পুলিশ ‘রিমান্ড’ কি বাণিজ্যিক বিষয়? by তৈমূর আলম খন্দকার
রিমান্ড
(REMAND), বাংলায় অর্থ ফেরত আনা, কিন্তু আইনি ভাষায় ‘পুলিশ হেফাজতে আটক’
রাখা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শব্দার্থ যাই হোক, ‘রিমান্ড’ কী ও কেমন, এটা
ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা পরিবার ছাড়া কেউ বলা তো দূরের কথা, ধারণাও করতে পারবে
না। রিমান্ডে মানবাধিকার, আইন বা সংবিধানের কার্যকারিতা একেবারেই অচল।
এখানে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, এটাই শিরোধার্য। কয়েক বছর ধরে রিমান্ড নিয়ে অনেক
আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সংবাদপত্রের ভাষায় ‘রিমান্ড বাণিজ্য’ নামে
একটি কথাও প্রকাশ্যে বাজার বন্দরে চাউড় হচ্ছে, যা দেশের জনগণ অবগত।
দেশবাসীর মতো আমারও প্রশ্নÑ ‘রিমান্ড’ কি একটি বাণিজ্যিক বিষয়? এ প্রশ্ন
কোথায় করব, তা জানি না। কারণ যাদের কাছে প্রশ্ন রাখব তাদের চোখ, মুখ, কান
এখন বন্ধ। প্রমোশন ও লোভনীয় পোস্টিংয়ের প্রত্যাশায় তারাই পক্ষপাতিত্বের
দোষে দুষ্ট। তবে আমার প্রত্যাশা জাতির বিবেকের কাছে। রিমান্ডে অনেক আসামির
মৃত্যু হয়েছে, বানোয়াট স্বীকারোক্তি আদায় করে কর্তার ইচ্ছায় বিচারকার্যকে
প্রভাবিত করা হয়েছে, কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিচার হয়নি,
পুলিশের সহকারী কমিশনার আকরাম ছাড়া। রিমান্ডে রুবেল হত্যার জন্য তার
যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। তাও হতো না, যদি দেশের রথী, মহারথীরা বিচারের দাবিতে
সোচ্চার না হতেন।
রিমান্ডে আসামির মৃত্যু, পঙ্গুত্ব এবং বানোয়াট স্বীকারোক্তি যখন চরম পর্যায়ে এবং এর বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের কলম যখন পত্রিকার পাতায় ঝড় তুলছে, তখন ২০০৯ সালে সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন প্রণয়নের জন্য জাতীয় সংসদে একটি বেসরকারি বিল উপস্থাপন করেন। সরকারদলীয় এমপি বেসরকারি বিল উপস্থাপন করায় অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কার্যত কিছুই হয়নি। ২০১০ সালে রিমান্ডে পরপর তিনজন মৃত্যুবরণ করায় ডিএমপি কমিশনার ১২টি দিকনির্দেশনা জারি করে পরিস্থিতি ধামাচাপা দেয়, যা ছিল নিছক লোক দেখানো। দুই বছর পর ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ ২০১৩ পাস হলেও এর কার্যকারিতা তো নেই-ই, বরং এর সংশোধনের জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিশের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে লিখিতভাবে জোর দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এ সংশোধনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ক্ষমতায় থাকাকালে জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর মতোই পুলিশ সরকারের অনৈতিক সব লক্ষ্য পূরণ করে বলেই কোনো সরকারই তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায় না। তবে ক্ষমতার বাইরে গেলে বোঝা যায়। সাবেক প্রায় সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই পুলিশ পিটিয়েছে। আবদুল মতিন চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, লুৎফুজ্জামান বাবর- কেউই তাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, রিমান্ডে নেয়া আসামিদের ১৪ ধরনের নির্যাতন করা হয়। সেগুলোর মধ্যে গিটা নির্যাতন, বাদুড় ধোলাই, ওয়াটার থেরাপি, উলঙ্গ করে নির্যাতন, সারা দিন না খাইয়ে নির্যাতন, বোতল থেরাপি, ডিম থেরাপি, ডিস্কো ড্যান্স নির্যাতন, সেলাই নির্যাতন, ঝালমুড়ি নির্যাতন, টানা নির্যাতন, বাতাস নির্যাতন উল্লেখযোগ্য। আসামিদের হাত-পায়ের প্রতিটি জয়েন্টে লাঠিপেটা করার নামই হলো গিটা নির্যাতন। এ নির্যাতনের ফলে হাড়-মাংস থেঁতলে যায়। কিন্তু বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। চিত করে ফোরে ফেলে দুই হাত, দুই পা বেঁধে মুখে গামছা বা কাপড় ঢুকিয়ে পানি ঢেলে মারধর করাকে বলা হয় ওয়াটার থেরাপি। নাকে-মুখে পানি দিতে থাকলে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। পরে আসামিরা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে তথ্য দিতে থাকে। দু’টি উঁচু টেবিলের মাঝখানে দুই হাত বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানোকে বলা হয় বাদুড় ধোলাই। এ রকমের নির্যাতন করলে যেকোনো আসামি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। গরম বা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ডিম আসামিদের মলদ্বারে ঢুকিয়ে নির্যাতন করাকে বলা হয় ডিম থেরাপি। এ নির্যাতনের ফলে আসামির মলদ্বার ফুলে যায় এবং অনবরত রক্ত পড়তে থাকে। যতক্ষণ আসামিরা স্বীকারোক্তি না দেয় ততক্ষণ মলদ্বারে ডিম ঢুকাতে থাকে। পরে বাধ্য হয়ে স্বীকারোক্তি দেয়। হাত-পায়ে অবিরাম ইলেকট্রিক শক দেয়াকে বলা হয় ডিস্কো ড্যান্স থেরাপি। হাত-পায়ের নখে মোটা সুই ঢুকানোকে বলা হয় সেলাই নির্যাতন। সুই ঢোকানোর পর হাত-পায়ের নখগুলো ফুলে যায়। চোখ-মুখ ও নাকে শুকনো মরিচ লাগানোকে বলা হয় ঝালমুড়ি নির্যাতন। সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে নির্যাতন করাকে বলা হয় বাতাস পদ্ধতি। সাধারণ আসামিদের পাশাপাশি সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ীদের রিমান্ডে নিয়ে একই কায়দায় নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গ্রেফতার ও রিমান্ড সম্পর্কে ফৌজদারি কার্যবিধির ৬১ এবং ১৬৭(২) ধারায় যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ : ধারা ৬১- গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় আটক রাখা যাবে না- ১৬৭ ধারা অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেটের বিশেষ আদেশ না থাকলে এরূপ আইনের সময় গ্রেফতারের স্থান থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে যাওয়ার সময় বাদ দিয়ে ২৪ ঘণ্টার বেশি হবে না।
ধারা ১৬৭(২)- ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করা না গেলে তখনকার পদ্ধতি :
(১) যখনই কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে হেফাজতে আটক রাখা হয় এবং প্রতীয়মান হয় যে, ৬১ ধারায় নির্ধারিত ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করা যাবে না এবং এরূপ বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, অভিযোগ বা সংবাদ দৃঢ়ভিত্তিক, তা হলে থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার বা তদন্তকারী পুলিশ অফিসার, তিনি যদি সাব-ইন্সপেক্টর পদের নিম্নপদস্থ না হন, অবিলম্বে অতঃপর নির্ধারিত ডায়েরিতে লিখিত ঘটনা সম্পর্কিত তথ্যের নকলসহ আসামিকে নিকটতম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করবেন। (২) এই ধারা অনুসারে আসামিকে যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করা হবে, তার সংশ্লিষ্ট মামলার বিচার করার অধিক্ষেত্রে থাকুক বা না থাকুক, তিনি তার বিবেচনামতো আসামিকে উক্তরূপ হেফাজতে আটক রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে কর্তৃত্ব প্রদান করবেন, তবে এরূপ আটকের মেয়াদ সর্বমোট ১৫ দিনের অধিক হবে না। মামলাটি বিচার করার অথবা বিচারার্থে পাঠানোর অধিক্ষেত্রে যদি তার না থাকে এবং তিনি আরো আটক রাখা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন, তা হলে তিনি আসামিকে এইরূপ অধিক্ষেত্রসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণের আদেশ দিতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে, তৃতীয় শ্রেণীর কোনো ম্যাজিস্ট্রেট এবং সরকার কর্তৃক এ বিষয়ে বিশেষভাবে ক্ষমতাবান নন, এরূপ কোনো দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে পুলিশের হেফাজতে আটক রাখার কর্তৃত্ব দেবেন না।
‘রিমান্ডে’ থাকাবস্থায় আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশি আচরণ সম্পর্কে ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট নিন্মবর্ণিত চারটি দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন : (ক) কাচের দেয়াল সম্পন্ন একটি কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। (খ)জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে অভিযুক্তদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। (গ) প্রতিবার রিমান্ডের মেয়াদ তিন দিনের বেশি হবে না। (ঘ) কাচের দেয়াল নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত আসামির আইনজীবী ও আত্মীয়স্বজনদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
কিন্তু রাজনৈতিক মামলাসহ কোনো মামলাতেই পুলিশ রিমান্ডসংক্রান্ত আইন, সংবিধান এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসরণ করছে না। বাংলাদেশ মানবধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রাজনৈতিক ভাষায় অনেক চটকদার কথা বলেন। কিন্তু একজন অসুস্থ পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ রুহুল কবীর রিজভীকে যখন একের পর এক রিমান্ডে নেয়া হচ্ছেÑ এ সম্পর্কে তার মুূখে কোনো কথা সরে না। এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে জবাব আসেÑ আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। আমার প্রশ্ন আইন ‘নিজস্ব গতিতে চলা’র মাপকাঠি কী? আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করার সুযোগ দেয়া তো দূরের কথা, প্রায়ই তিন-চার দিন আটক রেখে নির্যাতনের পরে (আটকের কথা গোপন রেখে) গ্রেফতার দেখিয়ে কোর্টে চালান দেয়া হয়Ñ এ কথা পানের দোকানদার ও রিকশাচালকসহ সবাই জানেন; কিন্তু জানেন না শুধু তারা যাদের হাতে প্রতিকারের ক্ষমতা রয়েছে। সব প্রতিকারই নীরব নিস্তব্ধ হয়ে আছে শুধু ক্ষমতাধর একজনের ইচ্ছায়।
পুলিশ নির্ভরতার কারণে বর্তমান সরকার পুলিশের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না; বরং ‘আমি দেখব’ বলে সরকারপ্রধান কর্তৃক পুলিশকে ব্ল্যাংক চেক প্রদান করা হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানি করে কি সরকারের শেষ রক্ষা হবে? আইনের শাসন যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়, তখন মানুষ কোথায় আশ্রয় পাবে? ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করায় মহান স্বাধীনতা আন্দোলন আরো বেগবান হয়েছিল। ফলে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনকে নড়েচড়ে বসতে হয়েছিল। জনগণের আশা-আকাক্সার প্রতিফলনের জন্য আবারো কোনো বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীর আবির্ভাব হবে কি না জানি না, তবে আমাদের জাতীয় চরিত্র কোনো দিনই কোনো অনাচার দীর্ঘ দিন সহ্য করেনি। আইনের ব্যানারে এ বেআইনি নির্যাতন থেকে ভিন্ন মতাদর্শীরা কবে রক্ষা পাবেন, আইন নিজস্ব গতিতে চলার মাপকাঠিইবা কবে নিরূপণ হবে? আইন নিজস্ব গতিতে চলছে কি না বা সাংবিধানিক অধিকার ব্যাহত হচ্ছে কি নাÑ এ বিষয়টি দেখার দায়িত্ব কার? সংবিধান এখানে কী বলে? এ অনাচার থেকে রক্ষা পেতে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির দিকে তাকিয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই যেখানে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন আমরা কি প্রতিকারের জন্য রাষ্ট্রপতি বা প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ আশা করতে পারি? উত্তর নেগেটিভ হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ সংবিধান বা আইনে যাই থাকুক না কেন, তারাও তো প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাকিয়ে থাকেন। নতুবা এ অভাগা দেশে আইনের শাসনের এ করুণ পরিণতি কেন?
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী ও আইনজীবী,আইন সম্পাদক, কেন্দ্রীয় বিএনপি
রিমান্ডে আসামির মৃত্যু, পঙ্গুত্ব এবং বানোয়াট স্বীকারোক্তি যখন চরম পর্যায়ে এবং এর বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের কলম যখন পত্রিকার পাতায় ঝড় তুলছে, তখন ২০০৯ সালে সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন প্রণয়নের জন্য জাতীয় সংসদে একটি বেসরকারি বিল উপস্থাপন করেন। সরকারদলীয় এমপি বেসরকারি বিল উপস্থাপন করায় অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কার্যত কিছুই হয়নি। ২০১০ সালে রিমান্ডে পরপর তিনজন মৃত্যুবরণ করায় ডিএমপি কমিশনার ১২টি দিকনির্দেশনা জারি করে পরিস্থিতি ধামাচাপা দেয়, যা ছিল নিছক লোক দেখানো। দুই বছর পর ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ ২০১৩ পাস হলেও এর কার্যকারিতা তো নেই-ই, বরং এর সংশোধনের জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিশের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে লিখিতভাবে জোর দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এ সংশোধনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ক্ষমতায় থাকাকালে জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর মতোই পুলিশ সরকারের অনৈতিক সব লক্ষ্য পূরণ করে বলেই কোনো সরকারই তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায় না। তবে ক্ষমতার বাইরে গেলে বোঝা যায়। সাবেক প্রায় সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই পুলিশ পিটিয়েছে। আবদুল মতিন চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, লুৎফুজ্জামান বাবর- কেউই তাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, রিমান্ডে নেয়া আসামিদের ১৪ ধরনের নির্যাতন করা হয়। সেগুলোর মধ্যে গিটা নির্যাতন, বাদুড় ধোলাই, ওয়াটার থেরাপি, উলঙ্গ করে নির্যাতন, সারা দিন না খাইয়ে নির্যাতন, বোতল থেরাপি, ডিম থেরাপি, ডিস্কো ড্যান্স নির্যাতন, সেলাই নির্যাতন, ঝালমুড়ি নির্যাতন, টানা নির্যাতন, বাতাস নির্যাতন উল্লেখযোগ্য। আসামিদের হাত-পায়ের প্রতিটি জয়েন্টে লাঠিপেটা করার নামই হলো গিটা নির্যাতন। এ নির্যাতনের ফলে হাড়-মাংস থেঁতলে যায়। কিন্তু বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। চিত করে ফোরে ফেলে দুই হাত, দুই পা বেঁধে মুখে গামছা বা কাপড় ঢুকিয়ে পানি ঢেলে মারধর করাকে বলা হয় ওয়াটার থেরাপি। নাকে-মুখে পানি দিতে থাকলে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। পরে আসামিরা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে তথ্য দিতে থাকে। দু’টি উঁচু টেবিলের মাঝখানে দুই হাত বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানোকে বলা হয় বাদুড় ধোলাই। এ রকমের নির্যাতন করলে যেকোনো আসামি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। গরম বা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ডিম আসামিদের মলদ্বারে ঢুকিয়ে নির্যাতন করাকে বলা হয় ডিম থেরাপি। এ নির্যাতনের ফলে আসামির মলদ্বার ফুলে যায় এবং অনবরত রক্ত পড়তে থাকে। যতক্ষণ আসামিরা স্বীকারোক্তি না দেয় ততক্ষণ মলদ্বারে ডিম ঢুকাতে থাকে। পরে বাধ্য হয়ে স্বীকারোক্তি দেয়। হাত-পায়ে অবিরাম ইলেকট্রিক শক দেয়াকে বলা হয় ডিস্কো ড্যান্স থেরাপি। হাত-পায়ের নখে মোটা সুই ঢুকানোকে বলা হয় সেলাই নির্যাতন। সুই ঢোকানোর পর হাত-পায়ের নখগুলো ফুলে যায়। চোখ-মুখ ও নাকে শুকনো মরিচ লাগানোকে বলা হয় ঝালমুড়ি নির্যাতন। সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে নির্যাতন করাকে বলা হয় বাতাস পদ্ধতি। সাধারণ আসামিদের পাশাপাশি সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ীদের রিমান্ডে নিয়ে একই কায়দায় নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গ্রেফতার ও রিমান্ড সম্পর্কে ফৌজদারি কার্যবিধির ৬১ এবং ১৬৭(২) ধারায় যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ : ধারা ৬১- গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় আটক রাখা যাবে না- ১৬৭ ধারা অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেটের বিশেষ আদেশ না থাকলে এরূপ আইনের সময় গ্রেফতারের স্থান থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে যাওয়ার সময় বাদ দিয়ে ২৪ ঘণ্টার বেশি হবে না।
ধারা ১৬৭(২)- ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করা না গেলে তখনকার পদ্ধতি :
(১) যখনই কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে হেফাজতে আটক রাখা হয় এবং প্রতীয়মান হয় যে, ৬১ ধারায় নির্ধারিত ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করা যাবে না এবং এরূপ বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, অভিযোগ বা সংবাদ দৃঢ়ভিত্তিক, তা হলে থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার বা তদন্তকারী পুলিশ অফিসার, তিনি যদি সাব-ইন্সপেক্টর পদের নিম্নপদস্থ না হন, অবিলম্বে অতঃপর নির্ধারিত ডায়েরিতে লিখিত ঘটনা সম্পর্কিত তথ্যের নকলসহ আসামিকে নিকটতম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করবেন। (২) এই ধারা অনুসারে আসামিকে যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করা হবে, তার সংশ্লিষ্ট মামলার বিচার করার অধিক্ষেত্রে থাকুক বা না থাকুক, তিনি তার বিবেচনামতো আসামিকে উক্তরূপ হেফাজতে আটক রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে কর্তৃত্ব প্রদান করবেন, তবে এরূপ আটকের মেয়াদ সর্বমোট ১৫ দিনের অধিক হবে না। মামলাটি বিচার করার অথবা বিচারার্থে পাঠানোর অধিক্ষেত্রে যদি তার না থাকে এবং তিনি আরো আটক রাখা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন, তা হলে তিনি আসামিকে এইরূপ অধিক্ষেত্রসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণের আদেশ দিতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে, তৃতীয় শ্রেণীর কোনো ম্যাজিস্ট্রেট এবং সরকার কর্তৃক এ বিষয়ে বিশেষভাবে ক্ষমতাবান নন, এরূপ কোনো দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে পুলিশের হেফাজতে আটক রাখার কর্তৃত্ব দেবেন না।
‘রিমান্ডে’ থাকাবস্থায় আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশি আচরণ সম্পর্কে ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট নিন্মবর্ণিত চারটি দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন : (ক) কাচের দেয়াল সম্পন্ন একটি কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। (খ)জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে অভিযুক্তদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। (গ) প্রতিবার রিমান্ডের মেয়াদ তিন দিনের বেশি হবে না। (ঘ) কাচের দেয়াল নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত আসামির আইনজীবী ও আত্মীয়স্বজনদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
কিন্তু রাজনৈতিক মামলাসহ কোনো মামলাতেই পুলিশ রিমান্ডসংক্রান্ত আইন, সংবিধান এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসরণ করছে না। বাংলাদেশ মানবধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রাজনৈতিক ভাষায় অনেক চটকদার কথা বলেন। কিন্তু একজন অসুস্থ পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ রুহুল কবীর রিজভীকে যখন একের পর এক রিমান্ডে নেয়া হচ্ছেÑ এ সম্পর্কে তার মুূখে কোনো কথা সরে না। এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে জবাব আসেÑ আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। আমার প্রশ্ন আইন ‘নিজস্ব গতিতে চলা’র মাপকাঠি কী? আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করার সুযোগ দেয়া তো দূরের কথা, প্রায়ই তিন-চার দিন আটক রেখে নির্যাতনের পরে (আটকের কথা গোপন রেখে) গ্রেফতার দেখিয়ে কোর্টে চালান দেয়া হয়Ñ এ কথা পানের দোকানদার ও রিকশাচালকসহ সবাই জানেন; কিন্তু জানেন না শুধু তারা যাদের হাতে প্রতিকারের ক্ষমতা রয়েছে। সব প্রতিকারই নীরব নিস্তব্ধ হয়ে আছে শুধু ক্ষমতাধর একজনের ইচ্ছায়।
পুলিশ নির্ভরতার কারণে বর্তমান সরকার পুলিশের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না; বরং ‘আমি দেখব’ বলে সরকারপ্রধান কর্তৃক পুলিশকে ব্ল্যাংক চেক প্রদান করা হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানি করে কি সরকারের শেষ রক্ষা হবে? আইনের শাসন যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়, তখন মানুষ কোথায় আশ্রয় পাবে? ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করায় মহান স্বাধীনতা আন্দোলন আরো বেগবান হয়েছিল। ফলে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনকে নড়েচড়ে বসতে হয়েছিল। জনগণের আশা-আকাক্সার প্রতিফলনের জন্য আবারো কোনো বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীর আবির্ভাব হবে কি না জানি না, তবে আমাদের জাতীয় চরিত্র কোনো দিনই কোনো অনাচার দীর্ঘ দিন সহ্য করেনি। আইনের ব্যানারে এ বেআইনি নির্যাতন থেকে ভিন্ন মতাদর্শীরা কবে রক্ষা পাবেন, আইন নিজস্ব গতিতে চলার মাপকাঠিইবা কবে নিরূপণ হবে? আইন নিজস্ব গতিতে চলছে কি না বা সাংবিধানিক অধিকার ব্যাহত হচ্ছে কি নাÑ এ বিষয়টি দেখার দায়িত্ব কার? সংবিধান এখানে কী বলে? এ অনাচার থেকে রক্ষা পেতে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির দিকে তাকিয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই যেখানে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন আমরা কি প্রতিকারের জন্য রাষ্ট্রপতি বা প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ আশা করতে পারি? উত্তর নেগেটিভ হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ সংবিধান বা আইনে যাই থাকুক না কেন, তারাও তো প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাকিয়ে থাকেন। নতুবা এ অভাগা দেশে আইনের শাসনের এ করুণ পরিণতি কেন?
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী ও আইনজীবী,আইন সম্পাদক, কেন্দ্রীয় বিএনপি
No comments