এমন মনে করার মতো কারণ ঘটেনি।
প্রতিবাদ করতে গিয়ে হামলায় আহত লিটন নন্দী |
এমন
তো নয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে এমন ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি, ফলে এই নিয়ে
উদ্বেগের কারণ ছিল না। বইমেলার পর সম্ভবত এটাই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়
সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় ধরনের জনসমাবেশের ঘটনা, যা আগে থেকেই জানার কথা। ঘটনার
প্রাথমিক বর্ণনা শুনে গত মঙ্গলবার আমার মনে হয়েছিল, ‘নিষ্ক্রিয়তাও একটা
ক্রিয়া হতে পারে।’ সেটা অভিজিতের হত্যার সময় হতে পারে, নারীদের ওপরে
প্রকাশ্যে যৌন নির্যাতনের সময় হতে পারে, অন্য সময়েও হতে পারে। কেননা, আইন
রক্ষাকারীদের কী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটার খোঁজ নেওয়া দরকার সবচেয়ে আগে।
যদি না জেনে থাকেন, তবে খোঁজখবর নিন; আমরা চাইলে গতকাল বৃহস্পতিবারের
সংবাদপত্র ভালো করে পাঠ করে দেখতে পারি। আরও উৎসাহ থাকলে আইন ও সালিশ
কেন্দ্রের প্রকাশিত জানুয়ারি-মার্চের হিসাব দেখতে পারেন। ১ এপ্রিল প্রথম
আলোয় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বন্দুকযুদ্ধে পুলিশ এগিয়ে’। খবরে জানা
গিয়েছিল, তিন মাসে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে ৬৪ জন, তার মধ্যে ২৪ জন মারা
যায় পুলিশের হাতে।
অভিজিতের ওপরে হামলার
সময়কার বর্ণনা আমরা শুনেছি, পুলিশ মনে করেছে যে একটা ঝামেলা চলছে সেখানে,
তাদের কোনো ভূমিকা নেই। এ ক্ষেত্রেও সম্ভবত তার কোনো অন্যথা হয়নি। পুলিশ
ঝামেলায় জড়াতে চায়নি, যদিও ঘটনা ঘটেছে ঘণ্টা খানেক ধরে। পুলিশ কেন ঝামেলায়
যায় না, সেটাও কমবেশি সবার জানা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ
বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার-সমর্থক সংগঠকেরা ছাড়া আর কারও পক্ষে বীরদর্পে কিছু
করা সম্ভব, এটা কেউই মনে করেন না। পুলিশ ভিন্ন কিছু ভাববে, তা বিশ্বাস করার
কারণ নেই। ফলে এই ধরনের ঘটনায় পুলিশের দায়িত্ব কী, সেটা আমি-আপনি বুঝতে না
পারলেও পুলিশ ঠিকই বোঝে। এখন অভিজিতের হত্যা কিংবা এই যৌন নিপীড়নের
বিরুদ্ধে কথা বলার সময় আপনি কি এসব বিষয় এড়িয়ে যেতে পারেন? দায়িত্ব পালনের
ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকাকে আর সবকিছু থেকে বিযুক্ত করে ভেবে আত্মতৃপ্তি
মিলতে পারে, আমরা মনে করতে পারি যে সমাজে জবাবদিহির আর সব ব্যবস্থাকে
অস্বীকার করে কেবল একটি ঘটনায় আমরা চাইব প্রশাসন দায়িত্ববান হবে; কিন্তু
সেটা যে আদৌ সম্ভব নয়, তা বিবেচক মানুষ মাত্রই বোঝেন। এই ধরনের চাওয়ার
নৈতিক জোর কতটা, সেটাও ভাবা দরকার।
শুধু
তা-ই নয়, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের প্রশ্নে কেবল রাজধানীতে কী ঘটল,
সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার, সম্মান ও নিরাপত্তা কতটা বিঘ্নিত হলো, তাই নিয়ে
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশকে যদি নিজের একমাত্র করণীয় বলে
বিবেচনা করি, তবে এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে, যেমন অতীতে ঘটেছে। এসব
ন্যক্কারজনক ঘটনার আগেই যখন খাগড়াছড়িতে বৈসাবি মেলায় হামলা হচ্ছে, দেশের
বিভিন্ন স্থানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর বা মন্দিরে হামলা এবং তাদের
উচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে, তখনো একইভাবে আমাদের প্রতিক্রিয়া হয় না। আমার
বিবেচনায় নাগরিকের অধিকারের সমতা বিধান, তার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার
সংগ্রাম থেকে এগুলো কোনো আলাদা বিষয় নয়। রাষ্ট্র, ক্ষমতাসীন ও
ক্ষমতাবহির্ভূতরা যখন শক্তির জোরে সবকিছু সমাধানের চেষ্টা করবেন, তখন
সমাজের সর্বত্রই শক্তির জোরই প্রতিষ্ঠিত হবে। সেখানে সংখ্যালঘুরা যেমন
আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবে, তেমনি নারীরাও হবেন। দায়মুক্তির ব্যবস্থা থাকলে
তাতে ক্ষমতাসীনেরা বিভিন্নভাবেই পার পাবে; হত্যা করেও পার পাবে, ধর্ষণ করেও
পার পাবে।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পাশে (গোল চিহ্নত) পয়লা বৈশাখে যৌন হয়রানির ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতা নিশাত ইমতিয়াজ বিজয়। |
পুলিশ ও কর্তৃপক্ষের এসব
ভূমিকার মৌলিক দিকের পাশাপাশি আমার মনে প্রশ্ন রয়েছে অন্যান্য বিষয়েও। এই
ঘটনার পর অনেকেই, বিশেষ করে যাঁরা বাংলা নববর্ষের উদ্যাপন ও উদ্যাপনের
বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিয়ে আপত্তি করেন, একে অনৈসলামিক বলে দাবি করেন, পাবলিক
স্পেসে নারীদের উপস্থিতি বিষয়ে একধরনের কূপমণ্ডূকতায় ভোগেন, তাঁরা এই
সুযোগে তাঁদের এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত আছেন। তাঁদের কথা শুনলে মনে হয় দায় ওই
সব নারীর, যাঁরা ‘জেনেশুনে’ এই অবস্থার শিকার হতে স্বেচ্ছায় যথাসময়ে
যথাস্থানে হাজির হয়েছেন। এই ধরনের বক্তব্যের পেছনের রাজনীতি আমাদের
বোধগম্য। ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের এসব প্রতিনিধির রাজনীতির বিরুদ্ধে আদর্শিক
সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে; কিন্তু সেটা করতে হবে শক্তিশালী নৈতিক অবস্থান
থেকে। তাঁদের এসব পশ্চাদমুখী ধারণাকে নাকচ করে দেওয়ার, তার আবেদনকে দুর্বল ও
অগ্রহণযোগ্য করে দেওয়ার উপায় এটা নয় যে এই ধরনের ঘটনার জন্য তাঁদের
নির্বিচারে দায়ী করা। বরং উত্তর হচ্ছে নাগরিক হিসেবে নারীদের অধিকার
নিশ্চিত করা।
আগের ঘটনার বিচার কি হয়েছিল? এবারের ঘটনার বিচার ও কি হবে? বস্ত্রহরণরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগ নেতা রাসেল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের ছাত্র ছাত্রলীগ নেতা আলম |
যতক্ষণ পর্যন্ত তা করা
যাচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত অঙ্গুলি-সংকেত করার ফল ইতিবাচক হবে না। উল্টো এই
ধরনের ঘটনা ওই সব পশ্চাদমুখী চিন্তাকেই সাহায্য করবে। এসব ঘটনাই কেবল নয়,
এই ঘটনার পরে সেগুলোকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা যেমন অগ্রহণযোগ্য, ঠিক তেমনি এর
জন্য দায়িত্ব না নেওয়ার চেষ্টাও ক্ষতিকারক। এসবের কুফল আপনার ইচ্ছা
নিরপেক্ষ বলেই ধরে নিতে পারেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দায়মুক্তির সংস্কৃতির
অবসান, সর্বক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে বাধ্যবাধকতার রাজনৈতিক পরিবেশ এবং
জবাবদিহির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির দাবি থেকে বিচ্ছিন্ন করে সুনির্দিষ্ট
ঘটনার প্রতিবাদ করলে তাঁর পরিণতি কী হয়, সেটা বুঝতে হলে কেবল সাম্প্রতিক
ইতিহাসের দিকে তাকালেই যথেষ্ট। তার অর্থ এই নয় যে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করা
নিরর্থক; বরং একে আরও বৃহত্তর সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করা জরুরি।
যখনই
এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে, প্রকাশ্যে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা ঘটে,
তখনই একটা প্রশ্ন ওঠে-সাধারণ মানুষ, যারা দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে, তারা কেন
তাৎক্ষণিকভাবে সক্রিয় হলো না। অভিজিৎ রায়ের হত্যার ঘটনার পর অনেকেই এই
প্রশ্নের অবতারণা করেছিলেন। কিন্তু তার কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর আমরা পাই না।
এর একটা উত্তর সম্ভবত পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়’ ভূমিকার ব্যাখ্যার মধ্যেই আছে।
কিন্তু সেটা যথেষ্ট বলে আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের সমাজ মানসে কী এমন
পরিবর্তন ঘটেছে, যা মানুষকে সমবেদনাহীন, নিষ্ক্রিয় করে তুলছে?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments