একসঙ্গে পথ চলার অঙ্গীকার সত্যার্থী’র
শিশুদের
কল্যাণে নিরলস কাজ করে চলেছেন এ বছর যৌথভাবে শান্তিতে নোবেলজয়ী কৈলাস
সত্যার্থী। শিশুদের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে, তাদের প্রাপ্য অধিকার
আদায়ে নিবেদিত প্রাণ তিনি। পরশু নোবেল গ্রহণ করতে গিয়ে অসলোতে বিশ্ব
নেতৃবৃন্দের সামনে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার শুরুতেও সম্বোধন করেছেন সবার আগে
শিশুদের প্রতি। বিশ্বের সকল প্রাণপ্রিয় শিশুদের আগে উল্লেখ করে অভিবাদন
জানিয়েছেন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং তার সঙ্গে নোবেলজয়ী মালালাকে।
বক্তব্যের শুরুতে তিনি বলেন, শান্তি ও মানবতার এ মঞ্চে দাঁড়িয়ে গর্বের
সঙ্গে প্রজ্ঞার প্রাচীন আঁধার বেদ থেকে একটি মন্ত্র আবৃত্তি করছি- ‘আসুন
একসঙ্গে পথ চলি। বৈশ্বিক প্রগতির লক্ষ্যে একজন মানুষেরও বাদ পড়া উচিত নয়,
বিশ্বের কোন কোনায় কারও পিছে পড়ে থাকা উচিত নয়, পূর্ব থেকে পশ্চিম, দক্ষিণ
থেকে উত্তর। আসুন এক কণ্ঠে কথা বলি, আমাদের সবার মন একাত্ম হোক,
পূর্বসূরিদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আসুন সবাই মিলে সবার জন্য
জ্ঞান তৈরি করি যা সবার উপকারে আসবে।’ এরপর তিনি অবনত মস্তকে শ্রদ্ধা
জ্ঞাপন করেন তার প্রয়াত পিতা-মাতা, মাতৃভূমি ভারত এবং মাতৃতুল্য পৃথিবীর
প্রতি। তিনি বলেন, প্রতিবার যখন একটি শিশুকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছি তখন
হাজারো বার মুক্তি লাভ করেছি নিজে। উষ্ণ হৃদয়ে আমি সে স্মৃতি স্মরণ করি।
তাদের সুন্দর মুখে স্বাধীনতার প্রথম হাসিতে আমি সৃষ্টিকর্তাকে হাসতে
দেখেছি। শিশুদের জন্য তার আন্দোলন প্রয়াসের সম্মানে নোবেল স্বীকৃতির
কৃতিত্ব তিনি দিয়েছেন ভারতের কালু কুমার, ধুম দাস, কিশোর এবং পাকিস্তানের
ইকবাল মাসিহকে- যারা শিশুদের স্বাধীনতা আর মর্যাদা রক্ষায় চূড়ান্ত ত্যাগ
স্বীকার করেছেন। এসব আত্মোৎসর্গকারী, বিশ্বব্যাপী আমার সহকর্মী এবং আমার
নিজ দেশের মানুষের পক্ষ থেকে আমি বিনয়ের সঙ্গে এ পুরস্কার গ্রহণ করলাম।
তিনি বলেন, নোবেল কমিটি আমাকে বক্তব্য দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
সম্মানের সঙ্গে বলছি আমি এটা করতে সক্ষম নই। আমি এখানে প্রতিনিধিত্ব করছি
নীরবতার শব্দের, নিষ্পাপতার আর্তচিৎকারের আর অদৃশ্যে মুখের। আমি এখানে
এসেছি আমাদের শিশুদের কণ্ঠ আর স্বপ্নের কথা বলতে। কেননা তারা সবাই আমাদেরই
শিশু। বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন শিশুরে সঙ্গে তার মর্মপীড়াদায়ক
আলাপচারিতার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমাদের শিশুদের স্বপ্নগুলো
প্রত্যাখ্যানের চেয়ে বড় কোন সহিংসতা নেই। আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য,
প্রতিটি শিশু হবে মুক্ত, স্বাধীন। বেড়ে উঠতে স্বাধীন, খেতে, ঘুমাতে, দিনের
আলো দেখতে মুক্ত, হাসতে, কাঁদতে আর খেলাধুলা করতে মুক্ত। শিক্ষা গ্রহণে,
বিদ্যালয়ে যেতে মুক্ত। সর্বোপরি স্বপ্ন দেখতে মুক্ত। তিনি বলেন, প্রতিটি
ধর্ম আমাদের বলে শিশুদের যত্ন করতে। যিশুখ্রিষ্ট বলেছেন, শিশুদের আমার কাছে
আসতে দাও, তাদেরকে বাধা দিও না, কেননা খোদার রাজত্ব তাদেরই। পবিত্র কোরআনে
বলা হয়েছে, দারিদ্র্যের কারণে তোমাদের সন্তান হত্যা করো না। কৈলাস বলেন,
আমি এটা মানতে নারাজ যে, সকল মন্দির, মসজিদ, চার্চ আর উপাসনালয়গুলোতে
আমাদের শিশুদের স্বপ্নের জন্য কোন স্থান নেই। সামরিক বাহিনীতে বিশ্বের
মাত্র এক সপ্তাহের ব্যয় যখন আমাদের সকল শিশুকে শ্রেণীকক্ষে নিয়ে যেতে
যথেষ্ট তখন আমি মেনে নিতে নারাজ যে আমাদের বিশ্ব দরিদ্র। শিশুদের অধিকার
আদায়ে মুক্তির সংগ্রামে যাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করেছেন তাদের প্রতি সম্মান
প্রদর্শন করে তিনি বলেন গত কয়েক দশকে অনেক উন্নতিও হয়েছে। বিদ্যালয়ের বাইরে
থাকা শিশুদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। শিশু মৃত্যুর হার এবং
পুষ্টিহীনতা কমেছে। শিশুশ্রমিকদের সংখ্যা বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ কমে এসেছে।
তবে, ভুলে গেলে চলবে না বড় অনেক চ্যালেঞ্জ এখনও রয়েছে। তিনি বলেন, মানবতার
দরজায় সব থেকে বড় যে সঙ্কটটি কড়া নাড়ছে তা হলো অসষ্ণিুতা। শিশুদের শিক্ষার
অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছি। তারপরও মালালার মতো নবীনরা
বিশ্বের নানা প্রান্তে উঠে এসেছে। সহিংসতার বদলে শান্তি, সংঘাতের বদলে
সহিষ্ণুতা আর শঙ্কার বদলে সাহসিকতা বেছে নিয়েছে। তিনি বলেন দ্রুত
বিশ্বায়নের যুগে আমরা বাস করি। দ্রুতগতির ইন্টারনেট গতিতে আমরা একসূত্রে
গাঁথা। কিন্তু সব থেকে গুরুতর একটি সংযোগহীনতা রয়েছে। তা হলো, সহমর্মিতার
অভাব। আসুন আমরা নিবিষ্ট চিত্তে প্রতিটি মানুষের সহমর্মিতাকে বৈশ্বিক
আন্দোলতে রূপান্তর করি। আসুন সহমর্মিতাকে বৈশ্বিক রূপ দিই। পরোক্ষ
সহমর্মিতা নয় বরং রূপান্তরযোগ্য সহমর্মিতা যা ন্যায়বিচার, সমতা আর
স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যাবে। জরুরি ভিত্তিতে আমাদের সমষ্টিগত পদক্ষেপ
প্রয়োজন। প্রতিটি মিনিট মূল্যবান, প্রতিটি শিশু মূল্যবান আর প্রতিটি শৈশব
মূল্যবান। এ কারণে আমি বিশ্বের সকল সরকার, আন্তঃসরকার সংস্থা, ব্যবসা
প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ এবং আমাদের প্রত্যেকের প্রতি
আহ্বান জানাই শিশুদের বিরুদ্ধে সকল ধরনের সহিংসতা বন্ধ করার জন্য। সভ্য
সমাজে দাসত্ব, মানব পাচার, শিশু শ্রম, যৌন হয়রানি আর অশিক্ষার কোন স্থান
নেই। বক্তব্যের শেষে তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যেককে আমাদের শিশুদের সঙ্গে
দাঁড়াতে হবে, আমাদের সাহসী হতে হবে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে হবে, ইচ্ছাশক্তি
থাকতে হবে। আমাদের অবশ্যই প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে। আজকের দিনই সময় যেদিন সকল
শিশুর জীবনের অধিকার থাকবে, স্বাধীনতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা,
মর্যাদা, সাম্যতা আর শান্তির অধিকার থাকবে। আজ আমি হাজারো মহাত্মা গান্ধী,
মার্টিন লুথার কিং এবং নেলসন ম্যান্ডেলাকে সদর্পে সামনে এগিয়ে যেতে দেখি আর
আমাদেরকে আহ্বান করতে দেখি। ছেলে মেয়েরা যোগ দিয়েছে। আমি যোগ দিয়েছি। আমি
আপনাদের যোগ দেয়ার আহ্বান জানাই। আসুন জ্ঞানকে গণতান্ত্রিক রূপ দেই,
ন্যায়বিচারকে সর্বজনীন করি। একসঙ্গে আমাদের শিশুদের জন্য আসুন সহমর্মিতাকে
বৈশ্বিক রূপ দিই। আমি অন্যায় থেকে শিক্ষার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই।
দরিদ্রতা থেকে সমষ্টিগত সমৃদ্ধি, দাসত্ব থেকে মুক্তি আর সহিংসতা থেকে
শান্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই। আসুন আমরা অন্ধকার থেকে আলোতে
এগিয়ে যাই। আসুন আমরা মরণশীলতা থেকে অমরত্বের দিকে যাত্রা শুরু করি। আসুন
আমরা এগিয়ে যাই।
No comments