হতবিহ্বল পোড়াবাড়িয়া by আশরাফুল ইসলাম ও মানিক আহমেদ
ফুটফুটে
নাদুস-নুদুস চেহারা। যেন গরিবের ঘরে রাজার দুলাল। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে
হতো পাড়া-প্রতিবেশী সবার। বড়ই আদুরে ছোট্ট সোহানের মুখজুড়ে খেলা করতো
রাজ্যের হাসি। সোহাগ-পারুল দম্পতির একমাত্র সন্তান হিসেবে পরিবারেও সে ছিল
চোখের মণি। মা-বাবার কোলজুড়ে শোভার মতোই মনোহর ছিল শিশু সোহান। স্নেহময়ী
মায়ের কোলে শুয়ে পরম নিরাপদে নিদ্রা যেত সে। কিন্তু সেই নিরাপদ কোলে শুয়েই
মায়ের অস্বাভাবিকতার নৃশংস বলি হতে হয়েছে তাকে। সন্তানহন্তারক হয়ে ওঠা মা
পারুল আক্তার (২৫) কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে তার চোখের
মণিকেই। সন্তানের রক্তমাখা কুড়াল দিয়েই নিজেকে আঘাত করে সন্তানের সহযাত্রী
হতে চেয়েছিল সে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পারুলও রয়েছে জীবনমৃত্যুর
সন্ধিক্ষণে। মঙ্গলবারের কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় পোড়াবাড়িয়া গ্রামে ঘটা এ
হৃদয়বিদারক ঘটনায় হতবিহ্বল পুরো গ্রাম। এলাকাবাসী জানান, পাকুন্দিয়া
উপজেলার নারান্দী ইউনিয়নের পোড়াবাড়িয়া গ্রামের মৃত চাঁন মিয়ার সঙ্গে জমি
নিয়ে বিরোধ ছিল একই গ্রামের আবদুল জব্বারের। বিরোধের জের ধরে গত বছরের ১০ই
অক্টোবর রাত ১০টায় উপজেলার শ্রীরামদী কোল্ডস্টোর বাজার থেকে বাড়িতে ফেরার
পথে খন্দকার বাড়ির মসজিদসংলগ্ন রাস্তায় চাঁন মিয়ার ওপর হামলা চালায়
প্রতিপক্ষের লোকজন। এ সময় চাঁন মিয়াকে তারা দা দিয়ে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে
গুরুতর আহত করে। চাঁন মিয়ার চিৎকার শুনে বাড়ি থেকে স্ত্রী মোমেনা আক্তার,
বড় মেয়ে পারুল আক্তার ও ছোট মেয়ে ইয়াসমিন ঘটনাস্থলে ছুটে গেলে তারাও
প্রতিপক্ষের লোকজনের লাঠিসোটার আঘাতে আহত হয়। পরে ১২ই অক্টোবর দুপুরে
বাজিতপুর জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চাঁন
মিয়ার মৃত্যু হয়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম খোকন, পোড়াবাড়িয়া
গ্রামের যুবক দিদারুল ইসলামসহ স্থানীয়দের ভাষ্য, পিতার মৃত্যুতেই মানসিক
ভারসাম্য হারায় পারুল। এরপর থেকে কারণে-অকারণে স্বামী, মা, ভাইবোনদের সঙ্গে
প্রায়ই ঝগড়া হতো তার। এ অবস্থায় মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পোড়াবাড়িয়া
গ্রামের পিত্রালয়ের বসতঘরে পারুল তার শিশুসন্তান সোহানকে কুড়াল দিয়ে
উপর্যুপরি কুপিয়ে গুরুতর আহত করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। শিশুসন্তানকে
হত্যার পর পারুল কুড়াল দিয়ে নিজেকে আঘাত করে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।
কুড়ালের কোপে তার মাথায় মারাত্মক জখম হয়। বিষয়টি জানার পর প্রতিবেশীরা
ঘটনাস্থল থেকে শিশুটির লাশ ও গুরুতর আহত পারুলকে উদ্ধার করে। পরে আশঙ্কাজনক
অবস্থায় পারুলকে রাত পৌনে ১০টায় কিশোরগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে রাতেই তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার রাতে ঘটনাস্থলে
গিয়ে দেখা গেছে, একমাত্র শিশুসন্তানের লাশ সামনে নিয়ে বিলাপ করে কাঁদছেন
রাজমিস্ত্রি পিতা সোহাগ মিয়া। একই অবস্থা মামা সোহেল (২২), খালা ইয়াসমিন
(১২) ও নানি মোমেনা আক্তারের। আদরের সোহানের এমন মৃত্যুকে হতবাক
আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও। প্রতিবেশী আফাজউদ্দিন (৬০), দিদার হোসেন
সরকার (২৫), মঞ্জুরুল হক (৬৫), শহীদ মিয়া (৩৫), জুয়েল মিয়াসহ (৩০) অনেকেই
বেদনার্ত কণ্ঠে জানান, ফুটফুটে শিশুটি এমন নির্মমতার শিকার হবে, তা তারা
কেউ ভাবতেই পারেননি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মামা সোহেল জানান, ৫-৬ বছর আগে
উপজেলার চরফরাদী ইউনিয়নের ঝাউগারচর গ্রামের হাইছু মিয়ার পুত্র সোহাগ মিয়ার
সঙ্গে তার বোন পারুলের বিয়ে হয়। বিয়ের ৩-৪ মাস পর থেকেই স্বামীকে নিয়ে
পারুল পিত্রালয়ে সংসার জীবন শুরু করে। এরই মধ্যে তাদের সংসারে আসে নতুন
অতিথি। বাবা-মামার নামের সঙ্গে মিলিয়ে সে নতুন অতিথির তারা নাম রাখেন
সোহান। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমারে অহন মামা বইল্যা ডাইক্যা ক্যাডা
জড়াইয়্যা ধরবো! পাকুন্দিয়া থানার ওসি জাকির রাব্বানী জানান, এ ঘটনায়
শিশুটির পিতা সোহাগ মিয়া বাদী হয়ে শিশুটির মা পারুল আক্তারকে আসামি করে
গতকাল সন্ধ্যায় থানায় মামলা করেছেন। এছাড়া কিশোরগঞ্জ জেলা হাসপাতাল মর্গে
দুপুরে শিশুটির লাশের ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
No comments