মানবাধিকার নাকি মানবিক ‘প্রহসন’ দিবস? -মাহফুজ আনাম
মানবাধিকার
দিবসটা একটা প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে দেশে লজ্জাজনকভাবে বিচারবর্হিভূত
হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, আশংকাজনক মাত্রায় মানুষ গুম হচ্ছে, এর চাইতেও বিরক্তিকর
হচ্ছে- যার সরকারের ভাবটা ‘কুছ পরওয়া নেহি’ কিংবা এসব কর্মকাণ্ডকে মৌন
সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে তাতে ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’কে ‘প্রহসন দিবস’
হিসেবে পালন করা যেতে পারে। একটা সময় ছিল যখন দারিদ্র্যের জন্য আমরা পরিচিত
ছিলাম। সেদিনগুলো সৌভাগ্যবশত এখন আমরা অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছি। উপরন্তু
আমরা এখন একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের দেশ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করছি।
ক্ষমতাসীন দলের পেশিশক্তির দ্বারা এসব কাজে কর্তৃত্ব আরোপ হচ্ছে এবং এর
চাইতেও বিরক্তিকর হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও তাতে ভূমিকা রাখছে।
প্রসিদ্ধ ও স্বনামধন্য মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রর তথ্যমতে,
২০০৭ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ২৫০ জন
লোক অপহরণের শিকার হয়েছেন। গত বছরই পুলিশ, র্যা ব কিংবা তাদের সহযোগীদের
দ্বারা ৬৯ জন লোককে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়। গত বছরের প্রথম দশ মাসে যাদেরকে
অপহরণ করা হয় তাদের ও পুলিশের মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১১৮ জন।
গত বছর বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণে।ডর ঘটনা ঘটেছে ২০৮টি। আটকাবস্থায়
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের দ্বারা মৃত্যু কিংবা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা
মর্মান্তিকভাবে একটা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসব ঘটনা আমাদের
সরকারের মনেও কোনো প্রভাব সৃষ্টি করছে না। সবচাইতে অবাক করা কাণ্ড হচ্ছে,
এসব ঘটনায় অভিভাবক হিসেবে সরকার ন্যূনতম দায়িত্ববোধও অনুভব করছে না। ভাবছে
না নাগরিকদের সম্পদ ও নিরাপত্তা নিয়ে। বর্তমান বিশ্বের মানবাধিকারের দিকে
দৃষ্টি দিলে দেখতে পাবো সেখানে সরকারের সঙ্গে জনণের সম্পর্কের বিষয়টা
পরিপূরক। তাদের সামষ্টিক ও স্বাতন্ত্র্য দুটি দিকই রয়েছে। সাম্প্রতিক
অতীতেও যেটা দেখে গেছে গণতন্ত্র প্রতিটি মানুষের মধ্যে শিকড় গেঁড়েছে। এর
গুরুত্ব ও অবস্থান মানুষের মধ্যে শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিল। সরকার
প্রতিটি জণগণের নিশ্চয়তায় কাজ করে। প্রতিটি মানুষের সমর্থন নিয়ে তৈরি হতো
সরকারের ক্ষমতার উৎস। একক ব্যক্তির দ্বারা একটি দেশ পরিচালনা সম্ভব হয় না,
তাই আমরা সরকার নির্বাচিত করি। একই সময়ে সরকারকে দেশ পরিচালনার জন্য আমরা
সংবিধানের পোশাক পরিয়ে দিই। এছাড়া রয়েছে আইন ও অন্যান্য নিয়ম-নীতি যাতে
সরকার একটি সুনির্দিষ্ট পথে দেশ চালাতে পারে। সরকার অধিক ক্ষমতাধর হলেও
তাকে এ আইন দ্বারা পরিচালনা করা যায়। কিন্তু সমস্যাটা তখনই তৈরি হয় যখন
সরকার আইনের সীমাকে লঙ্ঘন করা শুরু করে। আর ভাবটা এমন যে, তারা আইনেরও
ঊর্ধ্বের একটা বস্তু। এ ধরনের চিন্তাভাবনা সংসদের সঙ্গে সরকারের শক্তির
বিষয়টির তুলনা সামনাসামনি চলে আসে। এবং এটি ‘যা করছি তা সঠিক’ এ ধরনের
ভাবনা তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকারের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। আমরা
সহজেই এটা অনুমান করতে পারি যখন কোনো সরকার যখন সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা
লাভ করে। এ জায়গায় থেকেই আমাদের গল্পের মূল শুরুটা করতে চাচ্ছি। আমরা মনে
করি, সরকার নিজেকে কেবল আইনের ঊর্ধ্বের একটা বস্তু মনে করছে না, তারা মনে
করছে তারাই ‘আইন’। যখন কোনো সংসদে নামকাওয়াস্তে বিরোধী দল থাকে, আর এ দলটিই
যখন সরকারেও থাকে আবার বিরোধী পক্ষেও থাকে, একটি জোট থেকে যখন সংসদের
অর্ধেক আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায়- তখন বিষয়টা এ জায়গায় গিয়ে
দাঁড়ায় যে, কেউ ব্যালটে একটা ভোট না দিলেও সরকার গঠন করতে পারবে তারা। তখন
সরকার নিজেদেরকে ‘আইন’ এর সমতুল্য মনে করবে এটাই স্বাভাবিক। আর এ জন্যই
আমাদের সমাজব্যবস্থাটা ‘ঠগ নিয়ন্ত্রিত’ হয়ে যাচ্ছে। আর দায়মুক্তি সংস্কৃতির
আশির্বাদে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংস্থাগুলো জনগণের কাছে কোনো ধরনের
জবাব দিতে বাধ্য নয়। অথচ জনগণের সেবাই তাদের দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে
ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার শাহনূর আলমের ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। গত ২৯
এপ্রিল তাকে তোলে নিয়ে যায় র্যা ব সদস্যরা। ৩০ এপ্রিল তাকে নবীনগর পুলিশ
স্টেশনে হস্তান্তর করা হয়। ১ মে কোর্টে হাজার করা হলে তাকে স্থানীয়
কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। ৪ মে তাকে কুমিল্লার একটি হাসপাতালে
ভর্তি করা হয়। এসময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আটকের পর প্রথম দেখা হয়
শাহনূরের। সে তাদের কাছে কারাগারের নির্যাতনের নির্মম কষ্টের কথা জানায়। এর
পরদিনই মারা যান তিনি। র্যা ব ও পুলিশ উভয়েই দেশের স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান,
আইনের আওতায় তাদের জবাবদিহিতার সুযোগ রয়েছে। আদালত জনগণের অধিকার রক্ষায় এ
ক্ষেত্রে কাজ করবে। কেন শাহনূরের মামলায় ধীর গতি অবলম্বন হচ্ছে? গত ৪
ডিসেম্বর প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে মারা যাওয়া শাহনূরের
দুই মেয়ে চার বছর বযসী আরওয়া ও দশ বছর বয়সী রাইতা। সংবাদ সম্মেলনে তারা
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে বাবাকে কেন র্যা ব ধরে নিয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে
জানতে চায়। একই জায়গায় আরো সাত অভিযোগকারী জানতে চান, তাদের প্রিয়জনরা এখন
কোথায়, কিভাবে রয়েছে। তাদেরকে আইনশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্যরা শহরের বিভিন্ন
জায়গা থেকে তোলে নিয়ে আসে। এরপর থেকে তারা নিখোঁজ রয়েছে। আইন ও সালিশ
কেন্দ্রের কাছে আরো ভয়ঙ্কর সব ঘটনার খবর রয়েছে। এসব বিষয়ে একই দিন
বিবিসি’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আইন প্র্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন,
“এ ধরনের ঘটনার বিষয়ে আমি র্যা বকেও জিজ্ঞাসা করেছি, পুলিশকেও জিজ্ঞাসা
করেছি। তারা আমাকে জানিয়েছে, তারা কিছু জানে না।” বিষয়টির যেন এখানেই
সমাপ্তি। কেউ এর জন্য দায়ী নয়, আইন, আদালত ও গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের
কাছে কেউ জবাবদিহির মুখোমুখি নয়। এছাড়া আরো অনেক কথা রয়েছে। এগুলো তখনই
করার সাহস পায় যখন নির্বাচিত সরকার তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কারো কাছে
দায়বদ্ধ নয় এ পরিবেশ সৃষ্টি করে। দায়মুক্তির এ সংস্কৃতির জন্যই ‘ঠগ
নিয়ন্ত্রিত’ সমাজ তৈরি হচ্ছে বলে দাবি করতে পারি। আর এর ফলে বিষয়টা এখন এমন
হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং সরকারি দলের হলে
নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারবে। সে যা মন চায় তাই করতে পারবে এবং আক্ষরিক
অর্থে চাইলে খুনও করতে পারবে। এর সবকিছু তখনই শুরু হলো যখন আওয়ামী লীগ
তাদের আগের শাসনামলে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ও লুটের মতো মামলায় অভিযুক্তদের
মামলা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যা দিয়ে তুলে নেয়া শুরু করলো। একই
কায়দার আশ্রয় নেয়া হলো ক্ষমতাসীন দলটির ছাত্র ও যুব সংগঠনের কর্মীদের
ক্ষেত্রে। যত বেশি দায়মুক্তি, তত বেশি সন্ত্রাসের বৃদ্ধি, গভীরতা ও
প্রসার ঘটছে। যখন জনগণকে এটা বুঝানো যাচ্ছিল না যে, এগুলো সরকারের
নেতা-কর্মীদের কাণ্ড, তখনই বলা হলো- দলের নাম ভাঙিয়ে একটি পক্ষ সন্ত্রাস
চালাচ্ছে। শিগগির পুলিশ, র্যাব ও অন্যরা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। যখন মিডিয়া
চলমান সন্ত্রাসের ওপর দৃষ্টিপাত করলো, তারা দেখাল যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
সদস্যরা ব্যক্তি কিংবা অন্যদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নিজেদের
ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। দায়মুক্তির সংস্কৃতি বের হয়ে আশার ক্ষেত্রে আমরা
সম্ভবত একমাত্র আশার আলো দেখতে পেলাম র্যাবের সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে।
এতে দেখানো হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
২১ সদস্য জড়িত। এক্ষেত্রে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে পারি, প্রথম দিকে খুনের
ঘটনায় কোনো ধরনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল
র্যাব। হাইকোর্টের একটি রুলের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার তদন্ত করতে বাধ্য হয়
তারা। আর এ রুলে চরম অখুশি হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রকাশ্যে
নির্বাহী কাজে আদালতের হস্তক্ষেপের জন্য নিন্দা জানান। মানবাধিকার দিবসে
জোর করে জানতে ইচ্ছে করে, আজকের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আমরা কতটা স্বাধীন,
আমাদের মত প্রকাশ ও সমাবেশ করার স্বাধীনতা কতটুকু? ক্ষমতাবান মানুষদের
বিপক্ষে নিজের মতামত ব্যক্ত করার জন্য কেন মানুষদের জেল খাটতে হবে? কেন
নিয়মবর্হিভূতভাবে মানুষকে আটক করা হবে আর জেলে দেয়া হবে? কেন পত্রিকার
অফিসে পুলিশ অভিযান চালাবে? তথাকথিত ‘উসকানিমূলক সংবাদ’ প্রকাশের দোষ দিয়ে
সাংবাদিকদের জোর করে আটক করে নিয়ে আসবে? মিডিয়ার জবাবদিহিতার জন্য তো
প্রতিষ্ঠিত অভিযোগ কেন্দ্র রয়েছে। নিঃসন্দেহে বাতাসে স্বৈরাচারী শাসনের
গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এই ‘ঠগ নিয়ন্ত্রিত’ ব্যবস্থা বিরোধী মত দমনের জন্য একটি
অস্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ের দায়মুক্তির এ সংস্কৃতি থেকে
পুরোপুরি বের হয়ে আসা না গেলে এবং সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে
আমাদের গণতন্ত্র শিগগির একটি নাম মাত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে
পড়ে যাবে। [ডেইলি স্টার থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন: গোলাম ইউসুফ সাগর]
No comments