ঢাকায় প্লট পেতে মরিয়া এমপিরা by কাজী সোহাগ
রাজধানী ঢাকায় প্লট পেতে মরিয়া সংসদ সদস্যরা। তারা ধরনা দিচ্ছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজউকে। বাদ যাচ্ছে না সংসদীয় কমিটির বৈঠকও। মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের টেবিলেও যাচ্ছে চাহিদাপত্র। পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও যোগাযোগ করছেন। এ নিয়ে রীতিমতো বিরক্ত মন্ত্রী। বেশির ভাগ এমপি দলীয় ও শরিক দলের হওয়ায় তাদের ফিরিয়েও দিতে পারছেন না। সব মিলিয়ে প্লট নিয়ে এমপিদের চাহিদার মুখে চাপের মুখে রয়েছেন মন্ত্রী। সমপ্রতি সংসদীয় কমিটির এক বৈঠকে এ মনোভাব তিনি প্রকাশও করেছেন। তারপরও থেমে নেই এমপিদের চাপ। রাজধানীতে প্লট তাদের চাই-ই চাই। ১৯৯১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত রাজউকের বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পে ৩৩৬ জন এমপিকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সংসদ সদস্য না হয়েও এমপি কোটায় রাজউক থেকে প্লট নেন প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা। এরা হলেন- সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক, সংসদীয় কমিটি ও সংসদ অধিবেশনের প্রশ্নোত্তরপর্ব তথ্যানুসন্ধানে এ চিত্র পাওয়া যায়। সংসদ ও সংসদ সদস্যদের কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, এটা রাজনীতি সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিবিদদের বড় একটি অংশ জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজের অবস্থানকে সম্পদ বৃদ্ধি ও সুযোগ-সুবিধা আদায়ের লাইসেন্স হিসেবে মনে করেন। গণতান্ত্রিক ধারার অগ্রযাত্রার জন্য এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে সংসদীয় কমিটির গত কয়েকটি বৈঠকে এমপিরা প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ দাবি করে আসছেন। বাদ নেই সংসদীয় কমিটির সভাপতিও। ঠাকুরগাঁও-২ আসন থেকে নির্বাচিত মো. দবিরুল ইসলাম নিজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সরাসরি মন্ত্রীর কাছে প্লট চেয়ে বসেন। এর আগে বরাদ্দ পাওয়া প্লটটি তিনি বিক্রি করে ফেলেছেন জানিয়ে তার নিজের নামে বা পরিবারের অন্য কারও নামে একটি প্লট বরাদ্দ দেয়ার অনুরোধ জানান। এতে বিব্রত হন মন্ত্রী। সভাপতির পথ অনুসরণ করে কমিটির অন্য সদস্যরাও নিজেদের জন্য প্লট বরাদ্দের দাবি জানান। এদিকে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্লট না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন কমিটির সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার। তিনি বলেন, অনেকেই একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট পাচ্ছেন। অথচ আমাকে একটাও বরাদ্দ দেয়া হয়নি। গত ২৩শে অক্টোবর সংসদীয় কমিটির বৈঠকে নতুন এমপিদের প্লট বরাদ্দের দাবি উত্থাপন করেন কমিটির সদস্য আবু সালেহ মোহাম্মদ সাঈদ (দুলাল)। তিনি বলেন, বিগত দিনে রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দশম সংসদের এমপিরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি ঝিলমিল বা পূর্বাচলে নতুন সদস্যদের প্লট বরাদ্দের বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ জানান। তার সঙ্গে একমত প্রকাশ করে কমিটির আরেক সদস্য বেগম নূরজাহান বেগম বলেন, প্রয়োজনে রাজধানীতে নতুন আবাসিক প্রকল্প গ্রহণ করে হলেও এমপিদের প্লট দিতে হবে। পরে এমপিদের চাপে কমিটির পক্ষ থেকে নতুন এমপিদের অনুকূলে আবাসিক প্লট বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়। ২৬শে জুন সংসদ অধিবেশনের প্রশ্নোত্তরে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন প্রশ্নোত্তরে জানান, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত রাজউকের বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পে ৩৩৬ জন এমপিকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তার দেয়া তথ্যমতে ২০০৬ সালে উত্তরা আবাসিক এলাকা/সম্প্রসারিত উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পে ৫৬ জন এমপিকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০০৫-০৬ সালে বনানী আবাসিক এলাকার এমপি ও একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীর নামে ২০ বিঘা প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০০৯ সালে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে দেয়া হয় ৫০ জনকে এবং ২০১৩ সালে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে আরও ২১ জন এমপিকে প্লট দেয়া হয়েছে। এছাড়া, ২০০৯ সালে সম্প্রসারিত উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পে আবাসিক এলাকায় ৮১ জন এবং রাজউক ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে ৪২ এমপি, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী সমমর্যাদাসম্পন্নদের নামে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর আগে গত বছরের ৬ই মার্চ অপর এক প্রশ্নোত্তরে মন্ত্রী জানান, নবম সংসদের ১৯৬ জন সংসদ সদস্য রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। একই দিন তিনি জানান, সংসদ সদস্য না হয়েও এমপি কোটায় রাজউক থেকে প্লট নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দুই প্রভাবশালী উপদেষ্টা। এরা হলেন-স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। ওই তথ্যে জানানো হয়, পূর্বাচল প্রকল্পে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের তালিকায় ৪৬ নম্বরে ছিল প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর নাম। ৬১ নম্বরে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানের নাম। তারা দু’জনেই সংসদ সদস্য না হলেও তালিকায় তাদের নামের পাশে বন্ধনী দিয়ে ‘এমপি’ লেখা ছিল। এছাড়া, তালিকায় আওয়ামী লীগ, মহাজোটের অন্যান্য শরিক দল, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য, বিরোধী দল বিএনপি এমনকি জামায়াতের সদস্যও ছিলেন। এদিকে নবম সংসদে ১৭ এমপি’র প্লট নেয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পূর্বাচল ও উত্তরা প্রকল্পে নিজেদের নামে প্লট থাকলেও হলফনামায় না দেয়ায় সমালোচিত হন তারা। এ নিয়ে সংসদীয় তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির সদস্য এস কে আবু বাকেরকে প্রধান করে তদন্ত কমিটির অপর তিন সদস্য ছিলেন- টি.আই.এম ফজলে রাব্বি, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও বজলুল হক হারুন। যদিও কমিটি শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কোন ধরনের তদন্তও করেনি।
No comments