ভুয়া ডাক্তার থেকে সাবধান
ডা. রানা রহমান ওরফে আলম (ভুয়া ডাক্তার)। টেনেটুনে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। এই শিক্ষার জোরেই এখন তিনি অভিজ্ঞ ডেন্টিস্ট। তার নামের শেষে বিশেষণ হিসেবে আছে পিডিডিএস, ঢাকা নামের ডিগ্রি। এই পিডিডিএসের ব্যাখ্যা রানা নিজেও জানেন না। রাজধানীর পল্লবীতে স্বপ্নিল ডেন্টাল কেয়ার নামে আলিশান চেম্বারও আছে তার। সেখানেই এ ভুয়া ডাক্তার রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। তার অনুপস্থিতিতেও চলে এই চেম্বার।
সম্প্রতি র্যাবের অভিযানে ধরা পড়েছেন এই ডাক্তার নামধারী প্রতারক। মোবাইল কোর্ট তাকে এক বছরের সাজা ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই মাসের সাজা দিয়েছেন। রানা কারাগারে থাকলেও তার চেম্বারটি এখনও চলছে। তার দূরসম্পর্কের ভাই রিয়াদ ডাক্তার না হয়েও চালিয়ে নিচ্ছেন চেম্বারটি। নিয়মিত দেখছেন রোগী।
ভুয়া ডাক্তারদের চিকিৎসা বন্ধ করতে বিএমডিসির ভূমিকা কি জানতে চাইলে বিএমডিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান যুগান্তরকে বলেন, যে আইনে মোবাইল কোর্টে তাদের সাজা হচ্ছে, ওই আইন সংশোধন করে সাজার মেয়াদ বাড়াতে হবে। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সরকারকে দেয়া হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তাদের যে মেয়াদের সাজাই হোক তারা যদি জামিনে বেরিয়ে আসার সুযোগ না পেত তাহলে হয়তো অন্যরা ভয়ে এ পেশা ছেড়ে দিত।
বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন-২০১০ এর ২২ ধারা ১ উপধারায় বলা আছে, অন্য কোনো আইনে যাই থাকুক না কেন, এই আইনের অধীন নিবন্ধন ব্যতীত কোনো মেডিকেল চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসক অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা করতে অথবা নিজেকে মেডিকেল চিকিৎসক বলে পরিচয় দিতে পারবেন না। ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কেউ ১ উপধারার লংঘন করলে তিনি তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ঢাকা জেলা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল যুগান্তরকে বলেন, মোবাইল কোর্টে যে সাজা দেয়া হয় তা নিতান্তই অপ্রতুল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জরিমানার টাকা দিয়ে অথবা কিছুদিন জেল খেটে ভুয়া ডাক্তাররা জামিনে বের হয়ে একই পেশায় ফিরে যায়। এক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন সংশোধন করে সাজার মেয়াদ বৃদ্ধি করা উচিত।
রোববার বিকালে ভুয়া ডাক্তার রানার সেল নম্বরে ফোন দিলে, রিসিভ করেন এক নারী। চিকিৎসা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ডা. রানার স্ত্রী পরিচয় দেন। বলেন, রানা দেশের বাইরে আছেন। মাসখানেক চিকিৎসা করতে পারবেন না। মোবাইল কোর্টের হাতে ধরা পড়ে সাজার বিষয়ে গোপন করেন তিনি। মোবাইল কোর্ট কেন রানাকে সাজা দিয়েছে জানতে চাইলে রানার স্ত্রী অত্যন্ত কৌশলে বলেন, অন্য একটি ডেন্টাল ক্লিনিকের ডাক্তার দুশমনি করে তার স্বামীকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছুই তিনি জানেন না। রানার স্ত্রী বলেন, তার স্বামী জেল থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত দেবর রিয়াদ রোগীদের চিকিৎসা দেবেন। এই রিয়াদকে এমবিবিএস ডাক্তার বলেও দাবি করেছেন রানার স্ত্রী। রিয়াদ কোন হাসপাতালের ডাক্তার এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো হাসপাতালের না, উনি আমার খালাতো দেবর। অনেক অনেক ভালো ও বড় ডাক্তার। আপাতত তার কাছে দেখাতে পারেন।
রানা কিংবা রিয়াদই নয়; রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো ভুয়া ডাক্তারের চেম্বারের সন্ধান পাওয়া গেছে। খোদ মিরপুরে একদিনে এ ধরনের ৯টি চেম্বারে ৯ জন ডেন্টিস্টকে সাজা দিয়েছেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আল আমীন। তারা এখন জেলহাজতে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. আবু সাফি আহমেদ আমিন যুগান্তরকে বলেন, কোনো মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করার পর বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন নিয়ে একজন ডাক্তার হিসেবে চিকিৎসাসেবা দেয়ার অধিকার অর্জন করেন। এর বাইরে যারা চিকিৎসা করে তারা স্রেফ প্রতারক। এ ধরনের কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই প্রতারকদের কাছ থেকে সবাইকে সাবধান থাকার আহ্বান জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর শহরতলি এলাকায় এদের বিচরণ বেশি। ডেমরা, কোনাপাড়া, শ্যামপুর, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, শাহ্আলী, পল্লবী, রূপনগর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, টঙ্গী ও আমিনবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ভুয়া ডাক্তারের ক্লিনিক ও চেম্বার আছে। চিকিৎসার নামে তারা রোগীর সঙ্গে প্রতারণা করছে। এরা চিকিৎসার নামে আদায় করছে মোটা অংকের টাকা।
ভুয়া ডাক্তাররা ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন, সিঙ্গাপুরসহ দেশী-বিদেশী নামিদামি মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী পরিচয়ও দিচ্ছে। তৈরি করছে জাল সার্টিফিকেট। এসব সার্টিফিকেট তৈরি ও বিক্রির একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে। রোগীদের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করতেই এসব মিথ্যা বিশেষণ যোগ করা হয়।
এমনই একজন ডাক্তার মো. আজাদুল ইসলাম। তার নামের শেষে আরএমপি (ভিডি), ডিডিটি (ঢাকা), ডিডিটি (কলকাতা), বিডিএ (কলকাতা) লেখা। তার ক্লিনিকের নাম উপশম ডেন্টাল কেয়ার। ঠিকানা যাত্রাবাড়ীর কোনাপাড়ায়।
সূত্র জানায়, এসব চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে রোগীরা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছে। পাশাপাশি রোগমুক্ত না হয়ে আরও বড় ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এমনই এক রোগী শোভা আক্তার। তিনি জানান, তার বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। মাস দুই আগে তিনি কুমিল্লা থেকে মেয়ের বাড়ি যাত্রাবাড়ীর কোনাপাড়ায় আসেন। তার একটি দাঁত যন্ত্রণা করত। তিনি কোনাপাড়ায় অ্যাপোলো ডেন্টাল ক্লিনিকে ভুয়া ডাক্তার ফিরোজ সিকদারের কাছে চিকিৎসার জন্য যান। প্রথমে কথিত ডাক্তার ৩০০ টাকা ফি নিয়ে তার চিকিৎসা দেন। ১০ দিন পর আবার আসতে বলেন চেম্বারে। ১০ দিন পর একটি দাঁত উঠিয়ে চার হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর বলেন, আরও দুটি দাঁত নষ্ট, ১৫-২০ দিনের মধ্যে তুলতে হবে। রোগীর একটি দাঁতে সমস্যা হলেও ডাক্তার জোর করে ৩টি দাঁত তুলে ফেলে। কয়েক দফায় মোট ১৪ হাজার টাকা নিয়েছে তার কাছ থেকে।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিএমডিসি, জেলা প্রশাসন, র্যাব, পুলিশ যৌথ উদ্যোগে ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট চালানো অব্যাহত রয়েছে। মোবাইল কোর্টে অর্থদণ্ড কিংবা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেও তারা পেশা বদলাচ্ছে না। কারাগার থেকে বেরিয়ে আবার আগের পেশায় ফিরে যাচ্ছে। এটি মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে ভুয়া ডাক্তারদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমডিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান যুগান্তরকে বলেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব সবার। মানুষকে সচেতন হতে হবে। সাইনবোর্ডে কিংবা প্যাডে বিএমডিসির রেজিস্ট্রশন নম্বর দেখে প্রকৃত চিকিৎসক কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে মানুষকে। ভুয়া ডাক্তারদের চিকিৎসা বন্ধ করতে বিএমডিসির ভূমিকা কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএমডিসির ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই। এছাড়া লোকবলের অভাব। দেশে ভূরি ভূরি ভুয়া ডাক্তার। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে হাজার হাজার মামলা করতে হবে। এটি ব্যয়সাপেক্ষ। এত টাকা ব্যয় করা বিএমডিসির পক্ষে অসম্ভব।
২২ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী কোনাপাড়ায় দুই ভুয়া ডাক্তারকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালত। নামের আগে ডাক্তার বিশেষণ দিয়ে ক্লিনিক পরিচালনা ও চিকিৎসা দেয়ার অভিযোগে গ্রামীণ সবুজ ছায়া স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক, অ্যাপোলো ডেন্টাল কেয়ার ও উপশম ডেন্টাল কেয়ার সিলগালা করে দেয়। সিলগালা ও অর্থদণ্ড করলেও তাদের পেশা তারা বদলায়নি। সোমবার বেলা ১১টায় কোনাপাড়া নাহার সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় গ্রামীণ সবুজ ছায়া স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিকে গিয়ে জানা যায়, ক্লিনিক বন্ধ থাকলেও পাশের একটি কক্ষে কথিত ডাক্তার আনিছুর রহমান রোগীর চিকিৎসা অব্যাহত রেখেছেন। সোমবার রোগী সেজে ওই ক্লিনিকে গেলে, পাশেই সোনার বাংলা ফাউন্ডেশনে বসে থাকা বোরকা পরা এক নারী ও এক পুরুষ ডাক দেন। চিকিৎসা নিতে যাওয়ার কথা শুনেই ওই নারী নিজেকে ডাক্তার সাবিনা পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি মহিলা রোগী দেখি। পুরুষ রোগী দেখেন ডা. আনিছুর রহমান। উনি পাশেই আছেন। আপনি বসেন, উনাকে কল করে ডেকে নিয়ে আসছি।
আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে জানা যায়, মোবাইল কোর্ট তার ক্লিনিক সিলগালা করে দেয়ার পর তিনি দূরে কোথাও অবস্থান করেন। রোগী এলে কল দিয়ে তাকে ডাকা হয়। রোগীর চিকিৎসা করে আবার সরে যান। একই এলাকায় মোবাইল কোর্টের সিলগালা করা অ্যাপোলো ডেন্টাল কেয়ারে গিয়ে দেখা যায়, বন্ধ এই প্রতিষ্ঠানের ভুয়া চিকিৎসক ফিরোজ সিকদার একটি বিজ্ঞাপন সেঁটেছেন দরজায়। তাতে লেখা বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণে আগামী ৫-১১-২০১৪ তারিখ পর্যন্ত ডেন্টাল ক্লিনিক বন্ধ থাকবে। এর নিচে একটি মোবাইল নম্বর দেয়া। রোগী সেজে ওই মোবাইলে সোমবার ফোন দিলে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সমস্যায় বন্ধ আছে। ৫ তারিখ (৫ নভেম্বর) থেকে চিকিৎসা দেয়া হবে। ৫ নভেম্বর অর্থাৎ বৃহস্পতিবার চিকিৎসার জন্য ওই কথিত ডাক্তারকে আবার ফোন দেয়া হয়। এ সময় তিনি বলেন, হরতালে বন্ধ আছে। আগামী সোমবার খুলতে পারি।
কোনাপাড়ায় ২২ অক্টোবর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম যুগান্তরকে বলেন, কোনাপাড়াসহ ঢাকার কয়েকটি এলাকায় আরও ভুয়া ডাক্তারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।
৪ সেপ্টেম্বর কারওয়ান বাজারে পাঁচ ভুয়া দন্ত চিকিৎসক এসএম ইলিয়াস হোসাইন, হাসানুর রহমান, আক্তার হোসেন, তোফাজ্জল হোসেন ও আলাউদ্দিনকে এক বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারা এসএসসি পাস করে মেডিকেলের জাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ডাক্তার সেজে রোগীর চিকিৎসা করে আসছিলেন। টাঙ্গাইলের হাতীরবান্দা এলাকার সবুজ খান সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে´ের সহকারী সার্জন ড. শেখ তৈয়েবুর রহমানের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ওই ডাক্তারের নামকরণ করে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি আশুলিয়ায় একটি গার্মেন্টে মেডিকেল অফিসার সেজে ডা. তৈয়েবুর রহমান নামে চাকরি নেয়ার পর তিনি র্যাব-৪ এর ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে ধরা পড়েন।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএম আনোয়ার পাশা বলেন, রেজিস্টার্ড দন্ত চিকিৎসকের সঙ্গে কিছুদিন কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ করে নিজেই চেম্বার খুলে রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে এরা, যা উদ্বেগজনক। কম খরচে দাঁতের চিকিৎসা করানোর নামে রোগীদের সর্বনাশ করছে এসব ভুয়া ডাক্তার। চিকিৎসার জন্য তারা যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তা জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা নেই। ফলে চিকিৎসা নিতে এসে অনেকেই নিজের অজান্তে নতুন রোগে আক্রান্তের ঝুঁকিতে পড়ছেন। তিনি আরও বলেন, ওষুধ বিষয়ে তাদের পড়াশোনা না থাকায়, বিভিন্ন মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ট্যাবলেট বা ইনজেকশন দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে শতাধিক ভুয়া ডাক্তার ধরে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। ভুয়া ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে বলে তিনি জানান।
সম্প্রতি র্যাবের অভিযানে ধরা পড়েছেন এই ডাক্তার নামধারী প্রতারক। মোবাইল কোর্ট তাকে এক বছরের সাজা ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই মাসের সাজা দিয়েছেন। রানা কারাগারে থাকলেও তার চেম্বারটি এখনও চলছে। তার দূরসম্পর্কের ভাই রিয়াদ ডাক্তার না হয়েও চালিয়ে নিচ্ছেন চেম্বারটি। নিয়মিত দেখছেন রোগী।
ভুয়া ডাক্তারদের চিকিৎসা বন্ধ করতে বিএমডিসির ভূমিকা কি জানতে চাইলে বিএমডিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান যুগান্তরকে বলেন, যে আইনে মোবাইল কোর্টে তাদের সাজা হচ্ছে, ওই আইন সংশোধন করে সাজার মেয়াদ বাড়াতে হবে। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সরকারকে দেয়া হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তাদের যে মেয়াদের সাজাই হোক তারা যদি জামিনে বেরিয়ে আসার সুযোগ না পেত তাহলে হয়তো অন্যরা ভয়ে এ পেশা ছেড়ে দিত।
বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন-২০১০ এর ২২ ধারা ১ উপধারায় বলা আছে, অন্য কোনো আইনে যাই থাকুক না কেন, এই আইনের অধীন নিবন্ধন ব্যতীত কোনো মেডিকেল চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসক অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা করতে অথবা নিজেকে মেডিকেল চিকিৎসক বলে পরিচয় দিতে পারবেন না। ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কেউ ১ উপধারার লংঘন করলে তিনি তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ঢাকা জেলা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল যুগান্তরকে বলেন, মোবাইল কোর্টে যে সাজা দেয়া হয় তা নিতান্তই অপ্রতুল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জরিমানার টাকা দিয়ে অথবা কিছুদিন জেল খেটে ভুয়া ডাক্তাররা জামিনে বের হয়ে একই পেশায় ফিরে যায়। এক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন সংশোধন করে সাজার মেয়াদ বৃদ্ধি করা উচিত।
রোববার বিকালে ভুয়া ডাক্তার রানার সেল নম্বরে ফোন দিলে, রিসিভ করেন এক নারী। চিকিৎসা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ডা. রানার স্ত্রী পরিচয় দেন। বলেন, রানা দেশের বাইরে আছেন। মাসখানেক চিকিৎসা করতে পারবেন না। মোবাইল কোর্টের হাতে ধরা পড়ে সাজার বিষয়ে গোপন করেন তিনি। মোবাইল কোর্ট কেন রানাকে সাজা দিয়েছে জানতে চাইলে রানার স্ত্রী অত্যন্ত কৌশলে বলেন, অন্য একটি ডেন্টাল ক্লিনিকের ডাক্তার দুশমনি করে তার স্বামীকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছুই তিনি জানেন না। রানার স্ত্রী বলেন, তার স্বামী জেল থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত দেবর রিয়াদ রোগীদের চিকিৎসা দেবেন। এই রিয়াদকে এমবিবিএস ডাক্তার বলেও দাবি করেছেন রানার স্ত্রী। রিয়াদ কোন হাসপাতালের ডাক্তার এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো হাসপাতালের না, উনি আমার খালাতো দেবর। অনেক অনেক ভালো ও বড় ডাক্তার। আপাতত তার কাছে দেখাতে পারেন।
রানা কিংবা রিয়াদই নয়; রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো ভুয়া ডাক্তারের চেম্বারের সন্ধান পাওয়া গেছে। খোদ মিরপুরে একদিনে এ ধরনের ৯টি চেম্বারে ৯ জন ডেন্টিস্টকে সাজা দিয়েছেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আল আমীন। তারা এখন জেলহাজতে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. আবু সাফি আহমেদ আমিন যুগান্তরকে বলেন, কোনো মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করার পর বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন নিয়ে একজন ডাক্তার হিসেবে চিকিৎসাসেবা দেয়ার অধিকার অর্জন করেন। এর বাইরে যারা চিকিৎসা করে তারা স্রেফ প্রতারক। এ ধরনের কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই প্রতারকদের কাছ থেকে সবাইকে সাবধান থাকার আহ্বান জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর শহরতলি এলাকায় এদের বিচরণ বেশি। ডেমরা, কোনাপাড়া, শ্যামপুর, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, শাহ্আলী, পল্লবী, রূপনগর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, টঙ্গী ও আমিনবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ভুয়া ডাক্তারের ক্লিনিক ও চেম্বার আছে। চিকিৎসার নামে তারা রোগীর সঙ্গে প্রতারণা করছে। এরা চিকিৎসার নামে আদায় করছে মোটা অংকের টাকা।
ভুয়া ডাক্তাররা ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন, সিঙ্গাপুরসহ দেশী-বিদেশী নামিদামি মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী পরিচয়ও দিচ্ছে। তৈরি করছে জাল সার্টিফিকেট। এসব সার্টিফিকেট তৈরি ও বিক্রির একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে। রোগীদের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করতেই এসব মিথ্যা বিশেষণ যোগ করা হয়।
এমনই একজন ডাক্তার মো. আজাদুল ইসলাম। তার নামের শেষে আরএমপি (ভিডি), ডিডিটি (ঢাকা), ডিডিটি (কলকাতা), বিডিএ (কলকাতা) লেখা। তার ক্লিনিকের নাম উপশম ডেন্টাল কেয়ার। ঠিকানা যাত্রাবাড়ীর কোনাপাড়ায়।
সূত্র জানায়, এসব চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে রোগীরা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছে। পাশাপাশি রোগমুক্ত না হয়ে আরও বড় ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এমনই এক রোগী শোভা আক্তার। তিনি জানান, তার বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। মাস দুই আগে তিনি কুমিল্লা থেকে মেয়ের বাড়ি যাত্রাবাড়ীর কোনাপাড়ায় আসেন। তার একটি দাঁত যন্ত্রণা করত। তিনি কোনাপাড়ায় অ্যাপোলো ডেন্টাল ক্লিনিকে ভুয়া ডাক্তার ফিরোজ সিকদারের কাছে চিকিৎসার জন্য যান। প্রথমে কথিত ডাক্তার ৩০০ টাকা ফি নিয়ে তার চিকিৎসা দেন। ১০ দিন পর আবার আসতে বলেন চেম্বারে। ১০ দিন পর একটি দাঁত উঠিয়ে চার হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর বলেন, আরও দুটি দাঁত নষ্ট, ১৫-২০ দিনের মধ্যে তুলতে হবে। রোগীর একটি দাঁতে সমস্যা হলেও ডাক্তার জোর করে ৩টি দাঁত তুলে ফেলে। কয়েক দফায় মোট ১৪ হাজার টাকা নিয়েছে তার কাছ থেকে।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিএমডিসি, জেলা প্রশাসন, র্যাব, পুলিশ যৌথ উদ্যোগে ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট চালানো অব্যাহত রয়েছে। মোবাইল কোর্টে অর্থদণ্ড কিংবা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেও তারা পেশা বদলাচ্ছে না। কারাগার থেকে বেরিয়ে আবার আগের পেশায় ফিরে যাচ্ছে। এটি মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে ভুয়া ডাক্তারদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমডিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান যুগান্তরকে বলেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব সবার। মানুষকে সচেতন হতে হবে। সাইনবোর্ডে কিংবা প্যাডে বিএমডিসির রেজিস্ট্রশন নম্বর দেখে প্রকৃত চিকিৎসক কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে মানুষকে। ভুয়া ডাক্তারদের চিকিৎসা বন্ধ করতে বিএমডিসির ভূমিকা কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএমডিসির ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই। এছাড়া লোকবলের অভাব। দেশে ভূরি ভূরি ভুয়া ডাক্তার। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে হাজার হাজার মামলা করতে হবে। এটি ব্যয়সাপেক্ষ। এত টাকা ব্যয় করা বিএমডিসির পক্ষে অসম্ভব।
২২ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী কোনাপাড়ায় দুই ভুয়া ডাক্তারকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালত। নামের আগে ডাক্তার বিশেষণ দিয়ে ক্লিনিক পরিচালনা ও চিকিৎসা দেয়ার অভিযোগে গ্রামীণ সবুজ ছায়া স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক, অ্যাপোলো ডেন্টাল কেয়ার ও উপশম ডেন্টাল কেয়ার সিলগালা করে দেয়। সিলগালা ও অর্থদণ্ড করলেও তাদের পেশা তারা বদলায়নি। সোমবার বেলা ১১টায় কোনাপাড়া নাহার সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় গ্রামীণ সবুজ ছায়া স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিকে গিয়ে জানা যায়, ক্লিনিক বন্ধ থাকলেও পাশের একটি কক্ষে কথিত ডাক্তার আনিছুর রহমান রোগীর চিকিৎসা অব্যাহত রেখেছেন। সোমবার রোগী সেজে ওই ক্লিনিকে গেলে, পাশেই সোনার বাংলা ফাউন্ডেশনে বসে থাকা বোরকা পরা এক নারী ও এক পুরুষ ডাক দেন। চিকিৎসা নিতে যাওয়ার কথা শুনেই ওই নারী নিজেকে ডাক্তার সাবিনা পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি মহিলা রোগী দেখি। পুরুষ রোগী দেখেন ডা. আনিছুর রহমান। উনি পাশেই আছেন। আপনি বসেন, উনাকে কল করে ডেকে নিয়ে আসছি।
আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে জানা যায়, মোবাইল কোর্ট তার ক্লিনিক সিলগালা করে দেয়ার পর তিনি দূরে কোথাও অবস্থান করেন। রোগী এলে কল দিয়ে তাকে ডাকা হয়। রোগীর চিকিৎসা করে আবার সরে যান। একই এলাকায় মোবাইল কোর্টের সিলগালা করা অ্যাপোলো ডেন্টাল কেয়ারে গিয়ে দেখা যায়, বন্ধ এই প্রতিষ্ঠানের ভুয়া চিকিৎসক ফিরোজ সিকদার একটি বিজ্ঞাপন সেঁটেছেন দরজায়। তাতে লেখা বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণে আগামী ৫-১১-২০১৪ তারিখ পর্যন্ত ডেন্টাল ক্লিনিক বন্ধ থাকবে। এর নিচে একটি মোবাইল নম্বর দেয়া। রোগী সেজে ওই মোবাইলে সোমবার ফোন দিলে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সমস্যায় বন্ধ আছে। ৫ তারিখ (৫ নভেম্বর) থেকে চিকিৎসা দেয়া হবে। ৫ নভেম্বর অর্থাৎ বৃহস্পতিবার চিকিৎসার জন্য ওই কথিত ডাক্তারকে আবার ফোন দেয়া হয়। এ সময় তিনি বলেন, হরতালে বন্ধ আছে। আগামী সোমবার খুলতে পারি।
কোনাপাড়ায় ২২ অক্টোবর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম যুগান্তরকে বলেন, কোনাপাড়াসহ ঢাকার কয়েকটি এলাকায় আরও ভুয়া ডাক্তারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।
৪ সেপ্টেম্বর কারওয়ান বাজারে পাঁচ ভুয়া দন্ত চিকিৎসক এসএম ইলিয়াস হোসাইন, হাসানুর রহমান, আক্তার হোসেন, তোফাজ্জল হোসেন ও আলাউদ্দিনকে এক বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারা এসএসসি পাস করে মেডিকেলের জাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ডাক্তার সেজে রোগীর চিকিৎসা করে আসছিলেন। টাঙ্গাইলের হাতীরবান্দা এলাকার সবুজ খান সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে´ের সহকারী সার্জন ড. শেখ তৈয়েবুর রহমানের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ওই ডাক্তারের নামকরণ করে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি আশুলিয়ায় একটি গার্মেন্টে মেডিকেল অফিসার সেজে ডা. তৈয়েবুর রহমান নামে চাকরি নেয়ার পর তিনি র্যাব-৪ এর ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে ধরা পড়েন।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএম আনোয়ার পাশা বলেন, রেজিস্টার্ড দন্ত চিকিৎসকের সঙ্গে কিছুদিন কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ করে নিজেই চেম্বার খুলে রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে এরা, যা উদ্বেগজনক। কম খরচে দাঁতের চিকিৎসা করানোর নামে রোগীদের সর্বনাশ করছে এসব ভুয়া ডাক্তার। চিকিৎসার জন্য তারা যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তা জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা নেই। ফলে চিকিৎসা নিতে এসে অনেকেই নিজের অজান্তে নতুন রোগে আক্রান্তের ঝুঁকিতে পড়ছেন। তিনি আরও বলেন, ওষুধ বিষয়ে তাদের পড়াশোনা না থাকায়, বিভিন্ন মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ট্যাবলেট বা ইনজেকশন দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে শতাধিক ভুয়া ডাক্তার ধরে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। ভুয়া ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে বলে তিনি জানান।
No comments