রেকর্ড পদোন্নতি ভারসাম্যহীন প্রশাসন by দীন ইসলাম
জনপ্রশাসনে
পর্যাপ্ত পদ না থাকলেও ঢালাও পদোন্নতি চলছেই। আওয়ামী সরকারের আমলে এ দফায়
সবচেয়ে বড় অর্থাৎ তিন স্তরে ৮৭৩ জনকে পদোন্নতি দিলেও অসংখ্য কর্মকর্তাকে
এবারও কাজ না দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
(ওএসডি) করে রাখা হবে। তাদের কাজ না দিয়ে বসিয়ে বসিয়ে বেতন ভাতা দেয়া হবে।
এতে প্রতি মাসে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হবে। সর্বশেষ গত সোমবারের
পদোন্নতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পর্যাপ্ত পদ না থাকা সত্ত্বেও
স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ ও অনুগত কর্মকর্তাদের ঢালাওভাবে পদোন্নতি দেয়ার কারণে
জনপ্রশাসনে উপ-সচিব থেকে ওপরের স্তরের পদগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত কর্মকর্তা
হয়ে গেছেন। ফলে জনপ্রশাসনের আদর্শ কাঠামো (পিরামিড কাঠামো) ভেঙে গিয়ে মাথা
মোটা হয়ে গেছে। আদর্শ নিয়মে নিচের স্তরের পদগুলোতে কর্মকর্তা বেশি থাকে আর
ওপরের স্তরে কম হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রশাসনের কাঠামো উল্টো পিরামিডের মতো
হয়ে গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারি
কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইন মানবজমিনকে বলেন, পদ ছাড়া
পদোন্নতি দেয়ার কারণে প্রশাসনে এখন ভারসাম্যহীন অবস্থা বিরাজ করছে। এটা দিন
দিন বাড়ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে জানান, একদিকে
ওএসডি আর অন্যদিকে ঢালাও পদোন্নতি প্রশাসনকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে। এ
ভারসাম্যহীনতা গত সোমবারের পদোন্নতির কারণে চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।
কোন প্রশাসনিক পরিকল্পনা ছাড়া এভাবে গণহারে পদোন্নতি দেয়ার কোন মানে হয় না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে উপ-সচিবের অনুমোদিত পদ
রয়েছে ৮৩০টি। সর্বশেষ এ পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে ৩৪৩ জন সিনিয়র সহকারী
সচিব ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাকে। সব মিলিয়ে বর্তমানে উপ-সচিব আছেন এক হাজার
২৭৫ জন। যুগ্ম সচিবের পদ আছে ৪৩০টি। বিপরীতে সর্বশেষ পদোন্নতিপ্রাপ্ত ২৯৯
জনসহ কর্মরত আছেন ৮৮৬ জন কর্মকর্তা। অতিরিক্ত সচিবের ১০৭টি পদের বিপরীতে
সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ২৩১ জনসহ কর্মরত আছেন ৪৫৩ জন। এ অবস্থায় উপ-সচিবের
মঞ্জুরিকৃত পদের বিপরীতে চার শ’ কর্মকর্তা বেশি কর্মরত আছেন। অন্যদিকে
যুগ্ম সচিব পদে দ্বিগুণ ও অতিরিক্ত সচিব পদে চার গুণ কর্মকর্তা কর্মরত
আছেন। এমন অবস্থায় সিনিয়র সহকারী সচিবের কাজ করছেন অসংখ্য উপ-সচিব।
অনেকক্ষেত্রে যুগ্ম সচিবরাও এ কাজ করছেন। একইভাবে উপ-সচিবের কাজ করছেন অনেক
যুগ্ম সচিব, আবার অতিরিক্ত সচিব হয়েও যুগ্ম সচিবের কাজ করতে হচ্ছে অনেক
কর্মকর্তাকে। ফলে কার্যবিধি অনুযায়ী শাখার প্রধান হিসেবে যুগ্ম সচিবেরা
যেখানে আগে সচিবের কাছে নথি পাঠাতেন, সেখানে এখন সেই কাজটি করছেন অতিরিক্ত
সচিবেরা। সব মিলিয়ে প্রশাসনে অনুমোদিত ১৪৩৭ পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন দুই
হাজার ৬১৪ জন কর্মকর্তা। ওদিকে গতকাল পর্যন্ত এক হাজারের বেশি কর্মকর্তা
ওএসডি হয়ে আছেন। এসব কর্মকর্তার কোন কাজ নেই, বসারও জায়গাও নেই। বাসা থেকে
সকাল সকাল বেরিয়ে তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিতে বসে পেপার ও
বইপুস্তক পড়ে সময় কাটান। বেশি সংখ্যায় কর্মকর্তা পদোন্নতি হওয়ায় প্রশাসনে
ওএসডি’র সংখ্যাও বাড়ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন,
মূল বেতন ৪০ হাজার টাকাসহ গাড়ি-বাড়ি, টেলিফোন সুবিধাসহ আনুষঙ্গিক মিলিয়ে
একজন সচিবের পেছনে সরকারের প্রতি মাসে ব্যয় হয় সর্বনিম্ন এক লাখ ১০ হাজার
টাকার মতো। একজন অতিরিক্ত সচিবের পেছনে খরচ এক লাখ তিন হাজার টাকা; একজন
যুগ্ম সচিবের পেছনে খরচ প্রায় ৯৮ হাজার টাকা এবং একজন উপ-সচিবের পেছনে খরচ
হচ্ছে প্রায় ৪২ হাজার টাকা। ওএসডি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ
সচিব আকবর আলি খান জানান, অযথা ওএসডি করে রাখার কারণে একদিকে যেমন সরকারের
অর্থের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে পড়ছে। এদিকে এবারের
পদোন্নতিতেও অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০তম
ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতির রেসে টিকতে পারেননি। এ ব্যাচ থেকে ৯০ জন
কর্মকর্তা বাদ পড়েছেন। এ ব্যাচের মেধা তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা
কর্মকর্তা মো. ফেরদৌস আলমকে বাদ রাখা হয়েছ। একইভাবে মেধা তালিকার ১৩তম
আজিজুল আলম শাহ, ১৫তম রাহেদ হোসেন, ১৬তম আসলাম হোসেন, ১৭তম খালেদ
মুহিউদ্দীন, ১৯তম মিহির কান্তি রাউৎকে পদোন্নতি দেয়া হয়নি। এভাবে আরও অনেক
মেধাবী কর্মকর্তাকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির
ক্ষেত্রে নবম ও দশম ব্যাচের অনেক যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদেরও বিবেচনায়
নেয়া হয়নি। অন্যদিকে অতিরিক্ত সচিব পদে মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা
কর্মকর্তাদের চেয়ে শেষের দিকের নেতা গোছের কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেয়া
হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে প্রশাসনে চলছে নানা আলোচনা।
No comments