ঝুনা খাইলে গুনা ডাব খাইলে মাফ by মোকাম্মেল হোসেন
এতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে বগল বাজানোর পর এ ধরনের কথা সহ্য করা কঠিন। আতর আলীর মাথা গরম হয়ে গেল। সে চোখ-মুখ লাল করে বলল-
: টিকেট নাই মানে?
পানখোর বুকিং ক্লার্ক আগে থেকেই ঠোঁট-জিহ্বা লাল করে বসে আছে। আতর আলীর লাল রঙ তার কাছে পাত্তা পেল না। তাচ্ছিল্যের সুরে সে বলল-
: নাই মানে নাই।
ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের প্লাটফরমে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট বিক্রির জন্য তিনটা কাউন্টারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এসব কাউন্টারে কম্পিউটার সামনে নিয়ে বসে থাকা প্রজাতন্ত্রের চাকরদের দেখেই বোঝা যায়- ব্যাটারা মহাচোর। চোরের সঙ্গে ন্যায়শাস্ত্র নিয়ে তর্ক করা বৃথা। আতর আলী চেহারায় অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বলল-
: ভাই, আমার ঢাকা যাওয়া খুব জরুরি।
লাল ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে তরমুজের বিচির মতো কালো দাঁত উঁকি মারল। চুন লাগানো পানের বোঁটায় কামড় বসিয়ে চপচপ আওয়াজ তুলে বুকিং ক্লার্ক বলল-
: আপনেরে যাইতে কে মানা করছে?
: টিকেট না পাইলে কেমনে যামু!
- বাসে যান।
আতর আলীর কাছে বাস কখনোই ট্রেনের বিকল্প নয়। ট্রেনের চেয়ে বাসের ভাড়া দ্বিগুণ। তাছাড়া পাঁচ বছর ধরে এপার বাংলার ফাটাকেষ্ট পান চিবুতে চিবুতে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক চারলেনে উন্নীত করার বাদ্য বাজাচ্ছেন। ফাটাকেষ্টর মুখের পান শেষ হচ্ছে না- উন্নয়নের গানও শেষ হচ্ছে না। ছিন্নভিন্ন রাস্তায় বাসের আরোহী হলে সময় নষ্ট হয়, শরীরের কলকব্জায় চোট পড়ে। এর বাইরে আছে দুর্ঘটনার ভয়। গরু-ছাগল শনাক্ত করার মেধা ও দক্ষতা নিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকাদের ব্যাপারে বাংলার মুকুটহীন মোঘল সম্রাট খান বাহাদুর শাহজাহান যতই গদগদ ভাব প্রকাশ করুক, আতর আলী কোনো ভরসা পায় না। গলায় বিস্ময়ের ঢেউ তুলে বুকিং ক্লার্ককে আতর আলী বলল-
: বাসে যাওয়ার পরামর্শ দিতেছেন কেন? আপনের বাস আছে নাকি?
- আমার বাস থাকত কেরে?
: না থাকাটাই তো অস্বাভাবিক। প্রতিদিন যেভাবে চুরি করতেছেন- তাতে তো শুধু বাস না, বিমান কিইন্যা ফেলার কথা!
বুকিং ক্লার্ককে দাঁত কিড়মিড় করতে দেখে আতর আলী সেখান থেকে দুই নম্বর প্লাটফরমে চলে এলো। এখানে সারি সারি চায়ের দোকান। বাজারে ঢোকার আগে এক কাপ চা খাওয়া যাক। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আতর আলীর মনে হল, এটা চা নয়- গরুর চনা। প্রথমে দেখনদারি- তারপর গুণবিচারি। দেখেই রুচি হচ্ছে না, স্বাদ কী রকম হবে- ভাবতে ভাবতে আতর আলী কাপে ঠোঁট ছোঁয়াল। রেলস্টেশনের চা বিশ্রী হয়। এটার স্বাদ ভয়াবহ রকমের বিশ্রী। এ রকম এক কাপ চায়ের জন্য ৫ টাকা খরচ হবে চিন্তা করতেই আতর আলীর কলিজা ফেটে রক্ত বের হওয়ার উপক্রম হল। টাকা-পয়সা ছাগলের লেদা না, ছাগল লেজ উঁচু করলেই তার পাছা দিয়ে হরহর করে ঝরে পড়বে। পয়সা উশুল করা দরকার। আতর আলী মুখ বিকৃত করে দোকানদারকে বলল-
: আমার অত্যধিক চিনি খাওয়ার অভ্যাস। গুইন্যা গুইন্যা চাইর চামচ চিনি কাপের মধ্যে ঢাইল্যা দেন।
চায়ের মামলা শেষ করে আতর আলী রেললাইন ধরে উত্তর দিকে হাঁটতে লাগল। হাতের বামপাশে মিন্টু কলেজ। মিন্টু কলেজের নাম অনেক লম্বা- আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজ। মিন্টু ৬৯-এর শহীদ। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে মিন্টু শহীদ হন। ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান শহীদ মিন্টুর নামে কেওয়াটখালির সিংহমার্কা বাড়িতে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতার পর কলেজটি এখানে স্থানান্তরিত হয়। শহীদ মিন্টুর স্মৃতি ও স্বীকৃতি বলতে এটুকুই। ৬৯ এর শহীদ বলতে সবাই আসাদের নাম উচ্চারণ করে। তাকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়। রাজধানীর বাইরে শহরে-বন্দরে মিন্টুর মতো শহীদদের নাম মনে রাখার ব্যাপারে জাতির কোনো আগ্রহ নেই। আতর আলীর বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল।
মিন্টু কলেজের সামনের রেললাইনে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাজার বসে। আতর আলী সেখানে পৌঁছে আতরজানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। আতরজান নামটা আতর আলীর দেয়া। বাসর রাতে আতর আলী নববধূকে বলেছিল-
: আজ থেইক্যা তোমার জীবনে একটার পর একটা পরিবর্তন ঘটতে থাকবে। ঠিক কিনা?
নববধূ মাথা নাড়ার পর আতর আলী পুনরায় বলে-
: পরিবর্তনটা নাম দিয়া শুরু হোক। তুমি হইলা এই আতর আলীর জান। এইজন্য তোমারে আমি আতরজান বইল্যা ডাকবাম। ঠিক আছে?
রিকশা থেকে নেমে আতরজান দেখল, আতর আলী রেললাইনের মাঝখানে উদাসীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এসে স্বামীর উদ্দেশে সে বলল-
: কুমবালা আইছুইন?
- একটু আগে।
: টিকেট পাইছুইন?
- নাহ!
: সাতদিন আগেও টিকেট পাওয়া যায় না?
- কেমনে পাওয়া যাইব? হারামজাদারা সব চোরের খাইট্টা। কম্পিউটার থেইক্যা সব টিকেট বাইর কইরা আগেই সাইড কইরা ফেলে।
: তাইলে ঢাকা যাওয়ার বুদ্ধি কী?
- ঢাকার চিন্তা পরে করি। আগে তোমার বাজার কী কী- কও।
পাঁচমিশালি গুঁড়ামাছ বিক্রি হচ্ছিল দেড়শ টাকা কেজি দরে। আতর আলী এক কেজি মাছ কিনে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল- পাশের মাছ বিক্রেতা দাড়িপাল্লায় একটা বোয়াল মাছ ওজন করছে। ওজন শেষ করে সে বলল-
: ৩ কেজি ৭০ গ্রাম। ১৫শ টেকা দেন স্যার।
এসময় পাশ থেকে একজন বলল-
: দাম কমাইয়া চা। ওনারে চিনস?
আতর আলী ভাবল, শহরের কোনো বড় ব্যবসায়ী হবে। ব্যবসায়ীদের পক্ষে দেড়-দুই হাজার টাকায় মাছ কেনা কোনো ব্যাপার না। মাছ বিক্রেতার কথা শুনে আতর আলীর ভুল ভাঙ্গল। মাছ বিক্রেতা বলল-
: কিতা কইন! চিনতাম না কেরে? এই স্যার আমরার ইউনো।
ইউএনও মানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার। আতর আলীকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আতরজান বলল-
: ও ঝমুরের আব্বা! খাম্বা হইয়া কী দেখতাছুইন?
- ইউনো সাবরে দেখতেছি!
: তারে দেখনের কী আছে?
- কত কিছু দেখনের আছে! দেখ, উনি আগের দিনের জমিদারদের মতো পাইক-পেয়াদা সঙ্গে লইয়া কী সৌন্দর্যজনকভাবে বাজার করবার আইছুইন। অনেক বছর আগে এই দেশ থেইক্যা জমিদাররা বিদায় হইলেও বাতাসের ভাবে মনে অইতেছে- তারা আবার কামব্যাক করতেছেন। তাদের মধ্যে কেউ উপজেলার জমিদার। কেউ জেলার জমিদার। কেউ বিভাগীয় জমিদার। আর সবার উপরে আছেন সেন্ট্রাল জমিদার। কিছু বুঝলা?
আতরজান না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। আতর আলী মুগ্ধ চোখে আতরজানের সরলতা পর্যবেক্ষণ করে বলল-
: ভেরি গুড। যত কম বুঝবা, তত শান্তিতে থাকবা। বেশি বুঝদারের জীবনে শান্তি থাকে না।
আতর আলীর বাসা শহরের নওমহল এলাকায়। বাসায় ফেরার পরপরই পাশের বাসার ইসহাক এসে হাজির। আতর আলীর মনোযোগ আকর্ষণ করে সে বলল-
: চল, একটা দরবার আছে।
- কিয়ের দরবার?
: বল্টু পীরের পোলারে লইয়া।
বল্টু পীরের প্রকৃত নাম লাল মিয়া। আগে সে চৌরঙ্গির মোড় বাজারে কাঁচামালের ব্যবসা করত। লাল মিয়া হঠাৎ একদিন স্বপ্নে পানিপড়ার তাবির পেয়ে নিজেকে পীর ঘোষণা করে বসে। লাল মিয়ার পানিপড়ার তেলেসমাতি নিয়ে এক সাংবাদিক স্থানীয় পত্রিকায় রিপোর্ট করার পর লাল মিয়া তাকে হুমকি দিয়ে বলেছিল-
: ব্যাটা আমারে চিনস? চান্দির মধ্যে এক্কেরে বল্টু মাইরা দিয়াম।
সেই থেকে লাল মিয়ার নাম হয়ে গেল বল্টু পীর। বল্টু পীর তার বাবার নামে একটা এতিমখানা খুলেছে। এতিমখানার সামনে সবাই হাজির হওয়ার পর দরবার শুরু হল। মহল্লার নিরাবত আলী বলল-
: বল্টু সাব, আপনার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ হইল, সে আমার নারকেল গাছ থেইক্যা ডাব চুরি করছে। অহন আপনে ছেলের কী বিচার করবাইন- করুইন।
বল্টু পীরকে খুব একটা বিচলিত মনে হল না। সে মৃদুহেসে উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে বলল-
: আপনেরা একটা ভুল বিষয় লইয়া মাথা গরম করতেছেন।
নিরাবত চিৎকার করে উঠল-
: ভুল বিষয় হইত কেরে! ঘটনা কি মিছা?
- আরে! হাছা-মিছার কথা না। আমি মারেফত ও শরীয়ত দুইটা লইয়াই কারবার করি। আপনেরা একটা বিষয় বুঝার চেষ্টা করুইন। আমার পোলা নারকেল চুরি করে নাই। চুরি করছে ডাব। ডাব মানে পানি। পানি খাইলে কি পাপ হয়? আমার মারেফতের জ্ঞান কয়- পাপ অয় না। তখনই পাপ অইব, যখন পানি আর পানি থাকব না; পানির মধ্য থেইক্যা নারকেল জন্ম লাভ করব। অহন আপনেরাই কইন- যে বিষয়ে কোনো পাপ নাই, সেই বিষয়ের ব্যাপারে আমি পোলার কী বিচার করবাম!
বাসায় ফেরার পথে আতর আলী মহা ভাবনায় পড়ে গেল। দেশের ছোট চোর, মাইজলা চোর, বড় চোর সবাই যদি মনে করে তারা নারকেল নয়, ডাব চুরি করছে- তাহলে তো কর্ম সাবাড়।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
: টিকেট নাই মানে?
পানখোর বুকিং ক্লার্ক আগে থেকেই ঠোঁট-জিহ্বা লাল করে বসে আছে। আতর আলীর লাল রঙ তার কাছে পাত্তা পেল না। তাচ্ছিল্যের সুরে সে বলল-
: নাই মানে নাই।
ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের প্লাটফরমে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট বিক্রির জন্য তিনটা কাউন্টারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এসব কাউন্টারে কম্পিউটার সামনে নিয়ে বসে থাকা প্রজাতন্ত্রের চাকরদের দেখেই বোঝা যায়- ব্যাটারা মহাচোর। চোরের সঙ্গে ন্যায়শাস্ত্র নিয়ে তর্ক করা বৃথা। আতর আলী চেহারায় অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বলল-
: ভাই, আমার ঢাকা যাওয়া খুব জরুরি।
লাল ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে তরমুজের বিচির মতো কালো দাঁত উঁকি মারল। চুন লাগানো পানের বোঁটায় কামড় বসিয়ে চপচপ আওয়াজ তুলে বুকিং ক্লার্ক বলল-
: আপনেরে যাইতে কে মানা করছে?
: টিকেট না পাইলে কেমনে যামু!
- বাসে যান।
আতর আলীর কাছে বাস কখনোই ট্রেনের বিকল্প নয়। ট্রেনের চেয়ে বাসের ভাড়া দ্বিগুণ। তাছাড়া পাঁচ বছর ধরে এপার বাংলার ফাটাকেষ্ট পান চিবুতে চিবুতে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক চারলেনে উন্নীত করার বাদ্য বাজাচ্ছেন। ফাটাকেষ্টর মুখের পান শেষ হচ্ছে না- উন্নয়নের গানও শেষ হচ্ছে না। ছিন্নভিন্ন রাস্তায় বাসের আরোহী হলে সময় নষ্ট হয়, শরীরের কলকব্জায় চোট পড়ে। এর বাইরে আছে দুর্ঘটনার ভয়। গরু-ছাগল শনাক্ত করার মেধা ও দক্ষতা নিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকাদের ব্যাপারে বাংলার মুকুটহীন মোঘল সম্রাট খান বাহাদুর শাহজাহান যতই গদগদ ভাব প্রকাশ করুক, আতর আলী কোনো ভরসা পায় না। গলায় বিস্ময়ের ঢেউ তুলে বুকিং ক্লার্ককে আতর আলী বলল-
: বাসে যাওয়ার পরামর্শ দিতেছেন কেন? আপনের বাস আছে নাকি?
- আমার বাস থাকত কেরে?
: না থাকাটাই তো অস্বাভাবিক। প্রতিদিন যেভাবে চুরি করতেছেন- তাতে তো শুধু বাস না, বিমান কিইন্যা ফেলার কথা!
বুকিং ক্লার্ককে দাঁত কিড়মিড় করতে দেখে আতর আলী সেখান থেকে দুই নম্বর প্লাটফরমে চলে এলো। এখানে সারি সারি চায়ের দোকান। বাজারে ঢোকার আগে এক কাপ চা খাওয়া যাক। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আতর আলীর মনে হল, এটা চা নয়- গরুর চনা। প্রথমে দেখনদারি- তারপর গুণবিচারি। দেখেই রুচি হচ্ছে না, স্বাদ কী রকম হবে- ভাবতে ভাবতে আতর আলী কাপে ঠোঁট ছোঁয়াল। রেলস্টেশনের চা বিশ্রী হয়। এটার স্বাদ ভয়াবহ রকমের বিশ্রী। এ রকম এক কাপ চায়ের জন্য ৫ টাকা খরচ হবে চিন্তা করতেই আতর আলীর কলিজা ফেটে রক্ত বের হওয়ার উপক্রম হল। টাকা-পয়সা ছাগলের লেদা না, ছাগল লেজ উঁচু করলেই তার পাছা দিয়ে হরহর করে ঝরে পড়বে। পয়সা উশুল করা দরকার। আতর আলী মুখ বিকৃত করে দোকানদারকে বলল-
: আমার অত্যধিক চিনি খাওয়ার অভ্যাস। গুইন্যা গুইন্যা চাইর চামচ চিনি কাপের মধ্যে ঢাইল্যা দেন।
চায়ের মামলা শেষ করে আতর আলী রেললাইন ধরে উত্তর দিকে হাঁটতে লাগল। হাতের বামপাশে মিন্টু কলেজ। মিন্টু কলেজের নাম অনেক লম্বা- আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজ। মিন্টু ৬৯-এর শহীদ। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে মিন্টু শহীদ হন। ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান শহীদ মিন্টুর নামে কেওয়াটখালির সিংহমার্কা বাড়িতে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতার পর কলেজটি এখানে স্থানান্তরিত হয়। শহীদ মিন্টুর স্মৃতি ও স্বীকৃতি বলতে এটুকুই। ৬৯ এর শহীদ বলতে সবাই আসাদের নাম উচ্চারণ করে। তাকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়। রাজধানীর বাইরে শহরে-বন্দরে মিন্টুর মতো শহীদদের নাম মনে রাখার ব্যাপারে জাতির কোনো আগ্রহ নেই। আতর আলীর বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল।
মিন্টু কলেজের সামনের রেললাইনে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাজার বসে। আতর আলী সেখানে পৌঁছে আতরজানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। আতরজান নামটা আতর আলীর দেয়া। বাসর রাতে আতর আলী নববধূকে বলেছিল-
: আজ থেইক্যা তোমার জীবনে একটার পর একটা পরিবর্তন ঘটতে থাকবে। ঠিক কিনা?
নববধূ মাথা নাড়ার পর আতর আলী পুনরায় বলে-
: পরিবর্তনটা নাম দিয়া শুরু হোক। তুমি হইলা এই আতর আলীর জান। এইজন্য তোমারে আমি আতরজান বইল্যা ডাকবাম। ঠিক আছে?
রিকশা থেকে নেমে আতরজান দেখল, আতর আলী রেললাইনের মাঝখানে উদাসীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এসে স্বামীর উদ্দেশে সে বলল-
: কুমবালা আইছুইন?
- একটু আগে।
: টিকেট পাইছুইন?
- নাহ!
: সাতদিন আগেও টিকেট পাওয়া যায় না?
- কেমনে পাওয়া যাইব? হারামজাদারা সব চোরের খাইট্টা। কম্পিউটার থেইক্যা সব টিকেট বাইর কইরা আগেই সাইড কইরা ফেলে।
: তাইলে ঢাকা যাওয়ার বুদ্ধি কী?
- ঢাকার চিন্তা পরে করি। আগে তোমার বাজার কী কী- কও।
পাঁচমিশালি গুঁড়ামাছ বিক্রি হচ্ছিল দেড়শ টাকা কেজি দরে। আতর আলী এক কেজি মাছ কিনে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল- পাশের মাছ বিক্রেতা দাড়িপাল্লায় একটা বোয়াল মাছ ওজন করছে। ওজন শেষ করে সে বলল-
: ৩ কেজি ৭০ গ্রাম। ১৫শ টেকা দেন স্যার।
এসময় পাশ থেকে একজন বলল-
: দাম কমাইয়া চা। ওনারে চিনস?
আতর আলী ভাবল, শহরের কোনো বড় ব্যবসায়ী হবে। ব্যবসায়ীদের পক্ষে দেড়-দুই হাজার টাকায় মাছ কেনা কোনো ব্যাপার না। মাছ বিক্রেতার কথা শুনে আতর আলীর ভুল ভাঙ্গল। মাছ বিক্রেতা বলল-
: কিতা কইন! চিনতাম না কেরে? এই স্যার আমরার ইউনো।
ইউএনও মানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার। আতর আলীকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আতরজান বলল-
: ও ঝমুরের আব্বা! খাম্বা হইয়া কী দেখতাছুইন?
- ইউনো সাবরে দেখতেছি!
: তারে দেখনের কী আছে?
- কত কিছু দেখনের আছে! দেখ, উনি আগের দিনের জমিদারদের মতো পাইক-পেয়াদা সঙ্গে লইয়া কী সৌন্দর্যজনকভাবে বাজার করবার আইছুইন। অনেক বছর আগে এই দেশ থেইক্যা জমিদাররা বিদায় হইলেও বাতাসের ভাবে মনে অইতেছে- তারা আবার কামব্যাক করতেছেন। তাদের মধ্যে কেউ উপজেলার জমিদার। কেউ জেলার জমিদার। কেউ বিভাগীয় জমিদার। আর সবার উপরে আছেন সেন্ট্রাল জমিদার। কিছু বুঝলা?
আতরজান না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। আতর আলী মুগ্ধ চোখে আতরজানের সরলতা পর্যবেক্ষণ করে বলল-
: ভেরি গুড। যত কম বুঝবা, তত শান্তিতে থাকবা। বেশি বুঝদারের জীবনে শান্তি থাকে না।
আতর আলীর বাসা শহরের নওমহল এলাকায়। বাসায় ফেরার পরপরই পাশের বাসার ইসহাক এসে হাজির। আতর আলীর মনোযোগ আকর্ষণ করে সে বলল-
: চল, একটা দরবার আছে।
- কিয়ের দরবার?
: বল্টু পীরের পোলারে লইয়া।
বল্টু পীরের প্রকৃত নাম লাল মিয়া। আগে সে চৌরঙ্গির মোড় বাজারে কাঁচামালের ব্যবসা করত। লাল মিয়া হঠাৎ একদিন স্বপ্নে পানিপড়ার তাবির পেয়ে নিজেকে পীর ঘোষণা করে বসে। লাল মিয়ার পানিপড়ার তেলেসমাতি নিয়ে এক সাংবাদিক স্থানীয় পত্রিকায় রিপোর্ট করার পর লাল মিয়া তাকে হুমকি দিয়ে বলেছিল-
: ব্যাটা আমারে চিনস? চান্দির মধ্যে এক্কেরে বল্টু মাইরা দিয়াম।
সেই থেকে লাল মিয়ার নাম হয়ে গেল বল্টু পীর। বল্টু পীর তার বাবার নামে একটা এতিমখানা খুলেছে। এতিমখানার সামনে সবাই হাজির হওয়ার পর দরবার শুরু হল। মহল্লার নিরাবত আলী বলল-
: বল্টু সাব, আপনার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ হইল, সে আমার নারকেল গাছ থেইক্যা ডাব চুরি করছে। অহন আপনে ছেলের কী বিচার করবাইন- করুইন।
বল্টু পীরকে খুব একটা বিচলিত মনে হল না। সে মৃদুহেসে উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে বলল-
: আপনেরা একটা ভুল বিষয় লইয়া মাথা গরম করতেছেন।
নিরাবত চিৎকার করে উঠল-
: ভুল বিষয় হইত কেরে! ঘটনা কি মিছা?
- আরে! হাছা-মিছার কথা না। আমি মারেফত ও শরীয়ত দুইটা লইয়াই কারবার করি। আপনেরা একটা বিষয় বুঝার চেষ্টা করুইন। আমার পোলা নারকেল চুরি করে নাই। চুরি করছে ডাব। ডাব মানে পানি। পানি খাইলে কি পাপ হয়? আমার মারেফতের জ্ঞান কয়- পাপ অয় না। তখনই পাপ অইব, যখন পানি আর পানি থাকব না; পানির মধ্য থেইক্যা নারকেল জন্ম লাভ করব। অহন আপনেরাই কইন- যে বিষয়ে কোনো পাপ নাই, সেই বিষয়ের ব্যাপারে আমি পোলার কী বিচার করবাম!
বাসায় ফেরার পথে আতর আলী মহা ভাবনায় পড়ে গেল। দেশের ছোট চোর, মাইজলা চোর, বড় চোর সবাই যদি মনে করে তারা নারকেল নয়, ডাব চুরি করছে- তাহলে তো কর্ম সাবাড়।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments