চীন ও বৈশ্বিক সুশাসন by হাভিয়ের সোলানা
বিগত
দুই দশকে দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূকৌশলগত পরিবর্তন হিসেবে চীনের
উত্থানকে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব চীনকে দুনিয়ার সুশাসনের
কাঠামোয় যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়নি, অন্যান্য উদীয়মান দেশের কথা আর নাই-বা
বললাম। এই পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।
দেখা যাচ্ছে, চীন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় নিজের অবস্থান পোক্ত করার জন্য এই মহাদেশগুলোর কয়েকটি দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। চীনের রিজার্ভ এখন ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। তারা এখন পণ্যের বিনিময়ে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে। এর মাধ্যমে সে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৃহত্তম অর্থদাতায় পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সে বিশ্বব্যাংককে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এসব দ্বিপক্ষীয় বন্দোবস্ত বাস্তবায়ন করে, তারা সব সময় সর্বোৎকৃষ্ট আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে না। সে কারণে পশ্চিম চীনকে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ার পথ ধরতে আহ্বান জানিয়েছে, যাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা যায়। যাতে আরও বেশি পরিমাণে বৈশ্বিক পরিসরে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তো চীনকে ‘মুক্ত সওয়ারি’ আখ্যা দিয়েই দিয়েছেন। কারণ, বৈশ্বিক শক্তির কাছ থেকে যে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করা হয়, চীন সেটা পূরণ করতে পারেনি।
কিন্তু চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক উদ্যোগের যদি কোনো লক্ষণ থেকে থাকে, তাহলে বলতে হয়, পরিবর্তন আসন্ন। গত বছরের জুলাইয়ে চীন ব্রিকসের পাঁচ সদস্য (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকা) দেশকে সঙ্গে নিয়ে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গঠন করেছে, এর ১০০ বিলিয়ন ফান্ড গঠনেও তারা বড় ভূমিকা রেখেছে। একইভাবে, বেইজিংয়ের সর্বশেষ এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশনের বৈঠকে চীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) গঠনেও নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে। আবার সে একই সঙ্গে ৪০ বিলিয়ন ডলারের সিল্ক রোড ফান্ডও গঠন করেছে। লক্ষ্য হচ্ছে, এশিয়া-ইউরোপ সংযোগকারী সেই প্রাচীন স্থল ও জলপথের পুনর্নির্মাণ।
তথাকথিত ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ কৌশল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে চীন ৬০টি দেশে বিনিয়োগ করবে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় এশিয়ার দেশগুলোও রয়েছে, যেখানে তার বিনিয়োগের পরিমাণ ইতিমধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সমুদ্রপথের মধ্যে ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ চীন সাগর ও ভূমধ্যসাগরও থাকবে। এগুলো একত্রে শুধু একটি সড়কই তৈরি করবে না, নেটওয়ার্ক নির্মাণ করবে; যার মাধ্যমে ইউরেশিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পণ্য সরবরাহ সহজতর হবে।
এই উদ্যোগে ইউরোপের ভূমিকা গ্রিক বন্দর পিরাউসের সঙ্গে উঠে আসছে। এই বন্দরটি পরিচালনার আংশিক দায়িত্ব চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত নৌ-কোম্পানি কসকোর ওপর ন্যস্ত। বলকান ও হাঙ্গেরিতে চীনা অর্থায়নের মাধ্যমে এই বন্দর ইউরোপের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এর দ্বারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান সহযোগী হিসেবে চীনের পায়ের তলার মাটি আরও শক্ত হবে।
নতুন করে এই সিল্ক রোড নির্মাণের উদ্যোগের মধ্যে চীনের ইউরেশীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়। এটা শুধু গতিশীল পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক কেন্দ্রের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের সংযোগই ঘটাবে না; কেন্দ্রীয় এশিয়াতেও চীনের প্রবেশদ্বার খুলে দেবে, যেখানে রাশিয়ার কর্তৃত্ব এ মুহূর্তে ক্ষয়িষ্ণু। আবার ভূমি নিয়ে চীনের পাশের বাড়ির প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, সিল্ক রোড সেটাও নিরসন করবে।
এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, চীনের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর চেষ্টা একরকম সফল হয়েছে; আবার তা শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাজ্য সম্প্রতি এআইআইবির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। এর ফলে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানি, কোরিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক ও স্পেনের মতো দেশগুলোর আবেদনে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ভরে যাচ্ছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এসব বিষয় ভূরাজনৈতিক পরিসরে ধাক্কার শামিল। এ ধরনের ব্যাখ্যায় মৌলিক গলদ রয়েছে। সর্বোপরি, চীন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাশ কাটাতে চাইছে; তার কারণ হচ্ছে এরা চীনকে তার অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মর্যাদা দেয়নি।
যেমন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ শতাংশ ভোট রয়েছে, যেখানে চীনের ভোট ৬ শতাংশেরও কম। আর জাপানিরাই সব সময় এই ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হয়। বিশ্বব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা, সেখানে মার্কিনরাই সব সময় সর্বেসর্বা। আর আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও সব সময় একজন ইউরোপীয়। জি-২০-এর সদস্যরা ২০১০ সালে আইএমএফে চীনের কোটা ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশে উন্নীত করতে চাইলেও মার্কিন কংগ্রেস তা অনুমোদন করেনি। জি-২০–এর এই সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক পথে খুবই ছোট একটি পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্র বাগড়া দেওয়ায় সেই সংস্কার আর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
সত্য কথা হচ্ছে, চীনের নতুন উদ্যোগ কোনো সংশোধনবাদী প্রপঞ্চ নয়, এটা প্রতিক্রিয়ামূলক। নতুন শক্তি যদি বিরাজমান বৈশ্বিক কাঠামোতে স্থান না পায়, তাহলে তারা নিজেরাই কাঠামো তৈরি করে নেবে। তার মানে হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোর হাতে এ ক্ষমতা রয়েছে যে তারা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে আদর্শিক ও অর্থনৈতিক ব্লকে বিভক্ত নাও হতে দিতে পারে, যদি তারা চীন সম্পর্কে কৌশলগত অবিশ্বাস দূর করতে পারে।
এই বিবেচনায় এআইআইবিতে আরও বেশি ইউরোপীয় দেশের যুক্ত হওয়াটা ইতিবাচক লক্ষণ। কারণ, এতে একটা ব্যাপার নিশ্চিত হবে: নতুন ব্যাংক বিরাজমান কাঠামোকে পূর্ণতা দেবে, তার সঙ্গে বিরোধে জড়াবে না (বস্তুত, ইউরোপের প্রভাব আরও ব্যাপক হতে পারে যদি একক রাষ্ট্রের জায়গায় এআইআইবিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব থাকে, যেমন জি-২০ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় রয়েছে)।
বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় চীনকে নিয়ে আসার জন্য পশ্চিমকে এখনো অনেক কিছু করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমকে চীনাদের নির্মিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজও করতে হবে, সেগুলোকে মেনে নিতে হবে। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বহুপক্ষীয়তার সর্বোৎকৃষ্ট নজির স্থাপন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে, সে লক্ষ্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে পশ্চিমা নেতারা উদারতার পরিচয় দিতে পারেন। আর সেসব প্রতিষ্ঠান যাতে আন্তর্জাতিক শ্রম ও পরিবেশ মানদণ্ড মেনে চলে, সেটাও নিশ্চিত করা যেতে পারে।
এ প্রক্রিয়া শুরু করার এটাই আদর্শ সময়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যদি তাদের অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে এ বছর তাদের আকাঙ্ক্ষা এক বিন্দুতে মেলাতে পারে, তাহলে ২০১৬ সালে চীনে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনকে তারা চূড়ান্তভাবে সফল করতে পারবে।
চীন যে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে, সেটা দুনিয়ার জন্য সত্যিই ভালো খবর। ইউরোপ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চীনবিষয়ক কৌশলগত অবিশ্বাস কাটিয়ে উঠতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
হাভিয়ের সোলানা: ন্যাটোর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল।
দেখা যাচ্ছে, চীন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় নিজের অবস্থান পোক্ত করার জন্য এই মহাদেশগুলোর কয়েকটি দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। চীনের রিজার্ভ এখন ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। তারা এখন পণ্যের বিনিময়ে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে। এর মাধ্যমে সে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৃহত্তম অর্থদাতায় পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সে বিশ্বব্যাংককে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এসব দ্বিপক্ষীয় বন্দোবস্ত বাস্তবায়ন করে, তারা সব সময় সর্বোৎকৃষ্ট আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে না। সে কারণে পশ্চিম চীনকে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ার পথ ধরতে আহ্বান জানিয়েছে, যাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা যায়। যাতে আরও বেশি পরিমাণে বৈশ্বিক পরিসরে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তো চীনকে ‘মুক্ত সওয়ারি’ আখ্যা দিয়েই দিয়েছেন। কারণ, বৈশ্বিক শক্তির কাছ থেকে যে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করা হয়, চীন সেটা পূরণ করতে পারেনি।
কিন্তু চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক উদ্যোগের যদি কোনো লক্ষণ থেকে থাকে, তাহলে বলতে হয়, পরিবর্তন আসন্ন। গত বছরের জুলাইয়ে চীন ব্রিকসের পাঁচ সদস্য (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকা) দেশকে সঙ্গে নিয়ে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গঠন করেছে, এর ১০০ বিলিয়ন ফান্ড গঠনেও তারা বড় ভূমিকা রেখেছে। একইভাবে, বেইজিংয়ের সর্বশেষ এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশনের বৈঠকে চীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) গঠনেও নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে। আবার সে একই সঙ্গে ৪০ বিলিয়ন ডলারের সিল্ক রোড ফান্ডও গঠন করেছে। লক্ষ্য হচ্ছে, এশিয়া-ইউরোপ সংযোগকারী সেই প্রাচীন স্থল ও জলপথের পুনর্নির্মাণ।
তথাকথিত ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ কৌশল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে চীন ৬০টি দেশে বিনিয়োগ করবে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় এশিয়ার দেশগুলোও রয়েছে, যেখানে তার বিনিয়োগের পরিমাণ ইতিমধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সমুদ্রপথের মধ্যে ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ চীন সাগর ও ভূমধ্যসাগরও থাকবে। এগুলো একত্রে শুধু একটি সড়কই তৈরি করবে না, নেটওয়ার্ক নির্মাণ করবে; যার মাধ্যমে ইউরেশিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পণ্য সরবরাহ সহজতর হবে।
এই উদ্যোগে ইউরোপের ভূমিকা গ্রিক বন্দর পিরাউসের সঙ্গে উঠে আসছে। এই বন্দরটি পরিচালনার আংশিক দায়িত্ব চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত নৌ-কোম্পানি কসকোর ওপর ন্যস্ত। বলকান ও হাঙ্গেরিতে চীনা অর্থায়নের মাধ্যমে এই বন্দর ইউরোপের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এর দ্বারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান সহযোগী হিসেবে চীনের পায়ের তলার মাটি আরও শক্ত হবে।
নতুন করে এই সিল্ক রোড নির্মাণের উদ্যোগের মধ্যে চীনের ইউরেশীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়। এটা শুধু গতিশীল পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক কেন্দ্রের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের সংযোগই ঘটাবে না; কেন্দ্রীয় এশিয়াতেও চীনের প্রবেশদ্বার খুলে দেবে, যেখানে রাশিয়ার কর্তৃত্ব এ মুহূর্তে ক্ষয়িষ্ণু। আবার ভূমি নিয়ে চীনের পাশের বাড়ির প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, সিল্ক রোড সেটাও নিরসন করবে।
এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, চীনের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর চেষ্টা একরকম সফল হয়েছে; আবার তা শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাজ্য সম্প্রতি এআইআইবির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। এর ফলে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানি, কোরিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক ও স্পেনের মতো দেশগুলোর আবেদনে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ভরে যাচ্ছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এসব বিষয় ভূরাজনৈতিক পরিসরে ধাক্কার শামিল। এ ধরনের ব্যাখ্যায় মৌলিক গলদ রয়েছে। সর্বোপরি, চীন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাশ কাটাতে চাইছে; তার কারণ হচ্ছে এরা চীনকে তার অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মর্যাদা দেয়নি।
যেমন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ শতাংশ ভোট রয়েছে, যেখানে চীনের ভোট ৬ শতাংশেরও কম। আর জাপানিরাই সব সময় এই ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হয়। বিশ্বব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা, সেখানে মার্কিনরাই সব সময় সর্বেসর্বা। আর আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও সব সময় একজন ইউরোপীয়। জি-২০-এর সদস্যরা ২০১০ সালে আইএমএফে চীনের কোটা ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশে উন্নীত করতে চাইলেও মার্কিন কংগ্রেস তা অনুমোদন করেনি। জি-২০–এর এই সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক পথে খুবই ছোট একটি পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্র বাগড়া দেওয়ায় সেই সংস্কার আর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
সত্য কথা হচ্ছে, চীনের নতুন উদ্যোগ কোনো সংশোধনবাদী প্রপঞ্চ নয়, এটা প্রতিক্রিয়ামূলক। নতুন শক্তি যদি বিরাজমান বৈশ্বিক কাঠামোতে স্থান না পায়, তাহলে তারা নিজেরাই কাঠামো তৈরি করে নেবে। তার মানে হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোর হাতে এ ক্ষমতা রয়েছে যে তারা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে আদর্শিক ও অর্থনৈতিক ব্লকে বিভক্ত নাও হতে দিতে পারে, যদি তারা চীন সম্পর্কে কৌশলগত অবিশ্বাস দূর করতে পারে।
এই বিবেচনায় এআইআইবিতে আরও বেশি ইউরোপীয় দেশের যুক্ত হওয়াটা ইতিবাচক লক্ষণ। কারণ, এতে একটা ব্যাপার নিশ্চিত হবে: নতুন ব্যাংক বিরাজমান কাঠামোকে পূর্ণতা দেবে, তার সঙ্গে বিরোধে জড়াবে না (বস্তুত, ইউরোপের প্রভাব আরও ব্যাপক হতে পারে যদি একক রাষ্ট্রের জায়গায় এআইআইবিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব থাকে, যেমন জি-২০ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় রয়েছে)।
বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় চীনকে নিয়ে আসার জন্য পশ্চিমকে এখনো অনেক কিছু করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমকে চীনাদের নির্মিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজও করতে হবে, সেগুলোকে মেনে নিতে হবে। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বহুপক্ষীয়তার সর্বোৎকৃষ্ট নজির স্থাপন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে, সে লক্ষ্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে পশ্চিমা নেতারা উদারতার পরিচয় দিতে পারেন। আর সেসব প্রতিষ্ঠান যাতে আন্তর্জাতিক শ্রম ও পরিবেশ মানদণ্ড মেনে চলে, সেটাও নিশ্চিত করা যেতে পারে।
এ প্রক্রিয়া শুরু করার এটাই আদর্শ সময়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যদি তাদের অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে এ বছর তাদের আকাঙ্ক্ষা এক বিন্দুতে মেলাতে পারে, তাহলে ২০১৬ সালে চীনে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনকে তারা চূড়ান্তভাবে সফল করতে পারবে।
চীন যে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে, সেটা দুনিয়ার জন্য সত্যিই ভালো খবর। ইউরোপ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চীনবিষয়ক কৌশলগত অবিশ্বাস কাটিয়ে উঠতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
হাভিয়ের সোলানা: ন্যাটোর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল।
No comments