রাজনীতির লঙ্কায় কেজরিওয়ালও রাবণ by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ওঁরা এখন সেই বহুকথিত বাক্যটি আওড়াতেই পারেন, লঙ্কায় যে যায়, সে-ই হয় রাবণ।
ওঁরা চারজনই আম আদমি পার্টি (এএপি) থেকে প্রায় বিতাড়িত। যোগেন্দ্র যাদব, প্রশান্ত ভূষণ, আনন্দ কুমার ও অজিত ঝা। ওঁরা সঙ্গে পেয়েছেন নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল রামদসকে, যিনি ছিলেন এই সদ্যোজাত দলের অভ্যন্তরীণ লোকপাল। দলের আহ্বায়ক এবং একচ্ছত্র অধিপতি দিল্লীশ্বর অরবিন্দ কেজরিওয়াল এই মুহূর্তে তাঁদের চোখের বালি। সাক্ষাৎ রাবণ। সেই রাবণই এখন তাঁর চলার পথের সব কাঁটা উপড়ে ফেলতে উৎসুক। কেননা, তিনি জানেন, পাঁচটা বছর তাঁর সামনে কোনো বাধা, কোনো বিপত্তি কেউই সৃষ্টি করতে পারবে না। কেজরিওয়াল তাই নির্দয়। তা ছাড়া সেই গল্পটাও নিশ্চয় তাঁর জানা, যার মূল কথা, বিড়ালকে প্রথম রাতেই মারতে হয়। এটুকু পড়ার মধ্য দিয়েই বোঝা যাচ্ছে, প্রবল সাড়া ও স্বপ্ন জাগিয়ে যে দলটি এই সেদিন ভূমিষ্ঠ হয়ে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় দিল্লিতে ক্ষমতায় এসেছে, দিল্লি বিধানসভায় ৭০টির মধ্যে ৬৭টি আসন দখল করেছে, কংগ্রেসকে পুরোপুরি এবং বিজেপিকে প্রায় ঝাড়ে-বংশে উৎখাত করে দিয়েছে, সেই এএপিতে সবকিছু মোটেই ঠিকঠাক যাচ্ছে না। নীতিগত প্রশ্নে দল বিভাজিত। দলের বেশির ভাগ নেতা মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের পাশে দাঁড়ালেও যোগেন্দ্র যাদব ও প্রশান্ত ভূষণ যে প্রশ্নগুলো তুলে ধরেছেন, তা ক্রমেই গুরুতর আকার ধারণ করেছে। সংখ্যার তুলনায় কম হলেও তাঁদের পেছনে ক্রমেই জড়ো হচ্ছেন বিভিন্ন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা, যাঁরা বিকল্প এক রাজনীতির স্বপ্ন ফেরি করে এএপিকে একজোট করেছিলেন। এই বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত দলকে ভেঙে দেবে, যার সব রকম ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কেজরিওয়াল কোনো সমঝোতার রাস্তায় হাঁটতে রাজি নন। মানুষের সমর্থনে বলীয়ান তিনি আগামী পাঁচ বছর নির্ভাবনায় রাজত্ব করতে চান। তাঁর স্থির নিদান, হয় আমায় বাছো, নয়তো ওঁদের। আমাকে বাছলে ওঁদের সরাতে হবে। পদে পদে বাধা নিয়ে আমি দল ও সরকার চালাতে পারব না। বিদ্রোহীরাও মাথা নোয়াতে নারাজ। তাঁদের কাছে বড় তাঁদের আদর্শ ও নীতি, যা জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁরা মহাপাতক হতে চান না। এই রেষারেষির নিট ফল এএপিতে অসন্তোষ ও সম্ভাব্য ভাঙন। যোগেন্দ্র-প্রশান্ত জুটি অতঃপর নতুন দল গড়বেন কি না, কিংবা সেই দলকে মানুষ কোল পেতে দেবে কি না, তা পরের কথা।
কেজরিওয়ালকে কেন রাবণের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে? কারণ, বিকল্প রাজনীতির কথা বলে তিন বছর আগে যে দলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যোগেন্দ্র-প্রশান্তরা মনে করছেন, সেই আদর্শ থেকে কেজরিওয়াল বিচ্যুত হয়ে আর পাঁচটা দলের মতোই এএপি পরিচালনা করছেন। যে নৈতিকতার ধ্বজা তুলে তাঁরা ভোট চেয়েছেন, মানুষের সমর্থন পেয়েছেন, তা আদৌ পালিত হচ্ছে না। যেমন দল চালাতে অর্থের জোগানে রাশ টানা হয়নি। ভোটের খরচ চালাতে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ নেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র পালিত হচ্ছে না। সমালোচনা শুনতে প্রবল অনীহা। বিরুদ্ধ মত উঠলেই তা দমানো হচ্ছে এবং যাঁরা বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করছেন, তাঁদের কপালে দলবিরোধিতার তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে। যোগেন্দ্র-প্রশান্তদের অভিযোগ, ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই এএপি তার যাবতীয় নিজস্বতা হারিয়ে আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের মতো হয়ে গেছে। কোনো পার্থক্য আর নেই। কেজরিওয়ালদের পাল্টা অভিযোগ, ক্ষমতালোভী যোগেন্দ্র-প্রশান্ত জুটি তাঁদের পেছন থেকে ছুরি মারতে চেয়েছেন। ওঁরা চাননি দল ক্ষমতায় আসুক। সে জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। নাশকতা করতে চেয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব দুষ্ট গরু হটিয়ে গোয়াল সাফ করা জরুরি।
প্রধানত দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন এএপির আঁতুড়ঘর। কংগ্রেস শাসনের শেষ দিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্না হাজারের আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ মদদ দিতে শুরু করলে সেই বিক্ষোভ সমাবেশ ক্রমেই উত্তাল হয়ে ওঠে। তিন বছর আগের সেই আন্দোলনের শরিক ছিলেন কেজরিওয়াল, যোগেন্দ্র, প্রশান্ত ও তাঁর বাবা শান্তি ভূষণও। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আন্নার যতটা অনাগ্রহ ছিল, ততটাই আগ্রহী ছিলেন কেজরিওয়াল-যোগেন্দ্ররা। ফলে একটা সময় তাঁরা আন্নার আপত্তি সত্ত্বেও রাজনীতিতে এসে রাজনৈতিক দুরাচারগুলো দূর করার সংকল্প নেন। লক্ষণীয়, এএপিই সম্ভবত প্রথম ভারতীয় দল, যার কোনো আদর্শগত ভিত্তি ছিল না। বিভিন্ন ভাবনা, বিভিন্ন পেশা, বিভিন্ন মতের কিছু মানুষ জোটবদ্ধ হয়েছিলেন; দুর্নীতিমুক্ত, সুস্থ ও স্বচ্ছ রাজনীতি যার অনুঘটকের কাজ করেছিল। রাজনীতিতে একটি দলের শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ কাজ করে। শক্তিশালী ও জনমোহিনী নেতৃত্ব, আন্দোলন ও কর্মসূচি এবং ঠাসবুনট সংগঠন। নীতি ও বাস্তবতার সমঝোতার মধ্য দিয়ে সেই দলকে এগোতে হয়। শুধু আদর্শ বা শুধুই যুগের সঙ্গে চলনশীল হওয়া কোনো দলকে দীর্ঘমেয়াদি করে তুলতে পারে না। এই অভ্যন্তরীণ রসায়ন বড় দ্রুত, বড়ই আচম্বিতে নড়বড়ে হয়ে গেল এএপিতে। যোগেন্দ্র-প্রশান্ত জুটি শুধু আদর্শকে আঁকড়ে এগোতে চাইলেন সেই সময়ে, যখন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেজরিওয়ালের মূল্যায়নের সময় আসেনি। কেজরিওয়ালের কাছে এটা সৌভাগ্যের। দলে নিজের আধিপত্য পুরোপুরি কায়েম করতে এই সন্ধিক্ষণকেই তিনি বেছে নিলেন, যখন তাঁর সামনে পরেরবারের ভোটের জন্য পড়ে রয়েছে অঢেল সময়।
রাজনীতিতে নেতা বনাম তাত্ত্বিক নেতৃত্বের সংঘাত নতুন নয়। কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস, ভারতীয় জনতা পার্টি কিংবা সোশ্যালিস্ট দলগুলোতে নেতা বনাম তাত্ত্বিকদের সংঘাতের ভূরি ভূরি উদাহরণ ইতিহাসে রয়েছে। শেষ বিচারে দল তাঁর সঙ্গেই থাকে, সংসদীয় গণতন্ত্রে যাঁর ভোটে জেতানোর ক্ষমতা বেশি। বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদি, তৃণমূল কংগ্রেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সমাজবাদী পার্টিতে মুলায়ম সিং যাদব, বহুজন সমাজ পার্টিতে মায়াবতী, দুই দ্রাবিড় পার্টিতে জয়ললিতা বা করুণানিধি, প্রত্যেকেই আদর্শের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ব্যক্তিগত ক্যারিশমায়। ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসেও তাই সোনিয়া-রাহুলদের কদর আর সবার চেয়ে এখনো বেশি; যেহেতু যতটুকু ভোট এখনো আসছে, তা তাঁদের জন্যই। আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার লড়াইয়ে তাত্ত্বিক নেতাদের ছেড়ে সব দলের অধিকাংশ সদস্য এ কারণেই বাস্তববাদী নেতাদের অনুগামী হয়েছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বারবার ঘটে যায়। তাত্ত্বিক যোগেন্দ্র-প্রশান্তদের সরাতে বাস্তববাদী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে তাই খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। মেধা পাটেকর বা রামদাসেরা সরে গেছেন। তাঁদেরই মতো অরাজনৈতিক চরিত্ররাও হয়তো ক্রমেই হতাশ হয়ে দল ত্যাগ করবেন। তাতে এই মুহূর্তে দলে নিজের প্রাধান্য শতভাগ কায়েম করতে কেজরিওয়ালের অসুবিধা হবে না; বরং তিনি অনেক ভারমুক্ত হয়ে দল ও সরকার চালাতে পারবেন।
যোগেন্দ্র-প্রশান্তরা বারবার কেজরিওয়ালকে স্বৈরতন্ত্রী বলে অভিহিত করেছেন। একই অভিযোগ ছিল কিরণ বেদির। এই অভিযোগেই সাজিয়া ইলমি এএপি ছেড়েছিলেন। বিনোদ বিন্নিও। কিন্তু তাঁদের কেউই যোগেন্দ্র যাদবের মতো তাত্ত্বিক হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য ছিলেন না, প্রশান্ত ভূষণের মতো গণতন্ত্রী আইনজীবী ‘অ্যাকটিভিস্ট’ ছিলেন না, কিংবা শান্তি ভূষণের মতো নিঃস্বার্থ স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন না। এ কথা ভুললে চলবে না যে প্রবীণ শান্তি ভূষণ এএপির প্রতিষ্ঠা সদস্যই শুধু নন, দল গড়তে নিজের সঞ্চয় থেকে তিনি দুই কোটি টাকা দানও করেছিলেন। এঁরা সবাই যতটা আদর্শবাদী, ততটা বাস্তববাদী হতে পারেননি। এঁদের কাছে মস্তিষ্কের তুলনায় হৃদয় প্রাধান্য পায় বেশি। কিন্তু এঁরা ভুলে গেলেন, আজকের দুনিয়ায় আদর্শভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি ফলের প্রতীক্ষার চেয়ে চটজলদি সাফল্যেরই দাম বেশি। সেই সাফল্য যিনি এনে দিতে পারেন, কদর তাঁরই। যোগেন্দ্র বা প্রশান্ত কিংবা রামদসেরা সেখানে অপরিহার্য ও বিকল্প হয়ে উঠতে পারেন না। নরেন্দ্র মোদি তাই সংঘ পরিবারের আদর্শের চেয়ে বেশি কাম্য, মমতা-মুলায়ম-মায়াবতী-জয়ললিতাদের পালে তাই সব সময় হাওয়া বেশি থাকে।
ভবিষ্যতে কার ভাগ্যে কী লেখা আছে, তা ভবিষ্যৎই জানে। তবে এটা ঠিক, যোগেন্দ্র-প্রশান্ত-শান্তি ভূষণদের সীমানার বাইরে পাঠানোর মধ্য দিয়ে কেজরিওয়াল তাঁর পথ নিষ্কণ্টক করলেও এএপি কিন্তু তার বিবেককে হারাল। গণতন্ত্রে বিরুদ্ধ স্বর তত্ত্বগতভাবে গ্রাহ্য হলেও এমন কোনো গণতন্ত্রী নেতা বা নেত্রী এই মুহূর্তে এ দেশে নেই, যিনি সেই বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। দলে নিজের অবস্থান প্রশ্নাতীত করে তুলে অরবিন্দ কেজরিওয়ালও নিজেকে সেই তালিকাভুক্ত করলেন। রাজনীতির লঙ্কায় তিনিও আর পাঁচজনের মতোই রাবণ হয়ে গেলেন।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
ওঁরা চারজনই আম আদমি পার্টি (এএপি) থেকে প্রায় বিতাড়িত। যোগেন্দ্র যাদব, প্রশান্ত ভূষণ, আনন্দ কুমার ও অজিত ঝা। ওঁরা সঙ্গে পেয়েছেন নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল রামদসকে, যিনি ছিলেন এই সদ্যোজাত দলের অভ্যন্তরীণ লোকপাল। দলের আহ্বায়ক এবং একচ্ছত্র অধিপতি দিল্লীশ্বর অরবিন্দ কেজরিওয়াল এই মুহূর্তে তাঁদের চোখের বালি। সাক্ষাৎ রাবণ। সেই রাবণই এখন তাঁর চলার পথের সব কাঁটা উপড়ে ফেলতে উৎসুক। কেননা, তিনি জানেন, পাঁচটা বছর তাঁর সামনে কোনো বাধা, কোনো বিপত্তি কেউই সৃষ্টি করতে পারবে না। কেজরিওয়াল তাই নির্দয়। তা ছাড়া সেই গল্পটাও নিশ্চয় তাঁর জানা, যার মূল কথা, বিড়ালকে প্রথম রাতেই মারতে হয়। এটুকু পড়ার মধ্য দিয়েই বোঝা যাচ্ছে, প্রবল সাড়া ও স্বপ্ন জাগিয়ে যে দলটি এই সেদিন ভূমিষ্ঠ হয়ে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় দিল্লিতে ক্ষমতায় এসেছে, দিল্লি বিধানসভায় ৭০টির মধ্যে ৬৭টি আসন দখল করেছে, কংগ্রেসকে পুরোপুরি এবং বিজেপিকে প্রায় ঝাড়ে-বংশে উৎখাত করে দিয়েছে, সেই এএপিতে সবকিছু মোটেই ঠিকঠাক যাচ্ছে না। নীতিগত প্রশ্নে দল বিভাজিত। দলের বেশির ভাগ নেতা মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের পাশে দাঁড়ালেও যোগেন্দ্র যাদব ও প্রশান্ত ভূষণ যে প্রশ্নগুলো তুলে ধরেছেন, তা ক্রমেই গুরুতর আকার ধারণ করেছে। সংখ্যার তুলনায় কম হলেও তাঁদের পেছনে ক্রমেই জড়ো হচ্ছেন বিভিন্ন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা, যাঁরা বিকল্প এক রাজনীতির স্বপ্ন ফেরি করে এএপিকে একজোট করেছিলেন। এই বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত দলকে ভেঙে দেবে, যার সব রকম ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কেজরিওয়াল কোনো সমঝোতার রাস্তায় হাঁটতে রাজি নন। মানুষের সমর্থনে বলীয়ান তিনি আগামী পাঁচ বছর নির্ভাবনায় রাজত্ব করতে চান। তাঁর স্থির নিদান, হয় আমায় বাছো, নয়তো ওঁদের। আমাকে বাছলে ওঁদের সরাতে হবে। পদে পদে বাধা নিয়ে আমি দল ও সরকার চালাতে পারব না। বিদ্রোহীরাও মাথা নোয়াতে নারাজ। তাঁদের কাছে বড় তাঁদের আদর্শ ও নীতি, যা জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁরা মহাপাতক হতে চান না। এই রেষারেষির নিট ফল এএপিতে অসন্তোষ ও সম্ভাব্য ভাঙন। যোগেন্দ্র-প্রশান্ত জুটি অতঃপর নতুন দল গড়বেন কি না, কিংবা সেই দলকে মানুষ কোল পেতে দেবে কি না, তা পরের কথা।
কেজরিওয়ালকে কেন রাবণের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে? কারণ, বিকল্প রাজনীতির কথা বলে তিন বছর আগে যে দলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যোগেন্দ্র-প্রশান্তরা মনে করছেন, সেই আদর্শ থেকে কেজরিওয়াল বিচ্যুত হয়ে আর পাঁচটা দলের মতোই এএপি পরিচালনা করছেন। যে নৈতিকতার ধ্বজা তুলে তাঁরা ভোট চেয়েছেন, মানুষের সমর্থন পেয়েছেন, তা আদৌ পালিত হচ্ছে না। যেমন দল চালাতে অর্থের জোগানে রাশ টানা হয়নি। ভোটের খরচ চালাতে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ নেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র পালিত হচ্ছে না। সমালোচনা শুনতে প্রবল অনীহা। বিরুদ্ধ মত উঠলেই তা দমানো হচ্ছে এবং যাঁরা বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করছেন, তাঁদের কপালে দলবিরোধিতার তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে। যোগেন্দ্র-প্রশান্তদের অভিযোগ, ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই এএপি তার যাবতীয় নিজস্বতা হারিয়ে আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের মতো হয়ে গেছে। কোনো পার্থক্য আর নেই। কেজরিওয়ালদের পাল্টা অভিযোগ, ক্ষমতালোভী যোগেন্দ্র-প্রশান্ত জুটি তাঁদের পেছন থেকে ছুরি মারতে চেয়েছেন। ওঁরা চাননি দল ক্ষমতায় আসুক। সে জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। নাশকতা করতে চেয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব দুষ্ট গরু হটিয়ে গোয়াল সাফ করা জরুরি।
প্রধানত দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন এএপির আঁতুড়ঘর। কংগ্রেস শাসনের শেষ দিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্না হাজারের আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ মদদ দিতে শুরু করলে সেই বিক্ষোভ সমাবেশ ক্রমেই উত্তাল হয়ে ওঠে। তিন বছর আগের সেই আন্দোলনের শরিক ছিলেন কেজরিওয়াল, যোগেন্দ্র, প্রশান্ত ও তাঁর বাবা শান্তি ভূষণও। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আন্নার যতটা অনাগ্রহ ছিল, ততটাই আগ্রহী ছিলেন কেজরিওয়াল-যোগেন্দ্ররা। ফলে একটা সময় তাঁরা আন্নার আপত্তি সত্ত্বেও রাজনীতিতে এসে রাজনৈতিক দুরাচারগুলো দূর করার সংকল্প নেন। লক্ষণীয়, এএপিই সম্ভবত প্রথম ভারতীয় দল, যার কোনো আদর্শগত ভিত্তি ছিল না। বিভিন্ন ভাবনা, বিভিন্ন পেশা, বিভিন্ন মতের কিছু মানুষ জোটবদ্ধ হয়েছিলেন; দুর্নীতিমুক্ত, সুস্থ ও স্বচ্ছ রাজনীতি যার অনুঘটকের কাজ করেছিল। রাজনীতিতে একটি দলের শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ কাজ করে। শক্তিশালী ও জনমোহিনী নেতৃত্ব, আন্দোলন ও কর্মসূচি এবং ঠাসবুনট সংগঠন। নীতি ও বাস্তবতার সমঝোতার মধ্য দিয়ে সেই দলকে এগোতে হয়। শুধু আদর্শ বা শুধুই যুগের সঙ্গে চলনশীল হওয়া কোনো দলকে দীর্ঘমেয়াদি করে তুলতে পারে না। এই অভ্যন্তরীণ রসায়ন বড় দ্রুত, বড়ই আচম্বিতে নড়বড়ে হয়ে গেল এএপিতে। যোগেন্দ্র-প্রশান্ত জুটি শুধু আদর্শকে আঁকড়ে এগোতে চাইলেন সেই সময়ে, যখন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেজরিওয়ালের মূল্যায়নের সময় আসেনি। কেজরিওয়ালের কাছে এটা সৌভাগ্যের। দলে নিজের আধিপত্য পুরোপুরি কায়েম করতে এই সন্ধিক্ষণকেই তিনি বেছে নিলেন, যখন তাঁর সামনে পরেরবারের ভোটের জন্য পড়ে রয়েছে অঢেল সময়।
রাজনীতিতে নেতা বনাম তাত্ত্বিক নেতৃত্বের সংঘাত নতুন নয়। কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস, ভারতীয় জনতা পার্টি কিংবা সোশ্যালিস্ট দলগুলোতে নেতা বনাম তাত্ত্বিকদের সংঘাতের ভূরি ভূরি উদাহরণ ইতিহাসে রয়েছে। শেষ বিচারে দল তাঁর সঙ্গেই থাকে, সংসদীয় গণতন্ত্রে যাঁর ভোটে জেতানোর ক্ষমতা বেশি। বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদি, তৃণমূল কংগ্রেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সমাজবাদী পার্টিতে মুলায়ম সিং যাদব, বহুজন সমাজ পার্টিতে মায়াবতী, দুই দ্রাবিড় পার্টিতে জয়ললিতা বা করুণানিধি, প্রত্যেকেই আদর্শের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ব্যক্তিগত ক্যারিশমায়। ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসেও তাই সোনিয়া-রাহুলদের কদর আর সবার চেয়ে এখনো বেশি; যেহেতু যতটুকু ভোট এখনো আসছে, তা তাঁদের জন্যই। আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার লড়াইয়ে তাত্ত্বিক নেতাদের ছেড়ে সব দলের অধিকাংশ সদস্য এ কারণেই বাস্তববাদী নেতাদের অনুগামী হয়েছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বারবার ঘটে যায়। তাত্ত্বিক যোগেন্দ্র-প্রশান্তদের সরাতে বাস্তববাদী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে তাই খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। মেধা পাটেকর বা রামদাসেরা সরে গেছেন। তাঁদেরই মতো অরাজনৈতিক চরিত্ররাও হয়তো ক্রমেই হতাশ হয়ে দল ত্যাগ করবেন। তাতে এই মুহূর্তে দলে নিজের প্রাধান্য শতভাগ কায়েম করতে কেজরিওয়ালের অসুবিধা হবে না; বরং তিনি অনেক ভারমুক্ত হয়ে দল ও সরকার চালাতে পারবেন।
যোগেন্দ্র-প্রশান্তরা বারবার কেজরিওয়ালকে স্বৈরতন্ত্রী বলে অভিহিত করেছেন। একই অভিযোগ ছিল কিরণ বেদির। এই অভিযোগেই সাজিয়া ইলমি এএপি ছেড়েছিলেন। বিনোদ বিন্নিও। কিন্তু তাঁদের কেউই যোগেন্দ্র যাদবের মতো তাত্ত্বিক হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য ছিলেন না, প্রশান্ত ভূষণের মতো গণতন্ত্রী আইনজীবী ‘অ্যাকটিভিস্ট’ ছিলেন না, কিংবা শান্তি ভূষণের মতো নিঃস্বার্থ স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন না। এ কথা ভুললে চলবে না যে প্রবীণ শান্তি ভূষণ এএপির প্রতিষ্ঠা সদস্যই শুধু নন, দল গড়তে নিজের সঞ্চয় থেকে তিনি দুই কোটি টাকা দানও করেছিলেন। এঁরা সবাই যতটা আদর্শবাদী, ততটা বাস্তববাদী হতে পারেননি। এঁদের কাছে মস্তিষ্কের তুলনায় হৃদয় প্রাধান্য পায় বেশি। কিন্তু এঁরা ভুলে গেলেন, আজকের দুনিয়ায় আদর্শভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি ফলের প্রতীক্ষার চেয়ে চটজলদি সাফল্যেরই দাম বেশি। সেই সাফল্য যিনি এনে দিতে পারেন, কদর তাঁরই। যোগেন্দ্র বা প্রশান্ত কিংবা রামদসেরা সেখানে অপরিহার্য ও বিকল্প হয়ে উঠতে পারেন না। নরেন্দ্র মোদি তাই সংঘ পরিবারের আদর্শের চেয়ে বেশি কাম্য, মমতা-মুলায়ম-মায়াবতী-জয়ললিতাদের পালে তাই সব সময় হাওয়া বেশি থাকে।
ভবিষ্যতে কার ভাগ্যে কী লেখা আছে, তা ভবিষ্যৎই জানে। তবে এটা ঠিক, যোগেন্দ্র-প্রশান্ত-শান্তি ভূষণদের সীমানার বাইরে পাঠানোর মধ্য দিয়ে কেজরিওয়াল তাঁর পথ নিষ্কণ্টক করলেও এএপি কিন্তু তার বিবেককে হারাল। গণতন্ত্রে বিরুদ্ধ স্বর তত্ত্বগতভাবে গ্রাহ্য হলেও এমন কোনো গণতন্ত্রী নেতা বা নেত্রী এই মুহূর্তে এ দেশে নেই, যিনি সেই বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। দলে নিজের অবস্থান প্রশ্নাতীত করে তুলে অরবিন্দ কেজরিওয়ালও নিজেকে সেই তালিকাভুক্ত করলেন। রাজনীতির লঙ্কায় তিনিও আর পাঁচজনের মতোই রাবণ হয়ে গেলেন।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
No comments