বেগম রওশন এরশাদের কাছে আন্তরিক ক্ষমা চেয়ে by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আজকের লেখাটি জাতীয় পার্টি এবং সংসদে
বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে শুরু
করছি। গত মাসের (ডিসেম্বর) মধ্যভাগে আমি যখন ঢাকায় অবস্থান করছি, তখন তিনি
আমাকে কয়েকবার টেলিফোন করেছিলেন। তার ইচ্ছে ছিল আমি তার সঙ্গে দেখা করি।
দেশের রাজনীতি নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছিলেন। আমারও ইচ্ছে ছিল
তার সঙ্গে সাক্ষাতের এই সুযোগটা গ্রহণ করার। তাহলে দেশের একটি রাজনৈতিক
দলের মনোভাব জানতে পারব, যে দলটি একই সঙ্গে সরকারে রয়েছে এবং সংসদে বিরোধী
দলের ভূমিকাও পালন করছে।
আমার দুর্ভাগ্য, আমি শেষ পর্যন্ত বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারিনি; এমনকি সেজন্য তার কাছে ক্ষমা চাইতেও পারিনি। ঢাকায় হাতে নানা ধরনের কাজ থাকায় এবং দেশের বাইরে কলকাতা, বাগডোরা, দার্জিলিংয়ে ছোটাছুটি করায় বেগম রওশন এরশাদের আমন্ত্রণ আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গ্রহণ করতে পারিনি। সেজন্যই সাক্ষাতে তাকে যে কথাগুলো বলতে পারিনি, আজ নিজের কলামে তা লেখার শুরুতে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
বেগম রওশন এরশাদের রাজনীতির সঙ্গে সহমত পোষণ না করলেও তার প্রতি আমার এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আছে। বর্তমান জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে তার পারফরম্যান্স কখনও কখনও চমৎকার। দেশের বর্তমান রাজনীতিতে অত্যন্ত দুরূহ ভারসাম্য রক্ষায় তিনি যে দক্ষতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দিচ্ছেন তা এক কথায় অনবদ্য। দেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক সঙ্কটে তার এই গঠনমূলক ভূমিকা ইতিহাসে হয়তো একদিন স্বীকৃতি পাবে।
দেশে এখন রাজনৈতিক সংঘাত আছে, গণতান্ত্রিক বিরোধিতা নেই। এই বিরোধিতার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ইচ্ছা না থাকলেও হয়তো একদলীয় শাসন ক্ষমতার অধিকারী হতো। বিএনপি ভীষ্মের শরশয্যা গ্রহণের মতো ইচ্ছামৃত্যুর পথ ধরে সংঘাতের রাজনীতিতে লিপ্ত রয়েছে। আন্দোলন নেই, আছে বিক্ষিপ্ত ও ব্যর্থ সন্ত্রাস। গত রোববারও বিএনপি ঢাকায় যা করেছে তা আত্মঘাতী গোল দেয়া ছাড়া আর কিছু নয়। বিএনপির সন্ত্রাসীরা যার গাড়ি পুড়িয়েছে, তা বিএনপি-নেত্রীরই উপদেষ্টা সাবিহউদ্দীন আহমদের। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়ার আরেক প্রভাবশালী উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর বাড়িতে হামলা হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর বেয়াই হলেও তার আসল পরিচয় তিনি খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর ও উপদেষ্টা। বিএনপির সন্ত্রাসীরা তার বাড়িতেই হামলা চালিয়েছে। বিএনপিকে যে ডেথ উইশে পেয়েছে এটা তার প্রমাণ।
এ ক্ষেত্রে বেগম রওশন এরশাদ তার জাতীয় পার্টি নিয়ে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তিনি দেশে গণতান্ত্রিক বিরোধিতার বদলে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে যে সন্ত্রাসী অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক শাসনকে ক্ষমতা ধরে রাখতে সমর্থন দিয়েছেন, এমনকি তাদের সহযোগী হয়েছেন। অন্যদিকে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক বিরোধিতার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ যে অনিবার্য একদলীয় শাসনক্ষমতার অধিকারী হতো, তা ঠেকিয়ে রাখার জন্য সংসদে বিরোধী দলের অবস্থানও গ্রহণ করেছেন।
এটা একটা রাজনৈতিক দলের পরস্পরবিরোধী ভূমিকা মনে হতে পারে। কিন্তু কোনো কোনো দেশে কোনো কোনো সময় এমন রাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হয়, যে অবস্থায় গণতন্ত্রের স্বার্থেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দলকে এ ধরনের স্ববিরোধী ভূমিকায় নামতে হয়। তাতে দলটির হয়তো ক্ষতি হয়। কিন্তু দেশের নাজুক গণতন্ত্র রক্ষা পায়। নজির হিসেবে প্রতিবেশী ভারতের কথা উল্লেখ করা যায়। দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর নেহেরুর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় বসে বটে, কিন্তু ক্ষমতায় বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এবং বাইরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চক্রান্তের সম্মুখীন হয় নেহেরু সরকার।
স্বাধীনতা লাভের বছরখানেকের মধ্যে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক চক্রের হাতে নিহত হন। ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের ভেতর থেকেই সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে একটি প্রতিক্রিয়াশীল অংশ নেহেরুর গণতান্ত্রিক ও সেকুলার রাষ্ট্রনীতিকে সাবোটাজ করার চক্রান্ত শুরু করে। বাইরে থেকে আমেরিকা তার নয়া সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের জালে ভারতকে বেঁধে ফেলার অপচেষ্টা চালায়।
এই সময় অবিভক্ত সিপিআই বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ছিল দেশটির বৃহত্তম দ্বিতীয় রাজনৈতিক দল। কথা ছিল তারা কংগ্রেসের বিরোধী দলের শক্তিশালী ভূমিকায় নামবেন। কিন্তু তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সিপিআই এমন এক নীতি গ্রহণ করে, যা পরে দলটির ভীষণ ক্ষতি করেছে; কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রকে মৌলবাদী অভ্যুত্থান ও সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য থেকে রক্ষা করেছে। সিপিআইয়ের তখনকার সিদ্ধান্তটি ছিল তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল নীতির ক্ষেত্রে নেহেরু সরকারকে সমর্থন দেবেন, তবে সরকারে আসন গ্রহণ করবেন না। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নেহেরু সরকারের ভুলভ্রান্তির তারা বিরোধিতা করে যাবেন।
এই নীতি সিপিআইকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্র সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে। দীর্ঘকাল পর ভারতের রাজনীতিতে এই একই নীতি গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছিল কয়েক বছর আগে বামফ্রন্টকে। দেশটিতে হিন্দুত্ববাদী অপশক্তি তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী ও একক দল ক্ষমতায় না থাকায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দীর্ঘকাল পর দেশটিতে তার সামরিক প্রভাব বিস্তারের চক্রান্ত সফল করতে চাচ্ছিল।
এ সময় বামফ্রন্ট সিদ্ধান্ত নেয়, তারা সাম্প্রদায়িক জোটের বিরুদ্ধে সোনিয়া-মনমোহন সিংয়ের সেকুলার কংগ্রেসী জোটকে ক্ষমতায় আসার কাজে সাহায্য জোগাবে। তারা তা জুগিয়েছে এবং কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় বসার পর দীর্ঘ সময় তারা এই সরকারকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছেন। অবশ্য তারা মন্ত্রিসভায় আসন নেননি। পরে নীতিগত প্রশ্নে এই সমর্থন তারা প্রত্যাহার করেন বটে, কিন্তু কংগ্রেস জোট সরকারের বিপদ তখন কেটে গিয়েছিল।
বাংলাদেশের জাতীয় পার্টি (এরশাদ) অবশ্যই বাম রাজনৈতিক দল নয়। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে হবে, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে গত নির্বাচনবিরোধী সন্ত্রাসী আন্দোলন ব্যর্থ করার ব্যাপারে জাতীয় পার্টি একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সফল করা এবং পরবর্তী পর্যায়ে মৌলবাদী সন্ত্রাসী জোট এবং একটি তথাকথিত সুশীল সমাজের সম্মিলিত হামলা থেকে নির্বাচন-পরবর্তী সরকারকে রক্ষা করার ব্যাপারেও দলটি তার সাধ্যমতো ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
সরকারকে শুধু সমর্থন দেয়া নয়, তারা সরকারে আসন গ্রহণও করেছে। একই সঙ্গে সরকারে আসন গ্রহণ এবং সরকারের বিরোধিতার কথা বলা একটি রাজনৈতিক দলের স্ববিরোধী নীতি মনে হতে পারে। কিন্তু জাতীয় সঙ্কটে এই ধরনের ভূমিকা গ্রহণ দলের জন্য না হলেও দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক হয় তার উদাহরণ আগেই দিয়েছি।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে বেগম রওশন এরশাদ বলেছেন, ‘সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে জাতীয় পার্টির সদস্যদের অচিরেই ফিরিয়ে আনা হবে। কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের জন্যই দলের নেতারা সরকার থেকে সরে আসবেন।’ বেগম রওশন এরশাদের মন্তব্যকে কেউ কেউ এই বলে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন যে, তিনি বুঝি মধ্যবর্তী নির্বাচন চান। কিন্তু এই বিশ্লেষণের কোনো অবকাশ নেই। একই সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি, বিএনপির দাবির সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই।’ অর্থাৎ বিরোধীদলীয় নেত্রী চান, বর্তমান সংসদ তার মেয়াদ পূর্ণ করুক। হয়তো মন্ত্রিসভা থেকে সরে এসে তারা বিরোধী দলের স্বাভাবিক ভূমিকা গ্রহণ করতে চান।
মন্ত্রিসভা থেকে সরে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জাতীয় পার্টি এখনও নেয়নি। দলনেতা এরশাদ সাহেব মন্ত্রিত্ব ত্যাগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে হয়তো সহমত পোষণ করবেন না। তবে আমার ধারণা, জাতীয় পার্টি যদি মন্ত্রিত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্তও নেয় (যা তারা এই মুহূর্তে নেবেন বলে মনে হয় না), তাহলেও তারা সরকারের ওপর সমর্থন প্রত্যাহার করবেন না। অগণতান্ত্রিক ও অশুভ শক্তির ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের মুখে তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার কাজে যে সচেষ্ট থাকবেন, তা বেগম রওশন এরশাদের কথার মধ্যেও স্পষ্ট।
বিএনপির বদলে জাতীয় পার্টি যদি দেশে সত্যিই বিরোধী দলের অবস্থান গ্রহণ করতে পারে, তাহলে এ কথা বলতে দ্বিধা করি না যে, আমি তাতে আনন্দিত হব। বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান এখন আর একটি গণতান্ত্রিক দলের নয়; এই অবস্থান এখন একটি সন্ত্রাসী দলের এবং তাদের ভূমিকাও রাষ্ট্রীয় আদর্শের বিরোধী, আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা এখন স্বাধীনতা যুদ্ধের মৌল আদর্শ, এমনকি জাতির পিতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণে দ্বিধা করছে না। স্বাধীনতার শত্রুদের সব স্লোগান ও প্রোপাগান্ডা এখন বিএনপির একমাত্র রাজনৈতিক মূলধন।
এ ক্ষেত্রে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার বিরোধিতার ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রের মৌল আদর্শের প্রতি আনুগত্য পোষণকারী একটি দলের আবির্ভাব ঘটে, দলটি শক্তি সঞ্চয় করে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করে এবং সে দলটি হয় জাতীয় পার্টি, তাকে দেশপ্রেমিক মানুষ মাত্রই অভিনন্দন জানাবে। বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এই অবস্থানে উঠে আসুক, সে কামনা আমি করি।
আমার দুর্ভাগ্য, আমি শেষ পর্যন্ত বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারিনি; এমনকি সেজন্য তার কাছে ক্ষমা চাইতেও পারিনি। ঢাকায় হাতে নানা ধরনের কাজ থাকায় এবং দেশের বাইরে কলকাতা, বাগডোরা, দার্জিলিংয়ে ছোটাছুটি করায় বেগম রওশন এরশাদের আমন্ত্রণ আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গ্রহণ করতে পারিনি। সেজন্যই সাক্ষাতে তাকে যে কথাগুলো বলতে পারিনি, আজ নিজের কলামে তা লেখার শুরুতে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
বেগম রওশন এরশাদের রাজনীতির সঙ্গে সহমত পোষণ না করলেও তার প্রতি আমার এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আছে। বর্তমান জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে তার পারফরম্যান্স কখনও কখনও চমৎকার। দেশের বর্তমান রাজনীতিতে অত্যন্ত দুরূহ ভারসাম্য রক্ষায় তিনি যে দক্ষতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দিচ্ছেন তা এক কথায় অনবদ্য। দেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক সঙ্কটে তার এই গঠনমূলক ভূমিকা ইতিহাসে হয়তো একদিন স্বীকৃতি পাবে।
দেশে এখন রাজনৈতিক সংঘাত আছে, গণতান্ত্রিক বিরোধিতা নেই। এই বিরোধিতার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ইচ্ছা না থাকলেও হয়তো একদলীয় শাসন ক্ষমতার অধিকারী হতো। বিএনপি ভীষ্মের শরশয্যা গ্রহণের মতো ইচ্ছামৃত্যুর পথ ধরে সংঘাতের রাজনীতিতে লিপ্ত রয়েছে। আন্দোলন নেই, আছে বিক্ষিপ্ত ও ব্যর্থ সন্ত্রাস। গত রোববারও বিএনপি ঢাকায় যা করেছে তা আত্মঘাতী গোল দেয়া ছাড়া আর কিছু নয়। বিএনপির সন্ত্রাসীরা যার গাড়ি পুড়িয়েছে, তা বিএনপি-নেত্রীরই উপদেষ্টা সাবিহউদ্দীন আহমদের। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়ার আরেক প্রভাবশালী উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর বাড়িতে হামলা হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর বেয়াই হলেও তার আসল পরিচয় তিনি খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর ও উপদেষ্টা। বিএনপির সন্ত্রাসীরা তার বাড়িতেই হামলা চালিয়েছে। বিএনপিকে যে ডেথ উইশে পেয়েছে এটা তার প্রমাণ।
এ ক্ষেত্রে বেগম রওশন এরশাদ তার জাতীয় পার্টি নিয়ে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তিনি দেশে গণতান্ত্রিক বিরোধিতার বদলে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে যে সন্ত্রাসী অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক শাসনকে ক্ষমতা ধরে রাখতে সমর্থন দিয়েছেন, এমনকি তাদের সহযোগী হয়েছেন। অন্যদিকে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক বিরোধিতার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ যে অনিবার্য একদলীয় শাসনক্ষমতার অধিকারী হতো, তা ঠেকিয়ে রাখার জন্য সংসদে বিরোধী দলের অবস্থানও গ্রহণ করেছেন।
এটা একটা রাজনৈতিক দলের পরস্পরবিরোধী ভূমিকা মনে হতে পারে। কিন্তু কোনো কোনো দেশে কোনো কোনো সময় এমন রাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হয়, যে অবস্থায় গণতন্ত্রের স্বার্থেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দলকে এ ধরনের স্ববিরোধী ভূমিকায় নামতে হয়। তাতে দলটির হয়তো ক্ষতি হয়। কিন্তু দেশের নাজুক গণতন্ত্র রক্ষা পায়। নজির হিসেবে প্রতিবেশী ভারতের কথা উল্লেখ করা যায়। দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর নেহেরুর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় বসে বটে, কিন্তু ক্ষমতায় বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এবং বাইরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চক্রান্তের সম্মুখীন হয় নেহেরু সরকার।
স্বাধীনতা লাভের বছরখানেকের মধ্যে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক চক্রের হাতে নিহত হন। ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের ভেতর থেকেই সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে একটি প্রতিক্রিয়াশীল অংশ নেহেরুর গণতান্ত্রিক ও সেকুলার রাষ্ট্রনীতিকে সাবোটাজ করার চক্রান্ত শুরু করে। বাইরে থেকে আমেরিকা তার নয়া সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের জালে ভারতকে বেঁধে ফেলার অপচেষ্টা চালায়।
এই সময় অবিভক্ত সিপিআই বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ছিল দেশটির বৃহত্তম দ্বিতীয় রাজনৈতিক দল। কথা ছিল তারা কংগ্রেসের বিরোধী দলের শক্তিশালী ভূমিকায় নামবেন। কিন্তু তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সিপিআই এমন এক নীতি গ্রহণ করে, যা পরে দলটির ভীষণ ক্ষতি করেছে; কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রকে মৌলবাদী অভ্যুত্থান ও সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য থেকে রক্ষা করেছে। সিপিআইয়ের তখনকার সিদ্ধান্তটি ছিল তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল নীতির ক্ষেত্রে নেহেরু সরকারকে সমর্থন দেবেন, তবে সরকারে আসন গ্রহণ করবেন না। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নেহেরু সরকারের ভুলভ্রান্তির তারা বিরোধিতা করে যাবেন।
এই নীতি সিপিআইকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্র সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে। দীর্ঘকাল পর ভারতের রাজনীতিতে এই একই নীতি গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছিল কয়েক বছর আগে বামফ্রন্টকে। দেশটিতে হিন্দুত্ববাদী অপশক্তি তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী ও একক দল ক্ষমতায় না থাকায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দীর্ঘকাল পর দেশটিতে তার সামরিক প্রভাব বিস্তারের চক্রান্ত সফল করতে চাচ্ছিল।
এ সময় বামফ্রন্ট সিদ্ধান্ত নেয়, তারা সাম্প্রদায়িক জোটের বিরুদ্ধে সোনিয়া-মনমোহন সিংয়ের সেকুলার কংগ্রেসী জোটকে ক্ষমতায় আসার কাজে সাহায্য জোগাবে। তারা তা জুগিয়েছে এবং কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় বসার পর দীর্ঘ সময় তারা এই সরকারকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছেন। অবশ্য তারা মন্ত্রিসভায় আসন নেননি। পরে নীতিগত প্রশ্নে এই সমর্থন তারা প্রত্যাহার করেন বটে, কিন্তু কংগ্রেস জোট সরকারের বিপদ তখন কেটে গিয়েছিল।
বাংলাদেশের জাতীয় পার্টি (এরশাদ) অবশ্যই বাম রাজনৈতিক দল নয়। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে হবে, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে গত নির্বাচনবিরোধী সন্ত্রাসী আন্দোলন ব্যর্থ করার ব্যাপারে জাতীয় পার্টি একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সফল করা এবং পরবর্তী পর্যায়ে মৌলবাদী সন্ত্রাসী জোট এবং একটি তথাকথিত সুশীল সমাজের সম্মিলিত হামলা থেকে নির্বাচন-পরবর্তী সরকারকে রক্ষা করার ব্যাপারেও দলটি তার সাধ্যমতো ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
সরকারকে শুধু সমর্থন দেয়া নয়, তারা সরকারে আসন গ্রহণও করেছে। একই সঙ্গে সরকারে আসন গ্রহণ এবং সরকারের বিরোধিতার কথা বলা একটি রাজনৈতিক দলের স্ববিরোধী নীতি মনে হতে পারে। কিন্তু জাতীয় সঙ্কটে এই ধরনের ভূমিকা গ্রহণ দলের জন্য না হলেও দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক হয় তার উদাহরণ আগেই দিয়েছি।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে বেগম রওশন এরশাদ বলেছেন, ‘সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে জাতীয় পার্টির সদস্যদের অচিরেই ফিরিয়ে আনা হবে। কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের জন্যই দলের নেতারা সরকার থেকে সরে আসবেন।’ বেগম রওশন এরশাদের মন্তব্যকে কেউ কেউ এই বলে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন যে, তিনি বুঝি মধ্যবর্তী নির্বাচন চান। কিন্তু এই বিশ্লেষণের কোনো অবকাশ নেই। একই সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি, বিএনপির দাবির সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই।’ অর্থাৎ বিরোধীদলীয় নেত্রী চান, বর্তমান সংসদ তার মেয়াদ পূর্ণ করুক। হয়তো মন্ত্রিসভা থেকে সরে এসে তারা বিরোধী দলের স্বাভাবিক ভূমিকা গ্রহণ করতে চান।
মন্ত্রিসভা থেকে সরে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জাতীয় পার্টি এখনও নেয়নি। দলনেতা এরশাদ সাহেব মন্ত্রিত্ব ত্যাগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে হয়তো সহমত পোষণ করবেন না। তবে আমার ধারণা, জাতীয় পার্টি যদি মন্ত্রিত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্তও নেয় (যা তারা এই মুহূর্তে নেবেন বলে মনে হয় না), তাহলেও তারা সরকারের ওপর সমর্থন প্রত্যাহার করবেন না। অগণতান্ত্রিক ও অশুভ শক্তির ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের মুখে তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার কাজে যে সচেষ্ট থাকবেন, তা বেগম রওশন এরশাদের কথার মধ্যেও স্পষ্ট।
বিএনপির বদলে জাতীয় পার্টি যদি দেশে সত্যিই বিরোধী দলের অবস্থান গ্রহণ করতে পারে, তাহলে এ কথা বলতে দ্বিধা করি না যে, আমি তাতে আনন্দিত হব। বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান এখন আর একটি গণতান্ত্রিক দলের নয়; এই অবস্থান এখন একটি সন্ত্রাসী দলের এবং তাদের ভূমিকাও রাষ্ট্রীয় আদর্শের বিরোধী, আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা এখন স্বাধীনতা যুদ্ধের মৌল আদর্শ, এমনকি জাতির পিতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণে দ্বিধা করছে না। স্বাধীনতার শত্রুদের সব স্লোগান ও প্রোপাগান্ডা এখন বিএনপির একমাত্র রাজনৈতিক মূলধন।
এ ক্ষেত্রে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার বিরোধিতার ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রের মৌল আদর্শের প্রতি আনুগত্য পোষণকারী একটি দলের আবির্ভাব ঘটে, দলটি শক্তি সঞ্চয় করে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করে এবং সে দলটি হয় জাতীয় পার্টি, তাকে দেশপ্রেমিক মানুষ মাত্রই অভিনন্দন জানাবে। বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এই অবস্থানে উঠে আসুক, সে কামনা আমি করি।
No comments