‘প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ঢাকা’ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
হরপ্পা
ও মহেঞ্জোদারোর নিয়তি বরণ করতে জাহাঙ্গীরনগর ওরফে ঢাকার খুব বেশি সময়
লাগবে না। মহেঞ্জোদারোর শেষ মেয়র, অর্থাৎ ধ্বংস হওয়ার অব্যবহিত আগে যিনি
ওই নগরের প্রশাসক ছিলেন, যদি বিধাতার অনুমতি নিয়ে ওপার থেকে হজরত শাহজালাল
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে নামেন এবং সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে গুলিস্তান
নগর ভবনে যান, তাহলে তাঁর সময়ের মহেঞ্জোদারোর সঙ্গে ঢাকার একটা
তুলনামূলক সমীক্ষা করতে পারবেন। তাঁর যদি প্রেস ব্রিফিং করার সুযোগ থাকে, তাহলে তিনি বলবেন:
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ, আপনারা আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আপনাদের এই সাত-আট শ বছরের প্রাচীন নগর সম্পর্কে এই মুহূর্তে আমি বিশেষ কিছু বলতে পারব না। প্রথমত, আমি ক্লান্ত। বিমানভ্রমণে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু বিমানবন্দরে এসে বিপদে পড়ি। কনভেয়ার বেল্টের কাছে ট্রলি নিয়ে ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে থেকে আমার কোমর ধরে যায়। কিন্তু আমার লাগেজ আসে না। দু-চারজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করি। তাঁরা কোনো জবাব না দিয়ে একধরনের বিদঘুটে ভিরকুটি করেন। তার অর্থ অনেকটা এ রকম: মালমাত্তা ব্যাটা তোর, আমার কী করার আছে! যা হোক, শেষ পর্যন্ত কেউ একজন একটা সুটকেস এনে দিল। কিন্তু বড় যে বাক্সটায় দামি জিনিসপত্র ছিল, সেটা পাইনি। তারপর ট্যাক্সি ভাড়া করতে গিয়ে যা ঘটেছে তা না বলাই ভালো। বিমানবন্দর থেকে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ দিয়ে নূর হোসেন চত্বরে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টার মতো লাগে। এই দীর্ঘ সময়ে আমি ঢাকা নগরের অনেক কিছুই দেখতে পারতাম, কিন্তু দেখার মধ্যে মাটিতে দেখেছি মানুষ পিল পিল করছে, আর পথের দুপাশে ডানে-বাঁয়ে যেদিকে দু চোখ যায় দেখেছি পোস্টার আর প্রকাণ্ড ডিজিটাল বিলবোর্ড। সেই বিলবোর্ডে কোনো ফুল-লতা-পাতার ছবি নয়, মানুষের ছবি। রাস্তায় মানুষ, বিলবোর্ডেও মানুষ। বলুন তো দেখি ব্যাপার কী?
এক সাংবাদিক বললেন: সিটি নির্বাচন হচ্ছে। প্রার্থীদের পোস্টার-বিলবোর্ড।
মহেঞ্জোদারোর মেয়র বললেন: তা বেশ। এত বিলবোর্ডের লেখা ও ছবি কে দেখবে? তবে দেখুন, আমাদের সময় এত সব নির্বাচন-টির্বাচন ছিল না। নাগরিকেরাই বসে যোগ্য একজনকে মনোনীত করতেন। যিনি মেয়র হতেন তাঁর কাছে তাঁর ঘর-সংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, নগরই ছিল সব। মানুষের নাগরিক সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখকে মেয়র নিজের বলে অনুভব করতেন। সে রকম মেয়র নাকি আপনাদের এই ঢাকায়ও অনেকে ছিলেন শুনেছি। অবশ্য সেটা অনেক আগের কথা। তখন আপনারা ইংরেজ সাহেবদের অধীন ছিলেন।
মহেঞ্জোদারোর নগরপিতা বলতে থাকেন: একটা কথা শুধু আমি আপনাদের বলতে চাই। অনেক উঁচু উঁচু দালানকোঠা বানিয়েছেন বটে, আমি একটা জিনিস দেখেছি, আমার নগর ধ্বংস হওয়ার আগে যেসব লক্ষণ লক্ষ করেছি, তার পনেরো আনা ঢাকায়ও দেখতে পাচ্ছি। আমার নিজের মেয়র-জীবনের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এই পুরোনো নগরটিকে আপনারা গত ৪০ বছরে তিলে তিলে হত্যা করেছেন। কোনো স্বাধীন দেশের রাজধানী-নগর কী, সে সম্পর্কে আপনাদের কোনো ধারণা নেই। অথচ আপনাদের এই নগরের মেয়র ও প্রশাসকেরা দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ইবনে বতুতা, মার্কো পলো ও হিউয়েন সাংয়ের চেয়ে বেশি সারা দুনিয়া ঘুরেছেন। ওসব রাজধানীতে গিয়ে দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে দেখেছেন, বড় বড় হোটেলে সস্ত্রীক থেকেছেন, রেস্তোরাঁয় গিয়ে সবচেয়ে দামি খাবারের অর্ডার দিয়েছেন, বিশেষ করে সুপার মার্কেটগুলোতে কেনাকাটাতেই বেশি সময় দিয়েছেন। ওসব দেশ থেকে কিছু শিখে আসেননি। ৪০ বছরের সব মেয়রেরই সয়সম্পত্তির দিক থেকে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, আর অধঃপতনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে ঢাকা নগর। দেখুন, সততা ও দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। আপনাদের দেশে চাপাবাজি ও চালবাজি জিনিসটি খুব বেশি। আমাদের সময় আমরা কোনো গালভরা প্রতিশ্রুতিই দিতাম না। কাজ যা করার তা নীরবে করে যেতাম। করার মতো কাজেরও শেষ নেই। অনেক কাজ করতে কোনো বড় বরাদ্দের প্রয়োজন নেই। একটি নগরে রাস্তার দুপাশে কীভাবে কী ধরনের গাছ লাগাতে হয়, সেটা পর্যন্ত আপনারা জানেন না। একটি জনবহুল নগরে পার্কের কী প্রয়োজন, সেটাও জানেন না। আসার সময় গাড়ি থেকে কী একটা পার্ক বা উদ্যানের মতো দেখলাম, তার না আছে কোনো শ্রী, না আছে কোনো উপযোগিতা।
মহেঞ্জোদারোর নগরপিতা বলেন: আমি যে গাড়িতে আসি, তার চালক ছিলেন বয়স্ক মানুষ। তাঁর শ্বশুরের বাড়ি ছিল পুরান ঢাকায়। তাঁদের নাকি লোকে ঢাকাইয়া বলে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে তাঁর শ্বশুর এক নগরপিতার ড্রাইভার ছিলেন। এই নগরের অনেক কথা তিনি জানতেন। ট্রাফিক সিগন্যালে যখন গাড়ি পনেরো-কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে থাকত, ড্রাইভার নানা বিষয়ে একা একাই বকবক করতেন। তিনি এই নগরের গত পনেরো বছরের হিস্ট্রি বললেন। তিনি বললেন, সর্বশেষ নির্বাচিত মেয়র নাকি ছিলেন বহু বছর। বহু বছর থাকার কারণ, সরকারি দলের প্রার্থী নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কায় সরকার নির্বাচনই দেয়নি। তারপর এক সন্ধ্যায় তাঁকে কৌশলে ধঁা করে সরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ছুরি দিয়ে করা হয় মহানগরকে জবাই বা দ্বিখণ্ডিত। সংবিধানে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে: ‘প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ঢাকা’। কোন ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী? ‘ঢাকা উত্তর’ না ‘ঢাকা দক্ষিণ’?
রসিক ধরনের এক রিপোর্টার ছিলেন, তিনি বললেন, ঢাকা ভাগ করার সময় ‘ঢাকা’ বানানটাকেও ভাগ করলে ভালো ছিল।
মহেঞ্জোদারোর মেয়র বললেন, কী রকম?
রিপোর্টার: ঢাকার এক অংশের নাম ‘ঢা’ এবং অপর অংশের নাম ‘কা’। উত্তরের অংশ যদি ঢা হয় তো দক্ষিণের অংশ কা।
আইন-আদালত কভার করেন এমন একজন সাংবাদিক এক কোনায় বসা ছিলেন। তিনি বললেন: আশির দশকে এক সামরিক শাসক ঢাকার ইংরেজদের দেওয়া বানান Dacca পরিবর্তন করে করেন Dhaka. কাজটি তিনি ভালো করেছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু সংবিধান সংশোধন না করে রাজধানীর বানান পরিবর্তন করা সংবিধান লঙ্ঘন।
তাঁকে বাধা দিলেন আর একজন সাংবাদিক। তিনি বললেন: সংবিধান লঙ্ঘন করে যিনি ক্ষমতা দখল করেন, তাঁর কাছে সংবিধানের মূল্য কী? যে দেশে নির্বাচিত ব্যক্তিরাই সংবিধানের তোয়াক্কা করেন না।
কোর্ট রিপোর্টার বলেন, রাজধানী ঢাকাকে দুই নামে নামকরণ করা সংবিধান অবমাননা। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য নগরকে তো ওয়ার্ডে ভাগ করাই আছে। তাতে আছেন কাউন্সিলর। সিটিকে দুভাগ করে দুটি নামে চিহ্নিত করার যৌক্তিকতা কোথায়? লন্ডনকে প্রধানমন্ত্রী থ্যাচার একবার করেছিলেন। ছয় মাসের মধ্যে তিনি তাঁর ভুল শুধরে নেন। ঢাকাকে যখন যূপকাষ্ঠে শুইয়ে বলি দেওয়া হয়, তখন সরকারের ঘনিষ্ঠ কলাম লেখকেরাও তার বিরোধিতা করেছিলেন। করজোড়ে অনুরোধ করছিলেন ও কাজ থেকে বিরত থাকতে। কর্ণপাত করা হয়নি কারও কথায়।
মহেঞ্জোদারোর সাবেক মেয়র বলেন: পৃথিবীর বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা সফরে এলে তাঁদের নাগরিক সংবর্ধনা দেন রাজধানীর মেয়র। তাঁকে দেওয়া হয় কাসকেটে মহানগরের চাবি উপহার। এরপর যদি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান ঢাকায় আসেন, নাগরিক সংবর্ধনা কোন মেয়র দেবেন, আর চাবিই বা কে দেবেন।
এক ছোকরা মতো সাংবাদিক উঠে দাঁড়িয়ে বলেন: বিদেশি অতিথিকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে দুই সিটি করপোরেশনের মাঝখানে নো ম্যানস ল্যান্ডে। দুই সিটির দুই দিক থেকে হাত বাড়িয়ে দুই মেয়র মহামান্য অতিথির দুই হাতে দুটি চাবি দেবেন।
আরেক সাংবাদিক বলেন: কে চাবি আগে দেবেন তা নিয়ে মারামারি হতে পারে তাঁদের সমর্থক বা ক্যাডারদের মধ্যে। কেউ খাবে থুতনিতে ঘুষি, কেউবা খোয়াবে এক পাটি দাঁত, কারও ভাঙবে পাঁজরের হাড়।
সাংবাদিকদের কথাবার্তা মহেঞ্জোদারোর মেয়র গালে হাত দিয়ে বসে শুনছিলেন। এর মধ্যে এক দৈনিকের একজন নারী রিপোর্টার বললেন: চাবি যদি লোহার তৈরি হয় কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু বিদেশি অতিথিদের নগরের সোনার চাবিই উপহার দেওয়া রীতি। সোনার হলে সর্বনাশ! কোনো মেয়রের চাবিতে খাদ থাকবে এগারো শতাংশ, কোনো মেয়রের চাবিতে সোনার খাদ থাকবে তেরো শতাংশ। সরকারি দলের মেয়রের চাবির খাদ যদি ১১ শতাংশ হয় কোনো কথা নেই, কিন্তু আরেক মেয়র যদি খোদানাখাস্তা বিরোধী দলের হন এবং তাঁরটির খাদ যদি হয় ১৩ শতাংশ, তাহলে একটি বছর তা নিয়ে বিতর্ক হবে এবং বিরোধী দলের মেয়র মামলায় জড়াবেন। তারপর জেলেও যেতে পারেন। সবশেষে বরখাস্তের আদেশ যাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে।
কোনো টিভি চ্যানেলের একটি সুদর্শন ছেলে, যাঁর মধ্যে নীতি-আদর্শ এখনো আছে, দাঁড়িয়ে নারী সাংবাদিককে থামিয়ে দেন: আপা, সোনার খাদ নিয়া আপনে আর কথা কইয়েন না। যে দেশের মানুষের মধ্যেই পনেরো আনা খাদ, সেখানে মেডেল আর চাবির খাদ মাপতে গেছেন!
সংবাদ সম্মেলনে কথাবার্তায় মহেঞ্জোদারোর মেয়র বিপন্ন বোধ করছিলেন। যেকোনো মহানগরের মেয়রের মর্যাদাই অসামান্য, তবে রাজধানী নগরের মেয়রের মর্যাদা বিরাট। কিন্তু যেসব দেশে একটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আছে, সেখানে কোনো মেয়র একজন কর্মকর্তা মাত্র। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন সহকারী সচিবের সঙ্গেও মেয়রকে দাঁত বের করে হাত কচলে কথা বলতে হয়। তাঁরা নাখোশ হলে সব পণ্ড। সেই বাস্তবতায় মহানগরের মেয়র যদি দেশের সবচেয়ে যোগ্য ও সৎ মানুষটিও নির্বাচিত হন, তাঁর পক্ষে হতভাগ্য নগরবাসীর উপকার করা সম্ভব নয়।
কোনো দেশের রাজধানী নগর আর উপজেলা শহর এক জিনিস নয়। ঢাকা নগর আর দুপচাঁচিয়া পৌরসভা সমান নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির কর্তারা নীহাররঞ্জন গুপ্তের দশ খণ্ড কিরীটী অমনিবাস পড়লেও পড়তে পারেন, কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানের মতো চটি বইটি আগাগোড়া পাঠ করেছেন—এ কথা আমরা হলফ করে বলতে পারি না। রাষ্ট্র চালানোর জন্য ওটি একটি
ভালো নির্দেশিকা। সংবিধানের ৫(২) অনুচ্ছেদে ছয়টি শব্দ আছে: ‘রাজধানীর সীমানা আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে।’
রাজধানী ঢাকার একটি স্থায়ী সীমানা নির্ধারিত হওয়া সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।
এই বাস্তবতায় নির্বাচনই হোক আর যা-ই হোক, মহানগরের মানুষ যে অন্ধকারে ও চরম দুর্দশায় রয়েছে, সেখানেই থাকবে। ঢাকার ভবিষ্যৎ দিব্য চোখে দেখতে পেয়ে মহেঞ্জোদারোর মেয়র সংবাদ সম্মেলন থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে যান।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ, আপনারা আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আপনাদের এই সাত-আট শ বছরের প্রাচীন নগর সম্পর্কে এই মুহূর্তে আমি বিশেষ কিছু বলতে পারব না। প্রথমত, আমি ক্লান্ত। বিমানভ্রমণে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু বিমানবন্দরে এসে বিপদে পড়ি। কনভেয়ার বেল্টের কাছে ট্রলি নিয়ে ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে থেকে আমার কোমর ধরে যায়। কিন্তু আমার লাগেজ আসে না। দু-চারজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করি। তাঁরা কোনো জবাব না দিয়ে একধরনের বিদঘুটে ভিরকুটি করেন। তার অর্থ অনেকটা এ রকম: মালমাত্তা ব্যাটা তোর, আমার কী করার আছে! যা হোক, শেষ পর্যন্ত কেউ একজন একটা সুটকেস এনে দিল। কিন্তু বড় যে বাক্সটায় দামি জিনিসপত্র ছিল, সেটা পাইনি। তারপর ট্যাক্সি ভাড়া করতে গিয়ে যা ঘটেছে তা না বলাই ভালো। বিমানবন্দর থেকে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ দিয়ে নূর হোসেন চত্বরে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টার মতো লাগে। এই দীর্ঘ সময়ে আমি ঢাকা নগরের অনেক কিছুই দেখতে পারতাম, কিন্তু দেখার মধ্যে মাটিতে দেখেছি মানুষ পিল পিল করছে, আর পথের দুপাশে ডানে-বাঁয়ে যেদিকে দু চোখ যায় দেখেছি পোস্টার আর প্রকাণ্ড ডিজিটাল বিলবোর্ড। সেই বিলবোর্ডে কোনো ফুল-লতা-পাতার ছবি নয়, মানুষের ছবি। রাস্তায় মানুষ, বিলবোর্ডেও মানুষ। বলুন তো দেখি ব্যাপার কী?
এক সাংবাদিক বললেন: সিটি নির্বাচন হচ্ছে। প্রার্থীদের পোস্টার-বিলবোর্ড।
মহেঞ্জোদারোর মেয়র বললেন: তা বেশ। এত বিলবোর্ডের লেখা ও ছবি কে দেখবে? তবে দেখুন, আমাদের সময় এত সব নির্বাচন-টির্বাচন ছিল না। নাগরিকেরাই বসে যোগ্য একজনকে মনোনীত করতেন। যিনি মেয়র হতেন তাঁর কাছে তাঁর ঘর-সংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, নগরই ছিল সব। মানুষের নাগরিক সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখকে মেয়র নিজের বলে অনুভব করতেন। সে রকম মেয়র নাকি আপনাদের এই ঢাকায়ও অনেকে ছিলেন শুনেছি। অবশ্য সেটা অনেক আগের কথা। তখন আপনারা ইংরেজ সাহেবদের অধীন ছিলেন।
মহেঞ্জোদারোর নগরপিতা বলতে থাকেন: একটা কথা শুধু আমি আপনাদের বলতে চাই। অনেক উঁচু উঁচু দালানকোঠা বানিয়েছেন বটে, আমি একটা জিনিস দেখেছি, আমার নগর ধ্বংস হওয়ার আগে যেসব লক্ষণ লক্ষ করেছি, তার পনেরো আনা ঢাকায়ও দেখতে পাচ্ছি। আমার নিজের মেয়র-জীবনের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এই পুরোনো নগরটিকে আপনারা গত ৪০ বছরে তিলে তিলে হত্যা করেছেন। কোনো স্বাধীন দেশের রাজধানী-নগর কী, সে সম্পর্কে আপনাদের কোনো ধারণা নেই। অথচ আপনাদের এই নগরের মেয়র ও প্রশাসকেরা দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ইবনে বতুতা, মার্কো পলো ও হিউয়েন সাংয়ের চেয়ে বেশি সারা দুনিয়া ঘুরেছেন। ওসব রাজধানীতে গিয়ে দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে দেখেছেন, বড় বড় হোটেলে সস্ত্রীক থেকেছেন, রেস্তোরাঁয় গিয়ে সবচেয়ে দামি খাবারের অর্ডার দিয়েছেন, বিশেষ করে সুপার মার্কেটগুলোতে কেনাকাটাতেই বেশি সময় দিয়েছেন। ওসব দেশ থেকে কিছু শিখে আসেননি। ৪০ বছরের সব মেয়রেরই সয়সম্পত্তির দিক থেকে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, আর অধঃপতনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে ঢাকা নগর। দেখুন, সততা ও দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। আপনাদের দেশে চাপাবাজি ও চালবাজি জিনিসটি খুব বেশি। আমাদের সময় আমরা কোনো গালভরা প্রতিশ্রুতিই দিতাম না। কাজ যা করার তা নীরবে করে যেতাম। করার মতো কাজেরও শেষ নেই। অনেক কাজ করতে কোনো বড় বরাদ্দের প্রয়োজন নেই। একটি নগরে রাস্তার দুপাশে কীভাবে কী ধরনের গাছ লাগাতে হয়, সেটা পর্যন্ত আপনারা জানেন না। একটি জনবহুল নগরে পার্কের কী প্রয়োজন, সেটাও জানেন না। আসার সময় গাড়ি থেকে কী একটা পার্ক বা উদ্যানের মতো দেখলাম, তার না আছে কোনো শ্রী, না আছে কোনো উপযোগিতা।
মহেঞ্জোদারোর নগরপিতা বলেন: আমি যে গাড়িতে আসি, তার চালক ছিলেন বয়স্ক মানুষ। তাঁর শ্বশুরের বাড়ি ছিল পুরান ঢাকায়। তাঁদের নাকি লোকে ঢাকাইয়া বলে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে তাঁর শ্বশুর এক নগরপিতার ড্রাইভার ছিলেন। এই নগরের অনেক কথা তিনি জানতেন। ট্রাফিক সিগন্যালে যখন গাড়ি পনেরো-কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে থাকত, ড্রাইভার নানা বিষয়ে একা একাই বকবক করতেন। তিনি এই নগরের গত পনেরো বছরের হিস্ট্রি বললেন। তিনি বললেন, সর্বশেষ নির্বাচিত মেয়র নাকি ছিলেন বহু বছর। বহু বছর থাকার কারণ, সরকারি দলের প্রার্থী নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কায় সরকার নির্বাচনই দেয়নি। তারপর এক সন্ধ্যায় তাঁকে কৌশলে ধঁা করে সরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ছুরি দিয়ে করা হয় মহানগরকে জবাই বা দ্বিখণ্ডিত। সংবিধানে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে: ‘প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ঢাকা’। কোন ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী? ‘ঢাকা উত্তর’ না ‘ঢাকা দক্ষিণ’?
রসিক ধরনের এক রিপোর্টার ছিলেন, তিনি বললেন, ঢাকা ভাগ করার সময় ‘ঢাকা’ বানানটাকেও ভাগ করলে ভালো ছিল।
মহেঞ্জোদারোর মেয়র বললেন, কী রকম?
রিপোর্টার: ঢাকার এক অংশের নাম ‘ঢা’ এবং অপর অংশের নাম ‘কা’। উত্তরের অংশ যদি ঢা হয় তো দক্ষিণের অংশ কা।
আইন-আদালত কভার করেন এমন একজন সাংবাদিক এক কোনায় বসা ছিলেন। তিনি বললেন: আশির দশকে এক সামরিক শাসক ঢাকার ইংরেজদের দেওয়া বানান Dacca পরিবর্তন করে করেন Dhaka. কাজটি তিনি ভালো করেছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু সংবিধান সংশোধন না করে রাজধানীর বানান পরিবর্তন করা সংবিধান লঙ্ঘন।
তাঁকে বাধা দিলেন আর একজন সাংবাদিক। তিনি বললেন: সংবিধান লঙ্ঘন করে যিনি ক্ষমতা দখল করেন, তাঁর কাছে সংবিধানের মূল্য কী? যে দেশে নির্বাচিত ব্যক্তিরাই সংবিধানের তোয়াক্কা করেন না।
কোর্ট রিপোর্টার বলেন, রাজধানী ঢাকাকে দুই নামে নামকরণ করা সংবিধান অবমাননা। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য নগরকে তো ওয়ার্ডে ভাগ করাই আছে। তাতে আছেন কাউন্সিলর। সিটিকে দুভাগ করে দুটি নামে চিহ্নিত করার যৌক্তিকতা কোথায়? লন্ডনকে প্রধানমন্ত্রী থ্যাচার একবার করেছিলেন। ছয় মাসের মধ্যে তিনি তাঁর ভুল শুধরে নেন। ঢাকাকে যখন যূপকাষ্ঠে শুইয়ে বলি দেওয়া হয়, তখন সরকারের ঘনিষ্ঠ কলাম লেখকেরাও তার বিরোধিতা করেছিলেন। করজোড়ে অনুরোধ করছিলেন ও কাজ থেকে বিরত থাকতে। কর্ণপাত করা হয়নি কারও কথায়।
মহেঞ্জোদারোর সাবেক মেয়র বলেন: পৃথিবীর বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা সফরে এলে তাঁদের নাগরিক সংবর্ধনা দেন রাজধানীর মেয়র। তাঁকে দেওয়া হয় কাসকেটে মহানগরের চাবি উপহার। এরপর যদি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান ঢাকায় আসেন, নাগরিক সংবর্ধনা কোন মেয়র দেবেন, আর চাবিই বা কে দেবেন।
এক ছোকরা মতো সাংবাদিক উঠে দাঁড়িয়ে বলেন: বিদেশি অতিথিকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে দুই সিটি করপোরেশনের মাঝখানে নো ম্যানস ল্যান্ডে। দুই সিটির দুই দিক থেকে হাত বাড়িয়ে দুই মেয়র মহামান্য অতিথির দুই হাতে দুটি চাবি দেবেন।
আরেক সাংবাদিক বলেন: কে চাবি আগে দেবেন তা নিয়ে মারামারি হতে পারে তাঁদের সমর্থক বা ক্যাডারদের মধ্যে। কেউ খাবে থুতনিতে ঘুষি, কেউবা খোয়াবে এক পাটি দাঁত, কারও ভাঙবে পাঁজরের হাড়।
সাংবাদিকদের কথাবার্তা মহেঞ্জোদারোর মেয়র গালে হাত দিয়ে বসে শুনছিলেন। এর মধ্যে এক দৈনিকের একজন নারী রিপোর্টার বললেন: চাবি যদি লোহার তৈরি হয় কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু বিদেশি অতিথিদের নগরের সোনার চাবিই উপহার দেওয়া রীতি। সোনার হলে সর্বনাশ! কোনো মেয়রের চাবিতে খাদ থাকবে এগারো শতাংশ, কোনো মেয়রের চাবিতে সোনার খাদ থাকবে তেরো শতাংশ। সরকারি দলের মেয়রের চাবির খাদ যদি ১১ শতাংশ হয় কোনো কথা নেই, কিন্তু আরেক মেয়র যদি খোদানাখাস্তা বিরোধী দলের হন এবং তাঁরটির খাদ যদি হয় ১৩ শতাংশ, তাহলে একটি বছর তা নিয়ে বিতর্ক হবে এবং বিরোধী দলের মেয়র মামলায় জড়াবেন। তারপর জেলেও যেতে পারেন। সবশেষে বরখাস্তের আদেশ যাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে।
কোনো টিভি চ্যানেলের একটি সুদর্শন ছেলে, যাঁর মধ্যে নীতি-আদর্শ এখনো আছে, দাঁড়িয়ে নারী সাংবাদিককে থামিয়ে দেন: আপা, সোনার খাদ নিয়া আপনে আর কথা কইয়েন না। যে দেশের মানুষের মধ্যেই পনেরো আনা খাদ, সেখানে মেডেল আর চাবির খাদ মাপতে গেছেন!
সংবাদ সম্মেলনে কথাবার্তায় মহেঞ্জোদারোর মেয়র বিপন্ন বোধ করছিলেন। যেকোনো মহানগরের মেয়রের মর্যাদাই অসামান্য, তবে রাজধানী নগরের মেয়রের মর্যাদা বিরাট। কিন্তু যেসব দেশে একটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আছে, সেখানে কোনো মেয়র একজন কর্মকর্তা মাত্র। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন সহকারী সচিবের সঙ্গেও মেয়রকে দাঁত বের করে হাত কচলে কথা বলতে হয়। তাঁরা নাখোশ হলে সব পণ্ড। সেই বাস্তবতায় মহানগরের মেয়র যদি দেশের সবচেয়ে যোগ্য ও সৎ মানুষটিও নির্বাচিত হন, তাঁর পক্ষে হতভাগ্য নগরবাসীর উপকার করা সম্ভব নয়।
কোনো দেশের রাজধানী নগর আর উপজেলা শহর এক জিনিস নয়। ঢাকা নগর আর দুপচাঁচিয়া পৌরসভা সমান নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির কর্তারা নীহাররঞ্জন গুপ্তের দশ খণ্ড কিরীটী অমনিবাস পড়লেও পড়তে পারেন, কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানের মতো চটি বইটি আগাগোড়া পাঠ করেছেন—এ কথা আমরা হলফ করে বলতে পারি না। রাষ্ট্র চালানোর জন্য ওটি একটি
ভালো নির্দেশিকা। সংবিধানের ৫(২) অনুচ্ছেদে ছয়টি শব্দ আছে: ‘রাজধানীর সীমানা আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে।’
রাজধানী ঢাকার একটি স্থায়ী সীমানা নির্ধারিত হওয়া সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।
এই বাস্তবতায় নির্বাচনই হোক আর যা-ই হোক, মহানগরের মানুষ যে অন্ধকারে ও চরম দুর্দশায় রয়েছে, সেখানেই থাকবে। ঢাকার ভবিষ্যৎ দিব্য চোখে দেখতে পেয়ে মহেঞ্জোদারোর মেয়র সংবাদ সম্মেলন থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে যান।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
No comments