ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে সুন্দরবন
সুন্দরবনে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা
করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ঘটনায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপি গভীর উদ্বেগ
প্রকাশ করেছে। মঙ্গলবার ডুবে যাওয়া ট্যাংকারের ৩ লাখ ৫০ হাজার লিটার তেল
ছড়িয়ে পড়েছে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শেলা নদীতে। এতে সুন্দরবনের
জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে বিরল ইরাবতী ও
গাঙ্গেয় ডলফিনের বিচরণ ক্ষেত্রও। রয়েছে সুবিস্তৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের
বাগান। ৫৪ ঘণ্টা পর নিমজ্জিত তেলবাহী ট্যাংকারটি উদ্ধার করা হলেও সম্ভব
হয়নি ছড়িয়ে পড়া তেল শোধন করা। গতকাল সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা
আমির হোসাইন চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ফার্নেস তেল বনের বিভিন্ন খালে
ভাসমান রয়েছে। এ তেল অপসারণে স্থানীয় জেলে ও সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানানো
হয়েছে। তারা কাপড়ে ছেকে ও ফোম দিয়ে বিল থেকে তেল সংগ্রহ শুরু করেছেন।
ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যেই বন মন্ত্রণালয় ১০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির
উল্লেখ করে জিডি করেছে। যদিও দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবনের এই ক্ষতি
৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বলেছেন।
রাশিদুল ইসলাম, খুলনা থেকে জানান, সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ডুবে যাওয়া ফার্নেস তেলবোঝাই ট্যাঙ্কারটি ৫৪ ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ট্যাঙ্কারটি উদ্ধার করে মূল শেলা নদী থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ অফিস সংলগ্ন জয়মণি ঘোল এলাকায় নদীর তীরে টেনে আনা হয়। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে উদ্ধারকারী জাহাজ জোবায়দা-৩, জোবায়দা-৪, জ্বলন্ত ও ডিবি রাইজিং-৩ নিমজ্জিত ট্যাঙ্কারটি উদ্ধারে তৎপরতা শুরু করে। নৌবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করেন। এছাড়া ভাসমান তেল নষ্ট করতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজ কা-ারি-১০ দুপুর একটার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। জাহাজটি বর্তমানে এক ধরনের পাউডার ছিটিয়ে তেল নষ্ট করছে। এছাড়া, পদ্মা অয়েল কোম্পানির পক্ষ থেকে ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কারের তেল স্থানীয়রা সংগ্রহ করলে তাদের কাছ থেকে ক্রয় করা হবে বলে ঘোষণা দেন। এরপর কৃত্রিম উপায়ে স্থানীয়রা নদী ও খাল-বিল থেকে ফার্নেস তেল সংগ্রহ করা শুরু করেছে। পরিবেশবিদ ও নৌ-পরিবহন সেক্টরের সংশ্লিষ্টদের অভিমত এ ঘটনায় ১০০-৫০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে তেল ছড়িয়ে পড়া এলাকাটি সরকার ঘোষিত ডলফিনের অভয়াশ্রু। এছাড়া, সুন্দরবন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। জাতিসংঘের ওই দুই সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী সুন্দরবনের ভেতর এ এলাকা দিয়ে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। বন বিভাগ থেকে একাধিকবার এবং জাতিসংঘের জলাভূমি বিষয়ক সংস্থা রামসা’র কর্তৃপক্ষ, বিজ্ঞান-শিক্ষা ও ঐতিহ্য বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো থেকে নৌপথটি নিয়ে আপত্তি তুলে তা বন্ধের আহ্বান জানানো হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া, জলজ প্রাণী ও ম্যানগ্রোভ বনের প্রাণীকুলের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত এ তেল জোয়ার-ভাটার টানে ভাসছে নদী ও খালের পানিতে। সুন্দরবনসহ আশপাশের নদ-নদীর অন্তত ২০০ কিলোমিটার এলাকায় জুড়ে বিষাক্ত এ তেলের বিস্তার ঘটেছে। এতে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীসহ নদীর জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের কথা বলে থানায় জিডি ও বাগেরহাট আদালতে মামলা করেছে বনবিভাগ। অপরদিকে ট্যাঙ্কারটি উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও খোঁজ মেলেনি ট্যাঙ্কারের নিখোঁজ মাস্টার মোকলেছুর রহমানের। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, শুধু সুন্দরবনই নয় আশপাশ এলাকার জলসম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। ডুবে যাওয়া তেলবাহী জাহাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠান মেসার্স হারুন অ্যান্ড কোং-এর ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন জানান, তিনটি কার্গো জাহাজ ও স্থানীয় ডুবুরিদের সহায়তায় দেশীয় পদ্ধতিতে ডুবন্ত জাহাজটিকে তারা তীরের দিকে টেনে নেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ এটিকে খুলনা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সম্মেলন কক্ষে এক জরুরি সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান ড. শামসুদ্দোহা খন্দকার। সভা শেষে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আমির হোসাইন চৌধুরী জানান, ফার্নেস তেল বনের ভেতর বিভিন্ন খালে ভাসমান রয়েছে। ভাসমান এ তেল অপসারণে সহায়তা করার জন্য স্থানীয় জেলে ও সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানান বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান। পদ্মা অয়েল কোম্পানির পক্ষ থেকে ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কারের তেল স্থানীয়রা সংগ্রহ করলে তাদের কাছ থেকে কেনা হবে বলে ঘোষণা দেন। এরপর কাপড়ে ছেঁকে, ফোম বা অন্য কোন কৃত্রিম উপায়ে স্থানীয়রা নদী ও খাল-বিল থেকে ফার্নেস তেল সংগ্রহ করা শুরু করে। তিনি বলেন, প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ, বনবিভাগ, বিপিসি’র সঙ্গে যৌথ সভা শেষে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান সামছুদোহা খন্দকার বলেন, পুনরায় আদেশ না দেয়া পর্যন্ত শেলা নদী দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নদীতে ভেসে থাকা তেল স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় উত্তোলন করা হবে। তিনি আরও বলেন, এ চ্যানেল ছাড়াও বিকল্প অনেক চ্যানেল রয়েছে, সেগুলোতে পথ বেশি হবে, একটু বেশি ঘুরতে হবে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এদিকে শেলা নদী দিয়ে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সবধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সার্বিক প্রস্তুতি তদারকের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রফিকুল ইসলামকে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অপরদিকে যে জাহাজটির ধাক্কায় তেলবাহী ট্যাঙ্কারটি ডুবে যায় সেই ‘এমটি টোটাল’কে বৃহস্পতিবার ভোলায় আটক করা হয়েছে এবং জাহাজটির সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন সনদ স্থগিত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক জরুরি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বাগেরহাট জেলার মংলা থানার অন্তর্গত শেলা নদীর মৃগামারী এলাকায় তেলবাহী ট্যাঙ্কার ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ ডুবির কারণে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ রুটে সবধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। সভায় জানানো হয়, ডুবে যাওয়া তেলবাহী ট্যাঙ্কার ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ উদ্ধারসহ সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার খুবই আন্তরিক। এ বিষয়ে ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কার থেকে নির্গত তেল যাতে আর ছড়িয়ে পড়তে না পারে তা রোধ করার প্রচেষ্টাসহ সবধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। সভায় অন্যান্যের মধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দিক, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খন্দকার রাকিবুর রহমান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব ফয়েজ আহম্মদ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাসির আরিফ মাহমুদ ও যুগ্ম সচিব মো. সোহরাব হোসেন শেখ উপস্থিত ছিলেন।
সমুদ্রের জোয়ার ভাটার টানে এলাকা জুড়ে ভাসমান তেলের বিস্তার ঘটছে ক্রমেই। ট্যাঙ্কারটি উদ্ধারের পর এখন নিখোঁজ মাস্টারের উদ্ধারে বিরতিহীনভাবে স্থানীয় ডুবুরি দল, কোস্টগার্ড ও বনবিভাগ অভিযান চালাচ্ছে। ডুবে যাওয়া কার্গো মালিকপক্ষের দাবি এ দুর্ঘটনায় প্রায় ৮ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতিপূরণ দাবি করে মংলা থানায় মামলা হয়েছে। ট্যাঙ্কার মালিক গ্রুপের ম্যানেজার গিয়াস উদ্দিন বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেন। এদিকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ মাছ ও জলজ প্রাণীর অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কা বনবিভাগের। সম্ভাব্য ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ উল্লেখ করে গত মঙ্গলবার রাতে মংলা থানায় সাধারণ ডায়েরি করে বনবিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ থানায় ওই ডায়েরিটি করেন। এতে তিনি উল্লেখ করে বলেন, সুন্দরবনের নদীতে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও নোঙ্গর করে রাখাই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। সূত্র জানায়, বিশ্বে ইরাবতী ডলফিনের সবচেয়ে বড় বিচরণক্ষেত্র বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে ছড়িয়ে থাকা স্বাদু পানির নদী-খালগুলো। বনের দক্ষিণ দিকের তিনটি এলাকা ২০১১ সালে এই ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়, এর একটি চাঁদপাই রেঞ্জ। এ রেঞ্জের কাছেই সেলা নদীতে গত মঙ্গলবার সকালে ঘটেছে এ দুর্ঘটনায় যাতে একটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার থেকে ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ছে নদী-খালে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং ডলফিন সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণার কাজ করা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুন্দরবনের পূর্বদিকের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে এই দুর্ঘটনায় পড়ায় সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বিশ্বের বিপন্ন প্রজাতির ইরাবতী ডলফিন। স্থানীয়রা জানান, এই নদীতে দু’বার জোয়ার-ভাটা হয়। তেল এখন উত্তর-দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতি ২০-২৫ মিনিট পর শ্বাস নেয়ার জন্য গভীর পানি থেকে ডলফিন উঠে আসে। ফার্নেস অয়েলের ঘনত্ব মবিল, ডিজেলের মতো। পানির উপরিস্তরে ছড়িয়ে থাকা তেলের জন্য অক্সিজেন নিতে সমস্যা হবে তাদের। ফলে নিজ অভয়াশ্রমে ইরাবতী ডলফিনের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। মংলা চিলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবু তালেব বলেন, হালকা এ তেল দ্রুত আশপাশের নদীতে ছড়িয়ে পড়ছে। আর এ তেলের বিস্তার ঘটবে বে অব বেঙ্গল সমুদ্রসীমা পর্যন্ত। এ তেল প্রাণীর লিভার ফাংশান ধীরে ধীরে অকেজো করে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি আশেপাশের উদ্ভিদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা, নদী-খালের পাড়ে এসে যেসব প্রাণী পানি পান করে, তাদের ওপর প্রভাব পড়বে। তার মতে, বলতে গেলে নদী-খালের মাছ, বানর, হরিণ, গাছ-গাছালি সুন্দরবনের পুরো ইকোসিস্টেমই তেলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দীর্ঘমেয়াদি এর প্রভাব থাকবে সুন্দরবন জুড়ে। আর এখন যেহেতু অতিথি পাখি আসার সময়, তাই অতিথি পাখিগুলো পানির উপরের খাবারের সঙ্কটে পড়বে, তাদের মারা পড়ার আশঙ্কাও আছে বলে মনে করছেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক (পরিবেশ বিশেষজ্ঞ) ড. সরদার শফিকুল ইসলাম বলেন, এ কালো তেল ছড়িয়ে পড়লে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে অক্সিজেনের অভাবে সমস্যায় পড়বে ডলফিনসহ অন্য যে কোন জলজ প্রাণী। এই দুর্ঘটনার সম্ভাব্য প্রভাব পুরো সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পলিন টেমেসিস বুধবার এক বিবৃতিতে বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধের জন্য সরকারের কাছে আবারও আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ ধরনের বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চললে তা দীর্ঘ মেয়াদে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। পলিন টেমেসিস আরও বলেন, সুন্দরবনের যে এলাকাটিতে তেল ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে বিশ্বের বিপদাপন্ন দুই প্রজাতি গাঙ্গেয় ও ইরাবতী ডলফিনের বিচরণ। এ ছাড়া অনেক সমৃদ্ধ জলজ প্রাণী রয়েছে সেখানে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সুন্দরবনের ভেতরে জাহাজডুবিতে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, সরকার সুন্দরবনের গুরুত্ব সম্পর্কে নির্লিপ্ত থেকে তার সুরক্ষার পরিবর্তে বনটির ভেতর দিয়ে বড় বড় নৌযান চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। এই দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্য যথেষ্ট যে সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ হলেও তা কতটা অরক্ষিত এবং এর নিকটবর্তী নদী দিয়ে তেল, কয়লা বা বিষাক্ত বর্জ্য পরিবহন কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির ঘটনায় পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টির পর ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নূরুল করিমকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে আগামী ১৮ই ডিসেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. দীলিপ কুমার দত্ত, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ড. সুলতান আহমদ, খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (বাণিজ্যিক) ড. মো. রেজাউল হক, বিআইডব্লিউটিএ’র একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পরিচালক (বিপণন) মীর রেজা আলী, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি। এছাড়া, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন অধিশাখার উপ-সচিব সৈয়দ মেহ্দী হাসানকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে। এব্যাপারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, তদন্ত কমিটি এখনও কাজ শুরু করেনি। তবে আজ শুক্রবার সকালে কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কাজ শুরু করবেন। তিনি বলেন, ভাসমান তেলকে নদীর তলানিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কেমিক্যাল ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। আর ভাসমান তেল যদি নদীর তলদেশে খিতু হয়ে যায় তাহলে অনেকটা জীববৈচিত্র্য ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবে সুন্দরবন পর্যবেক্ষণ দলের ব্যানারে বাপা, বেলা, ক্লিন, সিএসআরএল, এফপিপি ও ম্যাপ-এর যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২ ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত ২০১০) এর আওতায় সুন্দরবনে পরিবেশগত দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হবে; জরুরিভিত্তিতে সুন্দরবনের নদী ও খাল থেকে তেল অপসারণের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। এ জন্য সম্মিলিত সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী নিয়োগ করতে হবে এবং দেশী ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত করতে হবে; যদিও কোন অর্থমূল্যে পরিবেশগত ক্ষতি পুরোপুরি থামানো যাবে না; তবুও তেল-দূষণের জন্য দায়ী কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে যাতে তেল অপসারণ ও বাদাবন পুনর্বাসনের খরচ মেটানো যায় এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা বন্ধ হয়; সুন্দরবনের ভেতর থেকে বাণিজ্যিক নৌযান স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে; তেল অপসারণের কার্যক্রম যথাযথভাবে করার জন্য তদারকির দায়িত্ব পরিবেশ মন্ত্রীকে গ্রহণ করতে হবে; জরুরি ভিত্তিতে তেল-দূষণ দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ক্রয়ে অবিলম্বে উদ্যোগ নিতে হবে। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সদস্য সচিব হাসান মেহেদী। এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন গৌরাঙ্গ নন্দী, এডভোকেট বাবুল হাওলাদার, মাহফুজুর রহমান প্রমুখ।
সুন্দরবনে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে সহায়তায় আগ্রহী উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ
সুন্দরবনের ভেতরে তেলবাহী জাহাজ ডুবে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপি’র বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর পলিন ট্যামেসিস গতকাল এক বিবৃতিতে এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস এবং পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক সহযোগীদের নিয়ে ওই বিশ্ব সংস্থার তরফে সরকারকে সহায়তার আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। বিবৃতিতে জাতিসংঘের ওই কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে এ ধরনের দুর্ঘটনা সচরাচর পরিবেশের ওপর দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব ফেলে। সেই পরিবেশের পুনঃসংরক্ষণে বহু প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়। বন সংলগ্ন জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল জনপদের ওপরেও এর প্রভাব পড়ে। তাই বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস এবং পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকারি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদের নিয়ে সরকারকে সহায়তা করতে জাতিসংঘ আগ্রহী। গতকাল সন্ধ্যায় ইউএনডিপি’র ঢাকা কার্যালয় থেকে পাঠানো ওই বিবৃতিতে ঘটনার প্রেক্ষিত উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, গত ৯ই ডিসেম্বরে দুর্ঘটনাকবলিত একটি জাহাজ থেকে সুন্দরবনের ভেতরে তেল নিঃসরণের সামপ্রতিক ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে ইউএনডিপি বাংলাদেশও উদ্বিগ্ন বোধ করছে। তেল নিঃসরণের এলাকাটি চাঁদপাই অভয়ারণ্য সংলগ্ন যা বাংলাদেশ সরকারকর্তৃক ঘোষিত সর্ববৃহৎ সংরক্ষিত জলাভূমি এবং গাঙ্গেয় ও ইরাবতী ডলফিন প্রজাতির বিচরণ ক্ষেত্র। সুন্দরবনের শেলা নদী পথে সকল প্রকার নৌযান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের যে খবর পত্রপত্রিকায় এসেছে তা প্রশংসনীয়। ওই সিদ্ধান্ত সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার কার্যক্রমকে আরও বেগবান করবে। যদিও ওই দুর্ঘটনা আরও একবার সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সকল প্রকার বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়। এদিকে বিবৃতিতে উল্লেখ না থাকলেও অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে এ ঘটনায় কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা অনুসন্ধানে জাতিসংঘের একটি উচ্চপর্র্যায়ের প্রতিনিধি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসতে পারে।
No comments