বার্লিন প্রাচীর ধসের ২৫ বছর by দাউদ হায়দার
জেলার নাম ভেডিং। ভূগোল এরকম : বার্নাউয়ার স্ট্রাসে (সড়ক)। মেট্রো রেলওয়ে স্টেশন। সামনে-পেছনে, ডাইনে-বাঁয়ে আরও চারটি প্রশস্ত সড়ক। বার্নাউয়ার স্ট্রাসে থেকে এক কিলোমিটার দূরেই হিটলারের সবচেয়ে শক্ত, মজবুত, পাথুরে-কংক্রিট বাংকার (মিত্রবাহিনী দুই হাজার টন বোমা ফেলেও ভাঙতে পারেনি)। ভেডিং জেলাসহ দক্ষিণ বার্লিন ফ্রান্সের দখলে। পশ্চিম বার্লিন আমেরিকার, উত্তর ব্রিটেনের। অর্থাৎ, অ্যালায়েড ফোর্সের ভাগে বার্লিন। তিন রকম প্রশাসন। সাধারণত বলা হয়, পশ্চিম বার্লিন। পূর্ব বার্লিনসহ গোটা পূর্ব জার্মানিই সোভিয়েত ইউনিয়নের দেখভালে। যদিও আলাদা সরকার, আলাদা প্রশাসন। পলিটব্যুরো আলাদা। পূর্ব জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সরকারি নাম সিইডি (সোসালিস্ট ইউনিয়ন অব ডেমোক্রেটিক)। দেশের নাম ডিডিআর (ডিডিআর- ডয়েচে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক। পশ্চিম জার্মানির নাম এফআরজি- ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি)।
বলা নেই কওয়া নেই, এত জায়গা রেখে কেন বার্নাউয়ার স্ট্রাসে বেছে নেয়া হল বার্লিন দেয়াল নির্মাণের (দেয়াল নির্মাণ ১৩ অগাস্ট ১৯৬১। দু’দিন আগে ১১ ও ১২ তারিখে কাঁটাতারের বেড়া) জন্য? এখনও কোনো নথিপত্র পাওয়া যায়নি। এমনকি স্টাসির (গুপ্ত পুলিশ) দফতরেও। বলা হচ্ছে, অনেক নথির সঙ্গে ওই নথিও গায়েব। তবে একটি নথি পাওয়া গেছে, বার্লিন দেয়াল নির্মাণের হুকুমদাতা ক্রুশ্চভ। তিনি ও কোসেগিন (তিন বছর পর কোসেগিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী) বার্লিন দেয়াল নির্মাণ কতটা সম্পন্ন, কতটা পাকাপোক্ত- দেখতে আসেন, তথা পরিদর্শন করেন। দেখে সুখী। পাঁচ মিটার উঁচু। পাঁচ ফুট চওড়া। কোনো কোনো দেয়ালের পাঁচিলের উপরে আবার তিন ফুট উঁচু কাঁটাতার। ১৬১ কিলোমিটার বার্লিন দেয়াল। পূর্ব জার্মানি-পশ্চিম জার্মানির সীমান্তে পাঁচিল নেই, দশ ফুটের কাঁটাতার। আগস্ট ১৯৬১ থেকে জুলাই ১৯৮৯ পর্যন্ত বেড়া-দেয়াল টপকে সীমান্ত অতিক্রমণের সময় পূর্ব জার্মানির ১৯১ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। বার্লিনেই নিহত হয় ৩০ জনের বেশি।
পশ্চিম বার্লিনকে বলা হয় (দেয়াল ধসের আগে) মিউজিয়াম। কেউ বলেন, দেয়ালঘেরা শহর। মিথ্যে নয়। আছি ১৯৮৭ সাল থেকে, পশ্চিম বার্লিনে। পশ্চিম জার্মানির যে অঞ্চল থেকেই আসুন- হোক তা গাড়িতে, ট্রেনে, প্লেনে- পূর্ব জার্মানি ক্রস করতেই হবে। একমাত্র প্লেন ছাড়া গাড়িতে বা ট্রেনে পশ্চিম বার্লিনে আসছেন, ঢোকার আগে চেকপয়েন্ট। বৈধ পাসপোর্ট দেখাতেই হবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। চেকপয়েন্টের পুলিশের মেজাজ মিলিটারির। কথা বলে না, চোখের ইশারা।
পশ্চিম বার্লিনে প্রৌঢ়-বুড়োবুড়ির চেয়ে জোয়ানজোয়ানির সংখ্যা বেশি (দেয়াল ধসের আগের কথা বলছি)। হেতু, ১৮ বছর হলেই দুই বা তিন বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদান, প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক, পশ্চিম জার্মানির যে অঞ্চলেই থাকুন না কেন। বাদ শুধু পশ্চিম বার্লিনের রেসিডেন্ট পারমিটধারী হলে। এ ছাড় অ্যালায়েড ফোর্সের।
বার্লিন দেয়াল ধসের ঘটনায় কোনো বিপ্লবী নেতা ছিল না। জনগণই নেতা, জনগণই বিপ্লবী। শুরু হয়েছিল পূর্ব বার্লিনেই। ফ্রাউ (শ্রীমতী) বারবেল বোলাই, প্রত্যেক রোববার পূর্ব বার্লিনসহ পূর্ব জার্মানির বিভিন্ন গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা শেষে বক্তৃতা করেন বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, অবাধ যাতায়াতের। গ্রেফতারও হন, ছাড়াও পান তিন মাস পর (১৯৮৮ সালে)। কিন্তু দমে যাননি। ডয়েচে ভেলের জন্য সাক্ষাৎকার নিই। প্রথম কথা, কেন দমে যাব, দমলে বিপ্লব হয় না।
পোল্যান্ডের বিখ্যাত দৈনিক গাতসেটা ভ্যেইবোরতসরার সম্পাদক আডাম মিচনিক লিখেছেন (৫ অক্টোবর ১৯৮৯), মে ও আগস্টে (১৯৮৮) গণবিক্ষোভ হয় পূর্ব বার্লিনে, ওয়ারশয়, প্রাগে, বুদাপেস্টে একই সঙ্গে, একই দিনে, কাকতালীয়ভাবে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়াই। এই বিক্ষোভ-মিছিলেই পরিষ্কার হয়ে যায় পূর্ব ইউরোপের ভাগ্য।
১৯৮৯ সালের বিপ্লবের ঘটনাসূত্র, পরম্পরা দেখুন পূর্ব ইউরোপে।
১. ৯ অক্টোবর (১৯৮৯)। পূর্ব জার্মানির লাইপজিগে, বেলা ৩টার আগেই ৭০ হাজারের বেশি মানুষ রাস্তায়, বিক্ষোভে। সন্ধ্যার আগে তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বিক্ষোভ, মিছিল, সমাবেশ, মিটিং পরিচালনা করছেন লাইপজিগের নিকোলাইকির্সের (নিকোলাই গির্জা) ধর্মযাজক ক্রিস্টিয়ান ফ্যুয়েরার। ডয়েচে ভেলের জন্য টেলিফোনে রিপোর্ট করছি। বিবিসির জন্যও। ক্রিস্টিয়ানের দাবি (পরে) বার্লিন দেয়াল ধসের সূচনা ৯ অক্টোবর, ৯ নভেম্বর নয়।
২. ১০ নভেম্বর। বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট নেতা তুদোর তিসফকোভ রক্তপাতহীন বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত।
৩. ১৭ নভেম্বর। চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগ, ভেলভেট রেভ্যুলেশন। ৫ লাখ মানুষ। বিক্ষোভ, মিছিল। নেতা বহুমান্য নাট্যকার ভাসলাভ হাভেল।
৪. ২৭ নভেম্বর। চেকোস্লোভাকিয়া সরকারের পতন।
৫. ১৬ ডিসেম্বর। রুমানিয়ায় শাসক নিকোলাই চসেস্কুর বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন।
৬. ২২ ডিসেম্বর। রুমানিয়ার সৈন্যরা চসেস্কুর বিরুদ্ধে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান কার্যালয় ঘিরে ফেলে বিদ্রোহী জনতা। একনাগাড়ে পাঁচ দিন। ধূলিস্যাৎ করার নির্দেশ দেন চসেস্কু; শুধু অমান্যই নয়, সৈন্যরাই চসেস্কুর বাড়ি দখল করে।
৭. ২৫ ডিসেম্বর। চসেস্কুর সংক্ষিপ্ত বিচার। একেবারে পাবলিকলি হত্যা, স্ত্রীসহ।
বলতে ভুলে গেছি, ১২ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) ১৯৮৯, পূর্ব জার্মানি থেকে শতাধিক মানুষ হাঙ্গেরিতে গিয়ে অস্ট্রিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে। ছুটে যান চ্যান্সেলর হেলমুট কোল এবং হান্স গেনশার (পররাষ্ট্রমন্ত্রী)। স্বাগত জানান। পশ্চিম জার্মানিতে আসার অনুমতি দেন। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে ১০ হাজার ডয়েচ মার্ক, চাকরি এবং বাড়ি বরাদ্দের অঙ্গীকার।
বার্লিন দেয়াল ধ্বংস করার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না পূর্ব বার্লিনের মানুষের। করেওনি। করেছে পশ্চিম বার্লিনের মানুষ এবং পশ্চিম জার্মান সরকার। ৯ নভেম্বর হাজার হাজার মানুষ ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের সামনের দেয়ালের ওপরে। লাফিয়ে পড়ছে পূর্ব বার্লিনের ঘেরা দেয়া অংশে, যদিও নো ম্যানস ল্যান্ড। পশ্চিম বার্লিনের মানুষই হাতুড়ি-শাবল দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করে, পাথর-কংক্রিটে তৈরি, এক লহমায় বা একদিনে ধ্বংস করা সহজ নয়। হাতুড়ি-শাবলে কিছু টুকরো ভাঙে বৈকি। সপ্তাহখানেক পর পশ্চিম জার্মান সরকারের নির্দেশে (মূলত হেলমুট কোলের নির্দেশে) বোর্নহোলমার স্ট্রাসের চেকপয়েন্ট খোলা হয় প্রথম, ৮ নভেম্বর রাত ৮টায়। তাও মাত্র কয়েকজনকে প্রবেশের অনুমতি, অধিকাংশই যুবক-যুবতী। হাতে পূর্ব জার্মানির পাসপোর্ট। রাত ১১টার পর কয়েকশ’। বার্লিনের প্রতিটি চেকপয়েন্ট খোলা হয় রাত ১২টার পর। প্রত্যেকের হাতেই পূর্ব জার্মানির পাসপোর্ট। বাংলাদেশের খালেকুজ্জামান বলেন, পাসপোর্ট ছাড়াই তিনি প্রবেশ করেন। এই প্রতিবেদকও। সারা রাত ইচ্ছেমতন অবাধ বিচরণ। বলার কেউ নেই। যেহেতু রাত ১২টার পর, সেই হিসাবে তারিখ ধরা হয় ৯ নভেম্বর।
বার্লিন দেয়ালে যে গ্রাফিটি, তা এঁকেছে পৃথিবীর নানা দেশের শিল্পী। ছবির নিচে কারও নাম নেই। দেয়ালের পশ্চিমাংশেই ছবি, পূর্বাংশে নয়। পূর্ব বার্লিনের কোনো ছবি আঁকিয়ের ছবি নেই। অসম্ভব। কারণ, দেয়ালের কাছে ঘেঁষলেই পুলিশের গুলি, মৃত্যু। পোটসডামার প্লাতসের দেয়ালে নানা আঁকিবুকির মধ্যে চোখ আটকায়, বিশাল অক্ষরে কে যেন কাঁচা হাতে বাংলায় লিখেছে : শালা।
দাউদ হায়দার : জার্মানি প্রবাসী কবি
বলা নেই কওয়া নেই, এত জায়গা রেখে কেন বার্নাউয়ার স্ট্রাসে বেছে নেয়া হল বার্লিন দেয়াল নির্মাণের (দেয়াল নির্মাণ ১৩ অগাস্ট ১৯৬১। দু’দিন আগে ১১ ও ১২ তারিখে কাঁটাতারের বেড়া) জন্য? এখনও কোনো নথিপত্র পাওয়া যায়নি। এমনকি স্টাসির (গুপ্ত পুলিশ) দফতরেও। বলা হচ্ছে, অনেক নথির সঙ্গে ওই নথিও গায়েব। তবে একটি নথি পাওয়া গেছে, বার্লিন দেয়াল নির্মাণের হুকুমদাতা ক্রুশ্চভ। তিনি ও কোসেগিন (তিন বছর পর কোসেগিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী) বার্লিন দেয়াল নির্মাণ কতটা সম্পন্ন, কতটা পাকাপোক্ত- দেখতে আসেন, তথা পরিদর্শন করেন। দেখে সুখী। পাঁচ মিটার উঁচু। পাঁচ ফুট চওড়া। কোনো কোনো দেয়ালের পাঁচিলের উপরে আবার তিন ফুট উঁচু কাঁটাতার। ১৬১ কিলোমিটার বার্লিন দেয়াল। পূর্ব জার্মানি-পশ্চিম জার্মানির সীমান্তে পাঁচিল নেই, দশ ফুটের কাঁটাতার। আগস্ট ১৯৬১ থেকে জুলাই ১৯৮৯ পর্যন্ত বেড়া-দেয়াল টপকে সীমান্ত অতিক্রমণের সময় পূর্ব জার্মানির ১৯১ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। বার্লিনেই নিহত হয় ৩০ জনের বেশি।
পশ্চিম বার্লিনকে বলা হয় (দেয়াল ধসের আগে) মিউজিয়াম। কেউ বলেন, দেয়ালঘেরা শহর। মিথ্যে নয়। আছি ১৯৮৭ সাল থেকে, পশ্চিম বার্লিনে। পশ্চিম জার্মানির যে অঞ্চল থেকেই আসুন- হোক তা গাড়িতে, ট্রেনে, প্লেনে- পূর্ব জার্মানি ক্রস করতেই হবে। একমাত্র প্লেন ছাড়া গাড়িতে বা ট্রেনে পশ্চিম বার্লিনে আসছেন, ঢোকার আগে চেকপয়েন্ট। বৈধ পাসপোর্ট দেখাতেই হবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। চেকপয়েন্টের পুলিশের মেজাজ মিলিটারির। কথা বলে না, চোখের ইশারা।
পশ্চিম বার্লিনে প্রৌঢ়-বুড়োবুড়ির চেয়ে জোয়ানজোয়ানির সংখ্যা বেশি (দেয়াল ধসের আগের কথা বলছি)। হেতু, ১৮ বছর হলেই দুই বা তিন বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদান, প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক, পশ্চিম জার্মানির যে অঞ্চলেই থাকুন না কেন। বাদ শুধু পশ্চিম বার্লিনের রেসিডেন্ট পারমিটধারী হলে। এ ছাড় অ্যালায়েড ফোর্সের।
বার্লিন দেয়াল ধসের ঘটনায় কোনো বিপ্লবী নেতা ছিল না। জনগণই নেতা, জনগণই বিপ্লবী। শুরু হয়েছিল পূর্ব বার্লিনেই। ফ্রাউ (শ্রীমতী) বারবেল বোলাই, প্রত্যেক রোববার পূর্ব বার্লিনসহ পূর্ব জার্মানির বিভিন্ন গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা শেষে বক্তৃতা করেন বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, অবাধ যাতায়াতের। গ্রেফতারও হন, ছাড়াও পান তিন মাস পর (১৯৮৮ সালে)। কিন্তু দমে যাননি। ডয়েচে ভেলের জন্য সাক্ষাৎকার নিই। প্রথম কথা, কেন দমে যাব, দমলে বিপ্লব হয় না।
পোল্যান্ডের বিখ্যাত দৈনিক গাতসেটা ভ্যেইবোরতসরার সম্পাদক আডাম মিচনিক লিখেছেন (৫ অক্টোবর ১৯৮৯), মে ও আগস্টে (১৯৮৮) গণবিক্ষোভ হয় পূর্ব বার্লিনে, ওয়ারশয়, প্রাগে, বুদাপেস্টে একই সঙ্গে, একই দিনে, কাকতালীয়ভাবে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়াই। এই বিক্ষোভ-মিছিলেই পরিষ্কার হয়ে যায় পূর্ব ইউরোপের ভাগ্য।
১৯৮৯ সালের বিপ্লবের ঘটনাসূত্র, পরম্পরা দেখুন পূর্ব ইউরোপে।
১. ৯ অক্টোবর (১৯৮৯)। পূর্ব জার্মানির লাইপজিগে, বেলা ৩টার আগেই ৭০ হাজারের বেশি মানুষ রাস্তায়, বিক্ষোভে। সন্ধ্যার আগে তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বিক্ষোভ, মিছিল, সমাবেশ, মিটিং পরিচালনা করছেন লাইপজিগের নিকোলাইকির্সের (নিকোলাই গির্জা) ধর্মযাজক ক্রিস্টিয়ান ফ্যুয়েরার। ডয়েচে ভেলের জন্য টেলিফোনে রিপোর্ট করছি। বিবিসির জন্যও। ক্রিস্টিয়ানের দাবি (পরে) বার্লিন দেয়াল ধসের সূচনা ৯ অক্টোবর, ৯ নভেম্বর নয়।
২. ১০ নভেম্বর। বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট নেতা তুদোর তিসফকোভ রক্তপাতহীন বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত।
৩. ১৭ নভেম্বর। চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগ, ভেলভেট রেভ্যুলেশন। ৫ লাখ মানুষ। বিক্ষোভ, মিছিল। নেতা বহুমান্য নাট্যকার ভাসলাভ হাভেল।
৪. ২৭ নভেম্বর। চেকোস্লোভাকিয়া সরকারের পতন।
৫. ১৬ ডিসেম্বর। রুমানিয়ায় শাসক নিকোলাই চসেস্কুর বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন।
৬. ২২ ডিসেম্বর। রুমানিয়ার সৈন্যরা চসেস্কুর বিরুদ্ধে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান কার্যালয় ঘিরে ফেলে বিদ্রোহী জনতা। একনাগাড়ে পাঁচ দিন। ধূলিস্যাৎ করার নির্দেশ দেন চসেস্কু; শুধু অমান্যই নয়, সৈন্যরাই চসেস্কুর বাড়ি দখল করে।
৭. ২৫ ডিসেম্বর। চসেস্কুর সংক্ষিপ্ত বিচার। একেবারে পাবলিকলি হত্যা, স্ত্রীসহ।
বলতে ভুলে গেছি, ১২ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) ১৯৮৯, পূর্ব জার্মানি থেকে শতাধিক মানুষ হাঙ্গেরিতে গিয়ে অস্ট্রিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে। ছুটে যান চ্যান্সেলর হেলমুট কোল এবং হান্স গেনশার (পররাষ্ট্রমন্ত্রী)। স্বাগত জানান। পশ্চিম জার্মানিতে আসার অনুমতি দেন। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে ১০ হাজার ডয়েচ মার্ক, চাকরি এবং বাড়ি বরাদ্দের অঙ্গীকার।
বার্লিন দেয়াল ধ্বংস করার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না পূর্ব বার্লিনের মানুষের। করেওনি। করেছে পশ্চিম বার্লিনের মানুষ এবং পশ্চিম জার্মান সরকার। ৯ নভেম্বর হাজার হাজার মানুষ ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের সামনের দেয়ালের ওপরে। লাফিয়ে পড়ছে পূর্ব বার্লিনের ঘেরা দেয়া অংশে, যদিও নো ম্যানস ল্যান্ড। পশ্চিম বার্লিনের মানুষই হাতুড়ি-শাবল দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করে, পাথর-কংক্রিটে তৈরি, এক লহমায় বা একদিনে ধ্বংস করা সহজ নয়। হাতুড়ি-শাবলে কিছু টুকরো ভাঙে বৈকি। সপ্তাহখানেক পর পশ্চিম জার্মান সরকারের নির্দেশে (মূলত হেলমুট কোলের নির্দেশে) বোর্নহোলমার স্ট্রাসের চেকপয়েন্ট খোলা হয় প্রথম, ৮ নভেম্বর রাত ৮টায়। তাও মাত্র কয়েকজনকে প্রবেশের অনুমতি, অধিকাংশই যুবক-যুবতী। হাতে পূর্ব জার্মানির পাসপোর্ট। রাত ১১টার পর কয়েকশ’। বার্লিনের প্রতিটি চেকপয়েন্ট খোলা হয় রাত ১২টার পর। প্রত্যেকের হাতেই পূর্ব জার্মানির পাসপোর্ট। বাংলাদেশের খালেকুজ্জামান বলেন, পাসপোর্ট ছাড়াই তিনি প্রবেশ করেন। এই প্রতিবেদকও। সারা রাত ইচ্ছেমতন অবাধ বিচরণ। বলার কেউ নেই। যেহেতু রাত ১২টার পর, সেই হিসাবে তারিখ ধরা হয় ৯ নভেম্বর।
বার্লিন দেয়ালে যে গ্রাফিটি, তা এঁকেছে পৃথিবীর নানা দেশের শিল্পী। ছবির নিচে কারও নাম নেই। দেয়ালের পশ্চিমাংশেই ছবি, পূর্বাংশে নয়। পূর্ব বার্লিনের কোনো ছবি আঁকিয়ের ছবি নেই। অসম্ভব। কারণ, দেয়ালের কাছে ঘেঁষলেই পুলিশের গুলি, মৃত্যু। পোটসডামার প্লাতসের দেয়ালে নানা আঁকিবুকির মধ্যে চোখ আটকায়, বিশাল অক্ষরে কে যেন কাঁচা হাতে বাংলায় লিখেছে : শালা।
দাউদ হায়দার : জার্মানি প্রবাসী কবি
No comments