আবুল ফজলের ‘দুর্দিনের দিনলিপি’ ও এ সময় by ওয়ালিউল হক
আমরা
যখন ছোট ছিলাম তখন পিটিভিই ছিল একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল যা কি না
স্বাধীনতার পর বিটিভি নামে পরিচিতি লাভ করে। সে সময় ‘টক শো’ নামে কোনো
অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো না। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়।
সরকারি টেলিভিশনের পাশাপাশি এখন অনেক বেসরকারি টেলিভিশন চালু হয়েছে। এসব
বেসরকারি টেলিভিশনের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘টক শো’। তবে সব টক শোই
যে জনপ্রিয় তা বলা যাবে না কারণ টক শোর জনপ্রিয়তা নির্ভর করে সঞ্চালক ও
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ওপর। একপেশে কথা শুনতে দর্শকেরা আর রাজি
নয় কারণ সময়ের সাথে সাথে তাদেরও রুচির পরিবর্তন ঘটেছে।
এবার আসল কথায় আসা যাক, অনেকের মতো আমিও কিছু কিছু টক শো দেখি। কিন্তু মর্মাহত হই, যখন দেখি টক শোতে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী ঘরানার কোনো কোনো ব্যক্তি এ কথা বলেন যে, এখন নতুন কোনো নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়, কারণ তাতে করে বিএনপি-জামায়াতের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। কেউ কেউ তো এ কথাও বলেন যে, সরকার এবং বিরোধী দল দুটোকেই সমমনা হতে হবে। অর্থাৎ বিরোধী দলকেও হতে হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। বিরোধী দল অর্থাৎ বিএনপি যদি আওয়ামী লীগের মতো এই চারটি নীতিতে বিশ্বাসী হয় তাহলেই তাদেরকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া যেতে পারে অন্যথায় নয়।
তাদের এসব কথাবার্তা শুনে ‘জাতির বিবেক’ হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক আবুল ফজলের লেখা একটা বইয়ের কথা মনে পড়ছে। অধ্যাপক আবুল ফজল এক দিকে ছিলেন নামকরা শিক্ষাবিদ এবং অন্য দিকে খ্যাতিমান সাহিত্যিক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আবুল ফজলের লেখা ওই বই-এর নাম হচ্ছে ‘দুর্দিনের দিনলিপি’। ১৯৭১ সালে উনি যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তখন তিনি ঐ দিনলিপি লেখেন, যা ১৯৭২ সালে দুর্দিনের দিনলিপি নামে প্রকাশিত হয়। তিনি সেখানে গণতন্ত্র, স্বৈরাচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেছেন যা কি না বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য এখনো গুরুত্ববহ। পাঠকদের অবগতির জন্য তার কিছু অংশ নিচে তুলে দেয়া হলো-
২৮.০৭.৭১
রাষ্ট্রীয় জীবনে রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ক্ষমতাই সব শক্তি আর উদ্যোগের উৎস। এ ক্ষমতার চাবিকাঠি পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্ব কিছুতেই পূর্ব বাংলার মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। এ সত্য শুধু এবার প্রমাণিত হলো না। উনিশ শ’ চুয়ান্নর ‘যুক্ত ফ্রন্টে’র আমলেও একবার প্রমাণিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্ব সুবিধা বুঝে গণতন্ত্রের বুলি মুখে আওড়ায় বটে, কিন্তু অন্তরে তা মানে না। কারণ তা মানতে গেলে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়, যা দিতে তারা মোটেও রাজি নয়। তাই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। যুক্তফ্রন্টের আমলে এ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন ফজলুল হক-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী, এবার হলেন শেখ মুজিব আর তার দল আওয়ামী লীগ। এ এক অদ্ভুত খেলÑ মুখে গণতন্ত্রের বুলি অথচ গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে গররাজি!
অপরকে স্বেচ্ছায় পথ ছেড়ে দেয়ার এক ভদ্র পদ্ধতিরই নাম গণতন্ত্র। এ পদ্ধতির সৌন্দর্যও এখানে। বিনা প্রতিবাদ, বিনা রক্তপাতে অপরকে পথ ছেড়ে দেয়া। অপরে তোমাকে পথ ছেড়ে দিক এ যেমন তুমি চাও, তেমনি তোমারও উচিত অপরকে পথ ছেড়ে দেয়া। গণতন্ত্রের সাফল্যও নির্ভর করে পথ ছেড়ে দিতে জানার ওপর। এর জন্য শুধু যে ন্যায়নীতির প্রতি আনুগত্য আর শ্রদ্ধার প্রয়োজন তা নয়, মন-মানসের দীর্ঘ প্রস্তুতিও অত্যাবশ্যক। যা গোলাম মোহাম্মদ, ইসকান্দার মির্জা, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান কারো ছিল না। এসবের কিছুটা আশা করা যায় রাজনীতিবিদদের কাছে। এরা কেউই রাজনীতিবিদ ননÑ রাজনীতির পথ বেয়ে কেউই বসেননি ক্ষমতায়। ক্ষমতার পথেই এরা হয়েছেন ক্ষমতাসীন। তাই এরা শুধু ক্ষমতা দখল করে থাকাটাই জানতেন কিন্তু কী করে সসম্মানে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয় তা জানতেন না। ওই দিকে গণতন্ত্রের ভান না করেও ছাড়তেন না, কারণ গণতন্ত্র এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয়, ভদ্র আর স্বীকৃত পন্থা। একে অস্বীকার করলে বিশ্ববাসীর সামনে মুখ দেখানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বলেছি গণতন্ত্র মানে শুধু ক্ষমতা দখল নয়, ক্ষমতা ছেড়ে দেয়াও। গণতন্ত্রের সাফল্যও এ মনোভাবের ওপর নির্ভর করে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের যুগপৎ এ দুই পাঠই শিখতে হয়, এ দুইকেই করে নিতে হয় আন্তরিক বিশ্বাসের অঙ্গ। পাকিস্তানের পরম দুর্ভাগ্য, সত্যিকার রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনে জিতেও কখনো ক্ষমতাসীন তথা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারেননি, নানা ষড়যন্ত্রের কলকাঠি চালিয়ে এদেরে সব সময় ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে সুকৌশলে। ফলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি কিংবা গণতান্ত্রিক সরকার এখানে দানা বাঁধতে পারেনি আদৌ।
যেকোনো খেলায় যেমন কতকগুলো অপরিহার্য নিয়ম রয়েছে, যা পালিত আর অনুসৃত হলেই খেলা জমে এবং উপভোগ্য হয়ে ওঠে। তেমনি গণতন্ত্রও এক রকম খেলা, তারও কতকগুলো অপরিহার্য নিয়মকানুন রয়েছে, যা পালিত আর অনুসৃত না হলে গণতন্ত্র অচল হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের প্রধান কানুন সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে স্বীকার করে নেয়া। ফরাসি লেখক ও রাজনীতিবিদ আদ্রেঁ মালরোর মতে, ‘...ব্রিটিশ গণতন্ত্র আজ মডেল বা আদর্শ হয়ে রয়েছে সারা পৃথিবীর সামনে। কারণ ওখানে গণতান্ত্রিক নিয়মকানুন পালিত হয় সর্বতোভাবে। খেলার নিয়মকানুন না মানলে যেমন খেলা স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়, রাজনীতির বেলায়ও অবিকল তাই ঘটে।’ রাজনীতি ক্ষেত্রে এর পরিণাম একনায়কত্ব আর স্বৈরতন্ত্র। যার নগ্ন চেহারা আমরা পাকিস্তানে দেখতে পেয়েছি এক যুগ ধরে। ফলে আমাদের গোটা জাতি আজ স্বৈরতন্ত্রের শিকার। গোলাম মোহাম্মদ, ইসকান্দর মির্জার স্বৈরতন্ত্র ছিল এক ধরনের, আইয়ুব-ইয়াহিয়ার স্বৈরতন্ত্র নিয়েছে অন্যরূপÑ এ পুরোপুরি একনায়কত্ব। (পৃষ্ঠা-৩৬-৩৭)
৫.৯.৭১
পাকিস্তান সরকারের এক মস্ত বড় দুর্বলতা এ সরকার কোনো রকম সমালোচনাই বরদাশত করতে পারে না। সমালোচনা শুনতে না চাওয়া মানে নিজেকে সংশোধন করতে না চাওয়া। তার মানে, যা আছে, যেমনটি আছে তাকে আঁকড়ে ধরে যেখানে ছিলাম সেখানে স্থানু হয়ে পড়ে থাকা। অর্থাৎ না চলা আর না এগোনো। দ্রুত গতিশীল পৃথিবীতে এর অর্থ পেছনে হটা, অন্য দেশ আর জাতির পেছনে পড়ে থাকা। পাকিস্তানের দশা আজ অবিকল তাই। পাকিস্তানের জন্মমুহূর্তে আমরা যেখানে ছিলাম এখন তার থেকেও অনেক অনেক পেছনে পড়ে গেছি। তখন অন্তত স্বাধীনভাবে দশটা কথা বলা যেত, রাষ্ট্রের এ নীতি ও নীতি সম্বন্ধে করা চলত সমালোচনা। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সমালোচনা অপরিহার্য। বিরোধী দল ছাড়া যেমন গণতন্ত্র অর্থহীন তেমনি সমালোচনা আর সমালোচনার অধিকার ছাড়াও গণতন্ত্র অচল। অন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে গণতন্ত্র উৎকৃষ্ট আর অধিকতর আকাক্সিত এ কারণে যে, গণতন্ত্রে চুপ চুপ নীতির কোনো স্থান নেই। গণের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র স্বধর্ম রক্ষা করে বাঁচতে পারে না। গণতন্ত্রের স্বভাব আর চরিত্র সব সময় আলো-হাওয়ার প্রত্যাশী। ঢাক্ ঢাক্ গুড় গুড় হচ্ছে একনায়কত্ব তথা স্বৈরতন্ত্রের স্বভাব আর ধর্ম। মুখোশ ছাড়া একনায়কত্ব এক দিনও টিকে থাকতে পারে না। অন্য দিকে গণতন্ত্রের ধর্ম সব রকম মুখোশ ছিঁড়ে ফেলা, সরকার আর শাসকদের আসল চেহারাটা জনসমক্ষে তুলে ধরা, খুলে ফেলা ওদের মুখের ঘোমটা, সব রকম মুখোশকে ছিন্নভিন্ন করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়া। আমাদের শাসকেরা মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও আসলে কাজে কর্মে, ব্যবহার আর স্বভাবে পুরোপুরি স্বৈরতন্ত্রী। এ কারণেই এ সরকারের এত বেশি সমালোচনা-ভীতি। আলো বাতাসের স্পর্শ আর ঝড় বাতাসের ঝাঁপটা ছাড়া যেমন গাছ বড়, সবল আর দৃঢ়মূল হয় না তেমনি রাষ্ট্রদেহও সমালোচনার ঘাত-প্রতিঘাত ছাড়া শক্ত সতেজ, দৃঢ়ভিত আর মজবুত হয়ে ওঠে না।
গতকাল প্রচার করা হয়েছে প্রেস সেন্সরশিপ তুলে দেয়া হয়েছে। তবে সেই সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে বহু ‘কিন্তু’। ইসলাম আর পাকিস্তানি আদর্শের, পাকিস্তানের অখণ্ডতার, কায়েদে আযমের, অন্য রাজনৈতিক দলের, সামরিক আইন আর সামরিক কর্তাব্যক্তিদের এবং আরো বহুতর বিষয়ের সামলোচনা করা যাবে না! সরকারি ভাষায় একে সেন্সরশিপ তুলে দেয়া বললেও এ যে মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা নয় তা বুঝতে তেমন কিছু বুদ্ধির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। যা সমালোচনা সহ্য করতে অসমর্থ, মনে করতে হবে তা দুর্বল, ভঙ্গুর আর তাতে প্রচুর গলদ আর ভেজাল মেশানো রয়েছে। নকলের কারবারিরাই সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে আর হয়ে থাকে সন্দেহপ্রবণ। সমালোচনা-ভিতু সব সরকার সম্বন্ধেই এ কথা বলা যায়।
আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্রে গণ্ডগোলের অন্ত নেই, তবুও মতামত প্রকাশের ব্যাপারে ওখানে কোনো বিধিনিষেধ নেই। নেই কোনো জবরদস্তি। ওখানকার সরকার স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকারকে এতটুকু খর্ব করেনি। ফলে গণতন্ত্র ওখানে দিন দিনই দৃঢ়মূল হয়ে গড়ে উঠছে। ওখানে ধর্মের বিরুদ্ধে, ভারতের অখণ্ডতার কিংবা মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে, এমনকি রাম-সীতার বিরুদ্ধেও লেখা কিংবা সমালোচনা করা নিষিদ্ধ নয়। এবং এতে ওদের কিছুমাত্র ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে বলে আজো কোনো অভিযোগ ওঠেনি। এ স্বাধীনতা শুধু যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিকাশের জন্য অপরিহার্য তা নয়, জ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অপরিহার্যতা আরো বেশি। প্রাচীন মতামত বা অতীতে গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে শুধু হাঁ হাঁ করাই জ্ঞানচর্চা কিংবা গবেষণার উদ্দেশ্য নয়, তেমন উদ্দেশ্য হওয়া মানে নতুন করে অচলায়তনের পিঞ্জরে বাঁধা পড়া এবং জ্ঞানের পথে অগ্রসর না হওয়া। অতীতের জাবরকাটার নাম জ্ঞানসাধনা নয়। আশ্চর্য, পাকিস্তানে এ ধরনের জাবরকাটাকেই কি না মনে করা হয় জ্ঞানচর্চা! যে যত বেশি জাবরকাটায় ওস্তাদ এখানে সে-ই তত বেশি জ্ঞানী আর পণ্ডিত নামে চিহ্নিত।
( পৃষ্ঠা- ৮৭-৮৮)
এবার আসল কথায় আসা যাক, অনেকের মতো আমিও কিছু কিছু টক শো দেখি। কিন্তু মর্মাহত হই, যখন দেখি টক শোতে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী ঘরানার কোনো কোনো ব্যক্তি এ কথা বলেন যে, এখন নতুন কোনো নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়, কারণ তাতে করে বিএনপি-জামায়াতের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। কেউ কেউ তো এ কথাও বলেন যে, সরকার এবং বিরোধী দল দুটোকেই সমমনা হতে হবে। অর্থাৎ বিরোধী দলকেও হতে হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। বিরোধী দল অর্থাৎ বিএনপি যদি আওয়ামী লীগের মতো এই চারটি নীতিতে বিশ্বাসী হয় তাহলেই তাদেরকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া যেতে পারে অন্যথায় নয়।
তাদের এসব কথাবার্তা শুনে ‘জাতির বিবেক’ হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক আবুল ফজলের লেখা একটা বইয়ের কথা মনে পড়ছে। অধ্যাপক আবুল ফজল এক দিকে ছিলেন নামকরা শিক্ষাবিদ এবং অন্য দিকে খ্যাতিমান সাহিত্যিক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আবুল ফজলের লেখা ওই বই-এর নাম হচ্ছে ‘দুর্দিনের দিনলিপি’। ১৯৭১ সালে উনি যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তখন তিনি ঐ দিনলিপি লেখেন, যা ১৯৭২ সালে দুর্দিনের দিনলিপি নামে প্রকাশিত হয়। তিনি সেখানে গণতন্ত্র, স্বৈরাচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেছেন যা কি না বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য এখনো গুরুত্ববহ। পাঠকদের অবগতির জন্য তার কিছু অংশ নিচে তুলে দেয়া হলো-
২৮.০৭.৭১
রাষ্ট্রীয় জীবনে রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ক্ষমতাই সব শক্তি আর উদ্যোগের উৎস। এ ক্ষমতার চাবিকাঠি পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্ব কিছুতেই পূর্ব বাংলার মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। এ সত্য শুধু এবার প্রমাণিত হলো না। উনিশ শ’ চুয়ান্নর ‘যুক্ত ফ্রন্টে’র আমলেও একবার প্রমাণিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্ব সুবিধা বুঝে গণতন্ত্রের বুলি মুখে আওড়ায় বটে, কিন্তু অন্তরে তা মানে না। কারণ তা মানতে গেলে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়, যা দিতে তারা মোটেও রাজি নয়। তাই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। যুক্তফ্রন্টের আমলে এ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন ফজলুল হক-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী, এবার হলেন শেখ মুজিব আর তার দল আওয়ামী লীগ। এ এক অদ্ভুত খেলÑ মুখে গণতন্ত্রের বুলি অথচ গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে গররাজি!
অপরকে স্বেচ্ছায় পথ ছেড়ে দেয়ার এক ভদ্র পদ্ধতিরই নাম গণতন্ত্র। এ পদ্ধতির সৌন্দর্যও এখানে। বিনা প্রতিবাদ, বিনা রক্তপাতে অপরকে পথ ছেড়ে দেয়া। অপরে তোমাকে পথ ছেড়ে দিক এ যেমন তুমি চাও, তেমনি তোমারও উচিত অপরকে পথ ছেড়ে দেয়া। গণতন্ত্রের সাফল্যও নির্ভর করে পথ ছেড়ে দিতে জানার ওপর। এর জন্য শুধু যে ন্যায়নীতির প্রতি আনুগত্য আর শ্রদ্ধার প্রয়োজন তা নয়, মন-মানসের দীর্ঘ প্রস্তুতিও অত্যাবশ্যক। যা গোলাম মোহাম্মদ, ইসকান্দার মির্জা, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান কারো ছিল না। এসবের কিছুটা আশা করা যায় রাজনীতিবিদদের কাছে। এরা কেউই রাজনীতিবিদ ননÑ রাজনীতির পথ বেয়ে কেউই বসেননি ক্ষমতায়। ক্ষমতার পথেই এরা হয়েছেন ক্ষমতাসীন। তাই এরা শুধু ক্ষমতা দখল করে থাকাটাই জানতেন কিন্তু কী করে সসম্মানে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয় তা জানতেন না। ওই দিকে গণতন্ত্রের ভান না করেও ছাড়তেন না, কারণ গণতন্ত্র এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয়, ভদ্র আর স্বীকৃত পন্থা। একে অস্বীকার করলে বিশ্ববাসীর সামনে মুখ দেখানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বলেছি গণতন্ত্র মানে শুধু ক্ষমতা দখল নয়, ক্ষমতা ছেড়ে দেয়াও। গণতন্ত্রের সাফল্যও এ মনোভাবের ওপর নির্ভর করে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের যুগপৎ এ দুই পাঠই শিখতে হয়, এ দুইকেই করে নিতে হয় আন্তরিক বিশ্বাসের অঙ্গ। পাকিস্তানের পরম দুর্ভাগ্য, সত্যিকার রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনে জিতেও কখনো ক্ষমতাসীন তথা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারেননি, নানা ষড়যন্ত্রের কলকাঠি চালিয়ে এদেরে সব সময় ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে সুকৌশলে। ফলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি কিংবা গণতান্ত্রিক সরকার এখানে দানা বাঁধতে পারেনি আদৌ।
যেকোনো খেলায় যেমন কতকগুলো অপরিহার্য নিয়ম রয়েছে, যা পালিত আর অনুসৃত হলেই খেলা জমে এবং উপভোগ্য হয়ে ওঠে। তেমনি গণতন্ত্রও এক রকম খেলা, তারও কতকগুলো অপরিহার্য নিয়মকানুন রয়েছে, যা পালিত আর অনুসৃত না হলে গণতন্ত্র অচল হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের প্রধান কানুন সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে স্বীকার করে নেয়া। ফরাসি লেখক ও রাজনীতিবিদ আদ্রেঁ মালরোর মতে, ‘...ব্রিটিশ গণতন্ত্র আজ মডেল বা আদর্শ হয়ে রয়েছে সারা পৃথিবীর সামনে। কারণ ওখানে গণতান্ত্রিক নিয়মকানুন পালিত হয় সর্বতোভাবে। খেলার নিয়মকানুন না মানলে যেমন খেলা স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়, রাজনীতির বেলায়ও অবিকল তাই ঘটে।’ রাজনীতি ক্ষেত্রে এর পরিণাম একনায়কত্ব আর স্বৈরতন্ত্র। যার নগ্ন চেহারা আমরা পাকিস্তানে দেখতে পেয়েছি এক যুগ ধরে। ফলে আমাদের গোটা জাতি আজ স্বৈরতন্ত্রের শিকার। গোলাম মোহাম্মদ, ইসকান্দর মির্জার স্বৈরতন্ত্র ছিল এক ধরনের, আইয়ুব-ইয়াহিয়ার স্বৈরতন্ত্র নিয়েছে অন্যরূপÑ এ পুরোপুরি একনায়কত্ব। (পৃষ্ঠা-৩৬-৩৭)
৫.৯.৭১
পাকিস্তান সরকারের এক মস্ত বড় দুর্বলতা এ সরকার কোনো রকম সমালোচনাই বরদাশত করতে পারে না। সমালোচনা শুনতে না চাওয়া মানে নিজেকে সংশোধন করতে না চাওয়া। তার মানে, যা আছে, যেমনটি আছে তাকে আঁকড়ে ধরে যেখানে ছিলাম সেখানে স্থানু হয়ে পড়ে থাকা। অর্থাৎ না চলা আর না এগোনো। দ্রুত গতিশীল পৃথিবীতে এর অর্থ পেছনে হটা, অন্য দেশ আর জাতির পেছনে পড়ে থাকা। পাকিস্তানের দশা আজ অবিকল তাই। পাকিস্তানের জন্মমুহূর্তে আমরা যেখানে ছিলাম এখন তার থেকেও অনেক অনেক পেছনে পড়ে গেছি। তখন অন্তত স্বাধীনভাবে দশটা কথা বলা যেত, রাষ্ট্রের এ নীতি ও নীতি সম্বন্ধে করা চলত সমালোচনা। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সমালোচনা অপরিহার্য। বিরোধী দল ছাড়া যেমন গণতন্ত্র অর্থহীন তেমনি সমালোচনা আর সমালোচনার অধিকার ছাড়াও গণতন্ত্র অচল। অন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে গণতন্ত্র উৎকৃষ্ট আর অধিকতর আকাক্সিত এ কারণে যে, গণতন্ত্রে চুপ চুপ নীতির কোনো স্থান নেই। গণের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র স্বধর্ম রক্ষা করে বাঁচতে পারে না। গণতন্ত্রের স্বভাব আর চরিত্র সব সময় আলো-হাওয়ার প্রত্যাশী। ঢাক্ ঢাক্ গুড় গুড় হচ্ছে একনায়কত্ব তথা স্বৈরতন্ত্রের স্বভাব আর ধর্ম। মুখোশ ছাড়া একনায়কত্ব এক দিনও টিকে থাকতে পারে না। অন্য দিকে গণতন্ত্রের ধর্ম সব রকম মুখোশ ছিঁড়ে ফেলা, সরকার আর শাসকদের আসল চেহারাটা জনসমক্ষে তুলে ধরা, খুলে ফেলা ওদের মুখের ঘোমটা, সব রকম মুখোশকে ছিন্নভিন্ন করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়া। আমাদের শাসকেরা মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও আসলে কাজে কর্মে, ব্যবহার আর স্বভাবে পুরোপুরি স্বৈরতন্ত্রী। এ কারণেই এ সরকারের এত বেশি সমালোচনা-ভীতি। আলো বাতাসের স্পর্শ আর ঝড় বাতাসের ঝাঁপটা ছাড়া যেমন গাছ বড়, সবল আর দৃঢ়মূল হয় না তেমনি রাষ্ট্রদেহও সমালোচনার ঘাত-প্রতিঘাত ছাড়া শক্ত সতেজ, দৃঢ়ভিত আর মজবুত হয়ে ওঠে না।
গতকাল প্রচার করা হয়েছে প্রেস সেন্সরশিপ তুলে দেয়া হয়েছে। তবে সেই সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে বহু ‘কিন্তু’। ইসলাম আর পাকিস্তানি আদর্শের, পাকিস্তানের অখণ্ডতার, কায়েদে আযমের, অন্য রাজনৈতিক দলের, সামরিক আইন আর সামরিক কর্তাব্যক্তিদের এবং আরো বহুতর বিষয়ের সামলোচনা করা যাবে না! সরকারি ভাষায় একে সেন্সরশিপ তুলে দেয়া বললেও এ যে মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা নয় তা বুঝতে তেমন কিছু বুদ্ধির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। যা সমালোচনা সহ্য করতে অসমর্থ, মনে করতে হবে তা দুর্বল, ভঙ্গুর আর তাতে প্রচুর গলদ আর ভেজাল মেশানো রয়েছে। নকলের কারবারিরাই সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে আর হয়ে থাকে সন্দেহপ্রবণ। সমালোচনা-ভিতু সব সরকার সম্বন্ধেই এ কথা বলা যায়।
আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্রে গণ্ডগোলের অন্ত নেই, তবুও মতামত প্রকাশের ব্যাপারে ওখানে কোনো বিধিনিষেধ নেই। নেই কোনো জবরদস্তি। ওখানকার সরকার স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকারকে এতটুকু খর্ব করেনি। ফলে গণতন্ত্র ওখানে দিন দিনই দৃঢ়মূল হয়ে গড়ে উঠছে। ওখানে ধর্মের বিরুদ্ধে, ভারতের অখণ্ডতার কিংবা মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে, এমনকি রাম-সীতার বিরুদ্ধেও লেখা কিংবা সমালোচনা করা নিষিদ্ধ নয়। এবং এতে ওদের কিছুমাত্র ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে বলে আজো কোনো অভিযোগ ওঠেনি। এ স্বাধীনতা শুধু যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিকাশের জন্য অপরিহার্য তা নয়, জ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অপরিহার্যতা আরো বেশি। প্রাচীন মতামত বা অতীতে গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে শুধু হাঁ হাঁ করাই জ্ঞানচর্চা কিংবা গবেষণার উদ্দেশ্য নয়, তেমন উদ্দেশ্য হওয়া মানে নতুন করে অচলায়তনের পিঞ্জরে বাঁধা পড়া এবং জ্ঞানের পথে অগ্রসর না হওয়া। অতীতের জাবরকাটার নাম জ্ঞানসাধনা নয়। আশ্চর্য, পাকিস্তানে এ ধরনের জাবরকাটাকেই কি না মনে করা হয় জ্ঞানচর্চা! যে যত বেশি জাবরকাটায় ওস্তাদ এখানে সে-ই তত বেশি জ্ঞানী আর পণ্ডিত নামে চিহ্নিত।
( পৃষ্ঠা- ৮৭-৮৮)
No comments