এ কোন অপরাজনীতির কবলে দেশ by জি. মুনীর
‘রাজনীতি’
একটি শব্দবাচ্য বা পদবাচ্য। ইংরেজিতে যাকে বলি টার্ম। কারণ, এর শাব্দিক
অর্থ এটি ধারণ করে না। করলে রাজনীতি হতো শুধুই ‘রাজরাজড়ার নীতি’ বা চর্চার
বিষয়। দেশে সাধারণ মানুষের কোনো অধিকার রাজনীতিতে থাকত না। গণতন্ত্র
রাজনীতির ওপর জনগণের সে অধিকার দিয়েছে। শাব্দিক ব্যঞ্জনা যাই থাকুক,
রাজনীতিকে মানুষ দীর্ঘকাল দেখে আসছে একটি মহৎ কাজ হিসেবে। আমাদের দেশে
রাজনীতিতে যারা আসতেন, এরা ছিলেন মোটামুটি সচ্ছল ঘরের সন্তান। নিজের খেয়ে
বোনের মোষ তাড়ানোর মতো পরের উপকার করার সমূহ সুযোগ তাদের হাতে ছিল। তাই
সেবার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই এরা রাজনীতিতে আসতেন । উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে
গিয়ে এরা জেল-জুলুমের শিকার হলেও জনকল্যাণের মহৎ উদ্দেশ্য থেকে কখনো সরে
আসতেন না। ফলে এদের প্রতি দেশের মানুষের ছিল অগাধ শ্রদ্ধা-ভালোবাসা। এরা
রাজনীতি করেই হয়ে উঠেছেন মহাজন, স্মরণীয় বরণীয়জন। আজকের রাজনীতিবিদেরা যেন
ঠিক এর উল্টো। আজকের রাজনীতির লক্ষ্য যেন হয়ে উঠেছে জোরজবরদস্তি করে
ক্ষমতায় যাওয়া। আর কোনো কূটকৌশলে ক্ষমতায় একবার যেতে পারলে, ক্ষমতায় আজীবন
টিকে থাকার মানসে শুদ্ধ রাজনীতির বদলে যত ধরনের অপরাজনীতি আর অপকৌশল আছে,
লজ্জার যাবতীয় মাথা কেটে তা অবলম্বন করা।
কথাগুলো বলা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির বেহাল অবস্থা দেখে। আমরা আশ্চর্য হই, যখন দেখি বর্তমান ক্ষমতাসীন দল-জোটের নেতা-নেত্রীরা প্রায় প্রতিদিনই কোনো না সভা-সমাবেশে কিংবা সরকারি আচার অনুষ্ঠানে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্মূল করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন। দলীয় মুখপাত্র ও মন্ত্রিসভারও সদস্যদের মধ্যে এই প্রবণতা আরো বেশি প্রবল। এরা দিনে একবার বেগম জিয়াকে পাকিস্তানে পাঠান। এরা বলেন, তার জায়গা নাকি বাংলাদেশে নেই। কারণ তাদের ভাষায় খালেদা জিয়া জঙ্গিনেত্রী। গত ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিজ দলীয় এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে উদ্দেশ করে এরই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী জঙ্গিনেত্রীর স্থান বাংলাদেশে হবে না।’ প্রায় প্রতিদিনই প্রধানমন্ত্রীসহ তার মন্ত্রীদের একই ধরনের কথার পুনরাবৃত্তি শোনা যায়। অথচ সরকারি দলের নেতানেত্রীদের বোধে থাকে না- তারা যা বলেন দেশের মানুষ তা বিশ্বাস করে না। দেশের মানুষ যদি তা বিশ্বাস করতই, তবে বেগম জিয়া জনগণের ভোটে এ দেশে তিন তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না। আর দেশের বড় বড় সব সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন দল-জোটের নেতারা বিপুল ভোটে মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচিত হতে পারতেন না। আসলে, আওয়ামী লীগের অনেকেই তাদের দলের নেতানেত্রীদের এই বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারেন না। এরা বাইরে তা প্রকাশ না করলেও দলীয় নেতাদের এ ধরনের অমূলক বক্তব্যে ভেতরে ভেতরে বিব্রতবোধ করেন।
আসলে বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তার ভয়ে ভীত আমাদের সরকারি দল-জোটের শীর্ষসারির নেতানেত্রীরা। এরা বেগম জিয়া ফোবিয়ায় ভোগেন বলেই দলনিরপেক্ষ একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে জাতীয় নির্বাচন দিতে এতটা অনীহ। এদের মধ্যে বেগম জিয়াভীতি কাজ করে বলেই এরা গণতন্ত্রের যাবতীয় নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচন করে ভোটের আগেই সরকার গঠন করার মতো নির্বাচনী বিজয় নিশ্চিত করে ক্ষমমতায় টিকে থাকার অনৈতিক পথ অবলম্বন করে। এরা সেই নির্বাচনকে বৈধ করে তুলতে চায়, যা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ কোনো দেশ, জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। আজকে দেশে যে চরম রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে, মানুষ মরছে, অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের জটিল সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, দেশ জাতি অভাবনীয় ক্ষতির মুখেÑ সারা দুনিয়া বলছে এর জন্য দায়ী ৫ জানুয়ারির অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সবার অংশগ্রহণে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য অবাধ নির্বাচনই পারে বাংলাদেশকে এ সঙ্কট থেকে রক্ষা করতে। সব মহলের কথা- এজন্য দরকার সরকার ও সরকারবিরোধীদের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ। কিন্তু সরকার মহলের ধনুকভাঙা পণ- না, কোনো সংলাপ নয়, জঙ্গিনেত্রীর সাথে কিসের সংলাপ। ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন নয়।
সরকারি মহলে শুধু বেগম জিয়াভীতিই কাজ করছে, তা নয়। আসলে তার দলের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকারি মহলে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। না হলে এ সরকারের আমলে জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়া বিএনপি দলীয় মেয়রদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার শিকার হয়ে বরখাস্ত হতে হবে কেনো? রাজনৈতিক মামলায় এদের তিনজন কারাগারে। গ্রেফতার এড়াতে বাকি দু’জন আত্মপোপনে। এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন এ সরকারের আমলে নির্বচিত অনেক উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচত প্রতিনিধি। তাদের অপরাধ এরা সরকারবিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত।
সরকারি দলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, বেগম জিয়াকে যদি জঙ্গি-সন্ত্রাসী প্রমাণ করা যায় তবে কেল্লাফতে। কারণ, তখন পাশ্চাত্য বেগম জিয়ার সাথে লাদেন হিসেবে আচরণ করতে শুরু করে দেবে। আর তখন সরকারি দমনপীড়ন চললে দ্বিমুখী চাপে দিশেহারা হয়ে পড়বেন বেগম জিয়া। আর তখনই সহজেই সম্ভব হবে বেগম জিয়া ও তার দল-জোটকে নির্মূল করা। আর তা সম্ভব হলে দেশে আওয়ামীরাজ কায়েম নিশ্চিত হবে। এজন্যই আজ বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে তুমুল প্রচারণাÑ দেশে যত পেট্রলবোমা মেরে মানুষ মারা হচ্ছে সবই হচ্ছে বেগম জিয়ার নির্দেশে। সম্প্রতি ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা যায় আওয়ামী লীগের টানানো বিরাট বিরাট বিলবোর্ড। এগুলোতে দেখা যায়, আগুনে পোড়া মানুষের বেশ কিছু ছবি। বেগম জিয়া এক হাতে ধরে আছেন চেয়ারের একটি পা। আর এতে উদ্ধৃত করা হয়েছে তারেক জিয়ার একটি কাল্পনিক বক্তব্য। স্মৃতি থেকে বলছি তার বক্তব্যটি সম্ভবত এমন : ‘আমি তারেক বলছি, মা দেশটা জ্বালিয়ে দাও, জ্বেলেপুড়ে চারখার করে দাও। প্রয়োজন একটি চেয়ার।’
এর মাধ্যমে সরকার পক্ষ বলতে চাইছে বেগম জিয়া আজ পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছেন শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু দেশবাসী যখন দেখল সরকারি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে শুটিং চলেছে সাজানো প্রচারণা চালানোর জন্য, মোমবাতির আগুলে পুড়ে যাওয়া শিশুর ঘটনাকে বার্ন ইউনিটে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রচার করা হচ্ছে পেট্রলবোমার শিকার দেখিয়ে এবং কোনো কোনো পত্রিকা খবর প্রকাশ করছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও ধরা পড়ছেন পেট্রলবোমা নিয়ে এবং তাদের ছেড়েও দেয়া হচ্ছে. তখন কিন্তু এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করে। বেগম জিয়া অবশ্য বলেছেন, এসব ঘটনার প্রয়োজনে জাতিসঙ্ঘের অধীনে তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেয়া হোক। কার্যত তা হয়নি। যা হয়েছে- ঘটনা ঘটার সাথে সাথে বেগম জিয়াকে হুকুমের আসামি করে তার দল-জোটের হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে পুলিশি মামলা হয়েছে। গণহারে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। শুধু নেতাকর্মীরাই নন, তাদের আত্মীয়স্বজনও এ ধরনের হামলার শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। সময়ের সাথে এ প্রবণতা আরো জোরালো হচ্ছে। খুন, অপহরণ, হত্যা ও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটছে।
আসলে একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে সরকারদলীয় যাবতীয় গোয়েবলসীয় প্রচার-প্রচারণা সবই ভেস্তে যাচ্ছে। সরকার বলছে, দেশে কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট নেই, আছে আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত সমস্যা। সারা দুনিয়া বলছে তা ঠিক নয়, বাংলাদেশ চরম রাজনৈতিক সঙ্কটে নিপতিত, যার শেকড় নিহিত পাঁচ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচনই পারে এ সঙ্কটের সমাধান এনে দিতে। সরকারি জোটের বাইরে দেশের সব রাজনৈতিক দলেরও এই একই কথা। এমনকি সরকারি জোটে থাকা বেশ কয়েকটি দলও সংলাপের মাধ্যমে এর সমাধান চান, এসব দলের নেতারা এমনটি উল্লেখ করেছেন জোটের সভায়- এমন খবর প্রকাশিত হতে দেখা গেছে পত্রপত্রিকায়। দেশে সুশীল সমাজও তাই বলে আসছেন বারবার। কূনৈতিক মহলেরও একই অবস্থান। বেগম জিয়ার আন্দোলনের নৈতিক সাফল্য এখানেই। বেগম জিয়ার অবস্থানকেই সমর্থন জানাচ্ছে সরকার ছাড়া দেশ-বিদেশের সবাই। আর এতে রুষ্ট হয়েই আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে কূটনীতিক ও সুশীলসমাজের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনাকাক্সিক্ষত সব বক্তব্য। কারণ এরা সবাই চান সংলাপ ও সেই সূত্রে সঙ্কটের সমাধান। সে পথে না গিয়ে এখন সরকারপক্ষ বিলবোর্ড টানিয়ে বেগম জিয়ার ভাবমর্যাদা বিনাশ করার যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, তা শেষ পর্যন্ত কার ভাবমর্যাদা বিনাশ করে, সেটাই দেখার বিষয়।
এখানেই শেষ নয়, বেগম জিয়া পরিবারকে রাজনীতি থেকে উচ্ছেদের লক্ষ্য নিয়েও সরকারপক্ষ সক্রিয়- এমন খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ওয়ান-ইলেভেনের আমলের ও পরবর্তী সময়ে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা সচল হচ্ছে বলে জানিয়েছে একটি জাতীয় দৈনিক। এসব মামলা যে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের বিরাজনীতিকায়ন তথা রাজনীতিবিদদেরকে, আরো স্পষ্ট করে বললে দুই নেত্রীকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিদায় করার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে দায়ের করা হয়েছিল, তা এ দেশের সব মানুষের কাছে তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জিয়া পরিবারকে নির্মূল করার মানসে সেই হাতিয়ারটি এখন বর্তমান সরকারের হাতে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় এ ধরনের হয়রানিমূলক মামলার শিকার হয়েছিলেন এ দেশের বড় দুই দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাদের দলের সব মামলা প্রত্যাহার করে নিলেও বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার না করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এখন সরকার সেসব মামলা সক্রিয় করে বেগম জিয়ার পরিবারের সদস্যদের নির্বাচনে অযোগ্য করার প্রয়াস নতুন করে চালু করতে যাচ্ছে। এসব মামলায় তেমনটি করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ, সরকারের অনেক মন্ত্রী প্রায়ই বেগম জিয়াকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানোর হুমকি দিচ্ছেন।
এখন সরকার হঠাৎ করে ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে এমন এক সময়, যখন চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে ২০ দলীয় জোটের লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় জড়িয়ে হয় জেলে পাঠানো হয়েছে, নয়তো পালিয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। একই সাথে ক্রসফায়ারে নিহত হচ্ছেন ২০ দলীয় জোটের প্রচুর নেতাকর্মী। প্রতিদিনই গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে ২০ দলীয় জোটের অসংখ্য নেতাকর্মী। আসলে এরাই যে কোনো নির্বাচনী প্রচারণার ও ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনার মূল শক্তি। সরকার এদের বাইরে রেখে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করে পাঁচ জানয়ারির মতো খালি মাঠে গোল দেয়ার অপরাজনীতি করছে এ ক্ষেত্রেও। এ অবস্থায় নির্বাচনী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড যে বড় মাপে অনুপস্থিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত শনিবার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিবিসি সংলাপের ১০৯তম পর্ব। এ পর্বে শ্রোতারা বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা থাকে। দেশে বিদ্যমান সঙ্কট জিইয়ে রেখে এই সময়ে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। সিটি করপোরেশনের এই নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরো ঘনীভূত করে তুলতে পারে। তাই বলা দরকার, দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করে এই নির্বাচন দিলে অন্তত অপরাজনীতির বদনাম থেকে সরকার বাঁচার একটি সুযোগ পেত। কেনো যে সরকার সে পথে না হেঁটে শুধু রাজনৈতিক জটকে আরো জটিল করে তোলায়ই বেশি আগ্রহী, তা বলা মুশকিল। তবে অনেকের অভিমত, এ নির্বাচন আয়োজনের পেছনে সরকারপক্ষের আরেক গোপন লক্ষ্য হচ্ছে চলমান আন্দোলনের গতিকে আরো ধীরগতিতে নামিয়ে আনা। তা ছাড়া সরকার এক দিকে অন্যান্য সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত জনপ্রিয় নেতাদের সরিয়ে দেয়ার নানা ফন্দি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, অপর দিকে হঠাৎ করে এই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজনের পেছনে সরকারের যে কোনো সৎ উদ্দেশ্য নিহিত নেই, সে বোধ এ দেশের মানুষের আছে।
আজকে সরকার দেশের মানুষকে বোকা বানানোর বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার মনে করে, তাদের গোয়েবলসীয় প্রচার-প্রচারণায় দেশের জনগণ প্রভাবিত হয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে তালাক দিয়ে আওয়ামী শিবিরে যোগ দেবে। সেজন্যই আওয়ামী রাজনীতি এখন রূপ নিয়েছে রাজধানীর বিলবোর্ড আর ব্যানার ফেস্টুনের রাজনীতিতে। সারা ঢাকা ছেয়ে গেছে আওয়ামী নেতানেত্রীদের বিলবোর্ড আর ব্যানার ফেস্টুনে। সেই সাথে আওয়ামী নেতাদের পক্ষ থেকে রুটিন করে প্রতিদিন চলছে নানা অসৌজন্যমূলক বিশেষণে অভিহিত করে বেগম জিয়াকে নানাধর্মী আক্রমণ করে বিরামহীন বক্তব্য। একে নিছক গালাগাল বললেও ভুল হবে বলে মনে হয় না। অবাক হতে হয়, যেখানেই যাবেন চার দিকে শুধু নেতাদের বড় বড় ছবি সংবলিত বিলবোর্ড। আর এসব বিলবোর্ড ও ব্যানার ফেস্টুনে প্রচার করা হচ্ছে অদ্ভুদ সব সস্তা আওয়ামী দর্শন। এক জায়গায় দেখা গেল এমনই একটি আওয়ামী দর্শন : ‘ফার্স্ট লাইফ, নেক্সট ডেমোক্র্যাসি’। দর্শনের মর্মার্থ সরল। আগে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে, পরে ভাবা যাবে গণতন্ত্র নিয়ে। কিন্তু আওয়ামী দার্শনিকদের বোধে নেই- গণতন্ত্র থাকলেই শুধু মানুষের জীবন নিশ্চিত হয়, আর গণতন্ত্র না থাকলে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়, জানমাল হুমকির মুখে পড়ে। এর জায়মান প্রমাণ সাম্প্রতিক বাংলাদেশ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যে গণতান্ত্রিক ব্যত্যয় ঘটেছে, এরই পরিণামে আজ প্রতিদিন এ দেশে মানুষ মরছে। খুন, গুম, অপহরণ, ক্রসফায়ার, বিরোধী দলমতের দমন-পীড়ন সবই চলছে। এই মানুষ মরার যে প্রক্রিয়া চলমান, তা বন্ধ করার একমাত্র উপায় ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের শুদ্ধায়ন, ভিন্ন কিছু নয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার একগুঁয়েমি জিইয়ে রেখে ‘ফার্স্ট লাইফ, নেক্সট ডেমোক্র্যাসি’র ভুল দর্শন আওয়ামী লীগকে ভুলের মহাসড়ক থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সুযোগ দেবে না। বরং আরো বড় বড় ভুলের জন্ম দেবে। সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচনের পর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়া হবে। সরকার এখন সে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গিয়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার অবস্থান নেয়ায় সঙ্কট আরো প্রবল আকার নিয়েছে।
কথাগুলো বলা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির বেহাল অবস্থা দেখে। আমরা আশ্চর্য হই, যখন দেখি বর্তমান ক্ষমতাসীন দল-জোটের নেতা-নেত্রীরা প্রায় প্রতিদিনই কোনো না সভা-সমাবেশে কিংবা সরকারি আচার অনুষ্ঠানে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্মূল করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন। দলীয় মুখপাত্র ও মন্ত্রিসভারও সদস্যদের মধ্যে এই প্রবণতা আরো বেশি প্রবল। এরা দিনে একবার বেগম জিয়াকে পাকিস্তানে পাঠান। এরা বলেন, তার জায়গা নাকি বাংলাদেশে নেই। কারণ তাদের ভাষায় খালেদা জিয়া জঙ্গিনেত্রী। গত ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিজ দলীয় এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে উদ্দেশ করে এরই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী জঙ্গিনেত্রীর স্থান বাংলাদেশে হবে না।’ প্রায় প্রতিদিনই প্রধানমন্ত্রীসহ তার মন্ত্রীদের একই ধরনের কথার পুনরাবৃত্তি শোনা যায়। অথচ সরকারি দলের নেতানেত্রীদের বোধে থাকে না- তারা যা বলেন দেশের মানুষ তা বিশ্বাস করে না। দেশের মানুষ যদি তা বিশ্বাস করতই, তবে বেগম জিয়া জনগণের ভোটে এ দেশে তিন তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না। আর দেশের বড় বড় সব সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন দল-জোটের নেতারা বিপুল ভোটে মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচিত হতে পারতেন না। আসলে, আওয়ামী লীগের অনেকেই তাদের দলের নেতানেত্রীদের এই বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারেন না। এরা বাইরে তা প্রকাশ না করলেও দলীয় নেতাদের এ ধরনের অমূলক বক্তব্যে ভেতরে ভেতরে বিব্রতবোধ করেন।
আসলে বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তার ভয়ে ভীত আমাদের সরকারি দল-জোটের শীর্ষসারির নেতানেত্রীরা। এরা বেগম জিয়া ফোবিয়ায় ভোগেন বলেই দলনিরপেক্ষ একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে জাতীয় নির্বাচন দিতে এতটা অনীহ। এদের মধ্যে বেগম জিয়াভীতি কাজ করে বলেই এরা গণতন্ত্রের যাবতীয় নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচন করে ভোটের আগেই সরকার গঠন করার মতো নির্বাচনী বিজয় নিশ্চিত করে ক্ষমমতায় টিকে থাকার অনৈতিক পথ অবলম্বন করে। এরা সেই নির্বাচনকে বৈধ করে তুলতে চায়, যা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ কোনো দেশ, জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। আজকে দেশে যে চরম রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে, মানুষ মরছে, অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের জটিল সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, দেশ জাতি অভাবনীয় ক্ষতির মুখেÑ সারা দুনিয়া বলছে এর জন্য দায়ী ৫ জানুয়ারির অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সবার অংশগ্রহণে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য অবাধ নির্বাচনই পারে বাংলাদেশকে এ সঙ্কট থেকে রক্ষা করতে। সব মহলের কথা- এজন্য দরকার সরকার ও সরকারবিরোধীদের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ। কিন্তু সরকার মহলের ধনুকভাঙা পণ- না, কোনো সংলাপ নয়, জঙ্গিনেত্রীর সাথে কিসের সংলাপ। ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন নয়।
সরকারি মহলে শুধু বেগম জিয়াভীতিই কাজ করছে, তা নয়। আসলে তার দলের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকারি মহলে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। না হলে এ সরকারের আমলে জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়া বিএনপি দলীয় মেয়রদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার শিকার হয়ে বরখাস্ত হতে হবে কেনো? রাজনৈতিক মামলায় এদের তিনজন কারাগারে। গ্রেফতার এড়াতে বাকি দু’জন আত্মপোপনে। এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন এ সরকারের আমলে নির্বচিত অনেক উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচত প্রতিনিধি। তাদের অপরাধ এরা সরকারবিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত।
সরকারি দলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, বেগম জিয়াকে যদি জঙ্গি-সন্ত্রাসী প্রমাণ করা যায় তবে কেল্লাফতে। কারণ, তখন পাশ্চাত্য বেগম জিয়ার সাথে লাদেন হিসেবে আচরণ করতে শুরু করে দেবে। আর তখন সরকারি দমনপীড়ন চললে দ্বিমুখী চাপে দিশেহারা হয়ে পড়বেন বেগম জিয়া। আর তখনই সহজেই সম্ভব হবে বেগম জিয়া ও তার দল-জোটকে নির্মূল করা। আর তা সম্ভব হলে দেশে আওয়ামীরাজ কায়েম নিশ্চিত হবে। এজন্যই আজ বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে তুমুল প্রচারণাÑ দেশে যত পেট্রলবোমা মেরে মানুষ মারা হচ্ছে সবই হচ্ছে বেগম জিয়ার নির্দেশে। সম্প্রতি ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা যায় আওয়ামী লীগের টানানো বিরাট বিরাট বিলবোর্ড। এগুলোতে দেখা যায়, আগুনে পোড়া মানুষের বেশ কিছু ছবি। বেগম জিয়া এক হাতে ধরে আছেন চেয়ারের একটি পা। আর এতে উদ্ধৃত করা হয়েছে তারেক জিয়ার একটি কাল্পনিক বক্তব্য। স্মৃতি থেকে বলছি তার বক্তব্যটি সম্ভবত এমন : ‘আমি তারেক বলছি, মা দেশটা জ্বালিয়ে দাও, জ্বেলেপুড়ে চারখার করে দাও। প্রয়োজন একটি চেয়ার।’
এর মাধ্যমে সরকার পক্ষ বলতে চাইছে বেগম জিয়া আজ পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছেন শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু দেশবাসী যখন দেখল সরকারি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে শুটিং চলেছে সাজানো প্রচারণা চালানোর জন্য, মোমবাতির আগুলে পুড়ে যাওয়া শিশুর ঘটনাকে বার্ন ইউনিটে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রচার করা হচ্ছে পেট্রলবোমার শিকার দেখিয়ে এবং কোনো কোনো পত্রিকা খবর প্রকাশ করছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও ধরা পড়ছেন পেট্রলবোমা নিয়ে এবং তাদের ছেড়েও দেয়া হচ্ছে. তখন কিন্তু এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করে। বেগম জিয়া অবশ্য বলেছেন, এসব ঘটনার প্রয়োজনে জাতিসঙ্ঘের অধীনে তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেয়া হোক। কার্যত তা হয়নি। যা হয়েছে- ঘটনা ঘটার সাথে সাথে বেগম জিয়াকে হুকুমের আসামি করে তার দল-জোটের হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে পুলিশি মামলা হয়েছে। গণহারে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। শুধু নেতাকর্মীরাই নন, তাদের আত্মীয়স্বজনও এ ধরনের হামলার শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। সময়ের সাথে এ প্রবণতা আরো জোরালো হচ্ছে। খুন, অপহরণ, হত্যা ও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটছে।
আসলে একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে সরকারদলীয় যাবতীয় গোয়েবলসীয় প্রচার-প্রচারণা সবই ভেস্তে যাচ্ছে। সরকার বলছে, দেশে কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট নেই, আছে আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত সমস্যা। সারা দুনিয়া বলছে তা ঠিক নয়, বাংলাদেশ চরম রাজনৈতিক সঙ্কটে নিপতিত, যার শেকড় নিহিত পাঁচ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচনই পারে এ সঙ্কটের সমাধান এনে দিতে। সরকারি জোটের বাইরে দেশের সব রাজনৈতিক দলেরও এই একই কথা। এমনকি সরকারি জোটে থাকা বেশ কয়েকটি দলও সংলাপের মাধ্যমে এর সমাধান চান, এসব দলের নেতারা এমনটি উল্লেখ করেছেন জোটের সভায়- এমন খবর প্রকাশিত হতে দেখা গেছে পত্রপত্রিকায়। দেশে সুশীল সমাজও তাই বলে আসছেন বারবার। কূনৈতিক মহলেরও একই অবস্থান। বেগম জিয়ার আন্দোলনের নৈতিক সাফল্য এখানেই। বেগম জিয়ার অবস্থানকেই সমর্থন জানাচ্ছে সরকার ছাড়া দেশ-বিদেশের সবাই। আর এতে রুষ্ট হয়েই আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে কূটনীতিক ও সুশীলসমাজের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনাকাক্সিক্ষত সব বক্তব্য। কারণ এরা সবাই চান সংলাপ ও সেই সূত্রে সঙ্কটের সমাধান। সে পথে না গিয়ে এখন সরকারপক্ষ বিলবোর্ড টানিয়ে বেগম জিয়ার ভাবমর্যাদা বিনাশ করার যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, তা শেষ পর্যন্ত কার ভাবমর্যাদা বিনাশ করে, সেটাই দেখার বিষয়।
এখানেই শেষ নয়, বেগম জিয়া পরিবারকে রাজনীতি থেকে উচ্ছেদের লক্ষ্য নিয়েও সরকারপক্ষ সক্রিয়- এমন খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ওয়ান-ইলেভেনের আমলের ও পরবর্তী সময়ে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা সচল হচ্ছে বলে জানিয়েছে একটি জাতীয় দৈনিক। এসব মামলা যে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের বিরাজনীতিকায়ন তথা রাজনীতিবিদদেরকে, আরো স্পষ্ট করে বললে দুই নেত্রীকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিদায় করার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে দায়ের করা হয়েছিল, তা এ দেশের সব মানুষের কাছে তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জিয়া পরিবারকে নির্মূল করার মানসে সেই হাতিয়ারটি এখন বর্তমান সরকারের হাতে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় এ ধরনের হয়রানিমূলক মামলার শিকার হয়েছিলেন এ দেশের বড় দুই দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাদের দলের সব মামলা প্রত্যাহার করে নিলেও বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার না করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এখন সরকার সেসব মামলা সক্রিয় করে বেগম জিয়ার পরিবারের সদস্যদের নির্বাচনে অযোগ্য করার প্রয়াস নতুন করে চালু করতে যাচ্ছে। এসব মামলায় তেমনটি করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ, সরকারের অনেক মন্ত্রী প্রায়ই বেগম জিয়াকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানোর হুমকি দিচ্ছেন।
এখন সরকার হঠাৎ করে ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে এমন এক সময়, যখন চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে ২০ দলীয় জোটের লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় জড়িয়ে হয় জেলে পাঠানো হয়েছে, নয়তো পালিয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। একই সাথে ক্রসফায়ারে নিহত হচ্ছেন ২০ দলীয় জোটের প্রচুর নেতাকর্মী। প্রতিদিনই গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে ২০ দলীয় জোটের অসংখ্য নেতাকর্মী। আসলে এরাই যে কোনো নির্বাচনী প্রচারণার ও ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনার মূল শক্তি। সরকার এদের বাইরে রেখে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করে পাঁচ জানয়ারির মতো খালি মাঠে গোল দেয়ার অপরাজনীতি করছে এ ক্ষেত্রেও। এ অবস্থায় নির্বাচনী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড যে বড় মাপে অনুপস্থিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত শনিবার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিবিসি সংলাপের ১০৯তম পর্ব। এ পর্বে শ্রোতারা বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা থাকে। দেশে বিদ্যমান সঙ্কট জিইয়ে রেখে এই সময়ে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। সিটি করপোরেশনের এই নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরো ঘনীভূত করে তুলতে পারে। তাই বলা দরকার, দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করে এই নির্বাচন দিলে অন্তত অপরাজনীতির বদনাম থেকে সরকার বাঁচার একটি সুযোগ পেত। কেনো যে সরকার সে পথে না হেঁটে শুধু রাজনৈতিক জটকে আরো জটিল করে তোলায়ই বেশি আগ্রহী, তা বলা মুশকিল। তবে অনেকের অভিমত, এ নির্বাচন আয়োজনের পেছনে সরকারপক্ষের আরেক গোপন লক্ষ্য হচ্ছে চলমান আন্দোলনের গতিকে আরো ধীরগতিতে নামিয়ে আনা। তা ছাড়া সরকার এক দিকে অন্যান্য সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত জনপ্রিয় নেতাদের সরিয়ে দেয়ার নানা ফন্দি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, অপর দিকে হঠাৎ করে এই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজনের পেছনে সরকারের যে কোনো সৎ উদ্দেশ্য নিহিত নেই, সে বোধ এ দেশের মানুষের আছে।
আজকে সরকার দেশের মানুষকে বোকা বানানোর বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার মনে করে, তাদের গোয়েবলসীয় প্রচার-প্রচারণায় দেশের জনগণ প্রভাবিত হয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে তালাক দিয়ে আওয়ামী শিবিরে যোগ দেবে। সেজন্যই আওয়ামী রাজনীতি এখন রূপ নিয়েছে রাজধানীর বিলবোর্ড আর ব্যানার ফেস্টুনের রাজনীতিতে। সারা ঢাকা ছেয়ে গেছে আওয়ামী নেতানেত্রীদের বিলবোর্ড আর ব্যানার ফেস্টুনে। সেই সাথে আওয়ামী নেতাদের পক্ষ থেকে রুটিন করে প্রতিদিন চলছে নানা অসৌজন্যমূলক বিশেষণে অভিহিত করে বেগম জিয়াকে নানাধর্মী আক্রমণ করে বিরামহীন বক্তব্য। একে নিছক গালাগাল বললেও ভুল হবে বলে মনে হয় না। অবাক হতে হয়, যেখানেই যাবেন চার দিকে শুধু নেতাদের বড় বড় ছবি সংবলিত বিলবোর্ড। আর এসব বিলবোর্ড ও ব্যানার ফেস্টুনে প্রচার করা হচ্ছে অদ্ভুদ সব সস্তা আওয়ামী দর্শন। এক জায়গায় দেখা গেল এমনই একটি আওয়ামী দর্শন : ‘ফার্স্ট লাইফ, নেক্সট ডেমোক্র্যাসি’। দর্শনের মর্মার্থ সরল। আগে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে, পরে ভাবা যাবে গণতন্ত্র নিয়ে। কিন্তু আওয়ামী দার্শনিকদের বোধে নেই- গণতন্ত্র থাকলেই শুধু মানুষের জীবন নিশ্চিত হয়, আর গণতন্ত্র না থাকলে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়, জানমাল হুমকির মুখে পড়ে। এর জায়মান প্রমাণ সাম্প্রতিক বাংলাদেশ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যে গণতান্ত্রিক ব্যত্যয় ঘটেছে, এরই পরিণামে আজ প্রতিদিন এ দেশে মানুষ মরছে। খুন, গুম, অপহরণ, ক্রসফায়ার, বিরোধী দলমতের দমন-পীড়ন সবই চলছে। এই মানুষ মরার যে প্রক্রিয়া চলমান, তা বন্ধ করার একমাত্র উপায় ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের শুদ্ধায়ন, ভিন্ন কিছু নয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার একগুঁয়েমি জিইয়ে রেখে ‘ফার্স্ট লাইফ, নেক্সট ডেমোক্র্যাসি’র ভুল দর্শন আওয়ামী লীগকে ভুলের মহাসড়ক থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সুযোগ দেবে না। বরং আরো বড় বড় ভুলের জন্ম দেবে। সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচনের পর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়া হবে। সরকার এখন সে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গিয়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার অবস্থান নেয়ায় সঙ্কট আরো প্রবল আকার নিয়েছে।
জি. মুনীর |
ইদানীং
আরেকটি ভুল দর্শন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে। এ ভুল দর্শন আওড়ে
তাদের বলতে শোনা যায় : ‘উন্নয়ন হলে গণতন্ত্র নাইবা থাকল’। কিন্তু এখানেও
সেই একই ভুল। গোটা বিশ্বে বিতর্কাতীতভাবে স্বীকৃত- উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র ও
স্থিতিশীলতা অপরিহার্য দুই উপাদান। কিন্তু এর বিপরীতে হঠাৎ করে এ দেশে
শুনি ‘উন্নয়ন হলে গণতন্ত্র নাইবা থাকল’। টকশোতে কয়েকজন আওয়ামী বুদ্ধিজীবীকে
এ দর্শন প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে দেখেছি কিছু দিন। ইদানীং আর
তাদের এ কথা বলতে শোনা যাচ্ছে না। কারণ, তাদের এ দর্শনতরী হালে পানি পায়নি।
বলা দরকার, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করেন, এ দেশের সাধারণ মানুষের
তেমন লেখাপড়া নেই এবং বুদ্ধিশুদ্ধিও তেমন নেই। তাদের যেমনটি বোঝানো হবে
তেমনটিই বুঝবে, যেমনটি খাওয়াবে তেমনটিই খাবে। কিন্তু আমাদের জানা দরকার,
বাংলাদেশের মানুষ অভিজ্ঞতার আলোকে উদ্ভাসিত এবং যথার্থ অর্থেই প্রজ্ঞাবান।
চীনের এক কৃষক বলেছিলেন, অভিজ্ঞতার আলোকে আমি একজন কৃষিবিজ্ঞানী, কিন্তু
আমার জানা বিজ্ঞানটুকু জানতে তোমরা চাও না। সে সূত্র ধরেই আমাদের দেশের
সাধারণ মানুষ সম্পর্কেও এমনটি দাবি করতে পারি- তাদের মধ্যে আছে সহজাত এক
দর্শন। তাই এরা কখনোই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে না। বায়ান্ন, ঊনষাট,
একাত্তরে এরা ভুল করেনি। আগামীতেও করবে না। তাই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে
বোকা ভেবে তাদের অবমূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। এরা বোঝে শুদ্ধ রাজনীতি।
এরা বরাবর পরিহার করে অপরাজনীতি। সরকারে থেকে কিংবা সরকারের বাইরে থেকে যেই
অপরাজনীতি করবে, এ দেশের জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করবে। এমনটি বোধে রেখে
রাজনীতি যারা করবে, শেষ বিচারে সফলতা পাবে তারাই। সে রাজনীতিই তো সবার
কাম্য।
No comments