কূটনীতিক জোনে মিছিল সমাবেশ নিষিদ্ধের নেপথ্যে by দীন ইসলাম
ঢাকাস্থ
মার্কিন দূতাবাসের ‘উল্লেখযোগ্যহারে কর্মকর্তা’ প্রত্যাহারের হুমকির কারণে
কূটনৈতিক জোনে মিছিল, মিটিং ও বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। গত ১৭ই
ফেব্রুয়ারি মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন ডেভিড মিয়েল পুলিশের
শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং-এ জানান, আমরা সার্বক্ষণিক ওয়াশিংটনের
সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আগামীকাল (১৮ই ফেব্রুয়ারি) এর মধ্যে ডিপ্লোমেটিক
এনক্লেভে মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ প্রদর্শন ইত্যাদি বন্ধ না হলে
উল্লেখযোগ্যহারে দূতাবাস কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। এটি
কেবলমাত্র নিরাপত্তার স্বার্থে এবং আমেরিকান গ্লোবাল সিকিউরিটি পলিসির
আলোকে নেয়া পদক্ষেপ হবে। সমপ্রতি ইয়েমেন ও নাইজেরিয়াতে এটা বাস্তবায়ন করা
হয়েছে। তিনি জানান, আমরা আমাদের পরিবার-পরিজন, নাগরিক এবং আমেরিকান স্কুলের
বাচ্চাদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশে চলাচল/গমনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ
করতে পারি। আমাদেরকে এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা হলে অন্যান্য অনেক মিশনও
অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে ব্যাকফুটে চলে যায়
সরকার। ডিপ্লোমেটিক জোনে মিছিল, মিটিংয়ে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশের
আইজি, র্যাবের মহাপরিচালক ও ডিএমপি কমিশনারকে চিঠি দিয়েছে। চিঠি’র কপি
অবগতির জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ও
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পাঠানো হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারি
মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান
কার্যালয়কে ঘিরে বিভিন্ন ব্যানারে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে
মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এসব কর্মসূচিতে ককটেলসহ নানা সহিংসতার
ঘটনা ঘটে। মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের
বৈঠকের কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি গুলশান-২ নং
সার্কেলে এক কিলোগ্রাম ওজনের ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পরপরই
বিষয়টি ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীসহ
সরকারের উচ্চ মহলকে জানায়। এরপর ১৭ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার
মৌখিকভাবে ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি বিভাগকে মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে মিটিং
করার নির্দেশ দেয়। মৌখিক নির্দেশ পাওয়ার পর ওই দিন বেলা তিনটায় অতিরিক্ত
পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মোহাম্মদ ইব্রাহিম ফাতেমীর নেতৃত্বে
ডিসি (গুলশান) এবং ডিসি (ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি) মার্কিন দূতাবাসে মিটিং
করার জন্য যান। এ মিটিং-এ দূতাবাসের পক্ষ থেকে ডেপুটি চিফ অব মিশন ডেভিড
মিয়েল এবং রিজিওনাল সিকিউরিটি অফিসার ড্যানিয়েল উইলহ্যাম উপস্থিত ছিলেন।
ডেপুটি চিফ অব মিশন তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ
তথা ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন
প্রশংসাসূচক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যেও ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভে কিছুদিন ধরে
চলমান শোভাযাত্রা, মিটিং, বিক্ষোভ ও ককটেল নিক্ষেপের মতো উদ্বেগজনক ঘটনা
ঘটছে। বিশেষত গতকাল (১৫ই ফেব্রুয়ারি) গুলশান-২ নং সার্কেলে নিক্ষিপ্ত
ককটেল-এর বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন। এরপর তিনি পুলিশের পক্ষ থেকে বক্তব্য
প্রত্যাশা করেন। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহিম ফাতেমী তার
বক্তব্যে বলেন, দূতাবাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকার এবং ঢাকা
মেট্রোপলিটন পুলিশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। বর্তমান বিরাজমান পরিস্থিতিতে
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ চেকপোস্ট, মোবাইল পেট্রোল, ফুট পেট্রোল, সাদা
পোশাকধারী পুলিশ অহর্নিশ কাজ করে যাচ্ছে। সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের তদারকি
কার্যক্রম অধিক মাত্রায় জোরদার করা হয়েছে। একজন যুগ্ম পুলিশ কমিশনার
সার্বক্ষণিক ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভ-এ সশরীরে উপস্থিত থেকে অন্যান্য ঊর্ধ্বতন
পুলিশ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তদারকি কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। এ সভায়
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) দূতাবাস কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত
করে বলেন, নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশ সদা জাগ্রত আছে এবং থাকবে। রাজনৈতিক দল
বা বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক শান্তিপূর্ণ মিছিল বা মিটিং গণতন্ত্রের অংশবিশেষ।
ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভ-এ যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে তা
সম্পূর্ণভাবে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে। পুলিশের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের
পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং কার্যক্রমও অব্যাহত আছে। অতিরিক্ত
কমিশনারের বক্তব্য শেষে ডেপুটি চিফ অব মিশন ডেভিড মিয়েল বলেন, ডিপ্লোমেটিক
মিশন কর্মকর্তা, তাদের পরিবারবর্গ, আমেরিকান স্কুলের বাচ্চাদের এবং
বাংলাদেশে বসবাসরত ইউএস নাগরিকদের নিরাপত্তায় পুলিশ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এর মধ্যেও আমেরিকান দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে বহনকারী গাড়িতে গত ৫ই
ফেব্রুয়ারি গুলশান-২ নম্বর সার্কেলের পাশে ককটেল নিক্ষেপ, শাহজাদপুরে আরও
একটি গাড়িতে ককটেল নিক্ষেপ এবং ১৬ই ফেব্রুয়ারি গুলশান-২ নং সার্কেলে এক
কিলোগ্রাম ওজনের ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, ১৬ই ফেব্রুয়ারি
সংঘটিত ঘটনায় ঘটনাস্থলের অনুমান ২০ মিটার দূরে আমেরিকান স্কুলের একটি গাড়ি
ছিল। এ ঘটনার পরপরই দূতাবাসে উদ্বেগ এবং অভিভাবকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা
দেয়। এরপর মার্কিন দূতাবাসের অনুরোধের ভিত্তিতে আমেরিকান স্কুলের
ছাত্রছাত্রীদের ১২টি রুটে বহনকারী বাসগুলোর নিরাপদ গমনাগমন নিশ্চিত করতে
দু’জন ফোর্স ও অফিসারের সমন্বয়ে প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়। এ কার্যক্রম
অবশ্যই প্রশংসা পাবার যোগ্য। ডেপুটি চিফ অব মিশন স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,
ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভ-এ কোন বিক্ষোভ প্রদর্শন, মিছিল, মিটিং কাম্য নয়। এসব
অহিংস মিছিল, বিক্ষোভ যে কোন সময় সহিংস রূপ ধারণ করতে পারে। ডেপুটি চিফ তার
বক্তব্যের শেষে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আশা করছি আমাদের উদ্বেগের কথা আপনারা
সরকারকে অবহিত করবেন। যদিও এরই মধ্যে বিষয়টি সরকারকে দূতাবাসের পক্ষ থেকে
জানানো হয়েছে। মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে আলোচনা সংক্রান্ত কার্যবিবরণী দুই
ডিসি স্বাক্ষর করে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে পাঠান। ডিএমপি
কমিশনারের কাছে লেখা কার্যবিবরণীর শেষাংশে তারা বলেছেন, আপনার টেলিফোনে
প্রদত্ত নির্দেশক্রমে বিষয়টি মহোদয়ের সদয় অবগতি ও পরবর্তী কার্যকর ব্যবস্থা
গ্রহণের জন্য পাঠানো হলো। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ৩রা
মার্চ পুলিশ সদর দপ্তরের গোপনীয় শাখার স্মারক নং- ১৫০১ এর মাধ্যমে সভার
কার্যবিবরণী ও একটি চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে
পাঠানো হয়। যার ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার
নির্দেশ দিয়েছে। নির্দেশনার চিঠি’র বিষয়বস্তুতে বলা হয়েছে, ঢাকাস্থ মার্কিন
দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের
মতবিনিময় সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন। চিঠিতে পুলিশের সঙ্গে মার্কিন
দূতাবাসের বৈঠক ও তাদের মতামত তুলে ধরে বলা হয়, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া
গোপনীয় প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে এ বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের
জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
No comments