চাষী নজরুল ছিলেন অভিভাবক


চাষী নজরুল ইসলাম (২৩ অক্টোবর ১৯৪১—১১ জানুয়ারি ২০১৫)
চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের প্রস্থান অনেকের মনেই এক বিশাল শূন্যতার জন্ম দিয়েছে। কেউ অভিভাবক হারানোর শোকে আচ্ছন্ন। তারকাদের চোখে দেখা চাষী নজরুল ইসলাম ছিলেন বরাবরই এক মেধাবী নির্মাতা ও স্পষ্টবাদী মানুষ। তাঁরা বললেন প্রয়াত এই নির্মাতাকে নিয়ে আরও কিছু কথা
রাজ্জাক
সে ছিল মাস্টার: রাজ্জাক
১৯৬৫ সালের দিকে চাষীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ও তখন সহকারী পরিচালক, আর আমি তখনো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা একে অপরকে ‘দোস্ত’ বলে ডাকতাম। তার সঙ্গে প্রথম কাজ বাজিমাৎ ছবিতে। ওরা ১১ জন, শুভদাসহ চাষীর আরও কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছি। তার মতো পরিচালক হয় না। উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র তৈরিতে সে ছিল মাস্টার।
কবরী
ইশারায় তাঁকে সালাম দিলাম: কবরী

শুক্রবার চাষীকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। সিসিইউতে ছিলেন। ইশারায় কথা বললাম। জানতে চাইলাম চিনতে পেরেছেন কি না? তিনি মাথা নাড়লেন, চিনতে পেরেছেন। চাষীকে কোনো দিন আমি অতটা সম্মান দিয়ে কথা বলিনি। দেখা হলেই জোর গলায় বলতাম, ‘এই চাষী, কেমন আছেন? ভালো আছেন?’ আমাদের সম্পর্কটাই ছিল সে রকম। সেদিন কেন জানি ইশারায় তাঁকে সালাম দিলাম। তিনিও হাত তুলে সালাম নিলেন। চাষীর শারীরিক অবস্থা বলে দিচ্ছিল, তিনি চলে যাবেন। কিন্তু আমার কেন জানি মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার এখনো মনে হচ্ছে, চাষী মারা যাননি।
সোহেল রানা
দেশের মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে: সোহেল রানা

চাষী নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলার প্রথম মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন-এর পরিচালক। এই একটি কারণে হলেও বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন এ দেশের মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। কাজের কারণে চাষীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁর চলে যাওয়ায় এক বন্ধুকে হারালাম আমি।
সুচন্দা
সেই কণ্ঠ কানে বাজবে সব সময়: সুচন্দা

চাষী ভাই সত্যিকার অর্থে একজন ভালো মনের মানুষ ছিলেন। কোনো কথা বলতেই তিনি দ্বিধাবোধ করতেন না। স্পষ্টবাদী ছিলেন। কে কী বলবে না বলবে, এসব নিয়ে তাঁর ভাবনা ছিল না। আমার প্রযোজনায় তিনি বাসনা ও বেহুলা লখিন্দর নির্মাণ করেছিলেন। দরাজ কণ্ঠের মানুষ ছিলেন চাষী ভাই। অনেক মানুষের ভিড়েও মাইকেরও প্রয়োজন হতো না তাঁর! সেই দরাজ কণ্ঠ আর হয়তো শোনা হবে না। তাঁদের মতো মানুষের চলে যাওয়ায় চলচ্চিত্র অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ছে।
ফারুক
আমি বন্ধু হারালাম: ফারুক

শুনেছি, সে দিলীপ কুমারের অভিনয় খুব পছন্দ করত। সেই পছন্দ থেকে চাষী অভিনয় করার স্বপ্ন নিয়ে চলচ্চিত্রে আসে। এরপর তো সে নিজেই নির্মাণে অনেক বড় একটা জায়গায় চলে যায়। সে আমার বন্ধু ছিল। ছিল খুব মজার মানুষ। তার পরিচালনায় চারটি ছবিতে অভিনয় করেছি। এগুলো হলো বেহুলা লখিন্দর, পদ্মা মেঘনা যমুনা, দাঙ্গা ফ্যাসাদ ও মিয়া ভাই। এর মধ্যে মিয়া ভাই ছবিটি আমি প্রযোজনাও করি। সে যে কতটা ভার্সেটাইল, তার প্রমাণ তার ছবিগুলো। চাষীর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমি আমার ভালো বন্ধুকে হারালাম। আর চলচ্চিত্রশিল্প হারাল একজন অভিভাবক ও ভালো মানুষকে।
ববিতা
আপন মানুষেরা চলে যাচ্ছেন: ববিতা

সব আপন মানুষ একে একে চলে যাচ্ছেন। চলচ্চিত্রাঙ্গনে চাষী ভাইয়ের অবদান তাঁকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখবে। আমাদের চলচ্চিত্রকে তিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন তাঁর কাজ দিয়ে। তাঁর নির্দেশনায় আমি বিরহ ব্যথা, লেডি স্মাগলার, বেহুলা লখিন্দর, মিয়া ভাই, ভালো মানুষ ও হাসন রাজা ছবিতে অভিনয় করেছি। আমাদের তিন বোনের সঙ্গে চাষী ভাইয়ের সম্পর্কটা ছিল নিবিড়। পরিবারের বিভিন্ন সমস্যায় আমরা তাঁকে সব সময়ই কাছে পেয়েছি।
মৌসুমী
চাষী ভাই অভিভাবক ছিলেন: মৌসুমী

চাষী ভাই শুধু আমাদের নন, বাংলা চলচ্চিত্রের একজন অভিভাবক ছিলেন। তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল। কিছু স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন, কিছু অপূর্ণ রয়ে গেল। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন। একটি নয়, তাঁর তিনটি ছবিতে কাজ করেছি। এর মধ্যে দেবদাস আমার জীবনের স্মৃতিময় একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে। চাষী ভাইয়ের মতো অভিভাবককে আর কাছে পাব না, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।
শাকিব খান
স্যার আমার স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন: শাকিব খান

তাঁকে সম্মান করে ‘স্যার’ ডাকতাম। আমি দুর্ভাগা যে শহরের বাইরে থাকায় তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে পারিনি। তাঁর দুটি ছবিতে অভিনয় করেছি আমি—সুভা ও দেবদাস। দেবদাস ছিল আমার স্বপ্নের ছবি। স্যার আমার স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন। আমার সেই স্বপ্নপূরণের মানুষ, আমার অভিভাবক আজ চলে গেলেন। আমার হৃদয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন আমৃত্যু।
পূর্ণিমা
আমি যেন তাঁর পরিবারেরই সদস্য: পূর্ণিমা

চাষী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমার প্রথম ছবি মেঘের পরে মেঘ। আমাদের মধ্যে খুব ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমি যেন তাঁর পরিবারেরই সদস্য হয়ে উঠেছিলাম। আমার বিয়ের সময় অভিভাবক হিসেবে তিনি ছিলেন। আমার বাচ্চা হওয়ার খবর শুনে তিনি কোথা থেকে এসে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের বোঝাপড়ার জায়গাটা ছিল খুব পরিষ্কার।
অপু বিশ্বাস
কথা ছিল আরেকটি ছবি করার: অপু বিশ্বাস

চাষী আংকেলের মাত্র একটি ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছি আমি। তা ছিল দেবদাস। নির্মাতা হিসেবে তিনি যতটা বড়মাপের, কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম মানুষ হিসেবেও তিনি অনন্য। কথা ছিল তাঁর পরিচালনায় আরেকটি ছবিতে কাজ করার। কিন্তু তা আর হলো না।
গ্রন্থনা: মনজুর কাদের

No comments

Powered by Blogger.