রাতে রুনীর বাসায় রিমন by নেসারুল হক খোকন ও ওবায়েদ অংশুমান
হত্যাকাণ্ডের দিন পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ডিবি অফিস থেকে বেরিয়ে আসছে রুনীর ছোট ভাই রোমান ও রিমন (পেছনে) |
জড়িত সন্দেহে আটক করলেও প্রভাবশালীদের চাপে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় : সাগর-রুনী আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করে রিমন
নওয়াজীশ আলম রিমন। বেকার যুবক। নিহত সাংবাদিক মেহেরুন রুনীর ছোট ভাই। ঘটনার দিন সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে যাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আবার প্রভাবশালীদের চাপে তাকে ছেড়েও দিতে বাধ্য হয়। পরে তদন্ত সংস্থার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ঘটনার দিন রাতে রুনী-সাগরের ফ্ল্যাটে যায় রিমন। আর গভীর রাতে ধানমণ্ডিতে ছিল তার অবস্থান। রিমনই ফোন করে সবাইকে জানায়, ‘রুনী আপু আত্মহত্যা করেছে। পরে সাগরও সুইসাইড করেছে বলে প্রচার করে সে।’ অথচ তার দাবি অনুযায়ী, মেঘের কাছ থেকে রুনী-সাগরের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরও প্রথমে সে বাসা থেকে বের হয়নি।
তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, রিমন মাদকাসক্ত। আর রুনীদের বাসায় চুরির সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এসব কারণে সাগর রিমনকে পছন্দ করতেন না। এমনকি সাগর থাকলে তিনি ওই বাসায় যেতেন না। তার এমন কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পেয়ে রুনীও তাকে এড়িয়ে চলতেন। ঘটনার সঙ্গে রিমনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন সন্দেহে র্যাব একাধিকবার তাকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্ত সংস্থার পাশাপাশি যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে, রিমন ওই দিন রাতে সাগরদের বাসায় গিয়েছিল। একই নেটওয়ার্কে অবস্থান করে মোবাইলে দু’জনের সঙ্গে কথাও বলে।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে (১১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ৫৮/এ/২ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে সাগর-রুনীর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ফ্ল্যাটে তারা পাঁচ মাস বসবাস করেন।
রুনীদের বাসায় রিমন : রিমন এয়ারটেলের একটি সিম ব্যবহার করে। ঘটনার আগের তিন মাসের মোবাইল ফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রিমন তার ভগ্নিপতি সাগর কিংবা বোন রুনীর সঙ্গে কখনও মোবাইল ফোনে কথা বলার তথ্য নেই। তবে উল্লিখিত সময়ে (তিন মাস) সে সাগর-রুনীর বাসায় গেছে ২৪ বার। এর মধ্যে ঘটনার দিন রাতেই গেছে দু’বার। ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ৩৮ মিনিটে সে ওই ফ্ল্যাটে যায়। ওই ফ্ল্যাটে অবস্থানকালীন সে একটি ওয়ারিদ নম্বরে (০১৬৭৪৪৯৩২৬৬) কথা বলে। তার মোবাইল থেকে দেয়া এই কলের স্থায়িত্ব ছিল ৬৪ সেকেন্ড। পরে সে ওই বাসা ত্যাগ করে। আবার ওই দিন রাত ১১টায় ফের সাগরদের ফ্ল্যাটে যায়। তখন সে পুনরায় বাংলালিংকের (০১৯২৪৯৭৬৯৯৮) এই নম্বরে ১৪৪ সেকেন্ড কথা বলে। অথচ রহস্যজনকভাবে উল্লিখিত দুটি নম্বরই ঘটনার পর থেকে বন্ধ রয়েছে।
রিমনের অস্বীকার : এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিমন সোমবার যুগান্তরকে বলে, ‘আমি সেদিন ওদের (সাগর-রুনি) বাসায় যাইনি। কারণ আমার মা মেঘকে নিয়ে পিকনিকে গিয়েছিল। সারা দিন তারা বাইরে (সাভারে) ছিল। যদি কেউ বলে, আমি সেদিন বাসায় গেছি তবে তা মিথ্যা।’ এ ছাড়া মাদক সেবনের কথা অস্বীকার করে রিমন বলে, ‘আমার বিরুদ্ধে চুরিসহ অন্য যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য নয়।’
স্বীকার করলেন রোমান : তবে মামলার বাদী ও রিমনের মেজ ভাই নওশের আলম রোমান গত ৯ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরকে বলেন, ‘হাঁ, রিমন সেদিন রুনিদের বাসায় গিয়েছিল। বাসায় গেলেই কী সে খুন করছে? করলে র্যাব প্রমাণ করুক।’
মা থাকলেই রিমন আসত : ঘটনার পর তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন এমন একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সাগর যখন বাসায় থাকত না, তখন রিমন ওই বাসায় যেত। কারণ সাগর রিমনকে অপছন্দ করতেন। সে যে মাদকাসক্ত ছিল তা জানতেন সাগর। তিনি আরও বলেন, সাগর ধারণা করতেন, তার বাসা থেকে টাকা-পয়সাসহ যেসব জিনিস চুরি হয়েছে তা সম্ভবত রিমনই নিয়েছে। ঘটনার সময় ওই বাসার দায়িত্ব পালন করা নিরাপত্তাকর্মী রুদ্র পলাশ যুগান্তরকে বলেন, ‘রুনীর ভাই রিমন সাগরদের বাসায় খুব বেশি আসত। যখন রুনীর মা এ বাসায় থাকতেন তখনই রিমন আসতেন টাকার জন্য। প্রায় সময়ই রুনীর মা তার হাতে দু-তিনশ’ থেকে ৫শ’ টাকাও ধরিয়ে দিতেন। অনেক সময় টাকা খুচরা না থাকলে ৫শ’ টাকার নোট ভাঙানোর জন্য বাড়ির ম্যানেজার তাহেরের হাতে দিতেন তার মা নুরুন্নাহার মীর্জা। তা আমি দেখেছি। রিমন মূলত টাকার জন্যই এ বাসায় আসতেন।’
ওই বাসার তৎকালীন ব্যবস্থাপক আবু তাহের সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘রুনীর মা থাকলে রিমন ওই বাসায় আসতেন। আর আমি একবার টাকা ভাংতি করে দিলে রিমনকে টাকা দেন খালাম্মা (রুনীর মা)।’ তিনি আরও বলেন, ‘মেঘকে স্কুলে আনা-নেয়া করতেন খালাম্মা। এই বাসাতেও মাঝে মাঝে থাকতেন। তবে ঘটনার দিন রাতে তিনি ওই বাসায় ছিলেন কিনা আমি বলতে পারব না।’
আত্মহত্যা করেছে আপু : রুনীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ও সহকর্মী নাদিরা কিরন। তিনি বর্তমানে এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। রুনীও মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এটিএন বাংলায় সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার দিন সাগর-রুনীর মৃত্যুর সংবাদ নাদিরা কিরণকে রিমনই প্রথম জানিয়েছিল। মৃত্যুর সংবাদ প্রথম কীভাবে জেনেছিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে নাদিরা কিরন যুগান্তরকে বলেন, ‘রুনির ছোট ভাই রিমন আমাকে ফোন দেয়। টাইমটা এক্সাট বলতে পারব না। তবে ৭টা কিংবা সাড়ে ৭টা হবে। রিমন আমাকে বলল, নাদিরা আপা, আপুতো নাই। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপুতো নাই মানে? সে বলল, আপুতো সুইসাইড করেছে। আর আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সাগর কই। ও বলল, দাদাও-তো (সাগরকে দাদা বলে ডাকত) নাই। পরে বলল, দু’জনই আত্মহত্যা করেছে। তবে কেন ও (রিমন) আত্মহত্যার কথা বলেছিল তা আমি আর ওদের কাছে জিজ্ঞাসা করিনি।’ এদিকে আত্মহত্যা বলার কারণ জানতে চাইলে রিমন যুগান্তরকে বলে, অনেক দিন আগের ঘটনা। কাকে কী বলেছিলাম তা আমার মনে নেই। শুধু সাংবাদিক নাদিরা কিরণকে নয়, রিমন তার খালা-খালুকেও জানিয়েছিল, রুনি-সাগর আত্মহত্যা করেছে, যা রিমনের খালু ইমদাদ হোসেন যুগান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, রুনীদের ফ্ল্যাট থেকে আমাদের বাসা কাছাকাছি। সেদিন সকাল বেলা আমাদেরও বলা হয়, রুনী-সাগর সুইসাইড করেছে।
রিমন যেভাবে গ্রেফতার : তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনার দিন সারা রাত জেগেছিল রিমন। এমনকি সকাল বেলা তাকে অস্বাভাবিক মনে হয়। মোবাইল ফোনের কললিস্ট অনুযায়ী গভীর রাতে (২টা ৪৩ মিনিট) তাকে ধানমণ্ডিতে অবস্থান করতে দেখা যায়। এ রকম নানা সন্দেহের সূত্র ধরে ঘটনার দিন দুপুরে তাকে পুলিশ আটক করে। কিন্তু বিকালে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের তৎকালীন একজন উপকমিশনার যুগান্তরকে বলেন, ‘রিমন সেদিন সারা রাত জেগে ছিল। সকাল বেলা তাকে এবনরমাল মনে হয়েছে। ওই দিন রাতে রিমন ধানমণ্ডি গিয়েছিল তার প্রমাণ সিডিআরে পাওয়া গেছে। তাকে তো আমরা প্রথম দিনই গ্রেফতার করেছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘রিমনকে গ্রেফতার করে বিকাল পর্যন্ত আমাদের হেফাজতে রাখা হয়। পরে সাংবাদিকদের একটি মহল, মন্ত্রী-মিনিস্টার, সব জায়গা থেকে তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ আসতে থাকে। এমনকি ওর ফ্যামিলি থেকেও চরম বাধার সম্মুখীন হই। পরে আইজিপি স্যার, কমিশনার স্যার সিদ্ধান্ত দিলেন তাকে ছেড়ে দেয়া হোক। এভাবেই সে ছাড়া পায়। তবে ছেড়ে দিলেও সন্দেহের বাইরে ছিল না রিমন।’ তিনি জানান, ‘আমাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে, সাগর যখন বাসায় থাকতেন না তখন রিমন ওই বাসায় যেত। রিমন তার বোন রুনী ও তার মায়ের কাছ থেকে অনেক টাকা-পয়সা নিত। সাগরের কাছে টাকা চাওয়ার সাহস করত না সে।’ তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সাগরের সঙ্গে ওই ফ্যামিলির ভাইদের (রুনীর ভাই) সঙ্গে সম্পর্ক যে দুধে-ভাতে ছিল তা কিন্তু না। এমনকি রোমান তার বোন রুনীর সঙ্গে এক বছর কথা বলা বন্ধ রাখেন।’ এ বিষয়টি যুগান্তরের কাছেও স্বীকার করেন রোমান।
টাকা খোয়া, চাবি উধাও : রুনী তার বান্ধবী নাদিরা কিরনের কাছেও ফ্ল্যাট থেকে টাকা চুরি ও চাবি খোয়া যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। কেবল নাদিরা নন, জার্মানিতে থাকাকালীন সাগরের ঘনিষ্ঠ এক সহকর্মী যুগান্তরকে জানান, প্রায় রুনীদের বাসা থেকে টাকাসহ জিনিসপত্র চুরি হতো। যখন তারা বাসায় থাকত না তখনই এমন ঘটনা ঘটত। একবার তাদের বাসার চাবিও উধাও হয়ে যায়। এর একদিন পর ওই চাবি আবার ফেরতও পায়।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট র্যাবের এক কর্মকর্তাও যুগান্তরকে বলেন, টাকা-পয়সা চুরির সঙ্গে রিমন জড়িত ছিল। সাগরের পাশাপাশি তার নিজের বোন রুনীও বিষয়টি জানতে পারেন। কেননা এসব কারণে রুনিও তাকে দেখতে পারতেন না।’
রিমন কেন সন্দেহভাজন : র্যাবের সদ্য বিদায়ী সাবেক একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘শুরু থেকে রিমনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। একাধিকবার তাদের গ্রেফতারের পরিকল্পনাও হয়। কিন্তু বাদী রোমান সাংবাদিক (র্যাবের ভাষায় ) হওয়ায় সাংবাদিকদের একাংশকে তিনি ব্যবহার করছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অনেক বিষয় মাথায় রাখতে হয়েছে। রোমান-তো মামলার বাদী। আর আমরা এটাও ভেবেছি যে, তাদের গ্রেফতার করলে উল্টো র্যাবকে দোষারোপ করতে পারে সাংবাদিকদের একটি অংশ। তারা বলবে, মামলার কিছুই করতে পারেনি র্যাব, উল্টো বাদীপক্ষকে গ্রেফতার করে হয়রানি শুরু করেছে। সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাদের গ্রেফতার করার বিষয়টি থমকে আছে।’
যদিও বাদী রোমান যুগান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন যে, ‘ঘটনার পর থেকে টানা সাত মাস র্যাব তাকে পর্যবেক্ষণে রাখে। এমনকি তার বাসার সামনে একটি চায়ের স্টলও বসায় তারা।’
রিমন প্রসঙ্গে তদন্ত সংশ্লিষ্ট র্যাবের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ‘রুনীর পরিবারের দাবি অনুযায়ী, মেঘ তার নানীকে ফোন দিয়ে মৃত্যুর সংবাদ দেয়। তখন রিমনও মেঘের সঙ্গে কথা বলে। এমন সংবাদ পাওয়ার পরও সে তার নিজ বাসায় অবস্থান করে। কেন সে বাসায় অবস্থান করেছিল তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা আমাদের কাছে দিতে পারেনি। আবার এমন সংবাদ পাওয়ার পরও সে তার নিজের মোবাইল থেকেও কাউকে মৃত্যুর সংবাদ দেয়নি। ব্যবহার করেছে তার মায়ের মোবাইল। এরও জবাব দিতে পারেনি সে।’
র্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তার পাশাপাশি চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি র্যাবের এএসপি পদমর্যাদার আরেকজন কর্মকর্তা ছায়া তদন্ত করতেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে র্যাবের এএসপি পদমর্যাদার সাবেক ওই কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘সেদিন রাতে ওই বাসায় যে গিয়েছে তার খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার সম্ভাবনা বেশি। কারণ ঘটনার দিন রাতে রুনীদের বাসার পাশে হোটেল কাশবন থেকে খুনিরা বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়েছিল। যা তারা রাতে ওই বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে। ওই বাড়ির নিচ থেকে কাশবনের লেবেল লাগানো প্যাকেট উদ্ধার করি। পরে ঘটনার রাতে বিরিয়ানির প্যাকেট নেয়া হয়েছিল কিনা তা যাচাই করতে হোটেল কাশবনের মালিকের কাছেও গিয়েছিলাম। হোটেল মালিক বিরিয়ানির প্যাকেট নেয়ার কথা আমার কাছে স্বীকার করেন। তবে কারা নিয়েছিল তা তিনি আমার কাছে স্পষ্ট করতে পারেননি।’ তিনি আরও বলেন, ‘একাধিকবার আমি রিমনের মুখোমুখি হয়েছি। তাকে জিজ্ঞাসাও করেছি। কিন্তু রহস্যজনকভাবে যখনই তাকে জিজ্ঞাসা করেছি তখন বাদী রোমান তার সঙ্গে থাকত। রিমনকে জিজ্ঞাসা করলে রোমান সব প্রশ্নের উত্তর দিত। আর আমাকে বলত, ও (রিমন) পোলাপান মানুষ , ও কি বোঝে?’
রিপোর্টে প্রকাশিত সব সাক্ষাৎকারের অডিও-ভিডিও যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত।
নওয়াজীশ আলম রিমন। বেকার যুবক। নিহত সাংবাদিক মেহেরুন রুনীর ছোট ভাই। ঘটনার দিন সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে যাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আবার প্রভাবশালীদের চাপে তাকে ছেড়েও দিতে বাধ্য হয়। পরে তদন্ত সংস্থার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ঘটনার দিন রাতে রুনী-সাগরের ফ্ল্যাটে যায় রিমন। আর গভীর রাতে ধানমণ্ডিতে ছিল তার অবস্থান। রিমনই ফোন করে সবাইকে জানায়, ‘রুনী আপু আত্মহত্যা করেছে। পরে সাগরও সুইসাইড করেছে বলে প্রচার করে সে।’ অথচ তার দাবি অনুযায়ী, মেঘের কাছ থেকে রুনী-সাগরের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরও প্রথমে সে বাসা থেকে বের হয়নি।
তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, রিমন মাদকাসক্ত। আর রুনীদের বাসায় চুরির সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এসব কারণে সাগর রিমনকে পছন্দ করতেন না। এমনকি সাগর থাকলে তিনি ওই বাসায় যেতেন না। তার এমন কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পেয়ে রুনীও তাকে এড়িয়ে চলতেন। ঘটনার সঙ্গে রিমনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন সন্দেহে র্যাব একাধিকবার তাকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্ত সংস্থার পাশাপাশি যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে, রিমন ওই দিন রাতে সাগরদের বাসায় গিয়েছিল। একই নেটওয়ার্কে অবস্থান করে মোবাইলে দু’জনের সঙ্গে কথাও বলে।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে (১১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ৫৮/এ/২ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে সাগর-রুনীর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ফ্ল্যাটে তারা পাঁচ মাস বসবাস করেন।
রুনীদের বাসায় রিমন : রিমন এয়ারটেলের একটি সিম ব্যবহার করে। ঘটনার আগের তিন মাসের মোবাইল ফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রিমন তার ভগ্নিপতি সাগর কিংবা বোন রুনীর সঙ্গে কখনও মোবাইল ফোনে কথা বলার তথ্য নেই। তবে উল্লিখিত সময়ে (তিন মাস) সে সাগর-রুনীর বাসায় গেছে ২৪ বার। এর মধ্যে ঘটনার দিন রাতেই গেছে দু’বার। ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ৩৮ মিনিটে সে ওই ফ্ল্যাটে যায়। ওই ফ্ল্যাটে অবস্থানকালীন সে একটি ওয়ারিদ নম্বরে (০১৬৭৪৪৯৩২৬৬) কথা বলে। তার মোবাইল থেকে দেয়া এই কলের স্থায়িত্ব ছিল ৬৪ সেকেন্ড। পরে সে ওই বাসা ত্যাগ করে। আবার ওই দিন রাত ১১টায় ফের সাগরদের ফ্ল্যাটে যায়। তখন সে পুনরায় বাংলালিংকের (০১৯২৪৯৭৬৯৯৮) এই নম্বরে ১৪৪ সেকেন্ড কথা বলে। অথচ রহস্যজনকভাবে উল্লিখিত দুটি নম্বরই ঘটনার পর থেকে বন্ধ রয়েছে।
রিমনের অস্বীকার : এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিমন সোমবার যুগান্তরকে বলে, ‘আমি সেদিন ওদের (সাগর-রুনি) বাসায় যাইনি। কারণ আমার মা মেঘকে নিয়ে পিকনিকে গিয়েছিল। সারা দিন তারা বাইরে (সাভারে) ছিল। যদি কেউ বলে, আমি সেদিন বাসায় গেছি তবে তা মিথ্যা।’ এ ছাড়া মাদক সেবনের কথা অস্বীকার করে রিমন বলে, ‘আমার বিরুদ্ধে চুরিসহ অন্য যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য নয়।’
স্বীকার করলেন রোমান : তবে মামলার বাদী ও রিমনের মেজ ভাই নওশের আলম রোমান গত ৯ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরকে বলেন, ‘হাঁ, রিমন সেদিন রুনিদের বাসায় গিয়েছিল। বাসায় গেলেই কী সে খুন করছে? করলে র্যাব প্রমাণ করুক।’
মা থাকলেই রিমন আসত : ঘটনার পর তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন এমন একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সাগর যখন বাসায় থাকত না, তখন রিমন ওই বাসায় যেত। কারণ সাগর রিমনকে অপছন্দ করতেন। সে যে মাদকাসক্ত ছিল তা জানতেন সাগর। তিনি আরও বলেন, সাগর ধারণা করতেন, তার বাসা থেকে টাকা-পয়সাসহ যেসব জিনিস চুরি হয়েছে তা সম্ভবত রিমনই নিয়েছে। ঘটনার সময় ওই বাসার দায়িত্ব পালন করা নিরাপত্তাকর্মী রুদ্র পলাশ যুগান্তরকে বলেন, ‘রুনীর ভাই রিমন সাগরদের বাসায় খুব বেশি আসত। যখন রুনীর মা এ বাসায় থাকতেন তখনই রিমন আসতেন টাকার জন্য। প্রায় সময়ই রুনীর মা তার হাতে দু-তিনশ’ থেকে ৫শ’ টাকাও ধরিয়ে দিতেন। অনেক সময় টাকা খুচরা না থাকলে ৫শ’ টাকার নোট ভাঙানোর জন্য বাড়ির ম্যানেজার তাহেরের হাতে দিতেন তার মা নুরুন্নাহার মীর্জা। তা আমি দেখেছি। রিমন মূলত টাকার জন্যই এ বাসায় আসতেন।’
ওই বাসার তৎকালীন ব্যবস্থাপক আবু তাহের সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘রুনীর মা থাকলে রিমন ওই বাসায় আসতেন। আর আমি একবার টাকা ভাংতি করে দিলে রিমনকে টাকা দেন খালাম্মা (রুনীর মা)।’ তিনি আরও বলেন, ‘মেঘকে স্কুলে আনা-নেয়া করতেন খালাম্মা। এই বাসাতেও মাঝে মাঝে থাকতেন। তবে ঘটনার দিন রাতে তিনি ওই বাসায় ছিলেন কিনা আমি বলতে পারব না।’
আত্মহত্যা করেছে আপু : রুনীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ও সহকর্মী নাদিরা কিরন। তিনি বর্তমানে এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। রুনীও মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এটিএন বাংলায় সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার দিন সাগর-রুনীর মৃত্যুর সংবাদ নাদিরা কিরণকে রিমনই প্রথম জানিয়েছিল। মৃত্যুর সংবাদ প্রথম কীভাবে জেনেছিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে নাদিরা কিরন যুগান্তরকে বলেন, ‘রুনির ছোট ভাই রিমন আমাকে ফোন দেয়। টাইমটা এক্সাট বলতে পারব না। তবে ৭টা কিংবা সাড়ে ৭টা হবে। রিমন আমাকে বলল, নাদিরা আপা, আপুতো নাই। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপুতো নাই মানে? সে বলল, আপুতো সুইসাইড করেছে। আর আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সাগর কই। ও বলল, দাদাও-তো (সাগরকে দাদা বলে ডাকত) নাই। পরে বলল, দু’জনই আত্মহত্যা করেছে। তবে কেন ও (রিমন) আত্মহত্যার কথা বলেছিল তা আমি আর ওদের কাছে জিজ্ঞাসা করিনি।’ এদিকে আত্মহত্যা বলার কারণ জানতে চাইলে রিমন যুগান্তরকে বলে, অনেক দিন আগের ঘটনা। কাকে কী বলেছিলাম তা আমার মনে নেই। শুধু সাংবাদিক নাদিরা কিরণকে নয়, রিমন তার খালা-খালুকেও জানিয়েছিল, রুনি-সাগর আত্মহত্যা করেছে, যা রিমনের খালু ইমদাদ হোসেন যুগান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, রুনীদের ফ্ল্যাট থেকে আমাদের বাসা কাছাকাছি। সেদিন সকাল বেলা আমাদেরও বলা হয়, রুনী-সাগর সুইসাইড করেছে।
রিমন যেভাবে গ্রেফতার : তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনার দিন সারা রাত জেগেছিল রিমন। এমনকি সকাল বেলা তাকে অস্বাভাবিক মনে হয়। মোবাইল ফোনের কললিস্ট অনুযায়ী গভীর রাতে (২টা ৪৩ মিনিট) তাকে ধানমণ্ডিতে অবস্থান করতে দেখা যায়। এ রকম নানা সন্দেহের সূত্র ধরে ঘটনার দিন দুপুরে তাকে পুলিশ আটক করে। কিন্তু বিকালে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের তৎকালীন একজন উপকমিশনার যুগান্তরকে বলেন, ‘রিমন সেদিন সারা রাত জেগে ছিল। সকাল বেলা তাকে এবনরমাল মনে হয়েছে। ওই দিন রাতে রিমন ধানমণ্ডি গিয়েছিল তার প্রমাণ সিডিআরে পাওয়া গেছে। তাকে তো আমরা প্রথম দিনই গ্রেফতার করেছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘রিমনকে গ্রেফতার করে বিকাল পর্যন্ত আমাদের হেফাজতে রাখা হয়। পরে সাংবাদিকদের একটি মহল, মন্ত্রী-মিনিস্টার, সব জায়গা থেকে তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ আসতে থাকে। এমনকি ওর ফ্যামিলি থেকেও চরম বাধার সম্মুখীন হই। পরে আইজিপি স্যার, কমিশনার স্যার সিদ্ধান্ত দিলেন তাকে ছেড়ে দেয়া হোক। এভাবেই সে ছাড়া পায়। তবে ছেড়ে দিলেও সন্দেহের বাইরে ছিল না রিমন।’ তিনি জানান, ‘আমাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে, সাগর যখন বাসায় থাকতেন না তখন রিমন ওই বাসায় যেত। রিমন তার বোন রুনী ও তার মায়ের কাছ থেকে অনেক টাকা-পয়সা নিত। সাগরের কাছে টাকা চাওয়ার সাহস করত না সে।’ তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সাগরের সঙ্গে ওই ফ্যামিলির ভাইদের (রুনীর ভাই) সঙ্গে সম্পর্ক যে দুধে-ভাতে ছিল তা কিন্তু না। এমনকি রোমান তার বোন রুনীর সঙ্গে এক বছর কথা বলা বন্ধ রাখেন।’ এ বিষয়টি যুগান্তরের কাছেও স্বীকার করেন রোমান।
টাকা খোয়া, চাবি উধাও : রুনী তার বান্ধবী নাদিরা কিরনের কাছেও ফ্ল্যাট থেকে টাকা চুরি ও চাবি খোয়া যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। কেবল নাদিরা নন, জার্মানিতে থাকাকালীন সাগরের ঘনিষ্ঠ এক সহকর্মী যুগান্তরকে জানান, প্রায় রুনীদের বাসা থেকে টাকাসহ জিনিসপত্র চুরি হতো। যখন তারা বাসায় থাকত না তখনই এমন ঘটনা ঘটত। একবার তাদের বাসার চাবিও উধাও হয়ে যায়। এর একদিন পর ওই চাবি আবার ফেরতও পায়।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট র্যাবের এক কর্মকর্তাও যুগান্তরকে বলেন, টাকা-পয়সা চুরির সঙ্গে রিমন জড়িত ছিল। সাগরের পাশাপাশি তার নিজের বোন রুনীও বিষয়টি জানতে পারেন। কেননা এসব কারণে রুনিও তাকে দেখতে পারতেন না।’
রিমন কেন সন্দেহভাজন : র্যাবের সদ্য বিদায়ী সাবেক একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘শুরু থেকে রিমনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। একাধিকবার তাদের গ্রেফতারের পরিকল্পনাও হয়। কিন্তু বাদী রোমান সাংবাদিক (র্যাবের ভাষায় ) হওয়ায় সাংবাদিকদের একাংশকে তিনি ব্যবহার করছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অনেক বিষয় মাথায় রাখতে হয়েছে। রোমান-তো মামলার বাদী। আর আমরা এটাও ভেবেছি যে, তাদের গ্রেফতার করলে উল্টো র্যাবকে দোষারোপ করতে পারে সাংবাদিকদের একটি অংশ। তারা বলবে, মামলার কিছুই করতে পারেনি র্যাব, উল্টো বাদীপক্ষকে গ্রেফতার করে হয়রানি শুরু করেছে। সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাদের গ্রেফতার করার বিষয়টি থমকে আছে।’
যদিও বাদী রোমান যুগান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন যে, ‘ঘটনার পর থেকে টানা সাত মাস র্যাব তাকে পর্যবেক্ষণে রাখে। এমনকি তার বাসার সামনে একটি চায়ের স্টলও বসায় তারা।’
রিমন প্রসঙ্গে তদন্ত সংশ্লিষ্ট র্যাবের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ‘রুনীর পরিবারের দাবি অনুযায়ী, মেঘ তার নানীকে ফোন দিয়ে মৃত্যুর সংবাদ দেয়। তখন রিমনও মেঘের সঙ্গে কথা বলে। এমন সংবাদ পাওয়ার পরও সে তার নিজ বাসায় অবস্থান করে। কেন সে বাসায় অবস্থান করেছিল তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা আমাদের কাছে দিতে পারেনি। আবার এমন সংবাদ পাওয়ার পরও সে তার নিজের মোবাইল থেকেও কাউকে মৃত্যুর সংবাদ দেয়নি। ব্যবহার করেছে তার মায়ের মোবাইল। এরও জবাব দিতে পারেনি সে।’
র্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তার পাশাপাশি চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি র্যাবের এএসপি পদমর্যাদার আরেকজন কর্মকর্তা ছায়া তদন্ত করতেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে র্যাবের এএসপি পদমর্যাদার সাবেক ওই কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘সেদিন রাতে ওই বাসায় যে গিয়েছে তার খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার সম্ভাবনা বেশি। কারণ ঘটনার দিন রাতে রুনীদের বাসার পাশে হোটেল কাশবন থেকে খুনিরা বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়েছিল। যা তারা রাতে ওই বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে। ওই বাড়ির নিচ থেকে কাশবনের লেবেল লাগানো প্যাকেট উদ্ধার করি। পরে ঘটনার রাতে বিরিয়ানির প্যাকেট নেয়া হয়েছিল কিনা তা যাচাই করতে হোটেল কাশবনের মালিকের কাছেও গিয়েছিলাম। হোটেল মালিক বিরিয়ানির প্যাকেট নেয়ার কথা আমার কাছে স্বীকার করেন। তবে কারা নিয়েছিল তা তিনি আমার কাছে স্পষ্ট করতে পারেননি।’ তিনি আরও বলেন, ‘একাধিকবার আমি রিমনের মুখোমুখি হয়েছি। তাকে জিজ্ঞাসাও করেছি। কিন্তু রহস্যজনকভাবে যখনই তাকে জিজ্ঞাসা করেছি তখন বাদী রোমান তার সঙ্গে থাকত। রিমনকে জিজ্ঞাসা করলে রোমান সব প্রশ্নের উত্তর দিত। আর আমাকে বলত, ও (রিমন) পোলাপান মানুষ , ও কি বোঝে?’
রিপোর্টে প্রকাশিত সব সাক্ষাৎকারের অডিও-ভিডিও যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত।
No comments