পাকিস্তানের নৈতিক বিপর্যয় ফাতিমা ভুট্টো
সাত
ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শাফকাত। ২০০৩ সালের দিকে কাজের খোঁজে কাশ্মীর
থেকে করাচিতে পাড়ি দেয় সে। শেখার অক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে,
বিদ্যালয়ের বৈতরণী পার করা হয়ে উঠেনি তার। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই বিদ্যালয়ের
ঝরে পড়াদের তালিকায় নাম উঠে যায় শাফকাতের। পড়া কিংবা লেখা কোনটাই পারতো না
সে। করাচি আসার পর পিতা-মাতাকে আর কখনোই দেখেনি সে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে
অবৈধভাবে তাকে আটক করে পুলিশ; ভয়াবহভাবে মারধরও করে। অথচ পাকিস্তানে
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার যে বয়সসীমা, তার চেয়েও চার বছর ছোট ছিল সে। নির্জন
কারাবাসই সঙ্গী হয়ে উঠে তার। তার যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। সিগারেটের
আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় শরীর। তাকে যেসব পুলিশ সদস্য জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল,
তারা তার তিন আঙুলের নখ উঠিয়ে ফেলে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, শাফকাতের বিষয়টি
কোন ব্যতিক্রম ছিল না। এটাই ছিল নিয়ম। তাকে বলা হয়েছিল, ৭ বছর বয়সী এক
বালককে হত্যার স্বীকারোক্তি দিতে। অথচ এ অপরাধ সে করেনি। তাকে বলা হয়েছিল,
অন্যথায় সে কোন দিন কারাগার থেকে বের হতে পারবে না, তার প্রতি নির্যাতনও
বন্ধ হবে না। এরপর এক সাত বছর বয়সী বালককে অপহরণ ও খুনের অভিযোগ আনা হয়
শাফকাতের বিরুদ্ধে। বিচারে তার ফাঁসি হয়। শাফকাতের বড় ভাই মনজুর গত
ডিসেম্বরে নির্যাতনের মুখে শাফকাতের স্বীকারোক্তির বিষয়ে বিবিসির সঙ্গে কথা
বলেন। মনজুর বলেন, আমি যখন তাকে কারাগারে নির্যাতনের কথা জিজ্ঞেস করি, তখন
সে থরথর করে কাঁপা শুরু করলো এবং একপর্যায়ে প্রস্রাব করে দিলো। নিজের
মাথার ওপর উভয় হাত দিয়ে কান্না শুরু করে দেয় শাফকাত। সে বলতে থাকে, ‘আমাকে
কিছু জিজ্ঞেস করো না। আমি তোমাকে বলতে পারবো না তারা আমার সঙ্গে কি করেছে।’
তার বিরুদ্ধে একমাত্র প্রমাণ যেটি আদালত পেয়েছিলেন, তা হচ্ছে, পুলিশি
হেফাজতে নির্যাতনের মধ্যে ৯ দিন থাকার পর তার দেয়া স্বীকারোক্তিটি। কিশোর
অপরাধী হিসেবেও শাফকাতের বিচার করা হয়নি। তার বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ আনা হয়,
তখন কোন আইনজীবীর সঙ্গেও যোগাযোগ হয়নি তার। তার মা ১০ বছরেও একবার তাকে
দেখার সুযোগ পাননি। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে শাফকাতকে একবার দেখতে কাশ্মীর
থেকে করাচি যাওয়ার সামর্থ্যও নেই তার মায়ের। প্রায় ৭ বছর ধরে মুলতবি রাখার
পর, পাকিস্তান সম্প্রতি আবারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর শুরু করেছে। ১৬ই
ডিসেম্বর পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে এক সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়
শতাধিক শিশু। ওই হামলার ঘটনাটি ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ
হামলা। এ সহিংসতার জবাব সহিংসতা দিয়েই দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
চিন্তাভাবনা ছিল না, ছিল না কোন অন্তর অবলোকন। ছিল কেবল প্রতিশোধের স্পৃহা।
রাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ওপর মুলতবি প্রত্যাহার করে নেয়, গঠন করে
সামরিক আদালত। এসবের কোনটিই অপরাধ রোধক হিসেবে পরিচিত নয়। সামরিক আদালতের
বিচারক ও কৌঁসুলিরা আসেন সেনাবাহিনী থেকে। এটি হলো পাকিস্তানের গভীরভাবে
ভ্রান্ত ও নিষ্ফল বিচারিক পদ্ধতির নবতর বিতর্কিত সংযোজন। পাকিস্তানের
কলহপ্রিয় সন্ত্রাসবাদ বিরোধ আদালতের মতো, সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত মামলাগুলোর
বিচারের জন্যই সামরিক আদালতগুলোও গঠন করা হয়েছে। যদিও তাদের বিচারিক
এখতিয়ার সময়ের ব্যবধানে কেবল বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। পাকিস্তানে বর্তমানে
প্রায় ৮ হাজারেরও বেশি মানুষের ওপর মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলছে। এদের মধ্যে প্রায়
১০০০ অভিযুক্ত, যারা আপিল করতে করতে ক্লান্ত, তারা ফাঁসির কাষ্ঠের
অপেক্ষায় আছেন। ৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ইতিমধ্যেই কার্যকর হয়েছে। শাফকাতের
ফাঁসি আগামী বৃহসপতিবার কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয় তার ফাঁসির আদেশ স্থগিত করেছিল। এরপর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল
কী করে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরকে ফাঁসির মুখোমুখি করা হচ্ছে। তবে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই স্থগিতাদেশের ২ মাসেরও বেশি সময় পর,
পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদবিরোধী আদালত তার বিরুদ্ধে নতুন করে ফাঁসির আদেশ
দিয়েছে। ১৯৯৭ সালে বিধিবদ্ধ আইনের অধীনে ওই কঠোর আদালত প্রতিষ্ঠা করা
হয়েছিল, সাংবিধানিক আইনের অধীনে নয়। ওই আদালতগুলোর নিয়ম হচ্ছে, নিজেকে
নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলে, অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী বলেই সাব্যস্ত হবেন।
আসামিদের এ আদালতে জামিন দেয়া হয় না। সাধারণত, মামলাগুলো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ
করতে নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাই ওখানে হয় বেশি। শাফকাত হোসেন
মৃত্যুপরোয়ানা মাথায় নিয়ে প্রায় ১১টি বছর পার করেছে কারাগারের অন্ধকার
প্রকোষ্ঠে। তার বিরুদ্ধে যে অপরাধের অভিযোগ, সেটির সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের কোন
সমপর্কই নেই। সে কোন জঙ্গি নয়। করাচীতে সে স্বল্প সময় মুক্তভাবে ছিল, তখন
সে একটি বাসায় তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করতো। সে কোন অবস্থাতেই জাতীয়
নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলেনি। মৃত্যুদণ্ড পুনর্বহালের ঘটনাটি পাকিস্তানের
জন্য একটি নৈতিক বিপর্যয়। যারা মনে করেন, চোখের বদলে চোখ তুলে নেয়া উচিত,
তাদের কাছে পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননা, ধর্মত্যাগ ও ব্যভিচারের অভিযোগে
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের বিষয়টি কোন ছাপ ফেলবে না। অনুতাপহীন সহিংসতা,
অসহিষ্ণুতা ও অবিচারের এ যুগে, সহানুভূতির পক্ষে আমাদের কথা বলাটা
দায়িত্বস্বরূপ। পাকিস্তান নিজেকে কিছুতেই ন্যায়পরায়ণ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র
হিসেবে দাবি করতে পারে না। এ রাষ্ট্র নিষিদ্ধঘোষিত আহলে সুন্নাহ ওয়াল
জামায়াতের মতো সহিংস ও চরমপন্থি সামপ্রদায়িক দলের নেতাদের নিরাপত্তা প্রদান
করে, অথচ নির্দোষ অপ্রাপ্তবয়স্ককে ফাঁসির আদেশ দেয়।
---
(ফাতিমা ভুট্টো পাকিস্তানি লেখিকা। তিনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতনি ও আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ভাইঝি। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ প্রকাশিত হলো)।
---
(ফাতিমা ভুট্টো পাকিস্তানি লেখিকা। তিনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতনি ও আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ভাইঝি। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ প্রকাশিত হলো)।
No comments